অচলাবস্থার অবসান হতেই হবে by ড. আজিজুর রহমান
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর
তাকে ওই রকম একটা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে
হয়েছিল। নূ্যনতম সময়ের মধ্যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি
সংবিধান প্রণীত হয়, যাতে ছিল চারটি মূলনীতি_ ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র,
গণতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এর মধ্যে ষাট-সত্তরের দশকের
আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের
আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। বিজয়ী জাতির মধ্যে এ আশাটি প্রবল ছিল যে,
দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তানি রাষ্ট্রের উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পরিবর্তে
স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে পরিচালিত
হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশে পাকিস্তানিদের পরিচালিত ইতিহাসের নজিরবিহীন
গণহত্যা, ধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও
লুটপাটের মতো জঘন্য অমানবিক কর্মকাণ্ডে সর্বতোভাবে মদদ দিয়েছিল তাদের এ
দেশীয় সহযোগী জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদর-আলশামসের নেতাকর্মীরা। তাই ওই সব
নৃশংস দালাল- রাজাকারদের শীর্ষ সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী '৭২-এর
সংবিধানে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ওই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী সব
দালাল-রাজাকারকে আইনের আওতায় এনে যথোপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যাপারেও
বাঙালি জাতির মধ্যে একটা ঐকমত্য ছিল। সঙ্গতভাবেই বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২
সালের দালাল আইনে (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয়
সহযোগীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে।
কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর ওই খুনিচক্রের মূল হোতা খোন্দকার মোশতাক কর্তৃক মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহকে সরিয়ে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক ফরমানবলে জেনারেল জিয়া ১৯৭২ সালের দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বাতিল ঘোষণা করেন। ফলে দালাল আইনে বঙ্গবন্ধুর শুরু করা বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের এ দেশীয় যেসব ঘৃণ্য সহযোগী ওই সময় কারাগারে ছিল বা যাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল তারা সবাই পরবর্তীকালে ছাড়া পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সামরিক শাসক জিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অন্যতম মূলনীতি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' আমাদের সংবিধান থেকে কেটে ফেলেন, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারায়; তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন; মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের পর থেকে পাকিস্তানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান; মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানের মতো ঘৃণ্য নরপশুকে জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন; সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকারীদের 'বিচার করা যাবে না' মর্মে খুনি মোশতাক চক্রের জারি করা Indemnity Ordinance-কে ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংসদে বৈধতা দেওয়া হয়। তবে বক্ষমাণ নিবন্ধের এই ৪র্থ অংশে উলি্লখিত তথ্যাবলি নির্দেশ করে যে, প্রশাসক জিয়াউর রহমানের সব কার্যকলাপ এবং তার সময়ে ঘোষিত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ বা সংবিধানের সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। এর ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের যে মূল বিষয়াবলি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, তা তৎপরবর্তীকালে আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ আজ স্পষ্টতই দুটি ভাগে বিভক্ত_ স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর অনেক দেশই আমাদের মতো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বা তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করেছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধে পরাজিত শক্তি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বা যুদ্ধ-পূর্বকালে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আর কথা বলার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি। গণতন্ত্রের দাবিদার যে কোনো দেশেই মতভিন্নতা থাকবে এবং সেজন্য বহু রাজনৈতিক দলও থাকবে। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে কোনো একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে, সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে কোন কোন খাত (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ইত্যাদি) অগ্রাধিকার পাবে এ জাতীয় বিষয়ে, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই দেশটির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বা তার জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক নয়। আমাদের অনৈতিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক নষ্ট রাজনীতির কল্যাণে ওই অনভিপ্রেত কাজটিই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমি এতদসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোর বিস্তারিত আলাপে না গিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের মাত্র দু'একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আমার মূল বক্তব্য বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব।
এ বিষয়ে সবাই অবগত যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগ-রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের হাতে এ দেশের ৩০ লাখ মুক্তিপাগল মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে এবং প্রায় আড়াই লাখেরও অধিক মা-বোনকে তাদের ইজ্জত বিসর্জন দিতে হয়েছে। ওইসব বীর শহীদ এবং সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের ঋণ পরিশোধের জন্য পাকিস্তানের দালাল এ দেশীয় জামায়াত-শিবির-রাজাকার- আলবদরদের এ দেশের মাটিতে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি বিধানে জাতি হিসেবে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর তাই স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে এবং ইতিমধ্যে বিচারে একাধিক অপরাধীর শাস্তির রায় হয়েছে ও একটি রায় কার্যকর করা হয়েছে। এতে সমগ্র বাঙালি জাতি দীর্ঘদিনের কলঙ্ক মোচনের ব্যাপারে আশান্বিত হয় এবং ওই বিচারিক প্র্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায়। কিন্তু আমরা দেখলাম, আদালতের ওইসব রায় এবং একাত্তরের 'কসাই কাদের'খ্যাত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে মূলত আমাদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে ১৯৭১-এর কায়দায় জামায়াত-শিবির-হেফাজত গোষ্ঠী সারাদেশে ভয়ঙ্কর সহিংস কার্যকলাপ পরিচালনা করে চলেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর করার সময় যেমন নিশ্চুপ ছিল, তেমনি কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময়ও নীরবতা পালন করে। অবশ্য তারা বলেন যে তারাও '৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চান, কিন্তু তা হতে হবে স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন; যদিও ওই আন্তর্জাতিক মানটি আসলে কী রকম, তা তারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেননি। তবে আমি ওই মানবতাবিরোধী গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকদের জিজ্ঞাসা করতে চাই: ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে নির্বিচার গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাট পরিচালিত হয়েছিল, তা কোন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে হয়েছিল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে কোন আইন বা ক্ষমতাবলে হত্যা করেছিল? পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে আমাদের মধ্যে জাতীয় সংহতির অভাবে বা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্য না থাকার কারণে '৭১ সালে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিরুদ্ধে যখন ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়, তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ও কঠোর দৃঢ়তার সঙ্গে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি।
আমি রাজনীতিবিদ নই বিধায় দেশের রাজনৈতিক গতিধারার বিশ্লেষণ আমার কাজ নয়। তবে দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের জন্ম ইতিহাস, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে কোনো বিতর্ক/অবজ্ঞাভাব আমাকে ব্যথিত করে। পেশাগত কারণে আমার বাংলাদেশের বাইরে একাধিক দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি লক্ষ্য করেছি, ওইসব দেশের চতুর্থ/পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ূয়া ছেলেমেয়েদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়_ তাদের জাতীয় পরিচয় কী? তখন ওই বয়সী প্রতিটি শিশু একই রকম গর্ব এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে উচ্চারণ করে :'ও ধস ধ ইৎরঃরংয', 'ও ধস ধহ ঊমুঢ়ঃরধহ ', 'ও ধস ধহ ওহফরধহ' ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশের যে কোনো স্কুল গেটে গিয়ে একই বয়সী তিনটি শিশুকে অনুরূপ প্রশ্ন করলে ভিনদেশের শিশুদের মতো একই সাধারণ উত্তর পাওয়া যাবে কি? এ রকম আত্মপরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেম তৈরি হবে না এবং দেশপ্রেমহীন নাগরিকদের দ্বারা দেশের সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণও সাধিত হবে না। তাই বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন এবং সাধারণ নাগরিকদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ_ আপনারা প্রত্যেকে দয়া করে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন 'আপনারা কি প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, নাকি পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী?' একই দেশে এরূপ বিপরীতমুখী ভাবাদর্শের সহাবস্থান থাকতে পারে না, এর আশু নিষ্পত্তি অত্যাবশ্যক। এই বিভাজনকে কেন্দ্র করেই জাতীয় জীবনের এক গভীর সন্ধিক্ষণে আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির-হেফাজতের সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে একাত্তরের মতোই আজ বাংলাদেশের সব নাগরিকের জানমাল অনিরাপদ। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না, গুরুতর অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে পারছে না, খেটে খাওয়া মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ, সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য/শিল্পপ্রতিষ্ঠান অচল, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত। এ অচলাবস্থার ত্বরিত সমাধান না হলে বাংলাদেশ অচিরেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই কাম্য নয়।
অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পর ওই খুনিচক্রের মূল হোতা খোন্দকার মোশতাক কর্তৃক মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহকে সরিয়ে তৎকালীন উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এক ফরমানবলে জেনারেল জিয়া ১৯৭২ সালের দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বাতিল ঘোষণা করেন। ফলে দালাল আইনে বঙ্গবন্ধুর শুরু করা বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের এ দেশীয় যেসব ঘৃণ্য সহযোগী ওই সময় কারাগারে ছিল বা যাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছিল তারা সবাই পরবর্তীকালে ছাড়া পেয়ে যায়। শুধু তাই নয়, সামরিক শাসক জিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অন্যতম মূলনীতি 'ধর্মনিরপেক্ষতা' আমাদের সংবিধান থেকে কেটে ফেলেন, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র হারায়; তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেন; মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয়ের পর থেকে পাকিস্তানে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে ১৯৭৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দেন জিয়াউর রহমান; মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানের মতো ঘৃণ্য নরপশুকে জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন; সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকারীদের 'বিচার করা যাবে না' মর্মে খুনি মোশতাক চক্রের জারি করা Indemnity Ordinance-কে ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় সংসদে বৈধতা দেওয়া হয়। তবে বক্ষমাণ নিবন্ধের এই ৪র্থ অংশে উলি্লখিত তথ্যাবলি নির্দেশ করে যে, প্রশাসক জিয়াউর রহমানের সব কার্যকলাপ এবং তার সময়ে ঘোষিত বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ বা সংবিধানের সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। এর ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের যে মূল বিষয়াবলি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, তা তৎপরবর্তীকালে আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণ আজ স্পষ্টতই দুটি ভাগে বিভক্ত_ স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর অনেক দেশই আমাদের মতো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বা তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করেছে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধে পরাজিত শক্তি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বা যুদ্ধ-পূর্বকালে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আর কথা বলার স্পর্ধা দেখাতে পারেনি। গণতন্ত্রের দাবিদার যে কোনো দেশেই মতভিন্নতা থাকবে এবং সেজন্য বহু রাজনৈতিক দলও থাকবে। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে কোনো একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারে, সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে কোন কোন খাত (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, তথ্যপ্রযুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ইত্যাদি) অগ্রাধিকার পাবে এ জাতীয় বিষয়ে, কিন্তু কোনো অবস্থায়ই দেশটির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বা তার জন্ম ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক নয়। আমাদের অনৈতিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক নষ্ট রাজনীতির কল্যাণে ওই অনভিপ্রেত কাজটিই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে। আমি এতদসংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোর বিস্তারিত আলাপে না গিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের মাত্র দু'একটি বিষয়ের উল্লেখ করে আমার মূল বক্তব্য বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব।
এ বিষয়ে সবাই অবগত যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগ-রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের হাতে এ দেশের ৩০ লাখ মুক্তিপাগল মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে এবং প্রায় আড়াই লাখেরও অধিক মা-বোনকে তাদের ইজ্জত বিসর্জন দিতে হয়েছে। ওইসব বীর শহীদ এবং সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের ঋণ পরিশোধের জন্য পাকিস্তানের দালাল এ দেশীয় জামায়াত-শিবির-রাজাকার- আলবদরদের এ দেশের মাটিতে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি বিধানে জাতি হিসেবে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর তাই স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির-মুসলিম লীগের ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে এবং ইতিমধ্যে বিচারে একাধিক অপরাধীর শাস্তির রায় হয়েছে ও একটি রায় কার্যকর করা হয়েছে। এতে সমগ্র বাঙালি জাতি দীর্ঘদিনের কলঙ্ক মোচনের ব্যাপারে আশান্বিত হয় এবং ওই বিচারিক প্র্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায়। কিন্তু আমরা দেখলাম, আদালতের ওইসব রায় এবং একাত্তরের 'কসাই কাদের'খ্যাত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে মূলত আমাদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে ১৯৭১-এর কায়দায় জামায়াত-শিবির-হেফাজত গোষ্ঠী সারাদেশে ভয়ঙ্কর সহিংস কার্যকলাপ পরিচালনা করে চলেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর করার সময় যেমন নিশ্চুপ ছিল, তেমনি কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময়ও নীরবতা পালন করে। অবশ্য তারা বলেন যে তারাও '৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চান, কিন্তু তা হতে হবে স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন; যদিও ওই আন্তর্জাতিক মানটি আসলে কী রকম, তা তারা কখনোই পরিষ্কার করে বলেননি। তবে আমি ওই মানবতাবিরোধী গোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থকদের জিজ্ঞাসা করতে চাই: ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে নির্বিচার গণহত্যা, গণধর্ষণ, অগি্নসংযোগ, লুটপাট পরিচালিত হয়েছিল, তা কোন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে হয়েছিল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে কোন আইন বা ক্ষমতাবলে হত্যা করেছিল? পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে আমাদের মধ্যে জাতীয় সংহতির অভাবে বা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে ঐকমত্য না থাকার কারণে '৭১ সালে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার বিরুদ্ধে যখন ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়, তখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ও কঠোর দৃঢ়তার সঙ্গে এর প্রতিবাদ করতে পারিনি।
আমি রাজনীতিবিদ নই বিধায় দেশের রাজনৈতিক গতিধারার বিশ্লেষণ আমার কাজ নয়। তবে দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের জন্ম ইতিহাস, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে কোনো বিতর্ক/অবজ্ঞাভাব আমাকে ব্যথিত করে। পেশাগত কারণে আমার বাংলাদেশের বাইরে একাধিক দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি লক্ষ্য করেছি, ওইসব দেশের চতুর্থ/পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ূয়া ছেলেমেয়েদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়_ তাদের জাতীয় পরিচয় কী? তখন ওই বয়সী প্রতিটি শিশু একই রকম গর্ব এবং বলিষ্ঠতার সঙ্গে উচ্চারণ করে :'ও ধস ধ ইৎরঃরংয', 'ও ধস ধহ ঊমুঢ়ঃরধহ ', 'ও ধস ধহ ওহফরধহ' ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের দেশের যে কোনো স্কুল গেটে গিয়ে একই বয়সী তিনটি শিশুকে অনুরূপ প্রশ্ন করলে ভিনদেশের শিশুদের মতো একই সাধারণ উত্তর পাওয়া যাবে কি? এ রকম আত্মপরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের মধ্যে কোনো দেশপ্রেম তৈরি হবে না এবং দেশপ্রেমহীন নাগরিকদের দ্বারা দেশের সাধারণ মানুষের কোনো কল্যাণও সাধিত হবে না। তাই বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদ, বিশিষ্টজন এবং সাধারণ নাগরিকদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ_ আপনারা প্রত্যেকে দয়া করে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন 'আপনারা কি প্রকৃতই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, নাকি পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী?' একই দেশে এরূপ বিপরীতমুখী ভাবাদর্শের সহাবস্থান থাকতে পারে না, এর আশু নিষ্পত্তি অত্যাবশ্যক। এই বিভাজনকে কেন্দ্র করেই জাতীয় জীবনের এক গভীর সন্ধিক্ষণে আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির-হেফাজতের সহিংস কর্মকাণ্ডের কারণে একাত্তরের মতোই আজ বাংলাদেশের সব নাগরিকের জানমাল অনিরাপদ। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যেতে পারছে না, গুরুতর অসুস্থ রোগীরা চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে যেতে পারছে না, খেটে খাওয়া মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ, সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য/শিল্পপ্রতিষ্ঠান অচল, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত। এ অচলাবস্থার ত্বরিত সমাধান না হলে বাংলাদেশ অচিরেই একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যা কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিকেরই কাম্য নয়।
অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments