নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না
অবশেষে ব্যাপক সহিংসতার মধ্যে শেষ হলো দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন। এই নির্বাচনের, বিশেষ করে দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিএনপি ও শরিকেরা প্রায় দুই বছর সহিংস আন্দোলন করলেও তা মারাত্মক রূপ নেয় নির্বাচনের দুই রাত আগে থেকে। ১৫ থেকে ১৮ জনের প্রাণহানি হয়, যা দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্তপাতপূর্ণ নির্বাচন বলে বিবেচিত। অন্যদিকে, সহিংসতার বলি হয় ১১১টি বিদ্যাপীঠ। এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ও বিদ্যাপীঠের ধ্বংস অতীতে হয়নি। এমনকি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩৬ থেকে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসের প্রায় তিন গুণ। দশম সংসদে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত বলে বিবেচিত হয়েছেন, যার কারণে চার কোটি ৮০ লাখ ভোটার ভোটদান থেকে বঞ্চিত। নির্বাচনটি প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী জোট। বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে তারা। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন থেকে ঘোষণা করা হয়, ১৪৭টি আসনে ভোট পড়েছে শতকরা ৪০ শতাংশ। অথচ গণমাধ্যম ও অন্তত দুটি দেশীয় পর্যবেক্ষণ সংগঠন বলেছে আরও কম উপস্থিতির কথা। তাদের মতে, ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশ। যদি সরকারি দলের ভাষ্যও ধরে নেওয়া যায়, তথাপি প্রায় সাড়ে নয় কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় দুই কোটির নিচে ভোটার ভোট দিতে পেরেছেন।
সে ক্ষেত্রে প্রায় সাত কোটি ২০ লাখ ভোটার ভোট দেননি বা দিতে পারেননি। লক্ষণীয়, সেসব জায়গায় সরকারি দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনের প্রার্থী হতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তফাত এত বেশি যে তা হতবাক করার মতো। অথচ অনেক জায়গায় একই জেলায় পাশাপাশি আসনে অন্য প্রতীকের জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তফাতটাও যেমন কম, তেমন সমষ্টিগত ভোটের সংখ্যাও আগে উল্লিখিত প্রার্থীদের চেয়ে অনেক কম। এই নির্বাচনেও প্রায় ১৬ জন প্রার্থী কেন্দ্র দখল, জবরদস্তি সিল মারা এমনকি ফলাফল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর মতো গুরুতর অভিযোগে নির্বাচন বর্জন করেন। সরকার বলেছে, এটি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়মরক্ষার নির্বাচন। যেহেতু বিরোধী দল বা জোট নির্বাচনে আসতে রাজি হয়নি, সরকারের দাবি মোতাবেক অনেক ছাড় দেওয়া সত্ত্বেও, তাই সংবিধানের বাধ্যবাধকতা মোতাবেক নির্বাচন করতে হয়েছে। সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় নেতা এখন শর্ত সাপেক্ষে সত্বর ১১তম সংসদ নির্বাচনের কথাও বলছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগ থেকেই অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা পূর্বতন নির্বাচনগুলোয় দেখা যায়নি। নির্বাচনের পরের দিন পাঁচজনের প্রাণহানিসহ জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর অথবা দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা পরিকল্পনার বিন্যাস ও কার্যকারিতা নিয়ে। প্রায় তিন লাখ নিরাপত্তাকর্মী, প্রায় ৫০ হাজার সামরিক সদস্যের উপস্থিতিতে এ ধরনের নাশকতা স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতেই পারে সমন্বিত নিরাপত্তার পরিকল্পনা নিয়ে। প্রশ্ন থাকে যে ১১০টি ভোটকেন্দ্র কীভাবে ভস্মীভূত হলো?
এমনটা হওয়ার আগাম ঘোষিত এবং নিশ্চয়ই গোয়েন্দা তথ্য ছিল। সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের নাশকতা দুই দিন আগের রাতে হয়ে থাকলে সেসব কেন্দ্র দুই দিন আগেই নিরাপদ করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। স্মরণযোগ্য যে অর্ধেকেরও কম আসনে নির্বাচন হয়েছে। কাজেই, নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বেশি থাকার কথা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের নির্বাচনী বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় হয় নিরাপত্তা বিধানের জন্য। এবারের নির্বাচনে এ অর্থের পরিমাণ আরও বেড়েছে। আরও স্মরণযোগ্য, নির্বাচনকালে নিরাপত্তার দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, অন্য কারও নয়। এমনকি সরকারেরও নয়। ১৯৯৬ সালে কোনো তদন্ত হয়নি। তবে এবার তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে। কেন এই নিরাপত্তার অভাব হলো? পরিকল্পনায় কমতি ছিল কি না? এসব প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজন ভবিষ্যতের জন্য। দৃশ্যত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনকালীন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। দেশের তাবৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব নির্বাচনে যথাযথ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্নতর, সহিংস। একই সঙ্গে নির্বাচনী বাজেট থেকেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা উচিত। এ সহিংসতায় একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং আনসার সদস্য নিহত হয়েছেন। যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক।
তবে নির্বাচনী কর্তব্য পালনকালে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া কমিশনের নৈতিক দায়িত্ব। যদিও কোনো কিছুর বিনিময়ে মূল্যবান জীবনের ক্ষতিপূরণ হতে পারে না। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা রোধ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, অন্তত পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এ ধরনের সহিংসতার নজির বিরল নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের নিরাপত্তা পরিকল্পনায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ঠেকাতে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচন থেকে করণীয় নির্ধারণ করে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু অঞ্চলে ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল অন্তত কয়েক দিনের জন্য। ওই নির্বাচনের পর সব ধরনের বিজয় মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এবারে তেমন দেখা যায়নি। ছিল না বাড়তি নিরাপত্তা, যার কারণে কয়েক জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা হয়েছে। ঘরবাড়ি পুড়েছে। হতাহত হয়েছে। উপাসনালয় পুড়েছে। এই নিরাপত্তা বিধানের দায়দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনের। এ ধরনের ঘটনা নিন্দনীয় তো বটেই, নিরাপত্তার অভাবটা ছিল সুস্পষ্ট। এ ব্যর্থতা মেনে নেওয়া যায় না। এখানেও প্রয়োজন তদন্তের, যাতে ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ করা যায়। এই নির্বাচনে আরও অনেক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো নির্বাচন কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত। বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বে এ রকম নজির বিরল; যেখানে ৩৮টি কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। এটি একটি আশ্চর্য ব্যাপার।
এর মানে এই যে যেকোনো কারণেই হোক, ওই এলাকার মানুষ ভোট দিতে বিমুখ ছিলেন। বিষয়টি নির্বাচনের অঙ্গনে ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রভাব রাখবে, তা অবশ্যই নির্ণয় করা প্রয়োজন। যদিও নির্বাচনটি ছিল সম্পূর্ণ একপেশে, তথাপি অনেক ধরনের অভিযোগ, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও সাংসদ প্রার্থীদের অনিয়মের, প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কমিশনে উত্থাপিত হয়েছিল, যার বিষয়ে কমিশনের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রচুর অভিযোগ উঠেছে জাল ভোট প্রদানের, এমনকি পত্রপত্রিকায় ছবি ছাড়া তাৎ ক্ষণিকভাবে অনেক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ২০০৮ সাল এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় এমন চিত্র দেখা যায়নি। ওই সময়ে মনে করা হয়েছিল, আমরা এই অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি, কিন্তু এখন তা মনে হয় না। ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্বাচনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোনো কোনো জায়গায় আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ড ইত্যাদিকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে এ ধরনের গর্হিত কাজকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। এমনকি যশোরে একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী প্রার্থী অন্য আসনের প্রার্থীকে নির্বাচনে প্রকাশ্যে জাল ভোট প্রদানের যে ফর্মুলা দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, তা গুরুতর অভিযোগ।
আরপিওতে এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে তাৎ ক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া আছে। এ অভিযোগ খণ্ডিত হতেও শোনা যায়নি। তবে তথ্যে প্রকাশ, নির্বাচন কমিশন দুজনকে শোকজ করেছে এবং দুটি আসনের গেজেট প্রকাশ করা হয়নি। এটি আশার বিষয়। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সাধুবাদ পেতেই পারে। এখনই এ ধরনের দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় পুনরায় অব্যবস্থা ফিরে আসবে। কমিশন এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাতে কেন পারেনি, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। কোনো নির্বাচনই শতভাগ স্বচ্ছ হয় না, তবে যাঁরা পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তাঁদের প্রয়াস থাকে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অনেক অনিয়মের অভিযোগ, খবর ও খবরচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি ভোটারদের বঞ্চিত হতে হয়েছে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তা থেকে। এ ধরনের পরিস্থিতি কাম্য ছিল না। এই নির্বাচনের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁদের, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব ভবিষ্যতে সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য এসব বিষয়কে গুরুত্বসহ খতিয়ে দেখা। এ প্রয়াস অবশ্যই আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে সাহায্য করবে। তবে এবারের দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব প্রতিপালনের মাধ্যমে যেমনি প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হয়, তেমনি সমগ্র প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা বৃদ্ধি করে। অন্যথায় আস্থার সংকটের কারণে ভোটাররা ভোটদান থেকে বিমুখ হতে পারেন, কিন্তু সেটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য মোটেই কাম্য নয়। নির্বাচন কমিশনের শিথিলতায় ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের বিচ্যুতি জয়ী প্রার্থীদের ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক হতে পারে না। অবশেষে এই নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কর্তৃক একটি পর্যালোচনার প্রয়োজন ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা অটুট রাখার বা আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য। একটি সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, সরকারের নয়। সরকার সহায়ক ভূমিকা পালন করে মাত্র।
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.): অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com
No comments