সরকারের সদিচ্ছাটাই বেশি জরুরি by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
চার
হাজার ছয় শতাধিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, উপনির্বাচন,
চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সর্বশেষে
সরকারের শেষ বছরে চারটি বিভাগীয় শহরে এবং রাজধানীর সন্নিকটে গাজীপুর সিটি
কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে প্রাপ্ত মেসেজে সরকার তার জনপ্রিয়তার অবস্থা
বুঝতে পেরেছে। চারটি বিভাগীয় শহরের সিটি কর্পোরেশনে উন্নয়ন কাজ করেও
সরকারদলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হওয়ার পর গাজীপুরে ক্লিন ইমেজের আকর্ষণীয়
প্রার্থী দাঁড় করিয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও এক লাখ ছয় সহস্রাধিক ভোটের
ব্যবধানে পরাজয়ের পর সরকারের বুঝতে বাকি থাকেনি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের
অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে ওই নির্বাচনে সরকারি দলের পারফরম্যান্স কেমন
হবে। এসব নির্বাচনের ফলাফল ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি জরিপের ফলাফল
থেকেও সরকার তার জনপ্রিয়তা হ্রাসের তথ্য পেয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ কারণে
পরাজয় এড়াতেই সরকার গত সাড়ে চার বছরে ডিসিসি নির্বাচন দেয়নি। তবে সরকার যদি
তার মেয়াদকালে ডিসিসি নির্বাচন না করতে পারে, তাহলে বিরোধী পক্ষ সরকারের এ
ব্যর্থতাকে সংসদ নির্বাচনের প্রচারণাকালে সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী
অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে সরকার তার জনপ্রিয়তার নিুগতি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে তখন থেকেই কিভাবে আবারও ক্ষমতায় আসা যায় সে সম্পর্কে পরিকল্পনা শুরু করে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিশ্র“তি না থাকা সত্ত্বেও আদালতের দোহাই দিয়ে একটি মামলার বিভক্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের নিজ স্বার্থ উদ্ধারকারী অংশ ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত ও জনমত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। যেসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, ওই কারণগুলো দূর না করেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয় বলে প্রতীয়মান হয়। নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য আন্তরিক হলে সরকার বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পরিবর্তে এর ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থার সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিত। কিন্তু তা না করে সরকার অসুখ নিরাময়ের আগেই ওষুধ বন্ধ করে দেয়ার মতো পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়, অন্যদিকে এ সংশোধনীতে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকে।
এভাবে দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো প্রশাসনে নিজেদের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সরকার সহজে সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার ব্যবস্থা করে। তবে জনগণের মতামত না নিয়ে এ ব্যবস্থা করায় এ সরকারি পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হবে কি-না, তা দেখার জন্য জাতিকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার বিষয়টি দেশের সর্বস্তরের মানুষ মোটেও পছন্দ করেননি। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসিড টেস্ট হিসেবে আখ্যায়িত পাঁচটি হাইভোল্টেজ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মতামত প্রদানের মাধ্যমেও শহরাঞ্চলের সচেতন ভোটাররা সরকারি পরিকল্পনার বিপক্ষে তাদের সে মতামত জানিয়ে দিয়েছেন।
স্মর্তব্য, ড. হুদা কমিশনকে কাজে লাগিয়ে ইভিএমের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচন জেতার একটা সরকারি এক্সপেরিমেন্টও ব্যর্থ হয়। সে পরীক্ষায় কোটি কোটি টাকা খরচ করেও ওই পরিকল্পনা বিরোধী দল এবং জনগণকে গ্রহণ করাতে ব্যর্থ হয়ে এখন সে চেষ্টা থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন সরে এসেছে। ইভিএমে নির্বাচন করতে পারলে যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপি করা সম্ভব, সে বিষয়টি বিরোধী দল ও ভোটাররা অনুধাবন করে এ ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচন করতে কিছুতেই রাজি হয়নি। প্রধান বিরোধী দল কেবল ইভিএম প্রত্যাখ্যানই করেনি, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকালীন বাংলাদেশী ইভিএম যে হ্যাকপ্র“ফ নয় সে ব্যাপারে তারা নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কিভাবে এ মেশিন হ্যাক করা সম্ভব তা দেখানোর জন্য ইসির কাছে একটি ইভিএম মেশিন কয়েকদিনের জন্য চেয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে কমিশন বিরোধী দলকে সহযোগিতা করেনি। তাছাড়া বাংলাদেশী ইভিএমের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েট ছাড়া অন্য কোনো দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরকার বা ইসি এ ইভিএমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করায়নি। ফলে বিরোধী দল ও জনগণ কারও কাছে ইভিএম গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন অনেক দেরি করে বহু অর্থ গচ্চা দেয়ার পর হলেও ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করার পথ থেকে সরে এসেছে।
এসব পরিকল্পনা কার্যকর না করতে পেরে সরকার এখন আরও কিছু পরিকল্পনা করে নিজ তত্ত্বাবধানে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি হল উভয় দল থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন করা। এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে না পারলে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারকে প্রধান করে তাদের অধীনে উভয় বড় দল থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন করা। কিন্তু এসব পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এ পরিকল্পনাগুলোতে বিরোধীদলীয় আন্দোলনের মূল স্পিরিট- নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সুনিশ্চিত হয় না। কেননা প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং রাষ্ট্রপতি- এদের কেউই নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব নন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো একাধারে দলীয় ও সরকারপ্রধান, কাজেই তার অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে মনে করা যায় না। আর বাকি দু’জনও পদে আসার আগে রাজনীতি করেছেন এবং মাত্র কিছুদিন আগেও তারা দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। কাজেই বিরোধী দল তাদের নির্দলীয় সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে চাইবে না। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে একই চরিত্রের আন্দোলনে বিচারপতি কেএম হাসানের দীর্ঘ বিচারপতি জীবনে কোনো রকম দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বহু বছর আগে তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পাদক থাকার কারণে তাকে আওয়ামী লীগ নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে মেনে নেননি। একইভাবে এখন একই চরিত্রের আন্দোলনে বিএনপি যদি রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে রাজি না হয় তাহলে সরকার তাদের কিভাবে দোষ দেবে?
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারকে বিরোধী দল ও জনগণকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তারা যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছেন তাতে নির্বাচনটি সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি ও কারচুপিমুক্ত হবে। বিরোধী দলকে বোকা মনে করে গোঁজামিল দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে স্বনিয়োজিত নতজানু নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচনে রাজি করানোর চেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এ রকম রাজনৈতিক আন্দোলন আগেও হওয়ায় এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতাদের পরিষ্কার ধারণা আছে এবং বিরোধী দলেও যেহেতু অনেক কৌশলী, অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া নেতা রয়েছেন; কাজেই অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে যেনতেন প্রকারে বা গোঁজামিল দিয়ে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি করানো যাবে না। কিভাবে বা কোন শর্তে বিরোধী দল নির্বাচনে রাজি হবে সে সম্পর্কে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে সরকারের অনাগ্রহের কারণ বোধগম্য নয়। কতিপয় আশাবাদী সরকারদলীয় নেতাকে বলতে শোনা যাচ্ছে- এখনও সময় আছে, সময়মতো একটা গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের হয়ে আসবে। কিন্তু সে ফর্মুলাটা একটু আগেভাগে জাতিকে জানিয়ে সাধারণ মানুষকে টেনশনমুক্ত করতে অসুবিধা কোথায়? দেরি করে সমস্যার সমাধান করলে এ কারণে সৃষ্ট আন্দোলন, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দায় কে নেবে? তাছাড়া আগে থেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থার ফয়সালা হলে যুগপৎ নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণার কাজ গঠনমূলকভাবে করতে পারার সুবিধার বিষয়টি মাথায় না রাখার কারণ কী?
উভয় বড় দলের কতিপয় নেতা নির্বাচনী ব্যবস্থার ফয়সালা করার ক্ষেত্রে দু’দলের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। তাদের বক্তব্যে মনে হয়, সংলাপে বসলেই যেন উদ্ভূত সংকটের ফয়সালা হয়ে যাবে। বিষয়টি কিন্তু মোটেও সে রকম নয়। কারণ, এর আগে জাতি আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপের পরিণতি দেখেছে। এক্ষেত্রে সংলাপের চেয়ে সদিচ্ছা বেশি প্রয়োজন। সদিচ্ছাবিহীন সংলাপ সময় বিনষ্টকারী আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আর যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে সংলাপেরও দরকার হয় না। সরকারি দলের যদি সদিচ্ছা থাকে যে সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্তভাবে করতে হবে, তাহলে সংলাপ ছাড়াই তা করা সম্ভব। ১৯৯৬ সালে এহেন সমস্যা জটিল আকার ধারণ করার পরও তৎকালীন সরকারি দল কোনো সংলাপ না করে একটি যেনতেন প্রকারের নির্বাচন করে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ-জাপা-জামায়াতের দাবি মেনে নিয়ে ওই সমস্যার সমাধান করেছিল। সংলাপবিহীন ওই সমাধান আন্দোলনকারী দলগুলো মেনে নিয়ে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। বর্তমানে তো পরিস্থিতি অতটা নাজুক হয়নি। এখনও বিরোধী দলগুলো সংসদ থেকে সম্মিলিতভাবে পদত্যাগ করেনি। বর্তমানে বিরোধী দলগুলোর সংসদ থেকে পদত্যাগের কোনো পরিকল্পনা আছে বলেও শোনা যায় না। কাজেই সরকারি দল চাইলে সংসদের আসন্ন শেষ অধিবেশনে একাকী অথবা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে সহজে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারে।
বিরোধী দল যদি সরকারের আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলেও সরকারের কিছু এসে যায় না। কারণ, তাদের যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাতে তারা সংসদে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিল এনে সে বিল পাসের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সক্ষম। সরকারি দল যদি এককভাবেও এমন কাজ করে বাহবা নিতে চায়, তাহলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপির এককভাবে পাস করা ত্রয়োদশ সংশোধনী মেনে নিয়েছিল, সেভাবে বিরোধী দলের পক্ষে তা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে এক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো দেখা যাচ্ছে। কারণ প্রধান বিরোধী দল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে কোনো সরকারি উদ্যোগে তারা অংশগ্রহণ করবে এবং এ ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে। কাজেই এমন পরিস্থিতিতে সংলাপ করে সময়ক্ষেপণ করার পরিবর্তে সংসদের আসন্ন শেষ অধিবেশনে সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করে জাতির কাছ থেকে সরকারের বাহবা পাওয়ার সুযোগ আছে।
ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় নেতাদের অনেকে ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে সংসদ নির্বাচন করার যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব যেভাবে গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশের সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার তুলনা করতে যাওয়া বোকামি হবে। যে দেশের জাতীয় নেতারা বড় বড় জাতীয় সংকটে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে পারেন না, দুই প্রধান নেতা একজন আরেকজনের মুখদর্শন করতে চান না, তাদের মুখে ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে নির্বাচন করার প্রতিশ্র“তি জনগণের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অংশগ্রহণমূলক, স্থিতিশীল, সুশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কি কোনোভাবেই তুলনা করা যায়? কাজেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতিগত উন্নয়ন না ঘটিয়ে রাতারাতি ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে নির্বাচন করতে চাওয়াকে বড় ধরনের আহাম্মকি অথবা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলা বেমানান নয়।
সরকার যদি আসন্ন সংসদ অধিবেশনে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে দলীয় সরকারের ও স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে বিজয় সুনিশ্চিত করতে চায়, তাহলে তার পরিণতি সম্পর্কেও সরকার অবগত আছে। কারণ সরকার জানে, গোঁজামিল দিয়ে দলীয় ব্যবস্থাধীনে বিরোধী দলকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। বরং ওই রকম কোনো উপায় অবলম্বন করলে দীর্ঘমেয়াদি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এসব জেনেও প্রধানমন্ত্রী সচিব সভায় সংসদ ও মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে জনমতকে শ্রদ্ধা না করে আইন ও নিজেদের সংশোধিত সংবিধানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে যেভাবে নির্বাচন করার ছক উপস্থাপন করেছেন, তাতে নির্বাচন ও দেশ যথাক্রমে অনিশ্চয়তা ও সংঘাতমুখী হবে। এ ব্যাপারে অনড় অবস্থানে না থেকে প্রধানমন্ত্রী যদি তার সচিব সভার বক্তব্যকে বিরোধীদলীয় নেতাদের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে তাদের দরকষাকষিতে কিছুটা নমনীয় করতে ব্যবহার করে অচিরেই আসন্ন সংসদে এ অবস্থান থেকে সরে আসতে চান, তাহলে সে সুযোগ এখনও হাতছাড়া হয়ে যায়নি।
কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হবে কি-না এবং ওই নির্বাচন অবাধ ও দুর্নীতি-কারচুপিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি-না, তা মোটেও বিরোধীদলীয় আন্দোলন-সংগ্রাম বা সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সংলাপের ওপর নির্ভর করছে না; বরং বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। এখন দেখার বিষয়, আসন্ন সংসদ অধিবেশনে সরকার নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে প্রশংসিত হয়, নাকি নিজস্ব নির্বাচনী বিজয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না করে দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তা এবং দেশকে অস্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে সরকার তার জনপ্রিয়তার নিুগতি সম্পর্কে ধারণা পেয়ে তখন থেকেই কিভাবে আবারও ক্ষমতায় আসা যায় সে সম্পর্কে পরিকল্পনা শুরু করে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের প্রতিশ্র“তি না থাকা সত্ত্বেও আদালতের দোহাই দিয়ে একটি মামলার বিভক্ত রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের নিজ স্বার্থ উদ্ধারকারী অংশ ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার আগেই অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত ও জনমত উপেক্ষা করে তড়িঘড়ি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। যেসব কারণে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, ওই কারণগুলো দূর না করেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয় বলে প্রতীয়মান হয়। নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য আন্তরিক হলে সরকার বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পরিবর্তে এর ত্র“টি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধনের লক্ষ্যে এ ব্যবস্থার সংস্কার এবং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিত। কিন্তু তা না করে সরকার অসুখ নিরাময়ের আগেই ওষুধ বন্ধ করে দেয়ার মতো পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে একদিকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়, অন্যদিকে এ সংশোধনীতে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকে।
এভাবে দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো প্রশাসনে নিজেদের নিয়োগকৃত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সরকার সহজে সংসদ নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার ব্যবস্থা করে। তবে জনগণের মতামত না নিয়ে এ ব্যবস্থা করায় এ সরকারি পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হবে কি-না, তা দেখার জন্য জাতিকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়ার বিষয়টি দেশের সর্বস্তরের মানুষ মোটেও পছন্দ করেননি। অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসিড টেস্ট হিসেবে আখ্যায়িত পাঁচটি হাইভোল্টেজ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মতামত প্রদানের মাধ্যমেও শহরাঞ্চলের সচেতন ভোটাররা সরকারি পরিকল্পনার বিপক্ষে তাদের সে মতামত জানিয়ে দিয়েছেন।
স্মর্তব্য, ড. হুদা কমিশনকে কাজে লাগিয়ে ইভিএমের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচন জেতার একটা সরকারি এক্সপেরিমেন্টও ব্যর্থ হয়। সে পরীক্ষায় কোটি কোটি টাকা খরচ করেও ওই পরিকল্পনা বিরোধী দল এবং জনগণকে গ্রহণ করাতে ব্যর্থ হয়ে এখন সে চেষ্টা থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশন সরে এসেছে। ইভিএমে নির্বাচন করতে পারলে যে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল কারচুপি করা সম্ভব, সে বিষয়টি বিরোধী দল ও ভোটাররা অনুধাবন করে এ ব্যবস্থায় সংসদ নির্বাচন করতে কিছুতেই রাজি হয়নি। প্রধান বিরোধী দল কেবল ইভিএম প্রত্যাখ্যানই করেনি, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকালীন বাংলাদেশী ইভিএম যে হ্যাকপ্র“ফ নয় সে ব্যাপারে তারা নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে কিভাবে এ মেশিন হ্যাক করা সম্ভব তা দেখানোর জন্য ইসির কাছে একটি ইভিএম মেশিন কয়েকদিনের জন্য চেয়েছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে কমিশন বিরোধী দলকে সহযোগিতা করেনি। তাছাড়া বাংলাদেশী ইভিএমের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বুয়েট ছাড়া অন্য কোনো দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরকার বা ইসি এ ইভিএমের কার্যকারিতা পরীক্ষা করায়নি। ফলে বিরোধী দল ও জনগণ কারও কাছে ইভিএম গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন অনেক দেরি করে বহু অর্থ গচ্চা দেয়ার পর হলেও ইভিএমে সংসদ নির্বাচন করার পথ থেকে সরে এসেছে।
এসব পরিকল্পনা কার্যকর না করতে পেরে সরকার এখন আরও কিছু পরিকল্পনা করে নিজ তত্ত্বাবধানে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চাইছে। এসব পরিকল্পনার মধ্যে একটি হল উভয় দল থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন করা। এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে না পারলে রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারকে প্রধান করে তাদের অধীনে উভয় বড় দল থেকে সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচন করা। কিন্তু এসব পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এ পরিকল্পনাগুলোতে বিরোধীদলীয় আন্দোলনের মূল স্পিরিট- নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি সুনিশ্চিত হয় না। কেননা প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার এবং রাষ্ট্রপতি- এদের কেউই নির্দলীয় ব্যক্তিত্ব নন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তো একাধারে দলীয় ও সরকারপ্রধান, কাজেই তার অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে মনে করা যায় না। আর বাকি দু’জনও পদে আসার আগে রাজনীতি করেছেন এবং মাত্র কিছুদিন আগেও তারা দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। কাজেই বিরোধী দল তাদের নির্দলীয় সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে চাইবে না। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে একই চরিত্রের আন্দোলনে বিচারপতি কেএম হাসানের দীর্ঘ বিচারপতি জীবনে কোনো রকম দলীয় পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও বহু বছর আগে তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পাদক থাকার কারণে তাকে আওয়ামী লীগ নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে মেনে নেননি। একইভাবে এখন একই চরিত্রের আন্দোলনে বিএনপি যদি রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করতে রাজি না হয় তাহলে সরকার তাদের কিভাবে দোষ দেবে?
চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারকে বিরোধী দল ও জনগণকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তারা যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছেন তাতে নির্বাচনটি সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতি ও কারচুপিমুক্ত হবে। বিরোধী দলকে বোকা মনে করে গোঁজামিল দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে স্বনিয়োজিত নতজানু নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচনে রাজি করানোর চেষ্টা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এ রকম রাজনৈতিক আন্দোলন আগেও হওয়ায় এ ব্যাপারে বিরোধীদলীয় নেতাদের পরিষ্কার ধারণা আছে এবং বিরোধী দলেও যেহেতু অনেক কৌশলী, অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া নেতা রয়েছেন; কাজেই অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে যেনতেন প্রকারে বা গোঁজামিল দিয়ে তাদের দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি করানো যাবে না। কিভাবে বা কোন শর্তে বিরোধী দল নির্বাচনে রাজি হবে সে সম্পর্কে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করতে সরকারের অনাগ্রহের কারণ বোধগম্য নয়। কতিপয় আশাবাদী সরকারদলীয় নেতাকে বলতে শোনা যাচ্ছে- এখনও সময় আছে, সময়মতো একটা গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা বের হয়ে আসবে। কিন্তু সে ফর্মুলাটা একটু আগেভাগে জাতিকে জানিয়ে সাধারণ মানুষকে টেনশনমুক্ত করতে অসুবিধা কোথায়? দেরি করে সমস্যার সমাধান করলে এ কারণে সৃষ্ট আন্দোলন, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দায় কে নেবে? তাছাড়া আগে থেকেই নির্বাচনী ব্যবস্থার ফয়সালা হলে যুগপৎ নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণার কাজ গঠনমূলকভাবে করতে পারার সুবিধার বিষয়টি মাথায় না রাখার কারণ কী?
উভয় বড় দলের কতিপয় নেতা নির্বাচনী ব্যবস্থার ফয়সালা করার ক্ষেত্রে দু’দলের মধ্যে এ বিষয়ে সংলাপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। তাদের বক্তব্যে মনে হয়, সংলাপে বসলেই যেন উদ্ভূত সংকটের ফয়সালা হয়ে যাবে। বিষয়টি কিন্তু মোটেও সে রকম নয়। কারণ, এর আগে জাতি আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আবদুল জলিলের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপের পরিণতি দেখেছে। এক্ষেত্রে সংলাপের চেয়ে সদিচ্ছা বেশি প্রয়োজন। সদিচ্ছাবিহীন সংলাপ সময় বিনষ্টকারী আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আর যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে সংলাপেরও দরকার হয় না। সরকারি দলের যদি সদিচ্ছা থাকে যে সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্তভাবে করতে হবে, তাহলে সংলাপ ছাড়াই তা করা সম্ভব। ১৯৯৬ সালে এহেন সমস্যা জটিল আকার ধারণ করার পরও তৎকালীন সরকারি দল কোনো সংলাপ না করে একটি যেনতেন প্রকারের নির্বাচন করে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ-জাপা-জামায়াতের দাবি মেনে নিয়ে ওই সমস্যার সমাধান করেছিল। সংলাপবিহীন ওই সমাধান আন্দোলনকারী দলগুলো মেনে নিয়ে সপ্তম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। বর্তমানে তো পরিস্থিতি অতটা নাজুক হয়নি। এখনও বিরোধী দলগুলো সংসদ থেকে সম্মিলিতভাবে পদত্যাগ করেনি। বর্তমানে বিরোধী দলগুলোর সংসদ থেকে পদত্যাগের কোনো পরিকল্পনা আছে বলেও শোনা যায় না। কাজেই সরকারি দল চাইলে সংসদের আসন্ন শেষ অধিবেশনে একাকী অথবা বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে সংবিধানে সংশোধনী এনে সহজে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করতে পারে।
বিরোধী দল যদি সরকারের আহ্বানে সাড়া না দেয়, তাহলেও সরকারের কিছু এসে যায় না। কারণ, তাদের যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তাতে তারা সংসদে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিল এনে সে বিল পাসের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে সক্ষম। সরকারি দল যদি এককভাবেও এমন কাজ করে বাহবা নিতে চায়, তাহলে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যেমন বিএনপির এককভাবে পাস করা ত্রয়োদশ সংশোধনী মেনে নিয়েছিল, সেভাবে বিরোধী দলের পক্ষে তা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে এক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো দেখা যাচ্ছে। কারণ প্রধান বিরোধী দল থেকে বারবার বলা হচ্ছে, নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে কোনো সরকারি উদ্যোগে তারা অংশগ্রহণ করবে এবং এ ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে। কাজেই এমন পরিস্থিতিতে সংলাপ করে সময়ক্ষেপণ করার পরিবর্তে সংসদের আসন্ন শেষ অধিবেশনে সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে আলোচ্য সমস্যার সমাধান করে জাতির কাছ থেকে সরকারের বাহবা পাওয়ার সুযোগ আছে।
ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারদলীয় নেতাদের অনেকে ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে সংসদ নির্বাচন করার যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব যেভাবে গড়ে উঠেছে, বাংলাদেশের সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তার তুলনা করতে যাওয়া বোকামি হবে। যে দেশের জাতীয় নেতারা বড় বড় জাতীয় সংকটে এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে পারেন না, দুই প্রধান নেতা একজন আরেকজনের মুখদর্শন করতে চান না, তাদের মুখে ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে নির্বাচন করার প্রতিশ্র“তি জনগণের কাছে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অংশগ্রহণমূলক, স্থিতিশীল, সুশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির কি কোনোভাবেই তুলনা করা যায়? কাজেই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কৃতিগত উন্নয়ন না ঘটিয়ে রাতারাতি ওয়েস্টমিন্স্টার স্টাইলে নির্বাচন করতে চাওয়াকে বড় ধরনের আহাম্মকি অথবা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলা বেমানান নয়।
সরকার যদি আসন্ন সংসদ অধিবেশনে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে দলীয় সরকারের ও স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করে বিজয় সুনিশ্চিত করতে চায়, তাহলে তার পরিণতি সম্পর্কেও সরকার অবগত আছে। কারণ সরকার জানে, গোঁজামিল দিয়ে দলীয় ব্যবস্থাধীনে বিরোধী দলকে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো যাবে না। বরং ওই রকম কোনো উপায় অবলম্বন করলে দীর্ঘমেয়াদি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এসব জেনেও প্রধানমন্ত্রী সচিব সভায় সংসদ ও মন্ত্রী-এমপি বহাল রেখে জনমতকে শ্রদ্ধা না করে আইন ও নিজেদের সংশোধিত সংবিধানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে যেভাবে নির্বাচন করার ছক উপস্থাপন করেছেন, তাতে নির্বাচন ও দেশ যথাক্রমে অনিশ্চয়তা ও সংঘাতমুখী হবে। এ ব্যাপারে অনড় অবস্থানে না থেকে প্রধানমন্ত্রী যদি তার সচিব সভার বক্তব্যকে বিরোধীদলীয় নেতাদের ওপর স্নায়ুচাপ বাড়িয়ে তাদের দরকষাকষিতে কিছুটা নমনীয় করতে ব্যবহার করে অচিরেই আসন্ন সংসদে এ অবস্থান থেকে সরে আসতে চান, তাহলে সে সুযোগ এখনও হাতছাড়া হয়ে যায়নি।
কাজেই আগামী সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে হবে কি-না এবং ওই নির্বাচন অবাধ ও দুর্নীতি-কারচুপিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি-না, তা মোটেও বিরোধীদলীয় আন্দোলন-সংগ্রাম বা সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সংলাপের ওপর নির্ভর করছে না; বরং বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। এখন দেখার বিষয়, আসন্ন সংসদ অধিবেশনে সরকার নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে প্রশংসিত হয়, নাকি নিজস্ব নির্বাচনী বিজয় সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি না করে দলীয় ব্যবস্থাধীনে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তা এবং দেশকে অস্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments