কি করতে যাচ্ছে সরকার?
হরতাল চলছে। ৪৮ ঘণ্টা, তারপর ৩৬ ঘণ্টা।
এরশাদের বিরুদ্ধে ৭২ ঘণ্টাও হয়েছিল। সে সব হরতালের সঙ্গে তফাৎ আছে এখনকার
হরতালের। তেড়িয়া পিকেটার নেই, তবে মারমুখো পুলিশ। ককটেল, টিয়ার শেল,
ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি, লাঠিপেটা।
গাড়ি চলে না, দোকানপাট
বন্ধ, অফিসে কাজ থাকে না, রাস্তাঘাট ফাঁকা। পত্রিকা লেখে ঢিলেঢালা হরতাল।
মাঝেমধ্যে হঠাৎ পটকা ফোটে, জ্বালাও-পোড়াও ঘটে। তখন রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ,
গুলিও চালায়। হতাহত হয় আন্দোলনকারী বা নিরীহ পথচারী, গৃহবধূ কেউ। পত্রিকা
লেখে সহিংসতা। এখন হরতাল এমনই। রাজধানীর ভিআইপি রোড়ে বিক্ষিপ্ত দু’একটি
গাড়ি সহ কর্মব্যস্ত এলাকার নিষ্প্রাণ অবস্থা, গ্রিন বা তোপখানা রোডের পাশে
বেঞ্চ পেতে পুলিশদের ঝিমুনি - এ সব ছবিই দেখা যায় পত্রিকায়। আসলে হরতাল
এখন স্বতঃস্ফূর্ত। ডাকলেই সাড়া মেলে শহরে জনপদে। এখন ছড়িয়ে পড়েছে
গ্রামাঞ্চলে। আরও হরতাল আসছে সামনে। এর মধ্যেই অচল হয়ে পড়েছে কর্মব্যস্ততার
অনেকখানি। সামনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে পড়ারই আশঙ্কা। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে
চলেছে রপ্তানি বাণিজ্যে। এই সূত্রে সকল অর্থনৈতিক কার্যক্রমেই। ব্যবসায়ীরা ও
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিদিনে হরতালের ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরছেন,
কিন্তু এর জের কত ভয়াবহ তা বলছেন না এখনই। তারা পরিবহনের জন্য সড়কপথে
নিরাপত্তা দাবি করছেন, কিন্তু জানেন তা পাওয়া যাবে কতখানি। পুলিশকে যেভাবে
ব্যবহার করা হয়েছে দমন-নির্যাতনে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ভাবমূর্তি। এ
নিয়ে হতাশ তারা। তারপরও নানা টানাহেঁচড়ার মুখে পড়তে হয়েছে অনেক
কর্মকর্তার। বদলি, কারণ দর্শাও, ধমক, রক্তচক্ষু তো আছেই। এ সব নিয়ে অসন্তোষ
বাড়ছে তাদের। ওদিকে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে না সরকারি দলের লোকজন।
রাজধানীতে যদি বা কিছুটা চোখে পড়ে তৎপরতা, ঢাকার বাইরে নেই বললেই চলে।
সরকারের ভেতরকার সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠছে এতে। শুক্র, শনি ও ছুটির দিনে
কাজ করে হরতালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান অর্থমন্ত্রী, কিন্তু ১২ লাখ সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্ধমনস্ক কাজেই কি দেশ চলে? শেয়ার বাজার, হল-মার্ক,
পদ্মা সেতু সহ শ’-শ’ টেন্ডারবাজির সামনে কোনও ভাল কাজেই আসে নি এ ১২ লাখ,
এই অচলাবস্থার মধ্যেও আসবে না এটা নিশ্চিত।
কেবল
অর্থনীতি নয়, রাজনীতির মতো অচল হয়ে আসছে শিক্ষাজীবন-ও। তারিখ
পিছিয়ে-পিছিয়ে পরীক্ষা ও শিক্ষা কার্যক্রম চলতে পারে না বেশি দিন। চলবেও
না। সামনে পরীক্ষা ও অন্যান্য কার্যক্রম। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল বলেছেন,
সেটা আমাদের চিন্তায় আছে, কিন্তু আরও বড় কাজের মুখোমুখি এখন দেশ। তিনি
উল্লেখ করেছেন, এইচএসসি পরীক্ষার সময়ও শাহবাগের জাগরণ আন্দোলন চলেছে।
দেশের
এই অচলোন্মুখ পরিস্থিতির কারণ কি? নির্বাচনের আগেই প্রতিপক্ষকে সাইজ করার
সেই পুরনো খেলা? এ খেলার জন্য, এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? তিনি কি জানেন
কি করছেন দেশের অবস্থার? নাকি হুমকিতেই সকল সমস্যার সমাধান?
এখন
এই আন্দোলনকারী ব্লগাররাও শুরু করেছেন হুমকি দিতে। তাদের ৬ দফা নির্দিষ্ট
তারিখের মধ্যে পূরণ না করায় সরকারের মতিগতি নিয়ে নানা আশঙ্কা জেগেছে, তাই
নতুন সুরে এই প্রতিবাদ। এমন আশঙ্কা অবশ্য প্রথম দিকেই করেছিলেন অনেকে।
পাঞ্জাবের আকালি দলকে সাইজ করতে সন্ত জারনেল সিং ভিনদ্রানওয়ালে-কে,
পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম)-কে টাইট দিতে সুভাষ ঘিসিং-কে দাঁড় করিয়েছিলেন
ইন্দিরা গান্ধী। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর তাদের পরিণাম কি হয়েছে তা সকলেরই
জানা।
ব্লগাররা হুমকি দিয়ে
আসছে অবশ্য শুরু থেকেই। সে সব ছিল তাদের অপছন্দের সব কিছুর প্রতি, কেবল
সরকার ছাড়া। এবার হুমকির তালিকায় সরকারকে যোগ করেছেন তারা, বলেছেন সমুচিত
জবাব দেয়া হবে ‘সরকারের স্পর্ধা’র। ওদিকে নাস্তিক-ব্লগারদের বিরুদ্ধে হুমকি
অব্যাহত রয়েছে ইসলামি দলগুলোর। সরকার কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে নাস্তিকদের
ব্লগ বন্ধ করার, কিন্তু তাদের গ্রেপ্তার, বিচার ও ‘ফাঁসি’ দাবি থেকে তারা
হটবে বলে মনে হয় না। আর সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের হুমকির অন্ত নেই,
বিরোধীরাও কথা কইছে না ছেড়ে। হুমকি-হুমকিতে সারা দেশ হয়ে উঠেছে মোকাবেলার
ক্ষেত্র। হুমকির ভাষাও ছেড়ে গেছে শালীনতার মাত্রা।
তাহলে
কি হতে যাচ্ছে? কি করতে যাচ্ছে সরকার? নির্বাচনের আগে-আগে হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে
‘গ্রহণযোগ্য’ সরকারকে মাঠে নামাবে? কিন্তু সবাই তো জানেন ২০২১ সালে
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার প্রত্যাশা শেখ
হাসিনার। এছাড়া আর কি করতে পারেন তিনি? তাহলে খালেদা জিয়া কি করবেন বা কি
করছেন? তিনি শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট অবস্থানই নিয়েছেন। সিঙ্গাইরে ও বগুড়ায়
সোজাসুজি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বল ঠেলে দিয়েছেন সরকারের দিকে। কোনও ছক সাজানো
নির্বাচনে তাঁর দল ও জোট যাবে না। বলেছেন প্রয়োজনে রক্ত দিতে হবে। নিজের
রক্তের কথাই বলেছেন। শেষ যুদ্ধে তিনি রক্ত দেবেন, হটবেন না।
No comments