দগ্ধ সমাজের পোড়া কপাল ছুঁয়ে যাক শান্তির সমীরণ by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
ভোটের অধিকার আজ পৃথিবীতে মানবাধিকার
হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪৮ সালের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের ঘোষণার ২১(ক) ধারায়
বলা হয়, 'প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজ দেশের
সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।' ওই ধারার উপধারা (গ)-তে বলা
হয়েছে :'জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি। এই ইচ্ছা সার্বজনীন ও
সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ও প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে। গোপন
ব্যালট বা এ ধরনের অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এরূপ অনুষ্ঠিত হবে।' একই কথা
আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সনদ, ১৯৬৬-এর ২৫ ধারায় পুনরুল্লেখ
করে বলা হয়েছে :'প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার ও সুযোগ থাকবে এবং সে
ব্যাপারে কোনো বৈষম্য বা অন্যায্য বাধা থাকবে না। নির্বাচকদের মুক্ত ইচ্ছা
প্রকাশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এমন ব্যবস্থা থাকবে যে, প্রত্যেক নাগরিক
তার সার্বজনীন ও সমতাভিত্তিক ভোটাধিকারের বলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে
পর্যায়ক্রমিকভাবে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনে ভোট দিতে এবং ভোট দ্বারা
নিজেকে নির্বাচিত করতে পারবে।'
আমাদের নেতৃবৃন্দ বড়মুখ করে বলেন, তাঁরা আমাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষের কাছে ভোটের চেয়ে তার জীবনের নিরাপত্তা অনেক বেশি বড়। আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩২ ও ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এবং আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভে অধিকারী এবং বিধিবিধানের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। আমাদের দেশে ভোটাভুটি তেমন নতুন নয়। এই নিয়ে এক গণসঙ্গীতে বলা হতো, 'ভোটের বচন দিয়া রে, ভোটের বচন দিয়া।'
আমাদের দেশে নানা রকম রাজনৈতিক বেদাত দেখা যায়। আমরা দাবি করেছিলাম, গণতন্ত্র চর্চায় বাংলাদেশের একটি মূল্যবান বিষয় হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। এটা এমনই মূল্যবান যে, দু'ধাপের পর আর টিকতে পারল না। আমাদের দেশে, সংসদের পঞ্চম বৎসরে গত দুই দশক ধরে এক সংকট দেখা যাচ্ছে। এক উদ্ভট পঞ্চবার্ষিকী হাঙ্গামায় এক উপদ্রুত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে। তারপর কী যে হলো, আমরা বুঝতে পারলাম না। কেবল বিরোধী দলই ওই কথার ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেন। দেশে-বিদেশে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এ ব্যাপারে সাহায্য করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে চান। আমাদের চেয়েও উপদ্রুত দেশে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিরোধী দলের কথা, প্রশাসন যেখানে আপাদমস্তক 'আমাদের লোক' দ্বারা পরিব্যাপ্ত; সেখানে সংবিধানের বর্তমান বিধানানুুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশ এখন মহাসংকটে। কোথায় তাঁরে পাব খুঁজে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারে।
ভোটের অধিকারের চেয়ে বড় অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। প্রাণে না বাঁচলে সব ফক্কা। কথায় আছে, জান বাঁচানো ফরজ। সেই ফরজ আদায় করতে না পেরে আমাদের অনেক ভাইবোন অঘোরে মারা গিয়েছে। আমাদের অন্যান্য নানা অধিকার লঙ্ঘিত হলেও আজ আমরা এক প্রাথমিক অধিকার রক্ষা করতে বড়ই সংশয়িত। প্রজার মানবাধিকার রক্ষা করা সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। এর জন্য প্রধান এবং সবচেয়ে ফলপ্রদ ব্যবস্থা হলো একটা সুশৃঙ্খল শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতের কাছ থেকে আমরা যে প্রতিকার পেয়ে থাকি তা মাঝে মধ্যে আমাদেরকে আশান্বিত করে। আমরা সেই ভরসায় আদালতের আশ্রয় নিয়ে থাকি। তবে সেই ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় কাজ হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে পেশাগত দক্ষতা এবং মানবাধিকার চেতনা বৃদ্ধি করা। আমরা যখন খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে দেখি, দেশে রাজনৈতিক নন্দীভৃঙ্গীরা একজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারধর করছে; তখন তার কাছেই তার সহকর্মীরা নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল হয়ে নিষ্প্রাণ কেলেকার্তিকের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য বড়ই নিরাশাব্যঞ্জক। শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এক আক্রান্ত সহকর্মীর সাহায্যের জন্য যে এগিয়ে আসছে না, এ তো এক বড় অশুভ অলক্ষুনে ব্যাপার। আগে বলা হতো, রাজায় রাজায় যুদ্ধ আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আজ রাজনীতিক ও রাজনীতিকদের মধ্যে ভোটযুদ্ধ হয় আর নিরীহ ভোটারদের ঘটে প্রাণক্ষয়।
নির্বাচনে হারজিত আছেই। যারা হার মানতে চান না তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অযথা তাঁদের হৃৎপিণ্ডের হয়রানি বাড়াবেন না। কয়েকবার হেরে হেরে, হার মানা অভ্যস্ত হয়ে যায়। হার না মানলে হারু পার্টির 'নির্বাচনে বিজয়ী দল সূক্ষ বা স্থূল কারচুপি করে জয়লাভ করেছে'_ বলা ছাড়া অন্য কিছু বলার অবকাশ থাকবে না। গণআন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা, ঝটিকা বাহিনীর ঝাপ্টা আর পেট্রোল বোমার ধকল সহ্য করতে বাংলাদেশের মানুষকে অসম্ভব দুর্গতি পোহাতে হয়েছে। রাজনীতিতে নাকি সবই সম্ভব। আগামীতে আর যেন অসম্ভব কিছু না ঘটে এ জন্যই সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের প্রার্থনা। আমাদের রাজনীতিক ভাইয়েরা বোনেরা, আপনারা আমাদের স্যার/ আমাদের ম্যাডাম, আমাদের বড় ভাই/ আমাদের দাদা, আমাদের আপা/ আমাদের দিদি_ আমাদের সম্মানের পাত্র। আপনারা আমাদের আমমোক্তার, আমাদের প্রতিনিধি। সরকার আমাদের নাগালের বাইরে। তার সঙ্গে আপনারা আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। আপনারা আমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনেন এবং প্রতিবিধান করার চেষ্টা করেন। আপনাদের ছাড়া সরকারের পক্ষে প্রজাকুলের সঙ্গে খবর নিয়ে সম্পর্ক রক্ষা করা বা তাদেরকে জ্ঞান দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের গণতন্ত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হলো বিরোধী দলের চরম ব্যর্থতা। যখন বিরোধী দল সংসদে যান না আমাদের তখন বড়ই খারাপ লাগে। আমরা টেলিভিশনে কবির লড়াই দেখতে না পেয়ে বড় বিষণ্ন বোধ করি।
আমাদের বিরোধী দল ওয়াকআউটবিশারদ। অভিমানে, রাগে, দুঃখে, প্রতিবাদে বা হাঁচি ফেলতে তারা ওয়াকআউট করেন। তাঁদের কথা, 'সংসদে গিয়ে আমরা কী করব? আমার কথার তো দাম নেই। কথা বলতে দেয় না। আমরা কি সংসদে যাব খই ভাজার জন্য?' নির্বাচনী এলাকার লোকেরা বলেন, 'খই ভাজতে না পারলে খইয়ের ধান বাছেন, মুখে খই ফোটান।' আমরা আপনার তারিফ করে বলব, 'আপনি আমাগো একটা ব্যাটা! আপনাদের রসময় ব্যঙ্গময় বক্তব্য শুনে আমরা পুলকিত হব। আমাদের কবির লড়াই থেকে বঞ্চিত করেন ক্যান?'
আমাদের রাজনীতিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা কখনও দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে আবার কখনও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের শত্রুদের সঙ্গে হা-ডু-ডু থেকে লুডু_ নানা ধরনের খেলা খেলছেন। আমরা চমৎকৃত হইনি। আপনাদের খাসলত আমাদের এতই পরিচিত যে আমরা বিস্মিতও হইনি। আমাদের রাজনৈতিক ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ আপনাদের অনেক তৌফিক দিয়েছেন, আপনাদের তরক্কি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আপনাদের বেশিরভাগেরই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতকরা ৩২৯৮৫% ভাগেরও বেশি আয় বেড়েছে। আপনারা ভালো থেকেছেন এবং ভালো আছেন। আপনারা শুল্কমুক্ত দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন। আপনাদের ছেলেমেয়েদের হরতাল-অবরোধ উপদ্রুত শিক্ষায়তনে লেখাপড়া করতে হয় না। যে অসুখ ওষুধ না খেলেও সাত দিনে ভালো হয়, তার নিরাময়ের জন্য আপনারা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান। আপনাদের সহিসালামতে থাকা দেখে আমরা আনন্দিত। আপনাদের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, 'আমাদের প্রধানমন্ত্রী যা বেতন পান, তা বিদেশে কাউকে বলতে আমাদের লজ্জা করে।' আমাদের কোনো বোধ নেই বলে আমাদের লজ্জা করে না যে, এক ডলারের নিচে এই দেশে বহু লক্ষ মানুষ কী কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করে থাকে। আপনাদের কোনো দোষ নেই। আমি আপনাদের কোনো দোষারোপও করি না। সারা পৃথিবীর জনপ্রতিনিধিরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকার জন্য তাদের ঘাম হয় না এবং তাদের ঘাম শুকানোর প্রশ্ন নেই। নিজেদের বেতনাদি বৃদ্ধি করতে তাঁদের সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। অন্যদিকে শ্রমিকদের ঘাম গায়েই শুকোয়। ওয়েজবোর্ডের মিটিং শেষ হয় না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তেরও দেখা পাওয়া ভার। পোপ ফ্রান্সিস দুঃখ করে বলেছিলেন, দাসসম অবস্থায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা জীবন ধারণ করছেন। আমরা সারা পৃথিবীর উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করে যে পরিকল্পনা করি তারই সমর্থনে আমরাও বলে থাকি, আমাদের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
যাঁরা সরকারের দলের তাঁরা ভালো আছেন। ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, টিভি প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি, কোস্টাল ভেসেল কেনার অনুমতি ইত্যাদির লাইসেন্সের আপনারা সব অংশীদার। প্রতিরক্ষা বিভাগের যুদ্ধের লোহালক্কড় কেনায় আপনারা মধ্যমণি। আপনারা আয়করহীন মাছের ব্যবসায় সব আয় করেছেন, তাই অন্যরা আয় বৃদ্ধি বুঝতে চায় না অথবা তদের চোখ টাটায়। ফ্যাসিস্টদের মতন আমরা ঐকমত্য চাই না। দেশে মতানৈক্যের সুযোগ থাক। ভিন্নমতের বিকাশ ঘটুক এবং তার প্রকাশ হোক। বিভিন্ন মতের শত ফুল প্রস্ফুটিত হোক। সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা নূ্যনতম ঐকমত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক, যাতে ফুলটা সুস্থ ও সুন্দর হয়ে বড় হয়ে আমাদের আনন্দ দান করে। আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এই দেশে কি শান্তি ফিরে আসবে? আমি জানি না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি জানি, ইতিহাস ও অর্থনীতির মহামহোপাধ্যায়গণ ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে আমাদের কী হতাশই না করেছেন। শুধু এইটুকু বলা যায়, কিছুই থেমে থাকবে না। আকাশে সূর্যের পরিভ্রমণ ব্যাহত হবে না, দেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা কুলুকুলু করে বয়ে যাবে।
'আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।... আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। আপনারা সবাই এক হন, এক হয়ে আমাদের রক্ষা করুন।' অগি্নদগ্ধ গীতা সেনের এই মর্মস্পর্শী আকুতির সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করেছিলাম। আমরা এখন নৈরাজ্যময় বিভীষিকার দ্বারপ্রান্তে। দয়া করে আমাদের এক অতল ভয়াবহ গহ্বরের দিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন না। আপনাদের ধাক্কা মারার ও ল্যাংড়া-লুলা করার হুঙ্কার আমাদের মনে আছে। আর একটা কথা। ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ওপরে গানপাউডার ছিটিয়ে দয়া করে পেট্রোল বোমা ছুড়বেন না। গত কয়েক মাস ধরে সৃষ্টিছাড়া সহিংসতায় এবং অমানুষিক বর্বরতায় যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন আমরা তাদের মাগফিরাত কামনা করি। আমরা এক বড় বিপদে আছি। আল্লাহ তাঁর অপার অনুগ্রহে আমাদের সহায় হোন। প্রতিকারের আশায় উৎপীড়িতের প্রত্যাশার শেষ নেই। সেই অশেষ সীমাহীন আশায়, আমাদের প্রার্থনা_ দগ্ধ সমাজের পোড়া কপাল ছুঁয়ে যাক শান্তির সমীরণ, দেশের ওপর দিয়ে সুবাতাস বয়ে যাক।
(বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সর্বশেষ লেখেন সমকালে। গত ১ জানুয়ারি সমকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত তার লেখাটি এখানে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।)
আমাদের নেতৃবৃন্দ বড়মুখ করে বলেন, তাঁরা আমাদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মানুষের কাছে ভোটের চেয়ে তার জীবনের নিরাপত্তা অনেক বেশি বড়। আমাদের সংবিধানের ২৭, ৩২ ও ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না এবং এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে এবং আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের প্রবেশ, তল্লাশি ও আটক হতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তা লাভে অধিকারী এবং বিধিবিধানের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। আমাদের দেশে ভোটাভুটি তেমন নতুন নয়। এই নিয়ে এক গণসঙ্গীতে বলা হতো, 'ভোটের বচন দিয়া রে, ভোটের বচন দিয়া।'
আমাদের দেশে নানা রকম রাজনৈতিক বেদাত দেখা যায়। আমরা দাবি করেছিলাম, গণতন্ত্র চর্চায় বাংলাদেশের একটি মূল্যবান বিষয় হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। এটা এমনই মূল্যবান যে, দু'ধাপের পর আর টিকতে পারল না। আমাদের দেশে, সংসদের পঞ্চম বৎসরে গত দুই দশক ধরে এক সংকট দেখা যাচ্ছে। এক উদ্ভট পঞ্চবার্ষিকী হাঙ্গামায় এক উপদ্রুত অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকতে পারে। তারপর কী যে হলো, আমরা বুঝতে পারলাম না। কেবল বিরোধী দলই ওই কথার ওপর ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেন। দেশে-বিদেশে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা এ ব্যাপারে সাহায্য করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। সরকার সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করতে চান। আমাদের চেয়েও উপদ্রুত দেশে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিরোধী দলের কথা, প্রশাসন যেখানে আপাদমস্তক 'আমাদের লোক' দ্বারা পরিব্যাপ্ত; সেখানে সংবিধানের বর্তমান বিধানানুুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশ এখন মহাসংকটে। কোথায় তাঁরে পাব খুঁজে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টারে।
ভোটের অধিকারের চেয়ে বড় অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। প্রাণে না বাঁচলে সব ফক্কা। কথায় আছে, জান বাঁচানো ফরজ। সেই ফরজ আদায় করতে না পেরে আমাদের অনেক ভাইবোন অঘোরে মারা গিয়েছে। আমাদের অন্যান্য নানা অধিকার লঙ্ঘিত হলেও আজ আমরা এক প্রাথমিক অধিকার রক্ষা করতে বড়ই সংশয়িত। প্রজার মানবাধিকার রক্ষা করা সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। এর জন্য প্রধান এবং সবচেয়ে ফলপ্রদ ব্যবস্থা হলো একটা সুশৃঙ্খল শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতের কাছ থেকে আমরা যে প্রতিকার পেয়ে থাকি তা মাঝে মধ্যে আমাদেরকে আশান্বিত করে। আমরা সেই ভরসায় আদালতের আশ্রয় নিয়ে থাকি। তবে সেই ব্যবস্থা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় কাজ হবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা। তাদের মধ্যে পেশাগত দক্ষতা এবং মানবাধিকার চেতনা বৃদ্ধি করা। আমরা যখন খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে দেখি, দেশে রাজনৈতিক নন্দীভৃঙ্গীরা একজন পুলিশ কর্মকর্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মারধর করছে; তখন তার কাছেই তার সহকর্মীরা নিষ্ক্রিয় সাক্ষীগোপাল হয়ে নিষ্প্রাণ কেলেকার্তিকের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই দৃশ্য বড়ই নিরাশাব্যঞ্জক। শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এক আক্রান্ত সহকর্মীর সাহায্যের জন্য যে এগিয়ে আসছে না, এ তো এক বড় অশুভ অলক্ষুনে ব্যাপার। আগে বলা হতো, রাজায় রাজায় যুদ্ধ আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। আজ রাজনীতিক ও রাজনীতিকদের মধ্যে ভোটযুদ্ধ হয় আর নিরীহ ভোটারদের ঘটে প্রাণক্ষয়।
নির্বাচনে হারজিত আছেই। যারা হার মানতে চান না তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অযথা তাঁদের হৃৎপিণ্ডের হয়রানি বাড়াবেন না। কয়েকবার হেরে হেরে, হার মানা অভ্যস্ত হয়ে যায়। হার না মানলে হারু পার্টির 'নির্বাচনে বিজয়ী দল সূক্ষ বা স্থূল কারচুপি করে জয়লাভ করেছে'_ বলা ছাড়া অন্য কিছু বলার অবকাশ থাকবে না। গণআন্দোলনের নামে চোরাগোপ্তা হামলা, ঝটিকা বাহিনীর ঝাপ্টা আর পেট্রোল বোমার ধকল সহ্য করতে বাংলাদেশের মানুষকে অসম্ভব দুর্গতি পোহাতে হয়েছে। রাজনীতিতে নাকি সবই সম্ভব। আগামীতে আর যেন অসম্ভব কিছু না ঘটে এ জন্যই সৃষ্টিকর্তার কাছে আমাদের প্রার্থনা। আমাদের রাজনীতিক ভাইয়েরা বোনেরা, আপনারা আমাদের স্যার/ আমাদের ম্যাডাম, আমাদের বড় ভাই/ আমাদের দাদা, আমাদের আপা/ আমাদের দিদি_ আমাদের সম্মানের পাত্র। আপনারা আমাদের আমমোক্তার, আমাদের প্রতিনিধি। সরকার আমাদের নাগালের বাইরে। তার সঙ্গে আপনারা আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম। আপনারা আমাদের দুঃখ-কষ্টের কথা শোনেন এবং প্রতিবিধান করার চেষ্টা করেন। আপনাদের ছাড়া সরকারের পক্ষে প্রজাকুলের সঙ্গে খবর নিয়ে সম্পর্ক রক্ষা করা বা তাদেরকে জ্ঞান দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের গণতন্ত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হলো বিরোধী দলের চরম ব্যর্থতা। যখন বিরোধী দল সংসদে যান না আমাদের তখন বড়ই খারাপ লাগে। আমরা টেলিভিশনে কবির লড়াই দেখতে না পেয়ে বড় বিষণ্ন বোধ করি।
আমাদের বিরোধী দল ওয়াকআউটবিশারদ। অভিমানে, রাগে, দুঃখে, প্রতিবাদে বা হাঁচি ফেলতে তারা ওয়াকআউট করেন। তাঁদের কথা, 'সংসদে গিয়ে আমরা কী করব? আমার কথার তো দাম নেই। কথা বলতে দেয় না। আমরা কি সংসদে যাব খই ভাজার জন্য?' নির্বাচনী এলাকার লোকেরা বলেন, 'খই ভাজতে না পারলে খইয়ের ধান বাছেন, মুখে খই ফোটান।' আমরা আপনার তারিফ করে বলব, 'আপনি আমাগো একটা ব্যাটা! আপনাদের রসময় ব্যঙ্গময় বক্তব্য শুনে আমরা পুলকিত হব। আমাদের কবির লড়াই থেকে বঞ্চিত করেন ক্যান?'
আমাদের রাজনীতিক ভাই ও বোনেরা, আপনারা কখনও দেশের স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে আবার কখনও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের শত্রুদের সঙ্গে হা-ডু-ডু থেকে লুডু_ নানা ধরনের খেলা খেলছেন। আমরা চমৎকৃত হইনি। আপনাদের খাসলত আমাদের এতই পরিচিত যে আমরা বিস্মিতও হইনি। আমাদের রাজনৈতিক ভাই ও বোনেরা, আল্লাহ আপনাদের অনেক তৌফিক দিয়েছেন, আপনাদের তরক্কি হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আপনাদের বেশিরভাগেরই আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতকরা ৩২৯৮৫% ভাগেরও বেশি আয় বেড়েছে। আপনারা ভালো থেকেছেন এবং ভালো আছেন। আপনারা শুল্কমুক্ত দামি গাড়িতে চলাফেরা করেন। আপনাদের ছেলেমেয়েদের হরতাল-অবরোধ উপদ্রুত শিক্ষায়তনে লেখাপড়া করতে হয় না। যে অসুখ ওষুধ না খেলেও সাত দিনে ভালো হয়, তার নিরাময়ের জন্য আপনারা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান। আপনাদের সহিসালামতে থাকা দেখে আমরা আনন্দিত। আপনাদের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, 'আমাদের প্রধানমন্ত্রী যা বেতন পান, তা বিদেশে কাউকে বলতে আমাদের লজ্জা করে।' আমাদের কোনো বোধ নেই বলে আমাদের লজ্জা করে না যে, এক ডলারের নিচে এই দেশে বহু লক্ষ মানুষ কী কায়ক্লেশে জীবন ধারণ করে থাকে। আপনাদের কোনো দোষ নেই। আমি আপনাদের কোনো দোষারোপও করি না। সারা পৃথিবীর জনপ্রতিনিধিরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থাকার জন্য তাদের ঘাম হয় না এবং তাদের ঘাম শুকানোর প্রশ্ন নেই। নিজেদের বেতনাদি বৃদ্ধি করতে তাঁদের সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। অন্যদিকে শ্রমিকদের ঘাম গায়েই শুকোয়। ওয়েজবোর্ডের মিটিং শেষ হয় না, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তেরও দেখা পাওয়া ভার। পোপ ফ্রান্সিস দুঃখ করে বলেছিলেন, দাসসম অবস্থায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা জীবন ধারণ করছেন। আমরা সারা পৃথিবীর উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করে যে পরিকল্পনা করি তারই সমর্থনে আমরাও বলে থাকি, আমাদের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে।
যাঁরা সরকারের দলের তাঁরা ভালো আছেন। ব্যাংক, বীমা, বিশ্ববিদ্যালয়, টিভি প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি, কোস্টাল ভেসেল কেনার অনুমতি ইত্যাদির লাইসেন্সের আপনারা সব অংশীদার। প্রতিরক্ষা বিভাগের যুদ্ধের লোহালক্কড় কেনায় আপনারা মধ্যমণি। আপনারা আয়করহীন মাছের ব্যবসায় সব আয় করেছেন, তাই অন্যরা আয় বৃদ্ধি বুঝতে চায় না অথবা তদের চোখ টাটায়। ফ্যাসিস্টদের মতন আমরা ঐকমত্য চাই না। দেশে মতানৈক্যের সুযোগ থাক। ভিন্নমতের বিকাশ ঘটুক এবং তার প্রকাশ হোক। বিভিন্ন মতের শত ফুল প্রস্ফুটিত হোক। সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে একটা নূ্যনতম ঐকমত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক, যাতে ফুলটা সুস্থ ও সুন্দর হয়ে বড় হয়ে আমাদের আনন্দ দান করে। আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর এই দেশে কি শান্তি ফিরে আসবে? আমি জানি না। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমি জানি, ইতিহাস ও অর্থনীতির মহামহোপাধ্যায়গণ ভবিষ্যদ্বাণীর ব্যাপারে আমাদের কী হতাশই না করেছেন। শুধু এইটুকু বলা যায়, কিছুই থেমে থাকবে না। আকাশে সূর্যের পরিভ্রমণ ব্যাহত হবে না, দেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা কুলুকুলু করে বয়ে যাবে।
'আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাই না। আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।... আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না। আপনারা সবাই এক হন, এক হয়ে আমাদের রক্ষা করুন।' অগি্নদগ্ধ গীতা সেনের এই মর্মস্পর্শী আকুতির সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করেছিলাম। আমরা এখন নৈরাজ্যময় বিভীষিকার দ্বারপ্রান্তে। দয়া করে আমাদের এক অতল ভয়াবহ গহ্বরের দিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবেন না। আপনাদের ধাক্কা মারার ও ল্যাংড়া-লুলা করার হুঙ্কার আমাদের মনে আছে। আর একটা কথা। ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ওপরে গানপাউডার ছিটিয়ে দয়া করে পেট্রোল বোমা ছুড়বেন না। গত কয়েক মাস ধরে সৃষ্টিছাড়া সহিংসতায় এবং অমানুষিক বর্বরতায় যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন আমরা তাদের মাগফিরাত কামনা করি। আমরা এক বড় বিপদে আছি। আল্লাহ তাঁর অপার অনুগ্রহে আমাদের সহায় হোন। প্রতিকারের আশায় উৎপীড়িতের প্রত্যাশার শেষ নেই। সেই অশেষ সীমাহীন আশায়, আমাদের প্রার্থনা_ দগ্ধ সমাজের পোড়া কপাল ছুঁয়ে যাক শান্তির সমীরণ, দেশের ওপর দিয়ে সুবাতাস বয়ে যাক।
(বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সর্বশেষ লেখেন সমকালে। গত ১ জানুয়ারি সমকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত তার লেখাটি এখানে পুনর্মুদ্রণ করা হলো।)
No comments