একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না by ড. আবদুল হাই তালুকদার
রাজনৈতিক
সংকট চরম আকার ধারণ করায় দেশের মানুষের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলও উদ্বিগ্ন।
রাজনীতিকদের কথাবার্তায় সংকট সমাধানের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রাথমিক দায়িত্ব সরকারের।
সরকার সে পথে না গিয়ে বিরোধী দলকে হুমকি-ধামকি দিয়ে নির্বাচনে আনার কৌশল
অবলম্বন করছে। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ হওয়া, মধ্যযুগে
ফেরত নেয়া ইত্যাদি কথা বলে সরকার বিএনপির বিরুদ্ধে নানারকম প্রচারণা
চালাচ্ছে।
দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক বিধানটি খুব কার্যকর ও প্রায়োগিক ছিল। সরকার এরূপ জনবান্ধব একটি পদ্ধতি উঠিয়ে দিয়ে ওয়েস্ট মিন্স্টার ধরনের গণতন্ত্র অনুসরণ করতে চায়। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা গণতন্ত্রের বয়স অনেক। ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনে ও ১৭৭৬ সালে আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসি বিপ্লবে লাখ লাখ লোকের আÍদানে যে জনতার শাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তার হাওয়া সমস্ত ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ওয়েস্ট মিন্স্টার স্টাইল আশা করা যায় না। সরকারি দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ প্রজা এবং তারা সামন্ত প্রভু ও রাজা। তাদের ইচ্ছায় সবকিছু চলবে। তারা দয়া করে যেভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, জনগণ তা-ই মেনে নেবেন ও রাজনৈতিক দলগুলো সুড় সুড় করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে তারা একাই নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। বিরোধী দল না এলে কী হবে, বাম দলগুলোকে একত্রিত করে বিরোধী দল বানানো যাবে। তাদের দয়া করে ১০-২০টি আসন দিলেই চলবে। ওসব দলের জনভিত্তি নেই। ১০-২০টি সিট পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকবে। আমার বিবেচনায় ওরকম বিরোধী দলও পাওয়া মুশকিল হবে। সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো দল রাজনৈতিক আত্মহত্যার ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। দেশের সিংহভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার বিপরীতে যেতে চাইবে না কোনো রাজনৈতিক দল। সরকারের কথা শুনে অনেক সময় মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনে আসতে বাধ্য। জেনেশুনে বিএনপি বা অন্য দলগুলো এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কেন?
আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকটের সমাধান তাদেরই করতে হবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া এরূপ পরিবর্তন কেউ মানবে না। দেশের জ্ঞানী, গুণী ও প্রখ্যাত আইনজীবীরা সৃষ্ট সংকটের সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন। দেশের মানুষও শান্তি চায়। রাজনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা ও সম্পদের হানি কেউ চায় না।
বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা ইত্যাদি। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা গত সাড়ে চার বছরে অসংখ্য মামলা, হামলা, গুম, খুন-নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। মানুষের জানমালের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি নেত্রী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। ৫ সিটি কর্পোরেশনে তার দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিক দাবি সব মহল সমর্থন করে। সুশীল সমাজ, সংবাদকর্মী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিদেশী দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বাস্তবতা অনুধাবন করে বিরোধী দলের দাবি সমর্থন করেছে। দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধনকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও বেঈমানি বলে ঘোষণা করেছেন।
দেশের প্রায় সব বিরোধী দল ও ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাশা করে। তারপরও সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। আমাদের কথা হল, সংবিধান মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। তাছাড়া সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তাতে পরিবর্তন আনা যাবে না। জনগণের প্রয়োজনে ৪২ বছরে অনেকবার সংবিধান কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। বর্তমানে জনগণের আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে সংবিধানে সংশোধন আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক সংকট ও জনগণের অশান্তি অনুমান করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও চুপ থাকতে পারেননি। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি বলে কিছু নেই। নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে হবে।’ তার বক্তব্যের মধ্যে বর্তমান সংকটের সত্যিকার সমাধান নিহিত। সরকারি দল থেকে তার বক্তব্যকে ‘অযাচিত ও আগ বাড়িয়ে উপদেশ’ বলা হয়েছে। সরকারি দলের বক্তব্য ড. ইউনূসকে না বোঝার ফল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ড. ইউনূস নিজের জন্য কিছু বলেননি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনে তার কোনো লাভ নেই। তিনি নিশ্চয়ই মন্ত্রী-এমপি হবেন না। তার ধ্যানজ্ঞান গরিবের ভাগ্যোন্নয়ন। রাজকীয় পদের প্রতি তার কানাকড়ি লোভ আছে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, ড. ইউনূস বিবেকের আদেশ পালন করে জাতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। জাতীয় সংকটকালে চুপ থাকা বিবেকের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ের তাৎপর্য পরিপন্থী। দেশে অশান্তির কালোমেঘ দেখে চুপ থাকলে মানুষ তার প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে। আমি কয়েকটি লেখায় ড. ইউনূসকে মানবকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী বলেছি। মানুষের দুঃখকষ্ট, অশান্তি ও গরিব দেশের সম্পদহানি অনুমান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবারই উচিত সরকারকে চাপ দেয়া। ড. ইউনূস জাতীয় কর্তব্য পালন করে সবার সম্মান ও শ্রদ্ধা নতুন করে অর্জন করেছেন। বক্তব্যের জন্য তার প্রশংসা না করে সরকারি তরফ থেকে যেভাবে কটাক্ষ, বিদ্রুপ ও অপমানজনক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তা দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। ড. ইউনূস এ দেশের নাগরিক। এ দেশের সুখ-দুঃখে তিনি মতামত দিতেই পারেন। এতে দোষের কিছু নেই।
আগেই বলেছি, দেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার তাগিদ দিয়েছেন। পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে সমঝোতার তাগিদ দেন। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন। চীনের রাষ্ট্রদূত দুই নেত্রীকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিষয়টিকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা জাতিসংঘের পদক্ষেপকে যথোপযুক্ত মনে করে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আগের পদক্ষেপ সফল না হলেও জাতিসংঘ তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানা যায়। সে কারণে বিএনপি অহিংস ও নরম কর্মসূচি দিয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আশা করব, শিগগিরই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে তারা সংকট সমাধানের পথ প্রশস্ত করবেন। পারস্পরিক আস্থার সংকট কেটে গেলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে।
আওয়ামী লীগ বলতে গেলে এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশের চাপেও নির্দলীয় বিধান মানতে চাচ্ছে না। এককভাবে সব বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন করতে চাওয়া জনআকাক্সক্ষা ও জনস্বার্থবিরোধী চিন্তা। সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে চুপ করে বসে থাকবে না। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে যাবে। এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। শান্তি বিনষ্ট হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের মানুষ ও সম্পদ। এককভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রসর হওয়া দুঃখজনক। এটা রক্তক্ষয়ী সাংঘর্ষিক অবস্থার জন্ম দেবে। বিরোধী দলের আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে সংকটের সমাধান হবে না। কারণ প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সরকারকে এখনই সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানাচ্ছি। এতেই রাজনীতিকদের পাশাপাশি দেশের মঙ্গল নিহিত।
ড. আবদুল হাই তালুকদার : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের দুর্বল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক বিধানটি খুব কার্যকর ও প্রায়োগিক ছিল। সরকার এরূপ জনবান্ধব একটি পদ্ধতি উঠিয়ে দিয়ে ওয়েস্ট মিন্স্টার ধরনের গণতন্ত্র অনুসরণ করতে চায়। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা গণতন্ত্রের বয়স অনেক। ১৬৮৮ সালে ব্রিটেনে ও ১৭৭৬ সালে আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফরাসি বিপ্লবে লাখ লাখ লোকের আÍদানে যে জনতার শাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তার হাওয়া সমস্ত ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ওয়েস্ট মিন্স্টার স্টাইল আশা করা যায় না। সরকারি দলের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ প্রজা এবং তারা সামন্ত প্রভু ও রাজা। তাদের ইচ্ছায় সবকিছু চলবে। তারা দয়া করে যেভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন, জনগণ তা-ই মেনে নেবেন ও রাজনৈতিক দলগুলো সুড় সুড় করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ না নিলে তারা একাই নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। বিরোধী দল না এলে কী হবে, বাম দলগুলোকে একত্রিত করে বিরোধী দল বানানো যাবে। তাদের দয়া করে ১০-২০টি আসন দিলেই চলবে। ওসব দলের জনভিত্তি নেই। ১০-২০টি সিট পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকবে। আমার বিবেচনায় ওরকম বিরোধী দলও পাওয়া মুশকিল হবে। সাজানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো দল রাজনৈতিক আত্মহত্যার ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না। দেশের সিংহভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার বিপরীতে যেতে চাইবে না কোনো রাজনৈতিক দল। সরকারের কথা শুনে অনেক সময় মনে হয়, বিএনপি নির্বাচনে আসতে বাধ্য। জেনেশুনে বিএনপি বা অন্য দলগুলো এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কেন?
আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এ সংকটের সমাধান তাদেরই করতে হবে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া এরূপ পরিবর্তন কেউ মানবে না। দেশের জ্ঞানী, গুণী ও প্রখ্যাত আইনজীবীরা সৃষ্ট সংকটের সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছেন। দেশের মানুষও শান্তি চায়। রাজনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা ও সম্পদের হানি কেউ চায় না।
বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতীয় পার্টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা ইত্যাদি। বিএনপি নেতা-নেত্রীরা গত সাড়ে চার বছরে অসংখ্য মামলা, হামলা, গুম, খুন-নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু মনোবল হারাননি। মানুষের জানমালের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি নেত্রী শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। ৫ সিটি কর্পোরেশনে তার দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিক দাবি সব মহল সমর্থন করে। সুশীল সমাজ, সংবাদকর্মী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বিদেশী দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বাস্তবতা অনুধাবন করে বিরোধী দলের দাবি সমর্থন করেছে। দেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা, বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধনকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও বেঈমানি বলে ঘোষণা করেছেন।
দেশের প্রায় সব বিরোধী দল ও ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রত্যাশা করে। তারপরও সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। আমাদের কথা হল, সংবিধান মানুষের জন্য, মানুষ সংবিধানের জন্য নয়। তাছাড়া সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তাতে পরিবর্তন আনা যাবে না। জনগণের প্রয়োজনে ৪২ বছরে অনেকবার সংবিধান কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। বর্তমানে জনগণের আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে সংবিধানে সংশোধন আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক সংকট ও জনগণের অশান্তি অনুমান করে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও চুপ থাকতে পারেননি। তিনিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি বলে কিছু নেই। নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে হবে।’ তার বক্তব্যের মধ্যে বর্তমান সংকটের সত্যিকার সমাধান নিহিত। সরকারি দল থেকে তার বক্তব্যকে ‘অযাচিত ও আগ বাড়িয়ে উপদেশ’ বলা হয়েছে। সরকারি দলের বক্তব্য ড. ইউনূসকে না বোঝার ফল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ড. ইউনূস নিজের জন্য কিছু বলেননি। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনে তার কোনো লাভ নেই। তিনি নিশ্চয়ই মন্ত্রী-এমপি হবেন না। তার ধ্যানজ্ঞান গরিবের ভাগ্যোন্নয়ন। রাজকীয় পদের প্রতি তার কানাকড়ি লোভ আছে বলে মনে হয় না। আমরা মনে করি, ড. ইউনূস বিবেকের আদেশ পালন করে জাতীয় দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। জাতীয় সংকটকালে চুপ থাকা বিবেকের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ের তাৎপর্য পরিপন্থী। দেশে অশান্তির কালোমেঘ দেখে চুপ থাকলে মানুষ তার প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলবে। আমি কয়েকটি লেখায় ড. ইউনূসকে মানবকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী বলেছি। মানুষের দুঃখকষ্ট, অশান্তি ও গরিব দেশের সম্পদহানি অনুমান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবারই উচিত সরকারকে চাপ দেয়া। ড. ইউনূস জাতীয় কর্তব্য পালন করে সবার সম্মান ও শ্রদ্ধা নতুন করে অর্জন করেছেন। বক্তব্যের জন্য তার প্রশংসা না করে সরকারি তরফ থেকে যেভাবে কটাক্ষ, বিদ্রুপ ও অপমানজনক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে তা দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। ড. ইউনূস এ দেশের নাগরিক। এ দেশের সুখ-দুঃখে তিনি মতামত দিতেই পারেন। এতে দোষের কিছু নেই।
আগেই বলেছি, দেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল উদ্বিগ্ন। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাবান সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন করে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার তাগিদ দিয়েছেন। পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সঙ্গে সমঝোতার তাগিদ দেন। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চীন। চীনের রাষ্ট্রদূত দুই নেত্রীকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিষয়টিকে সরলভাবে দেখার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা জাতিসংঘের পদক্ষেপকে যথোপযুক্ত মনে করে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। আগের পদক্ষেপ সফল না হলেও জাতিসংঘ তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে জানা যায়। সে কারণে বিএনপি অহিংস ও নরম কর্মসূচি দিয়ে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আশা করব, শিগগিরই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে তারা সংকট সমাধানের পথ প্রশস্ত করবেন। পারস্পরিক আস্থার সংকট কেটে গেলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে।
আওয়ামী লীগ বলতে গেলে এখন নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশের চাপেও নির্দলীয় বিধান মানতে চাচ্ছে না। এককভাবে সব বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন করতে চাওয়া জনআকাক্সক্ষা ও জনস্বার্থবিরোধী চিন্তা। সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে চুপ করে বসে থাকবে না। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এগিয়ে যাবে। এতে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে। শান্তি বিনষ্ট হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের মানুষ ও সম্পদ। এককভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অগ্রসর হওয়া দুঃখজনক। এটা রক্তক্ষয়ী সাংঘর্ষিক অবস্থার জন্ম দেবে। বিরোধী দলের আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে সংকটের সমাধান হবে না। কারণ প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সরকারকে এখনই সংলাপ আয়োজনের আহ্বান জানাচ্ছি। এতেই রাজনীতিকদের পাশাপাশি দেশের মঙ্গল নিহিত।
ড. আবদুল হাই তালুকদার : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
No comments