শিশু গৃহদাসী আদুরী ও নিলুফাদের ঠিকানা ঢাকা মহানগরের ডাস্টবিন by মহিউদ্দিন আহমদ
শিশু
গৃহদাসী আদুরীর খবর কয়েক দিন ধরে পত্র-পত্রিকা এবং কয়েকটি টেলিভিশন
চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। আর আমার মনে পড়ছে, ১২-১৩ বছর আগের আরেক শিশু
গৃহদাসী, একই বয়সের নিলুফার কথা। নিলুফাকে মেরে নিউমার্কেটের পাশের
ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গিয়েছিল এক গৃহকর্তা। শীতের ভোরে এই দৃশ্যটি দেখে
ফেলেছিল ফুটপাতের এক চা দোকানদার। নিলুফার সচিত্র খবরও তখন প্রকাশিত হয়েছিল
দৈনিক ভোরের কাগজে। নিলুফার মৃত্যুর খবর শুনে তার মাও ছুটে এসেছিলেন
ময়মনসিংহের দূরের কোনো এক গ্রাম থেকে। নিলুফার লাশ গ্রামে নিয়ে দাফন করার
সামর্থ্য ছিল না তার মায়ের। তিনি তখন বলেছিলেন, নিলুফার লাশ গ্রামে নিয়ে
দাফনের ব্যবস্থাই যদি করতে পারবেন, তাহলে এই শিশুটিকে এত দূরের ঢাকা শহরে,
নিষ্ঠুর পরিবেশে বাসায় কাজ করতে কেন পাঠাবেন? নিলুফার মায়ের এমন আর্তনাদে
সাড়া দিয়ে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নিলুফার মা এবং তার লাশ গ্রামের বাড়িতে
পৌঁছে দিয়েছিল। নিলুফার গৃহকর্তা বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পরিচিত একজন
জীবনানন্দ গবেষকের ভাই ছিল, বলেছিলেন ভোরের কাগজের তখনকার বার্তা সম্পাদক
অমিত হাবিব। খবরটি পড়ে তখন আমার কাকরাইলের বাসার কাছে, ভোরের কাগজ অফিসে
গিয়েছিলাম; শিশুটির মাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য দুই হাজার টাকা দিয়েছিলাম।
কিন্তু টাকাগুলো নিলুফার মায়ের কাছে পৌঁছেনি, টাকাগুলো কয়েক মাস পর আমার
কাছে ফেরত এসেছিল।
আমাদের বাসাবাড়িগুলোতে চার লাখ একুশ হাজার গৃহকর্মী কাজ করছে বলে কয়েক দিন আগে একটি খবরে পড়েছিলাম। এদের বেশির ভাগই শিশু, এবং মেয়েশিশু; এদের ন্যূনতম অধিকারও নেই। বাসার সবার আগে তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়, বাসার সবার পরে তাকে ঘুমাতে যেতে হয়। তার শ্রমঘণ্টা প্রায়ই আঠার-উনিশ এবং কখনও কখনও শুধু পেটে-ভাতে। মা-বাবা, ভাইবোন- কারও সঙ্গে তার কদাচিৎ যোগাযোগ থাকে বা তাকে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়। পরিবারের ছোট শিশুটিসহ প্রায় প্রত্যেকটি লোক তাকে অবজ্ঞা করে, ঘৃণা করে, মারধর করে।
শিশু গৃহদাসী আদুরীর চেহারা গত শনিবার বেলা ২টায় চ্যানেল আইয়ের খবরে দেখছিলাম, তার ছোট্ট অনাহারক্লিষ্ট শরীরের কোনো অঙ্গ বাকি নেই যেখানে ক্ষত, দগদগে দাগ ছিল না। এমন নিষ্ঠুর আচরণ যখন তার ওপর চালানো হচ্ছিল, তখন গৃহকর্ত্রী এবং প্রধান নির্যাতনকারী নওরীন আক্তার নদী ছাড়াও তো ওই বাসায় আরও লোকজন ছিল। কিন্তু তাকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল দিনের পর দিন, বার বার, বাসার আর কেউই তো বাধা দেয়নি। আদুরী এখনও বেঁচে আছে, হয়তো বেঁচেও যাবে কিন্তু বাঁচতে পারেনি নিলুফা। আদুরীকে দেখতে গত শনিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদও গিয়েছিলেন। তিনি মনে হচ্ছে দয়াশীল একজন মানুষ। আদুরীর জন্য কিছু ফল-মূলও নিয়ে গিয়েছিলেন, টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকার খবরে দেখলাম।
অনেক বছর ধরেই একটি প্রশ্ন আমাকে বিচলিত এবং আলোড়িত করে চলেছে। ঢাকার পল্লবীর যে বাসায় আদুরী মাসের পর মাস নির্যাতিত হয়েছে, এই এলাকার জন্য তো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আছেন, আমাদের এই গণতন্ত্রের দেশে। ওই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন কামাল মজুমদার। তিনি কিন্তু আদুরীর কোনো খোঁজখবর রাখেননি, আদুরীকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে যাননি। আদুরীর খোঁজখবর নিচ্ছেন না আদুরীর পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বা চেয়ারম্যান; উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বা ওই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। আচ্ছা, এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কি কোনোই দায়িত্ব নেই এসব মানুষের জন্য? আদুরী হয়তো কোনো ভোটার নয়, কিন্তু তার মা শাফিয়া বেগম তো একজন ভোটার।
আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এমনসব নিষ্ঠুর, নির্দয় ঘটনাতেও এতটুকু নড়াচড়া করেন না। তবে মনে পড়ে, শেখ হাসিনার আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমন নির্যাতিত শিশুদের দেখতে ছুটে যেতেন। তখন গিয়েছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম; আর এবার গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ। আমার মনে পড়ছে আমাদের একজন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও আছেন। তার নাম মেহের আফরোজ চুমকি। শিশু ও মহিলাদের কল্যাণ, ভালোমন্দ দেখার জন্য এই প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু তার ‘দিল’ও এতটুকু গলেনি; তিনিও তো শিশু আদুরীকে দেখতে যেতে পারতেন। তার বাবা গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ ময়েজ উদ্দিন আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। এখন আক্রান্ত হচ্ছে কতসব শিশু আততায়ীর হাতে!
কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শিশু আদুরীর খোঁজখবর নেননি, খোঁজখবর নেননি মেহের আফরোজ চুমকিও।
খোঁজখবর নেননি কোনোদিনও এবং এখনও নিচ্ছেন না আমাদের ‘সিভিল সোসাইটি’র কেউ। আমাদের কতসব শিশুসাহিত্যিক আছেন। কিন্তু এতসব নির্যাতনের কাহিনী পড়েও কোনো শিশুসাহিত্যিক একটা লেখা লিখেছেন? তারা তাদের কোনো বক্তৃতায় এসব শিশুর কথা কি উল্লেখ করেছেন বা কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? এমন কিছুই মনে পড়ছে না। আমাদের ‘সিভিল সোসাইটি’র সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বা আমাদের শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান মোস্তফা মনোয়ার বা পরিচালক, কেউ কোনোদিন এ ক্ষেত্রে কিছু করেছেন, কেউ কি বলতে পারবেন?
কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম চিত্র নায়িকা মৌসুমী, জাদু শিল্পী জুয়েল আইচ এবং ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ‘ইউনিসেফ’-এর শুভেচ্ছা দূত নির্বাচিত হয়েছেন। ‘ইউনিসেফ’ তো শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। এই তিন শুভেচ্ছা রাষ্ট্রদূতেরও তো কোনো নড়া-চড়া দেখছি না। বস্তুত আমাদের ‘পাবলিক লাইফ’-এর একজন মাত্র বিশিষ্টজন, চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের দাবিতে ১৭-১৮ বছর ধরে কোনো ক্লান্তি ছাড়া আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের আর কেউ এমন কল্যাণমূলক কোনো কাজে এতটুকু সময় কি দিচ্ছেন? অথচ আমাদের দেশের এতসব বৃহৎ বৃহৎ লোকের এমন অনীহা এবং উদাসীনতার বিপরীতে পশ্চিমা দুনিয়ার সিনেমা, টেলিভিশন এবং খেলাধুলার ‘স্টার’রা শিশু ও প্রবীণদের জন্য কিছু সময় দিয়ে থাকেন। পাশের দেশ ভারতের শচীন টেন্ডুলকার এবং সৌরভ গাঙ্গুলীকেও এমন কাজে আগ্রহী দেখেছি।
খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন ফার্মগেটের এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম। আট-দশ বছর আগে শিশু গৃহদাসীদের ওপর আমার একটি লেখা পড়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এ, চিকিৎসাধীন শিশুদের জন্য কাপড়- চোপড় এবং চকলেট-লজেন্স নিয়ে। দুই-তিন বছর তিনি এমন করেছেন। কিন্তু এখন আর তাকে পাচ্ছি না। শুনেছি তিনি ফার্মগেট থেকে রথখোলায় কোনো এক ফার্মেসিতে আছেন। তার রথখোলার বাসার টেলিফোনে তাকে পাচ্ছি না।
ফার্মগেটের স্টার হার্ডওয়্যারের দোকানটি থেকে ঠিকানা নিয়ে রথখোলায় লোক পাঠিয়েছিলাম, খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরেকজন এমন লোক দেখেছিলাম, নিউইয়র্কে আমাদের বর্তমান স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. এম এ মোমেন। তিনিও এক ঈদের আগে তার এক সফরকালে আমার একটি লেখা পড়ে শিশুদের জন্য কিছু কাপড়- চোপড়, উপহার সামগ্রী নিয়ে ‘ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এ গিয়েছিলেন।
১৯৭৫-৭৬ এ আমাদের জেনেভার দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলাম, তখনকার একটি স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারি না, কোনোদিন ভুলতে পারবও না। পাশের দেশ ইতালিতে কয়েক বছরের একটি শিশু কয়েক ফুট গভীর গর্তে পড়ে যায়। সারা ইউরোপের মিডিয়া শিশুটির উদ্ধার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রচার করতে থাকে। তখন ইতালির প্রেসিডেন্ট গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি তখন বলেছিলেন, মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে ফিরিয়েও আনা হচ্ছে কিন্তু একটি শিশুকে গর্ত থেকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কী লজ্জা, কী ব্যর্থতা!
গত পনের বছরে আমি অন্তত দশটি কলাম লিখি এ শিশু গৃহদাসীদের ওপর। কিছুই ইতিবাচক করতে পারিনি। কারও কোনো দৃষ্টি আকর্ষণও করতে পারিনি। তবে এ যুগান্তর পত্রিকায় আট-দশ বছর আগে আমার এমন একটি লেখা পড়ে কবি শামসুর রাহমান কয়েক দিন পর আমাকে সমর্থন জানিয়ে যুগান্তরে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। আর উপরে উল্লিখিত দুজন- জনাব মফিজুল ইসলাম এবং ড. মোমেন, এর বাইরে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। শিশু অধিকার নিয়ে আমাদের এ দেশে অনেকগুলো এনজিও কাজ করছে। তবে বাস্তবে এরা একেকজন দোকানদার, সওদাগর। নিলুফার ক্ষেত্রেও এদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি, এখন আদুরীর ক্ষেত্রেও দেখছি না। তবুও আমার দুর্বল কণ্ঠে বলতেই থাকব, চিৎকার করতেই থাকব, দুর্বল হাতে লিখতেই থাকব- এই শিশু গৃহদাসীদের ওপর একটুু রহম করুন।
মহিউদ্দিন আহমদ : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কলাম লেখক
আমাদের বাসাবাড়িগুলোতে চার লাখ একুশ হাজার গৃহকর্মী কাজ করছে বলে কয়েক দিন আগে একটি খবরে পড়েছিলাম। এদের বেশির ভাগই শিশু, এবং মেয়েশিশু; এদের ন্যূনতম অধিকারও নেই। বাসার সবার আগে তাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়, বাসার সবার পরে তাকে ঘুমাতে যেতে হয়। তার শ্রমঘণ্টা প্রায়ই আঠার-উনিশ এবং কখনও কখনও শুধু পেটে-ভাতে। মা-বাবা, ভাইবোন- কারও সঙ্গে তার কদাচিৎ যোগাযোগ থাকে বা তাকে যোগাযোগ করতে দেয়া হয়। পরিবারের ছোট শিশুটিসহ প্রায় প্রত্যেকটি লোক তাকে অবজ্ঞা করে, ঘৃণা করে, মারধর করে।
শিশু গৃহদাসী আদুরীর চেহারা গত শনিবার বেলা ২টায় চ্যানেল আইয়ের খবরে দেখছিলাম, তার ছোট্ট অনাহারক্লিষ্ট শরীরের কোনো অঙ্গ বাকি নেই যেখানে ক্ষত, দগদগে দাগ ছিল না। এমন নিষ্ঠুর আচরণ যখন তার ওপর চালানো হচ্ছিল, তখন গৃহকর্ত্রী এবং প্রধান নির্যাতনকারী নওরীন আক্তার নদী ছাড়াও তো ওই বাসায় আরও লোকজন ছিল। কিন্তু তাকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছিল দিনের পর দিন, বার বার, বাসার আর কেউই তো বাধা দেয়নি। আদুরী এখনও বেঁচে আছে, হয়তো বেঁচেও যাবে কিন্তু বাঁচতে পারেনি নিলুফা। আদুরীকে দেখতে গত শনিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদও গিয়েছিলেন। তিনি মনে হচ্ছে দয়াশীল একজন মানুষ। আদুরীর জন্য কিছু ফল-মূলও নিয়ে গিয়েছিলেন, টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকার খবরে দেখলাম।
অনেক বছর ধরেই একটি প্রশ্ন আমাকে বিচলিত এবং আলোড়িত করে চলেছে। ঢাকার পল্লবীর যে বাসায় আদুরী মাসের পর মাস নির্যাতিত হয়েছে, এই এলাকার জন্য তো নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আছেন, আমাদের এই গণতন্ত্রের দেশে। ওই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হচ্ছেন কামাল মজুমদার। তিনি কিন্তু আদুরীর কোনো খোঁজখবর রাখেননি, আদুরীকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে যাননি। আদুরীর খোঁজখবর নিচ্ছেন না আদুরীর পটুয়াখালী জেলার জৈনকাঠি গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বা চেয়ারম্যান; উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বা ওই এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। আচ্ছা, এসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কি কোনোই দায়িত্ব নেই এসব মানুষের জন্য? আদুরী হয়তো কোনো ভোটার নয়, কিন্তু তার মা শাফিয়া বেগম তো একজন ভোটার।
আমাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এমনসব নিষ্ঠুর, নির্দয় ঘটনাতেও এতটুকু নড়াচড়া করেন না। তবে মনে পড়ে, শেখ হাসিনার আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এমন নির্যাতিত শিশুদের দেখতে ছুটে যেতেন। তখন গিয়েছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম; আর এবার গেলেন পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ। আমার মনে পড়ছে আমাদের একজন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীও আছেন। তার নাম মেহের আফরোজ চুমকি। শিশু ও মহিলাদের কল্যাণ, ভালোমন্দ দেখার জন্য এই প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু তার ‘দিল’ও এতটুকু গলেনি; তিনিও তো শিশু আদুরীকে দেখতে যেতে পারতেন। তার বাবা গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ ময়েজ উদ্দিন আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। এখন আক্রান্ত হচ্ছে কতসব শিশু আততায়ীর হাতে!
কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শিশু আদুরীর খোঁজখবর নেননি, খোঁজখবর নেননি মেহের আফরোজ চুমকিও।
খোঁজখবর নেননি কোনোদিনও এবং এখনও নিচ্ছেন না আমাদের ‘সিভিল সোসাইটি’র কেউ। আমাদের কতসব শিশুসাহিত্যিক আছেন। কিন্তু এতসব নির্যাতনের কাহিনী পড়েও কোনো শিশুসাহিত্যিক একটা লেখা লিখেছেন? তারা তাদের কোনো বক্তৃতায় এসব শিশুর কথা কি উল্লেখ করেছেন বা কোনো বিবৃতি দিয়েছেন? এমন কিছুই মনে পড়ছে না। আমাদের ‘সিভিল সোসাইটি’র সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রফেসর আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বা আমাদের শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান মোস্তফা মনোয়ার বা পরিচালক, কেউ কোনোদিন এ ক্ষেত্রে কিছু করেছেন, কেউ কি বলতে পারবেন?
কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম চিত্র নায়িকা মৌসুমী, জাদু শিল্পী জুয়েল আইচ এবং ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ‘ইউনিসেফ’-এর শুভেচ্ছা দূত নির্বাচিত হয়েছেন। ‘ইউনিসেফ’ তো শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। এই তিন শুভেচ্ছা রাষ্ট্রদূতেরও তো কোনো নড়া-চড়া দেখছি না। বস্তুত আমাদের ‘পাবলিক লাইফ’-এর একজন মাত্র বিশিষ্টজন, চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের দাবিতে ১৭-১৮ বছর ধরে কোনো ক্লান্তি ছাড়া আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশের আর কেউ এমন কল্যাণমূলক কোনো কাজে এতটুকু সময় কি দিচ্ছেন? অথচ আমাদের দেশের এতসব বৃহৎ বৃহৎ লোকের এমন অনীহা এবং উদাসীনতার বিপরীতে পশ্চিমা দুনিয়ার সিনেমা, টেলিভিশন এবং খেলাধুলার ‘স্টার’রা শিশু ও প্রবীণদের জন্য কিছু সময় দিয়ে থাকেন। পাশের দেশ ভারতের শচীন টেন্ডুলকার এবং সৌরভ গাঙ্গুলীকেও এমন কাজে আগ্রহী দেখেছি।
খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন ফার্মগেটের এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম। আট-দশ বছর আগে শিশু গৃহদাসীদের ওপর আমার একটি লেখা পড়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এ, চিকিৎসাধীন শিশুদের জন্য কাপড়- চোপড় এবং চকলেট-লজেন্স নিয়ে। দুই-তিন বছর তিনি এমন করেছেন। কিন্তু এখন আর তাকে পাচ্ছি না। শুনেছি তিনি ফার্মগেট থেকে রথখোলায় কোনো এক ফার্মেসিতে আছেন। তার রথখোলার বাসার টেলিফোনে তাকে পাচ্ছি না।
ফার্মগেটের স্টার হার্ডওয়্যারের দোকানটি থেকে ঠিকানা নিয়ে রথখোলায় লোক পাঠিয়েছিলাম, খুঁজে পাওয়া যায়নি। আরেকজন এমন লোক দেখেছিলাম, নিউইয়র্কে আমাদের বর্তমান স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. এম এ মোমেন। তিনিও এক ঈদের আগে তার এক সফরকালে আমার একটি লেখা পড়ে শিশুদের জন্য কিছু কাপড়- চোপড়, উপহার সামগ্রী নিয়ে ‘ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’-এ গিয়েছিলেন।
১৯৭৫-৭৬ এ আমাদের জেনেভার দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলাম, তখনকার একটি স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারি না, কোনোদিন ভুলতে পারবও না। পাশের দেশ ইতালিতে কয়েক বছরের একটি শিশু কয়েক ফুট গভীর গর্তে পড়ে যায়। সারা ইউরোপের মিডিয়া শিশুটির উদ্ধার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রচার করতে থাকে। তখন ইতালির প্রেসিডেন্ট গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি তখন বলেছিলেন, মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে ফিরিয়েও আনা হচ্ছে কিন্তু একটি শিশুকে গর্ত থেকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না। কী লজ্জা, কী ব্যর্থতা!
গত পনের বছরে আমি অন্তত দশটি কলাম লিখি এ শিশু গৃহদাসীদের ওপর। কিছুই ইতিবাচক করতে পারিনি। কারও কোনো দৃষ্টি আকর্ষণও করতে পারিনি। তবে এ যুগান্তর পত্রিকায় আট-দশ বছর আগে আমার এমন একটি লেখা পড়ে কবি শামসুর রাহমান কয়েক দিন পর আমাকে সমর্থন জানিয়ে যুগান্তরে একটি প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। আর উপরে উল্লিখিত দুজন- জনাব মফিজুল ইসলাম এবং ড. মোমেন, এর বাইরে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি। শিশু অধিকার নিয়ে আমাদের এ দেশে অনেকগুলো এনজিও কাজ করছে। তবে বাস্তবে এরা একেকজন দোকানদার, সওদাগর। নিলুফার ক্ষেত্রেও এদের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি, এখন আদুরীর ক্ষেত্রেও দেখছি না। তবুও আমার দুর্বল কণ্ঠে বলতেই থাকব, চিৎকার করতেই থাকব, দুর্বল হাতে লিখতেই থাকব- এই শিশু গৃহদাসীদের ওপর একটুু রহম করুন।
মহিউদ্দিন আহমদ : সাবেক সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; কলাম লেখক
No comments