সংঘাতের শেষে কি অপেক্ষা করছে? by সাজেদুল হক
আসলে সবাই জানতেন সংঘাত-সংঘর্ষের মুখোমুখি
হওয়াই হবে তাদের নিয়তি। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা ছিল তাদের মনে। ভাগ্য বদলাতে
প্রার্থনাতেও বসেছিলেন তারা। কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
এক
ব্যক্তির জেদ আর অহমিকার কাছে আজ পরাজিত বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল এখন
অগ্নিগর্ভ। মারা যাচ্ছে মানুষ। কেউ গুলিতে, কেউ আগুনে। যেভাবেই মারা যাক
তারা আদম সন্তান।
বছর চারেক আগের কথা। সুপ্রিম কোর্টে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি চলছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির চেয়ারে। টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুল ইসলাম। বাংলাদেশের আইনের ইতিহাসে অন্যতম প্রভাব বিস্তারকারী তিন আইনজীবী। তাদের আদর্শিক পথ আলাদা। কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রশ্নে একমত পোষণ করেছিলেন তিন জনই। উচ্চারণ করেছিলেন হুঁশিয়ারি। তারা পরিষ্কার বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলে অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। গৃহযুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন তারা। কিন্তু আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে চার বিচারপতি ওই বক্তব্য আমলে নেননি। তাদের সিদ্ধান্তে অবৈধ ঘোষিত হয় তত্ত্বাবধায়ক। যদিও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার সুযোগ রেখেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু যিনি তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের মওকা খুঁজছিলেন তিনি অপেক্ষা করেননি। সংসদীয় কমিটির সদস্যরা শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিলেও পরে ইশারায় তারাও বদলে যান। সংবিধান থেকে উঠে যায় ত্রয়োদশ সংশোধনী। আর এ কারণেই আজকের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে আসলে সেদিনই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরিকল্পনাটি আচমকা ছিল না। সুপ্রিম কোর্টে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার শুনানি শুরুর আগেই মানবজমিনে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এ সংশোধনী বাতিলের আশঙ্কা নিয়ে। ২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই শেখ হাসিনা এগিয়ে গেছেন স্থির লক্ষ্য নিয়ে। দুর্বল বিরোধী দল তার এ পথে কোন বাধাই তৈরি করতে পারেনি। আর পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত করেছেন সুকৌশলে। এমনকি এখন নির্বাচন না হলেও তার প্রধানমন্ত্রী পদে বসে থাকতে সাংবিধানিক ব্যাখ্যার অভাব হবে না।
অন্যদিকে, বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গত সাত বছরই একের পর এক আঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছে। পলায়নপর মনোবৃত্তির নেতাদের কাছ থেকে তেমন কোন সহযোগিতাই পাননি তিনি। তবে বিভিন্ন জনমত জরিপ আর ৫ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল আশাবাদী করে তোলে তাকে। এ কারণে যে কোন মূল্যে সমঝোতার পক্ষে ছিলেন বেগম জিয়া। পর্দার অন্তরালে সমঝোতায় বারবার সায়ও দিয়ে যান। যদিও শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে না যেতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তবে আন্দোলন কর্মসূচির আহ্বানে বিএনপি চেয়ারপারসন বরাবরই সতর্কতা অবলম্বন করেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও কড়া কোন কর্মসূচিতে যাননি তিনি। যদিও গত ২৫শে নভেম্বর নির্বাচন কমিশন একতরফা তফসিল ঘোষণার পর অলআউট অ্যাকশনে চলে যায় বিরোধী দল। এখন টানা অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে। তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এ পর্যন্ত সহিংসতায় কমপক্ষে ২৯ জন নিহত হয়েছেন। রাজধানী ঢাকা এখন কার্যত বিচ্ছিন্ন। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার পথে।
বাংলাদেশ যখন জ্বলছে তখন সারা দুনিয়াই উদ্বিগ্ন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দু’টি পার্লামেন্টে আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে। বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করছে জাতিসংঘ। কিন্তু ক্ষমতার চাবি যাদের হাতে তাদের এক চোখই শুধু খোলা। তারা দেখছেন, শুধু একটি দেশের অবস্থান। সবকিছুই থোড়াই কেয়ার করছেন তারা। এ অবস্থায় সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো আগামী ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসছেন। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। তারানকোর সর্বশেষ সমঝোতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বেশ কয়েকটি পথের কথা বলেছেন। তার মতে, একটি হলো এমনটা চলতে থাকলে জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে। সেই পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। হালকা অথবা বড় আকারের সেনা অভ্যুত্থান হতে পারে। একটি পর্যায়ে আবার সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তবে এমনটি হলে দু’টি দলের গণতান্ত্রিক অপমৃত্যু হবে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুনীরউজ্জামান মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশে সেনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সম্পর্কে বলে এসেছেন, হস্তক্ষেপের কোন ইচ্ছা সেনাবাহিনীর নেই। তবে সহিংসতা অব্যাহত থাকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোন এক পর্যায়ে তাদের ভূমিকা নিতে দেখা যেতে পারে।
‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’য় উইলিয়াম শেক্সপিয়ার লিখেছেন, নিজেদের ব্যাপারে অজ্ঞ আমরা প্রায়ই নিজেদের ক্ষতির জন্য প্রার্থনা করি, আর বিজ্ঞ পরম শক্তি আমাদের ভালর জন্য তা প্রত্যাখ্যান করেন: তাই নিজেদের প্রার্থনার বিফলতায় আমরা লাভবান হই। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এ কথা বলাই যায়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ধ্বংসের জন্যই কোন কোন রাজনীতিবিদ প্রার্থনা করছেন। বিজ্ঞ পরম করুণাময় তাদের প্রার্থনা এখনও পুরোপুরি কবুল করেননি। তবে তারা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। প্রাথমিকের পাঠ্যসূচিতে একসময় অনুবাদের জন্য প্রবচন মুখস্ত করতে হতো- ‘রোম যখন পুড়ছিলো নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ আজ বাংলাদেশ যখন পুড়ছে তখনও নীরোও বাঁশি বাজাচ্ছেন। নীরোর বাঁশির সুর দিনে দিনে আরও চড়া হচ্ছে। এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, সমঝোতা যদি না হয় এবং এ বাঁশি যদি বাজতেই থাকে তবে ব্যর্থ রাষ্ট্রই হবে বাংলাদেশের একমাত্র ঠিকানা।
No comments