দুচোখ ভরে ম্যান্ডেলাকে দেখেছি by রফিকুল ইসলাম রতন
দক্ষিণ
আফ্রিকা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু যে মানুষটি সারা বিশ্বে এ দেশটিকে
বিশেষভাবে পরিচিতি দিয়েছেন, সেই জীবন্ত কিংবদন্তিকে দেখেছি আমি। দু’চোখ ভরে
হৃদয়-মন উজাড় করে দেখেছি একটি ইতিহাসকে। কোঁকড়ানো চুলের বিশালদেহী আজন্ম
বিপ্লবী ও বর্ণবাদবিরোধী আপসহীন সেই কালো মানুষটিকে দেখে সেদিন মুগ্ধ
হয়েছিলাম। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম পলকহীন চোখে। তাকে দেখে শ্রদ্ধাবনত
চিত্তে মাথাও নুয়েছিলাম। তেমনই শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম ইয়াসির আরাফাতকে দেখেও।
আজ থেকে ১৬ বছর আগে অধিকার আদায়ের আজীবন সংগ্রামী, বিশ্ববরেণ্য এই নেতা পা
রেখেছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
আমন্ত্রণে অন্য দুই বিশ্ব নেতার সঙ্গে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ
দিতে এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেলসন
ম্যান্ডেলা। দিনটি ছিল ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ। এ অনুষ্ঠানে আরও ছিলেন আরেক
অকুতোভয় সংগ্রামী নেতা ফিলিস্তিনবাসীর প্রাণের মানুষ প্রেসিডেন্ট ইয়াসির
আরাফাত ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল।
তৎকালীন দৈনিক বাংলার একজন রিপোর্টার হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান কভার করার বিরল সুযোগ আমার হয়েছিল। আর এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আমার সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান শিক্ষাগুরু, চিফ রিপোর্টার জহিরুল হকের বদান্যতায়। মূলত তিনি নিজেই এ রাষ্ট্রীয় অনন্যসাধারণ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানটি কভার করেছিলেন। সঙ্গে রেখেছিলেন আমাকে। আমি সেদিন অনুষ্ঠানের টুকিটাকি ও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাগুলো তুলে ধরেছিলাম। ১৯৭১ সালে যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং যে স্থানটিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল- ঠিক সেই স্থানটিতে নির্মিত ‘স্বাধীনতা মঞ্চে’ আয়োজন করা হয়েছিল তিন দিনব্যাপী সেদিনের অনুষ্ঠানমালার। এই বিশ্ব বরেণ্য নেতাদের লালগালিচা অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজও আমার কানে বাজে সেদিনের নেলসন ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পঙ্ক্তিগুলো। আমরা সেদিন তন্ময় হয়ে শুধু শুনছিলাম এবং হৃদয়-মন উজাড় করে দু’চোখ ভরে তাদের দেখছিলাম। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মাথা নুয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বর্ণ বৈষম্যের অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছি, তখন বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার শোষিত বঞ্চিত নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। শুধু এ কারণেই আমি বাংলাদেশের একজন বন্ধু হতে চাই। তিনি বলেন, বর্ণ বৈষম্যের অন্ধকার থেকে স্বাধীনতার ভোরের পথে আমরা যখন হামাগুড়ি দিচ্ছি, তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালন করছে। আমার পরম সৌভাগ্য এমন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাওয়ার জন্য।’
দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী প্রিন্টের ফুলহাতা শার্ট ও অফ হোয়াইট প্যান্ট পরিহিত সদা হাস্যমুখের এই নেতা মঞ্চে উঠে যখন উপস্থিত সুধী ও জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লেন, তখন সবাই দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সেই সম্মানের জবাব দিয়েছিলেন, শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত করে তুলেছিলেন গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কোটরাগত গভীর চোখে অবাক বিস্ময়ে জনতার দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁতের হাসি দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এই ব-দ্বীপের অধিবাসীদেরও অকৃত্রিম বন্ধু।
সেদিনের সেই ছোট্ট ভাষণটির কী অপরিসীম গুরুত্ব, তখন হয়তো তা বুঝতেই পারিনি। তিনি হেলিকপ্টারে করে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শোক বইতে লিখেছিলেন, ‘বন্ধুরা, তোমাদের মৃত্যু নেই।’ তিনি স্মৃতিসৌধ চত্বরে একটি গাছের চারাও রোপণ করেছিলেন। সেদিন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, নেলসন ম্যান্ডেলা কিছুটা অসুস্থ অবস্থাতেই এসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার টানে। সাংবাদিকতার প্রায় তিন যুগ পার করতে চলেছি। কিন্তু জীবনে এমন মহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান দেশের মাটিতে আর কভার করার সুযোগ হয়নি। বিশ্বের বহু দেশে পেশাগত কাজে গেলেও ম্যান্ডেলা ও ইয়াসির আরাফাতের এ অনুষ্ঠানটিই ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনা।
বর্ণবাদের জাঁতাকলে যে দেশটি ছিল নিষ্পেষিত, যন্ত্রণাকাতর এবং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল যে জনপদটি, সেই পশ্চাৎপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদে লাশের গন্ধ আর ধংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এই মানুষটি। শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার-নির্যাতন আর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামের অবিসংবাদী এই নেতাকে কঠোর ও অমানুষিক পরিশ্রম করে নিজেকে জায়গা করে নিতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিয়ে গণমানুষের কাতারে এসে বিশ্ব নেতায় উদ্ভাসিত নেলসন ম্যান্ডেলা সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর বিদায় নিলেন। তিনি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন- সততা, সাহস, মহানুভবতা, উদারতা ও ক্ষমাই হতে পারে একটি জীবন্ত কিংবদন্তি হওয়ার পেছনের মূলমন্ত্র।
সেই ১৯৪৪ সালে মহাত্মা গান্ধীর গড়া রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগদানের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো একটি দিনের জন্যও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল ও সংগ্রামী ভূমিকার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সব কালো নির্যাতিত মানুষ। তার আহ্বানে দেশের উদারপন্থী সব শ্রেণী-গোত্রের মানুষই ঐকমত্যে এসেছিল ম্যান্ডেলার নেতৃত্ব মেনে নিতে। আফ্রিকার কালো মানুষদের ইতিহাসে এমন জাদুকরি নেতৃত্ব এর আগে আর কেউ দিতে পারেননি। তার নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতার সনদ। তিনি আত্মগোপনে থেকে শেষ পর্যন্ত যে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাতেই ভিত কেঁপে উঠেছিল অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ শাসকদের। তারপরও তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ যাওয়ার অভিযোগ এনে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় এই নেতাকে। বর্ণবাদী স্বৈরশাসক ফেড্রিক ডি ক্লার্ক নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর একের পর এক অত্যাচার-নির্যাতন করে প্রিটোরিয়াসহ বিভিন্ন জেলখানায় নিক্ষেপ এবং শেষে বিচ্ছিন্ন রোবেন দ্বীপে একটানা ১৮ বছরের কারাজীবনে নিক্ষেপ করে। ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রোবেন দ্বীপের ৮ ফুট বাই ৭ ফুটের ছোট্ট একটি প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপের পরও দমে যাননি তিনি। তার মনোবল এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে, তিনি কারাগারে বসেই দূরশিক্ষণের মাধ্যমে লন্ডন থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের নিষ্ঠুর শিকার কালো মানুষদের প্রায় সবাই যখন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, প্রতিশোধ আর জিঘাংসার আগুনে যখন জ্বলে-পুড়ে মরছে সবাই, যখন শ্বেতাঙ্গদের জীবন ও অস্তিত্ব চরম সংকটে, ঠিক তখনই ১৯৯০ সালে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ক্লার্ক সরকার। কিন্তু মুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা আবির্ভূত হন এক নতুন মানুষরূপে। মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা’ই হয়ে ওঠে তার প্রধান রাজনৈতিক দর্শন। জীবন যুদ্ধে পরাস্ত এবং অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষরা যখন প্রতিশোধ আগুনে পুড়ছে, ঠিক সেই রকম একটি উত্তেজনায় টানটান পরিস্থিতিতে তিনি তার মমত্ববোধ, প্রজ্ঞা, মানবতা ও মহানুভবতা দিয়ে গোটা জাতিকে প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে নিবৃত রেখে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। যা ছিল বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ও অনন্য দৃষ্টান্ত।
সেই ১৯১৮ সালে ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের পাহাড়ি ও ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা নিভৃত পল্লী এমভোজা কুনু গ্রামের নিুবিত্ত পরিবারে জন্মের পর থেকেই যে মানুষটি জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ঠেকে ঠেকে শিখেছিলেন মানুষকে আপন করে নেয়ার মূলমন্ত্র, যিনি কোনোদিন নীতির কাছে আপস করেননি, যার গুণ ও মহত্ত্ব সবাইকে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিয়েছিল- সেই ম্যান্ডেলা তো আর সাধারণ কাজ করতে পারেন না। তাই তিনি শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে ঘটালেন এক মহান মিলন। যার মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে পরিণত হলেন মহান এক আদর্শের প্রতিভূ হিসেবে, শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে একজন শিক্ষানবিস সেবিকা এলভিস নিতোকো মাসকে বিয়ে, বিয়ের পর ৯ মাস বয়সে কন্যা ম্যাকজিউয়ের মৃত্যু এবং ১৩ বছরের বিবাহ জীবনের অবসান (বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতি।
তৎকালীন দৈনিক বাংলার একজন রিপোর্টার হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান কভার করার বিরল সুযোগ আমার হয়েছিল। আর এ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল আমার সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান শিক্ষাগুরু, চিফ রিপোর্টার জহিরুল হকের বদান্যতায়। মূলত তিনি নিজেই এ রাষ্ট্রীয় অনন্যসাধারণ আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানটি কভার করেছিলেন। সঙ্গে রেখেছিলেন আমাকে। আমি সেদিন অনুষ্ঠানের টুকিটাকি ও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন ও ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনাগুলো তুলে ধরেছিলাম। ১৯৭১ সালে যে স্থানটিতে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এবং যে স্থানটিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পাক হানাদার বাহিনী মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল- ঠিক সেই স্থানটিতে নির্মিত ‘স্বাধীনতা মঞ্চে’ আয়োজন করা হয়েছিল তিন দিনব্যাপী সেদিনের অনুষ্ঠানমালার। এই বিশ্ব বরেণ্য নেতাদের লালগালিচা অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজও আমার কানে বাজে সেদিনের নেলসন ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার পঙ্ক্তিগুলো। আমরা সেদিন তন্ময় হয়ে শুধু শুনছিলাম এবং হৃদয়-মন উজাড় করে দু’চোখ ভরে তাদের দেখছিলাম। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি মাথা নুয়ে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা যখন বর্ণ বৈষম্যের অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছি, তখন বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার শোষিত বঞ্চিত নিগৃহীত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। শুধু এ কারণেই আমি বাংলাদেশের একজন বন্ধু হতে চাই। তিনি বলেন, বর্ণ বৈষম্যের অন্ধকার থেকে স্বাধীনতার ভোরের পথে আমরা যখন হামাগুড়ি দিচ্ছি, তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী পালন করছে। আমার পরম সৌভাগ্য এমন একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাওয়ার জন্য।’
দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী প্রিন্টের ফুলহাতা শার্ট ও অফ হোয়াইট প্যান্ট পরিহিত সদা হাস্যমুখের এই নেতা মঞ্চে উঠে যখন উপস্থিত সুধী ও জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লেন, তখন সবাই দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে সেই সম্মানের জবাব দিয়েছিলেন, শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত করে তুলেছিলেন গোটা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কোটরাগত গভীর চোখে অবাক বিস্ময়ে জনতার দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁতের হাসি দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এই ব-দ্বীপের অধিবাসীদেরও অকৃত্রিম বন্ধু।
সেদিনের সেই ছোট্ট ভাষণটির কী অপরিসীম গুরুত্ব, তখন হয়তো তা বুঝতেই পারিনি। তিনি হেলিকপ্টারে করে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শোক বইতে লিখেছিলেন, ‘বন্ধুরা, তোমাদের মৃত্যু নেই।’ তিনি স্মৃতিসৌধ চত্বরে একটি গাছের চারাও রোপণ করেছিলেন। সেদিন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, নেলসন ম্যান্ডেলা কিছুটা অসুস্থ অবস্থাতেই এসেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার টানে। সাংবাদিকতার প্রায় তিন যুগ পার করতে চলেছি। কিন্তু জীবনে এমন মহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান দেশের মাটিতে আর কভার করার সুযোগ হয়নি। বিশ্বের বহু দেশে পেশাগত কাজে গেলেও ম্যান্ডেলা ও ইয়াসির আরাফাতের এ অনুষ্ঠানটিই ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঘটনা।
বর্ণবাদের জাঁতাকলে যে দেশটি ছিল নিষ্পেষিত, যন্ত্রণাকাতর এবং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল যে জনপদটি, সেই পশ্চাৎপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন জনপদে লাশের গন্ধ আর ধংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন এই মানুষটি। শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার-নির্যাতন আর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে কালোদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সংগ্রামের অবিসংবাদী এই নেতাকে কঠোর ও অমানুষিক পরিশ্রম করে নিজেকে জায়গা করে নিতে হয়েছিল। প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে দিয়ে গণমানুষের কাতারে এসে বিশ্ব নেতায় উদ্ভাসিত নেলসন ম্যান্ডেলা সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর বিদায় নিলেন। তিনি তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন- সততা, সাহস, মহানুভবতা, উদারতা ও ক্ষমাই হতে পারে একটি জীবন্ত কিংবদন্তি হওয়ার পেছনের মূলমন্ত্র।
সেই ১৯৪৪ সালে মহাত্মা গান্ধীর গড়া রাজনৈতিক দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগদানের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো একটি দিনের জন্যও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল ও সংগ্রামী ভূমিকার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সব কালো নির্যাতিত মানুষ। তার আহ্বানে দেশের উদারপন্থী সব শ্রেণী-গোত্রের মানুষই ঐকমত্যে এসেছিল ম্যান্ডেলার নেতৃত্ব মেনে নিতে। আফ্রিকার কালো মানুষদের ইতিহাসে এমন জাদুকরি নেতৃত্ব এর আগে আর কেউ দিতে পারেননি। তার নেতৃত্বেই ১৯৫৫ সালে ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতার সনদ। তিনি আত্মগোপনে থেকে শেষ পর্যন্ত যে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাতেই ভিত কেঁপে উঠেছিল অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ শাসকদের। তারপরও তারা শেষ চেষ্টা হিসেবে ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ যাওয়ার অভিযোগ এনে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় এই নেতাকে। বর্ণবাদী স্বৈরশাসক ফেড্রিক ডি ক্লার্ক নেলসন ম্যান্ডেলার ওপর একের পর এক অত্যাচার-নির্যাতন করে প্রিটোরিয়াসহ বিভিন্ন জেলখানায় নিক্ষেপ এবং শেষে বিচ্ছিন্ন রোবেন দ্বীপে একটানা ১৮ বছরের কারাজীবনে নিক্ষেপ করে। ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে রোবেন দ্বীপের ৮ ফুট বাই ৭ ফুটের ছোট্ট একটি প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপের পরও দমে যাননি তিনি। তার মনোবল এতটাই সুদৃঢ় ছিল যে, তিনি কারাগারে বসেই দূরশিক্ষণের মাধ্যমে লন্ডন থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের নিষ্ঠুর শিকার কালো মানুষদের প্রায় সবাই যখন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, প্রতিশোধ আর জিঘাংসার আগুনে যখন জ্বলে-পুড়ে মরছে সবাই, যখন শ্বেতাঙ্গদের জীবন ও অস্তিত্ব চরম সংকটে, ঠিক তখনই ১৯৯০ সালে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ক্লার্ক সরকার। কিন্তু মুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা আবির্ভূত হন এক নতুন মানুষরূপে। মহাত্মা গান্ধীর ‘অহিংসা’ই হয়ে ওঠে তার প্রধান রাজনৈতিক দর্শন। জীবন যুদ্ধে পরাস্ত এবং অত্যাচার-নিপীড়নে জর্জরিত দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষরা যখন প্রতিশোধ আগুনে পুড়ছে, ঠিক সেই রকম একটি উত্তেজনায় টানটান পরিস্থিতিতে তিনি তার মমত্ববোধ, প্রজ্ঞা, মানবতা ও মহানুভবতা দিয়ে গোটা জাতিকে প্রতিশোধপরায়ণতা থেকে নিবৃত রেখে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। যা ছিল বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ও অনন্য দৃষ্টান্ত।
সেই ১৯১৮ সালে ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের পাহাড়ি ও ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা নিভৃত পল্লী এমভোজা কুনু গ্রামের নিুবিত্ত পরিবারে জন্মের পর থেকেই যে মানুষটি জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে ঠেকে ঠেকে শিখেছিলেন মানুষকে আপন করে নেয়ার মূলমন্ত্র, যিনি কোনোদিন নীতির কাছে আপস করেননি, যার গুণ ও মহত্ত্ব সবাইকে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিয়েছিল- সেই ম্যান্ডেলা তো আর সাধারণ কাজ করতে পারেন না। তাই তিনি শ্বেতাঙ্গ আর কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে ঘটালেন এক মহান মিলন। যার মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে পরিণত হলেন মহান এক আদর্শের প্রতিভূ হিসেবে, শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে।
মাত্র ২৪ বছর বয়সে একজন শিক্ষানবিস সেবিকা এলভিস নিতোকো মাসকে বিয়ে, বিয়ের পর ৯ মাস বয়সে কন্যা ম্যাকজিউয়ের মৃত্যু এবং ১৩ বছরের বিবাহ জীবনের অবসান (বিবাহ বিচ্ছেদের প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতি।
No comments