অসুস্থ রাজনীতি ও জাতিসংঘের উদ্যোগ by তারেক শামসুর রেহমান
ক’দিন
আগে অগ্নিদগ্ধ গীতা সরকারের হৃদয়ছোঁয়া বক্তব্য ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের বেডে শুয়ে আছেন গীতা সরকার। তিনি একজন
গৃহবধূ, তার সেখানে থাকার কথা নয়। অবরোধের সময় পেট্রল বোমায় দগ্ধ হয়ে তার
আশ্রয় হয়েছে বার্ন ইউনিটে। প্রধানমন্ত্রী তাদের দেখতে গিয়েছিলেন। কোনো রকম
রাখঢাক না রেখেই গীতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের তৈরি করেছি।
আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের
নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না।... আমরা ভালো সরকার চাই। আমরা অসুস্থ সরকার চাই
না।’ গীতা সরকারের এ বক্তব্য ইউটিউবের মাধ্যমে পৌঁছে গেছে লাখ লাখ মানুষের
কাছে। তার সেই মর্মস্পর্শী অথচ দৃঢ়চেতা বক্তব্যে হৃদয় ছুঁয়ে গেছে লাখো
মানুষের। একজন গীতা সরকার যেন হয়ে উঠেছেন এ দেশের অগণিত মানুষের
প্রতিচ্ছবি। তিনি যেন বলতে চেয়েছেন সবার কথা। এ কেমন রাজনীতি! অসুস্থ
রাজনীতির বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটের এক-একজনের কাহিনী যখন
পত্রিকায় পড়ি, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাও
রেহাই পাননি দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমা থেকে। ঢাকা কলেজের একজন ছাত্র,
যে আমার সন্তান হতে পারত, সেও রেহাই পায়নি। এক সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই
করে অবশেষে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে।
এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু এ কোন রাজনীতি? যে রাজনীতি গীতা সরকারকে দগ্ধ করে, যে রাজনীতি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ওহিদুর রহমান বাবুর জীবন কেড়ে নেয়, সে রাজনীতি আমাদের কী মঙ্গল বয়ে আনবে? মনে আছে, বছর দুয়েক আগে তুরস্কের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মওলানা ভাসানী সম্পর্কে, আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার ‘দৌড়ে’ তিনি কোনোদিন হরতাল ডাকেননি। অবরোধ ডাকেননি। তার সাহসী উচ্চারণ তাকে অবিসংবাদিত পুরুষে পরিণত করেছিল। তিনি আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি এই হিংস্র রাজনীতিকে সমর্থন করতেন?
একজন গীতা সরকারের সাহসী কণ্ঠস্বর যেন বলছে হাজারও মানুষের কথা- আমরা এই নষ্ট রাজনীতি চাই না! এই রাজনীতি অসুস্থ। এই রাজনীতি মানুষের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আমি খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্যেও উৎসাহিত হয়েছি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে- ‘আমি বিস্মিত, হতবাক, ক্ষুব্ধ, বেদনাহত।’ যারা পেট্রল বোমায় আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে পড়ে আছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের দুরবস্থার কথা ভেবে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য গীতা সরকারদের কতটুকু আশ্বস্ত করতে পারবে আমি জানি না। তবে মনে করি, রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে এসব বোমাবাজকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। আমরা এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চাই। আমরা ‘নষ্ট রাজনীতি’র কারণে আজ জিম্মি। হরতাল হচ্ছে। অবরোধ হচ্ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলছে দুষ্কৃতকারীরা। আগুন লাগিয়ে হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক কারখানা ধ্বংস করছে তারা। এটা তো কোনো সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ হতে পারে না। যে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের জন্য বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ উপার্জন করে, যে প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার কর্মীর চাকরির সংস্থান করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন দিয়ে ধ্বংস করার নাম আর যাই হোক রাজনীতি হতে পারে না। সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, রাষ্ট্রের মালিকানা সাধারণ মানুষের ওপর অর্পিত। সেখানে গীতা সেনের মতো সাধারণ নাগরিকদেরই রাষ্ট্রে নিরাপত্তা নেই।
যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে, তাদের ক’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে জানি না। কিন্তু সংবাদপত্রে দেখেছি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাহবাগের বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর মালিবাগে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ১৫ জন নেতার নামে মামলা হয়েছে। তারা সবাই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ‘হুকুমের আসামি’। এই নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন একদিকে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ অতিক্রান্ত হয়েছে, অন্যদিকে ১৮ দলের ডাকা লাগাতার অবরোধ চলছে। কিন্তু এরপর কী? আবারও কি অবরোধ আসছে? একটা ভালো নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে তাতে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে? এটা সত্য বিরোধী দল এই অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে, এসব নেতা বাসে পেট্রল বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু-একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষদের পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় এক-একটি পরিবারকে, তারা তো জনগণের বন্ধু হতে পারে না। এরা জনগণের শত্র“। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, হুকুমের আসামি হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়, তাহলে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
অবরোধের কারণে স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এমন পরিস্থিতিতে গুজব যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ আমরা দেখলাম গাজীপুরে গত ২৯ নভেম্বর। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আগুন দেয়া হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড গ্র“পের পোশাক কারখানাগুলোতে। আগুন লাগার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে ১ হাজার ২০২ কোটি টাকার সম্পদ। রোববার যুগান্তরের শেষের পাতায় ছাপা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড গ্র“পের মালিক প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেনের কান্নার ছবি। এ ঘটনায় আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল, আমাদের রাজনীতিকরা তা কতটুকু বুঝতে পেরেছেন জানি না। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয় বৈকি!
এই ‘অসুস্থ রাজনীতি’ আমাদের একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ৬ ডিসেম্বর এসেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। এ নিয়ে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এলেন। বোঝাই যায় বাংলাদেশের সহিংস ঘটনাবলীতে উদ্বিগ্ন বিশ্ব কমিউনিটি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল যখন ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে পারছে না, তখন জাতিসংঘ কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেবে কিনা? কিংবা তা উভয় পক্ষের মাঝে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সংবিধান অনুমোদন করে কিনা? সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব সম্পর্কে (১১৮-১২৬নং ধারা) বলা হয়েছে। সংবিধানের আওতায় জাতিসংঘকে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দু’পক্ষ যদি রাজিও হয় তাহলে ‘সংবিধানের আওতায়’ কিভাবে জাতিসংঘকে অনুমতি দেয়া যায়, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মতামত নিতে হবে। তবে এটা সত্য, সংঘাত-গৃহযুদ্ধকবলিত দেশে জাতিসংঘ এ ধরনের ‘দায়িত্ব’ পালন করে থাকে। যেমন বলা যেতে পারে নেপাল, হাইতি, তিমুর, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাইবেরিয়া, কম্বোডিয়ার কথা। কম্বোডিয়ায় ১৯৯৩ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলাদেশের সেনারা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের আওতায় সেই নির্বাচন পরিচালনা করেছিল। নেপালের কথা বলা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৭৪০নং রেজুলেশন অনুযায়ী সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ‘সহায়তা গ্র“প’ গঠন করা হয়েছিল। এটা সত্য, জতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব দেশে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ওই সব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে, রয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাও। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা একটা রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি। একটা সংবিধান আছে। সংবিধানের ধারা-উপধারা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পরপরই দেশ একটি সংবিধান পেয়েছে। কঙ্গো বা লাইবেরিয়ায় কোনো স্বীকৃত সংবিধান ছিল না। গৃহযুদ্ধ সেখানকার রাজনীতি নির্ধারণ করত। বাংলাদেশে এমনটি নেই। তবুও এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ‘সমঝোতা’র জন্য এ দেশে এসেছেন। আমরা বারবার বলে আসছি, সমঝোতা হতে হবে প্রধান দুই শক্তির মধ্যে- একদিকে সরকার, অন্যদিকে বিরোধী দল। এখানে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দিতে হবে। ‘ছাড়’ না দিলে সমঝোতা হবে না। সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। তবে ‘বিদেশীদের’ যত আমরা এড়াতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। এজন্য দরকার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার।
২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা পার হয়ে গেছে। এখন পুনঃতফসিলের সুযোগ আর আছে বলেও মনে হয় না। যদিও সিইসি বলেছেন, সেই সুযোগ আছে। কিন্তু আরপিও নিয়ে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারা জানেন নতুন করে তফসিল ঘোষণার আর সুযোগ নেই। ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদের জন্য প্রস্তাবিত তফসিল বাতিল করা হয়েছিল বটে। কিন্তু তা করা হয়েছিল ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্টে’র ধারাবলে। এখন এই মুহূর্তে এটা করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে স্পষ্টতই একটা সমঝোতা দরকার। এক্ষেত্রে সংবিধান কোনো বাধা হবে না বলেও আমি মনে করি। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে, ঐকমত্যের ক্ষেত্রে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সংবিধানের ১১তম সংশোধনী (বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়া) এর বড় প্রমাণ।
আজ সহিংসতা বন্ধে একটি সমঝোতা বড় প্রয়োজন। সরকার একটি নির্বাচন করে ফেলতে পারবে, এটা সত্য। কিন্তু ওই নির্বাচনই সব কথা নয়। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা না থাকায় জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। সরকার এ জাতির অভিভাবক। আমরা চাই না আরেকজন গীতা সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করুক। এ ধরনের বিরূপ মন্তব্য অসাংবিধানিক শক্তিকেই উৎসাহ জোগাবে। সহিংসতা বন্ধ হোক। দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। একজন গীতা সরকারের আর্তি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এই অসুস্থ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? রাজনীতি তো সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু এ কোন রাজনীতি? যে রাজনীতি গীতা সরকারকে দগ্ধ করে, যে রাজনীতি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ ওহিদুর রহমান বাবুর জীবন কেড়ে নেয়, সে রাজনীতি আমাদের কী মঙ্গল বয়ে আনবে? মনে আছে, বছর দুয়েক আগে তুরস্কের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন মওলানা ভাসানী সম্পর্কে, আজীবন যিনি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ক্ষমতার ‘দৌড়ে’ তিনি কোনোদিন হরতাল ডাকেননি। অবরোধ ডাকেননি। তার সাহসী উচ্চারণ তাকে অবিসংবাদিত পুরুষে পরিণত করেছিল। তিনি আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি এই হিংস্র রাজনীতিকে সমর্থন করতেন?
একজন গীতা সরকারের সাহসী কণ্ঠস্বর যেন বলছে হাজারও মানুষের কথা- আমরা এই নষ্ট রাজনীতি চাই না! এই রাজনীতি অসুস্থ। এই রাজনীতি মানুষের মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আমি খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্যেও উৎসাহিত হয়েছি। খালেদা জিয়ার বক্তব্য ছাপা হয়েছে এভাবে- ‘আমি বিস্মিত, হতবাক, ক্ষুব্ধ, বেদনাহত।’ যারা পেট্রল বোমায় আহত হয়ে বার্ন ইউনিটে পড়ে আছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের দুরবস্থার কথা ভেবে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য গীতা সরকারদের কতটুকু আশ্বস্ত করতে পারবে আমি জানি না। তবে মনে করি, রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে এসব বোমাবাজকে চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। আমরা এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চাই। আমরা ‘নষ্ট রাজনীতি’র কারণে আজ জিম্মি। হরতাল হচ্ছে। অবরোধ হচ্ছে। রেললাইন উপড়ে ফেলছে দুষ্কৃতকারীরা। আগুন লাগিয়ে হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাক কারখানা ধ্বংস করছে তারা। এটা তো কোনো সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ হতে পারে না। যে প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রের জন্য বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ উপার্জন করে, যে প্রতিষ্ঠান ১৫ হাজার কর্মীর চাকরির সংস্থান করেছে, সেই প্রতিষ্ঠানটিতে আগুন দিয়ে ধ্বংস করার নাম আর যাই হোক রাজনীতি হতে পারে না। সংবিধানের ১৩নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, রাষ্ট্রের মালিকানা সাধারণ মানুষের ওপর অর্পিত। সেখানে গীতা সেনের মতো সাধারণ নাগরিকদেরই রাষ্ট্রে নিরাপত্তা নেই।
যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করেছে, তাদের ক’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে জানি না। কিন্তু সংবাদপত্রে দেখেছি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শাহবাগের বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর মালিবাগে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ১৫ জন নেতার নামে মামলা হয়েছে। তারা সবাই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ‘হুকুমের আসামি’। এই নিবন্ধ যখন লিখছি, তখন একদিকে নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ অতিক্রান্ত হয়েছে, অন্যদিকে ১৮ দলের ডাকা লাগাতার অবরোধ চলছে। কিন্তু এরপর কী? আবারও কি অবরোধ আসছে? একটা ভালো নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে তাতে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ জরুরি। দরকার স্থিতিশীলতা। দরকার পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা। কিন্তু সংবাদপত্রে যখন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের ছবিগুলো দেখি, তখন দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণটা জরুরি, সেখানে তাদের সবার নামেই মামলা! হয়তো আজ বা আগামীকাল আমরা দেখব আরেকটি ‘কমান্ডো স্টাইলে’ গ্রেফতারের কাহিনী! এতে করে কি আস্থার সম্পর্ক তৈরি হবে? এটা সত্য বিরোধী দল এই অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাকে কি বিশ্বাস করতে হবে, এসব নেতা বাসে পেট্রল বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন! পত্রিকায় দু-একজন দুষ্কৃতকারীর ছবিও ছাপা হয়েছে, যারা বাসে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি কেন? এসব দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। এরা রাজনীতি করে না। এরা সন্ত্রাসী। যারা পেট্রল বোমা মেরে মানুষ মারে, সাধারণ মানুষদের পুড়িয়ে দেয়, অসহায় করে দেয় এক-একটি পরিবারকে, তারা তো জনগণের বন্ধু হতে পারে না। এরা জনগণের শত্র“। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। তবে এটাও সত্য, হুকুমের আসামি হিসেবে যদি বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়, তাহলে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না।
অবরোধের কারণে স্থবির হয়ে গেছে জনজীবন। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ আজ আর ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। এ পরিস্থিতি কোনো ভালো কথা বলে না। এমন পরিস্থিতিতে গুজব যে কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, তার বড় প্রমাণ আমরা দেখলাম গাজীপুরে গত ২৯ নভেম্বর। পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নিহতের গুজব ছড়িয়ে মাইকে ঘোষণা দিয়ে আগুন দেয়া হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় অবস্থিত স্ট্যান্ডার্ড গ্র“পের পোশাক কারখানাগুলোতে। আগুন লাগার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে ১ হাজার ২০২ কোটি টাকার সম্পদ। রোববার যুগান্তরের শেষের পাতায় ছাপা হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড গ্র“পের মালিক প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেনের কান্নার ছবি। এ ঘটনায় আমাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেল, আমাদের রাজনীতিকরা তা কতটুকু বুঝতে পেরেছেন জানি না। কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেয় বৈকি!
এই ‘অসুস্থ রাজনীতি’ আমাদের একটি অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। ৬ ডিসেম্বর এসেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত তারানকো। এ নিয়ে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এলেন। বোঝাই যায় বাংলাদেশের সহিংস ঘটনাবলীতে উদ্বিগ্ন বিশ্ব কমিউনিটি। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দল যখন ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে পারছে না, তখন জাতিসংঘ কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেবে কিনা? কিংবা তা উভয় পক্ষের মাঝে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা? প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সংবিধান অনুমোদন করে কিনা? সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন কমিশন গঠন ও এর দায়িত্ব সম্পর্কে (১১৮-১২৬নং ধারা) বলা হয়েছে। সংবিধানের আওতায় জাতিসংঘকে এ ধরনের সুযোগ দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। দু’পক্ষ যদি রাজিও হয় তাহলে ‘সংবিধানের আওতায়’ কিভাবে জাতিসংঘকে অনুমতি দেয়া যায়, সে ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মতামত নিতে হবে। তবে এটা সত্য, সংঘাত-গৃহযুদ্ধকবলিত দেশে জাতিসংঘ এ ধরনের ‘দায়িত্ব’ পালন করে থাকে। যেমন বলা যেতে পারে নেপাল, হাইতি, তিমুর, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, লাইবেরিয়া, কম্বোডিয়ার কথা। কম্বোডিয়ায় ১৯৯৩ সালে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলাদেশের সেনারা জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের আওতায় সেই নির্বাচন পরিচালনা করেছিল। নেপালের কথা বলা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৭৪০নং রেজুলেশন অনুযায়ী সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি ‘সহায়তা গ্র“প’ গঠন করা হয়েছিল। এটা সত্য, জতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এসব দেশে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে ওই সব দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংকট রয়েছে, রয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাও। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা একটা রাজনৈতিক কাঠামো দাঁড় করাতে পেরেছি। একটা সংবিধান আছে। সংবিধানের ধারা-উপধারা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার পরপরই দেশ একটি সংবিধান পেয়েছে। কঙ্গো বা লাইবেরিয়ায় কোনো স্বীকৃত সংবিধান ছিল না। গৃহযুদ্ধ সেখানকার রাজনীতি নির্ধারণ করত। বাংলাদেশে এমনটি নেই। তবুও এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক যে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ‘সমঝোতা’র জন্য এ দেশে এসেছেন। আমরা বারবার বলে আসছি, সমঝোতা হতে হবে প্রধান দুই শক্তির মধ্যে- একদিকে সরকার, অন্যদিকে বিরোধী দল। এখানে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দিতে হবে। ‘ছাড়’ না দিলে সমঝোতা হবে না। সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই একটা সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। তবে ‘বিদেশীদের’ যত আমরা এড়াতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। এজন্য দরকার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার।
২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা পার হয়ে গেছে। এখন পুনঃতফসিলের সুযোগ আর আছে বলেও মনে হয় না। যদিও সিইসি বলেছেন, সেই সুযোগ আছে। কিন্তু আরপিও নিয়ে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারা জানেন নতুন করে তফসিল ঘোষণার আর সুযোগ নেই। ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদের জন্য প্রস্তাবিত তফসিল বাতিল করা হয়েছিল বটে। কিন্তু তা করা হয়েছিল ‘জেনারেল ক্লজ অ্যাক্টে’র ধারাবলে। এখন এই মুহূর্তে এটা করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে স্পষ্টতই একটা সমঝোতা দরকার। এক্ষেত্রে সংবিধান কোনো বাধা হবে না বলেও আমি মনে করি। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। সমঝোতার ক্ষেত্রে, ঐকমত্যের ক্ষেত্রে সংবিধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সংবিধানের ১১তম সংশোধনী (বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের স্বপদে ফিরে যাওয়া) এর বড় প্রমাণ।
আজ সহিংসতা বন্ধে একটি সমঝোতা বড় প্রয়োজন। সরকার একটি নির্বাচন করে ফেলতে পারবে, এটা সত্য। কিন্তু ওই নির্বাচনই সব কথা নয়। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা না থাকায় জাতীয় পার্টিও নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় দেশের স্থিতিশীলতা, অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এসব বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। সরকার এ জাতির অভিভাবক। আমরা চাই না আরেকজন গীতা সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করুক। এ ধরনের বিরূপ মন্তব্য অসাংবিধানিক শক্তিকেই উৎসাহ জোগাবে। সহিংসতা বন্ধ হোক। দুষ্কৃতকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। একজন গীতা সরকারের আর্তি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments