অথঃ শিক্ষক রাজনীতি সমাচার ভিসি রাত কাটালেন রাস্তায় by একেএম শাহ নাওয়াজ
স্কুলে
ব্যাকরণ শিক্ষক আমাকে একটি লাইনের ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। তা হচ্ছে,
‘দুঃসংবাদ বেগে ধায়’। আমি সম্ভবত ভালো উত্তর দিতে পারিনি। পরে তাৎপর্য
বুঝেছি। আজ সকালে আরও স্পষ্ট হল। পারিবারিক কাজে গত দু’দিন ব্যস্ত ছিলাম।
ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগর করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকটের শেষ অবস্থার খোঁজ
নিতে পারিনি। নিুরুচির শিক্ষক রাজনীতির ধারা দেখে তথ্য জানার আগ্রহও হারিয়ে
ফেলেছি। কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাফসুতরো রাখার স্বার্থপরের মতো
চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফোন করলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকর্মী। বললেন,
আপনারা তো ভিসি তাড়ানোর নানা কসরৎ আমাদের শেখাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত একজন
উপাচার্যকে রাস্তায় রাত কাটাতে বাধ্য করলেন! নাকি উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার
হোসেন আপনাদের কষ্টের প্রতি সহমর্মী হয়ে আপনাদের সঙ্গে রাত কাটিয়ে কষ্ট ভাগ
করে নিলেন। তবে মানতেই হবে, এ পর্বে ভিসি সাহেবই জিতে গেলেন।
ধীরে ধীরে আমি সব বিষয় অবহিত হয়ে নিজের অস্তিত্বের দিকে তাকিয়ে দারুণ বিব্রত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের যা সম্মানহানি হওয়ার, গত কয়েক মাসে তো তা হয়েছেই। নষ্ট ও স্বার্থবাদী শিক্ষক রাজনীতি যে প্রতিদিন নানা অঘটনের জন্ম দিয়ে জ্ঞান কেন্দ্র হিসেবে এতদিনের একটি সুনামধারী প্রতিষ্ঠানকে এতটা কলংকিত করবে, তা ভাবতে ইচ্ছে করেনি। এখন বন্ধু পরিচিতজনদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো মনের জোর আর খুঁজে পাই না। যখন কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা বলুন তো কী হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে? সেখানে কি আদৌ লেখাপড়ার পরিবেশ রেখেছেন আপনারা?’ এখন আর জবাব দেই না। হাত জোর করে মাথা নিচু করি।
দু’দিন আগে জ্ঞানরঞ্জন চাকমা ফোন করলেন। তিনি বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন। ফোন করলেন আমাদের ভর্তি পরীক্ষা-সংক্রান্ত বিষয় জানতে। তার মেয়ে এবার পরীক্ষা দেবে। পরবর্তী প্রশ্নবাণ ছুটে আসবে ভেবে বুক দুরু দুরু করছিল। এলো সেই প্রশ্ন। বললেন, ‘দোস্ত আমাদের মান-সম্মান তো আর রইল না। তোমরা তোমাদের সহকর্মীদের বোঝাও। এসব মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কয়েকজনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় সবার। আমাদের এখানে অনেক অভিভাবক বলছেন, তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি পরীক্ষা দেয়াবে না।’
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মাস্টার্সের ছাত্র। নাম শুভ। এটি তার আসল নাম নয়। তার অনুরোধে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হল। কারণ ভয়, আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতা তার সরাসরি শিক্ষক। তার স্যার ক্লাস নেয়ার সময় পান না, তবে জানলে তার ওপর খক্ষ নামতে পারে। বলল, স্যার, আমাদের সহপাঠী বিনাচিকিৎসায় মারা গেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ অন্য শিক্ষকদের বাসায় ভাংচুর করেছিল। আপনি আমাদের এ কারণে তিরস্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রকৃত কারণ না জেনে অমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। আন্দোলনের নামে শিক্ষকদের বাসা পর্যন্ত ধাওয়া করা অসভ্যতা। কিন্তু এখন আপনারা আমাদের চেয়ে বড় অন্যায় করছেন। আমরা তো বয়সের কারণে ভুল করতেই পারি। বন্ধুর মৃতদেহ সামনে রেখে উত্তেজিত হয়ে অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু আপনারা কী করছেন! ভিসিবিরোধী যে আন্দোলন করছেন, তা একান্তই আপনাদের শিক্ষক রাজনীতির সংকীর্ণ বিষয়। অধিকাংশ শিক্ষকের সায় নেই এ আন্দোলনে। রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনো ছাত্র সংগঠন এর প্রতি সমর্থন জানায়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক রাখার জন্য মিছিল করেছে, ব্যানার টানিয়েছে। আর আপনারা একদল শিক্ষক দিনের পর দিন অফিসে বন্দি করে রেখেছিলেন একজন উপাচার্যকে। বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল দেখাতে রেজিস্ট্রারকে দু’দিন ধরে তার অফিস কক্ষে আটকে রেখেছেন। এরপর কথা নেই, বার্তা নেই, নতুন কোনো ঘটনা নেই, উত্তেজনা নেই- তারপরও আপনারা জনাকয়েক চেয়ার পেতে ভিসির বাসভবনের সামনে বসে অশ্লীলভাবে মাইক বাজিয়ে তাকে আর তার পরিবারকে বিরক্ত করছেন। স্যার, মানতে হবে আমরা ছাত্ররা কিন্তু এতটা নিচে নামিনি।
আমি জানি, আমার ছাত্রের প্রশ্নের কোনো জবাব আমার কাছে নেই। তাই মাথা নিচু করলাম। ছাত্রছাত্রীদের সামনে ‘ভালো’ মডেল হয়ে যাচ্ছি আমরা। এবার সহকর্মী ড. এমরান জাহানের কথা বলছি। ভিসি ভবনের উল্টো দিকে মাঠের অপর পাশে তার বাসা। বললেন, আন্দোলনকারী সহকর্মীরা ভিসিকে বিরক্ত করার জন্য জোরে মাইক বাজাচ্ছিলেন। এদিকে পড়ার ব্যাঘাত ঘটছিল আমার মেয়ের। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম, ছাত্ররা সন্ত্রাসী করলে সমালোচনা করতেন, এখন এর নৈতিকতাও হারালেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই যুক্তিহীন নিুমানের আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য নিয়ে জাতীয় দৈনিকে অনেক লিখেছি। আরও অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু যাদের আত্মচৈতন্যে ফিরে আসা দরকার, তারা গোয়ার্তুমি থেকে ফিরতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষদের গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছেন।
আরেকটি গোলমেলে বিষয় যুক্ত হয়েছে এখানে। দুর্বল ইস্যুর ওপর ভর করে পদত্যাগী সাবেক ভিসির অনুগত শিক্ষক গ্র“প নতুন ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আন্দোলনে নামে। আন্দোলনে একের পর এক নেয়া কর্মসূচি দেখলে বোঝা যায়, এতে প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত তীব্র। আগের ভিসির বিরুদ্ধে নানা স্খলনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তাই আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হলেও এ আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো তেমনই নেয়া হচ্ছে, যা যা নেয়া হয়েছিল আগের ভিসির বিরুদ্ধে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এখানে যে, আগের ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন যে বিএনপি গ্র“পের শিক্ষকরা, এবার তারাই নিজেদের রাজনৈতিক লাভ পাওয়ার জন্য হাত মেলালেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নাম জড়ানো গ্র“পের সহকর্মীদের সঙ্গে। কোনো আদর্শ ধারণ না করে এভাবে তেল-জল একসঙ্গে সাঁতার কাটছে আর নষ্ট করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ।
শিক্ষক রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কিছুসংখ্যক শিক্ষক নিজেদের লাভ, স্বার্থ ও ঈর্ষাকে মূল্য দিতে গিয়ে ক্লাস পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর নানা সমালোচনার মুখে ক্লাস পরীক্ষার ওপর অবরোধ তুলে নেন। এবার অবরোধ করেন প্রশাসনিক কাজে। শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে এখানেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। নির্বাচিত আইনানুগ ভিসিকে বল প্রয়োগে হলেও তাড়াবেনই। আমার এক সহকর্মী আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে নাকি শুনেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেউ বলেছেন- বিনা কারণে সরকারের পক্ষে একজন নির্বাচিত ভিসিকে সরানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভিসিকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে হবে। এই সিগনাল পেয়েই নাকি তারা নানাভাবে উপাচার্যকে বিরক্ত করার পথ বেছে নিয়েছেন। আমি অবশ্য এ ধারণা সত্য বলে মানতে চাই না। শিক্ষকরা নিশ্চয়ই এতটা নষ্ট হয়ে যাননি।
তবে ক্যাম্পাসে এখন যা ঘটছে, তা ঘটতে দেয়া যায় না। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো দুষ্টগ্রহ স্বেচ্ছাচারিতার এমন বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করলে তা সার্বিক পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। তা শিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক পরিবেশকে করে তুলবে কণ্টকাকীর্ণ। তাই ক্যাম্পাস পরিবার তো বটেই, দেশের সব সচেতন মানুষকে সরব হতে হবে অরাজকতা থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত রাখতে। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রণী হতে হবে। কোনো পক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হোক, জ্ঞানচর্চার পুণ্যভূমি ভাগাড়ে পরিণত হোক- তা কেউ চাইবে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীর ফোনালাপের শেষ কথা দিয়ে শেষ করি। বললেন, আপনারা ভিসিকে অফিস কক্ষে অবরোধ করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। এতে প্রভাবিত হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। আপনারা রেজিস্ট্রারকে অবরুদ্ধ করেছেন- আমরা হয়তো এ থেকে দীক্ষা নেব। আপনারা ভিসিকে বিরক্ত করার জন্য ভিসি ভবনের পাশে অবস্থান নিয়ে মাইক বাজিয়েছেন। আমরা হয়তো প্রাণিত হয়ে ডিসকো গানের আয়োজন করব। অত্যন্ত শিল্পিত প্রতিবাদ হিসেবে ভিসি সপরিবারে আপনাদের সঙ্গে রাস্তায় রাত কাটিয়েছেন। আমরা হয়তো ভিসিকে চার দেয়ালের বাইরে বেরুতে দেব না। আপনারা তো সব অপশনই কাজে লাগালেন। এরপর বাকি রইল গায়ে হাত দেয়া। দয়া করে ওটি করবেন না। আমরা এতটা নিতে পারব না, যা দেখছি তাতে এখনই তো আত্মপরিচয় লুকোতে হয়। তখন কী করব!
আমি থ হয়ে গেলাম। বন্ধুর এতসব কথা নিতে পারলাম না। নিজেকে লুকোতে চাইলাম। তাই চরম অভদ্রের মতো আচমকা কেটে দিলাম টেলিফোনের লাইন।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ধীরে ধীরে আমি সব বিষয় অবহিত হয়ে নিজের অস্তিত্বের দিকে তাকিয়ে দারুণ বিব্রত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের যা সম্মানহানি হওয়ার, গত কয়েক মাসে তো তা হয়েছেই। নষ্ট ও স্বার্থবাদী শিক্ষক রাজনীতি যে প্রতিদিন নানা অঘটনের জন্ম দিয়ে জ্ঞান কেন্দ্র হিসেবে এতদিনের একটি সুনামধারী প্রতিষ্ঠানকে এতটা কলংকিত করবে, তা ভাবতে ইচ্ছে করেনি। এখন বন্ধু পরিচিতজনদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো মনের জোর আর খুঁজে পাই না। যখন কেউ প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা বলুন তো কী হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে? সেখানে কি আদৌ লেখাপড়ার পরিবেশ রেখেছেন আপনারা?’ এখন আর জবাব দেই না। হাত জোর করে মাথা নিচু করি।
দু’দিন আগে জ্ঞানরঞ্জন চাকমা ফোন করলেন। তিনি বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন। ফোন করলেন আমাদের ভর্তি পরীক্ষা-সংক্রান্ত বিষয় জানতে। তার মেয়ে এবার পরীক্ষা দেবে। পরবর্তী প্রশ্নবাণ ছুটে আসবে ভেবে বুক দুরু দুরু করছিল। এলো সেই প্রশ্ন। বললেন, ‘দোস্ত আমাদের মান-সম্মান তো আর রইল না। তোমরা তোমাদের সহকর্মীদের বোঝাও। এসব মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কয়েকজনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় সবার। আমাদের এখানে অনেক অভিভাবক বলছেন, তারা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি পরীক্ষা দেয়াবে না।’
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মাস্টার্সের ছাত্র। নাম শুভ। এটি তার আসল নাম নয়। তার অনুরোধে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হল। কারণ ভয়, আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতা তার সরাসরি শিক্ষক। তার স্যার ক্লাস নেয়ার সময় পান না, তবে জানলে তার ওপর খক্ষ নামতে পারে। বলল, স্যার, আমাদের সহপাঠী বিনাচিকিৎসায় মারা গেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ অন্য শিক্ষকদের বাসায় ভাংচুর করেছিল। আপনি আমাদের এ কারণে তিরস্কার করেছিলেন। বলেছিলেন, প্রকৃত কারণ না জেনে অমন আচরণ করা ঠিক হয়নি। আন্দোলনের নামে শিক্ষকদের বাসা পর্যন্ত ধাওয়া করা অসভ্যতা। কিন্তু এখন আপনারা আমাদের চেয়ে বড় অন্যায় করছেন। আমরা তো বয়সের কারণে ভুল করতেই পারি। বন্ধুর মৃতদেহ সামনে রেখে উত্তেজিত হয়ে অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু আপনারা কী করছেন! ভিসিবিরোধী যে আন্দোলন করছেন, তা একান্তই আপনাদের শিক্ষক রাজনীতির সংকীর্ণ বিষয়। অধিকাংশ শিক্ষকের সায় নেই এ আন্দোলনে। রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কোনো ছাত্র সংগঠন এর প্রতি সমর্থন জানায়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক রাখার জন্য মিছিল করেছে, ব্যানার টানিয়েছে। আর আপনারা একদল শিক্ষক দিনের পর দিন অফিসে বন্দি করে রেখেছিলেন একজন উপাচার্যকে। বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল দেখাতে রেজিস্ট্রারকে দু’দিন ধরে তার অফিস কক্ষে আটকে রেখেছেন। এরপর কথা নেই, বার্তা নেই, নতুন কোনো ঘটনা নেই, উত্তেজনা নেই- তারপরও আপনারা জনাকয়েক চেয়ার পেতে ভিসির বাসভবনের সামনে বসে অশ্লীলভাবে মাইক বাজিয়ে তাকে আর তার পরিবারকে বিরক্ত করছেন। স্যার, মানতে হবে আমরা ছাত্ররা কিন্তু এতটা নিচে নামিনি।
আমি জানি, আমার ছাত্রের প্রশ্নের কোনো জবাব আমার কাছে নেই। তাই মাথা নিচু করলাম। ছাত্রছাত্রীদের সামনে ‘ভালো’ মডেল হয়ে যাচ্ছি আমরা। এবার সহকর্মী ড. এমরান জাহানের কথা বলছি। ভিসি ভবনের উল্টো দিকে মাঠের অপর পাশে তার বাসা। বললেন, আন্দোলনকারী সহকর্মীরা ভিসিকে বিরক্ত করার জন্য জোরে মাইক বাজাচ্ছিলেন। এদিকে পড়ার ব্যাঘাত ঘটছিল আমার মেয়ের। দরজা-জানালা বন্ধ করেও রেহাই পাচ্ছিলাম না। আমি বললাম, ছাত্ররা সন্ত্রাসী করলে সমালোচনা করতেন, এখন এর নৈতিকতাও হারালেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই যুক্তিহীন নিুমানের আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য নিয়ে জাতীয় দৈনিকে অনেক লিখেছি। আরও অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু যাদের আত্মচৈতন্যে ফিরে আসা দরকার, তারা গোয়ার্তুমি থেকে ফিরতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষদের গৌরবময় আন্দোলন সংগ্রামের ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছেন।
আরেকটি গোলমেলে বিষয় যুক্ত হয়েছে এখানে। দুর্বল ইস্যুর ওপর ভর করে পদত্যাগী সাবেক ভিসির অনুগত শিক্ষক গ্র“প নতুন ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আন্দোলনে নামে। আন্দোলনে একের পর এক নেয়া কর্মসূচি দেখলে বোঝা যায়, এতে প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত তীব্র। আগের ভিসির বিরুদ্ধে নানা স্খলনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তাই আন্দোলন ছিল সর্বাত্মক। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন হলেও এ আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো তেমনই নেয়া হচ্ছে, যা যা নেয়া হয়েছিল আগের ভিসির বিরুদ্ধে। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এখানে যে, আগের ভিসির বিরুদ্ধে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন যে বিএনপি গ্র“পের শিক্ষকরা, এবার তারাই নিজেদের রাজনৈতিক লাভ পাওয়ার জন্য হাত মেলালেন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নাম জড়ানো গ্র“পের সহকর্মীদের সঙ্গে। কোনো আদর্শ ধারণ না করে এভাবে তেল-জল একসঙ্গে সাঁতার কাটছে আর নষ্ট করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ।
শিক্ষক রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কিছুসংখ্যক শিক্ষক নিজেদের লাভ, স্বার্থ ও ঈর্ষাকে মূল্য দিতে গিয়ে ক্লাস পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর নানা সমালোচনার মুখে ক্লাস পরীক্ষার ওপর অবরোধ তুলে নেন। এবার অবরোধ করেন প্রশাসনিক কাজে। শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে এখানেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। নির্বাচিত আইনানুগ ভিসিকে বল প্রয়োগে হলেও তাড়াবেনই। আমার এক সহকর্মী আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে নাকি শুনেছেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেউ বলেছেন- বিনা কারণে সরকারের পক্ষে একজন নির্বাচিত ভিসিকে সরানো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে ভিসিকে স্বেচ্ছায় সরে যেতে হবে। এই সিগনাল পেয়েই নাকি তারা নানাভাবে উপাচার্যকে বিরক্ত করার পথ বেছে নিয়েছেন। আমি অবশ্য এ ধারণা সত্য বলে মানতে চাই না। শিক্ষকরা নিশ্চয়ই এতটা নষ্ট হয়ে যাননি।
তবে ক্যাম্পাসে এখন যা ঘটছে, তা ঘটতে দেয়া যায় না। দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো দুষ্টগ্রহ স্বেচ্ছাচারিতার এমন বাজে দৃষ্টান্ত তৈরি করলে তা সার্বিক পরিবেশকে সংকটাপন্ন করে তুলবে। তা শিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক পরিবেশকে করে তুলবে কণ্টকাকীর্ণ। তাই ক্যাম্পাস পরিবার তো বটেই, দেশের সব সচেতন মানুষকে সরব হতে হবে অরাজকতা থেকে ক্যাম্পাসকে মুক্ত রাখতে। বিশেষ করে ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রণী হতে হবে। কোনো পক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ভূলুণ্ঠিত হোক, জ্ঞানচর্চার পুণ্যভূমি ভাগাড়ে পরিণত হোক- তা কেউ চাইবে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীর ফোনালাপের শেষ কথা দিয়ে শেষ করি। বললেন, আপনারা ভিসিকে অফিস কক্ষে অবরোধ করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। এতে প্রভাবিত হয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। আপনারা রেজিস্ট্রারকে অবরুদ্ধ করেছেন- আমরা হয়তো এ থেকে দীক্ষা নেব। আপনারা ভিসিকে বিরক্ত করার জন্য ভিসি ভবনের পাশে অবস্থান নিয়ে মাইক বাজিয়েছেন। আমরা হয়তো প্রাণিত হয়ে ডিসকো গানের আয়োজন করব। অত্যন্ত শিল্পিত প্রতিবাদ হিসেবে ভিসি সপরিবারে আপনাদের সঙ্গে রাস্তায় রাত কাটিয়েছেন। আমরা হয়তো ভিসিকে চার দেয়ালের বাইরে বেরুতে দেব না। আপনারা তো সব অপশনই কাজে লাগালেন। এরপর বাকি রইল গায়ে হাত দেয়া। দয়া করে ওটি করবেন না। আমরা এতটা নিতে পারব না, যা দেখছি তাতে এখনই তো আত্মপরিচয় লুকোতে হয়। তখন কী করব!
আমি থ হয়ে গেলাম। বন্ধুর এতসব কথা নিতে পারলাম না। নিজেকে লুকোতে চাইলাম। তাই চরম অভদ্রের মতো আচমকা কেটে দিলাম টেলিফোনের লাইন।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments