আমিনীর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল
ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ্ মাঠে এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী ও সহপাঠী মাওলানা আবদুল হাই।
প্রায় ২১ মাস গৃহবন্দি থাকা মুফতি আমিনী মঙ্গলবার রাতে পুলিশ পাহারাতেই রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। প্রয়াত এ নেতার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন- বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এমকে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লাহ বুলু, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আবদুল লতিফ নেজামী, খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, মাওলানা শাহ্ আহমাদুল্লাহ আশরাফসহ দেশের প্রায় সব ইসলামী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
জানাজায় জড়ো হওয়া লক্ষাধিক লোকের জমায়েত জাতীয় ঈদগাহ্ মাঠ ও সংলগ্ন রাজপথ ছাপিয়ে উত্তরে মৎস্য ভবন, পূর্বে জাতীয় প্রেস ক্লাব, পশ্চিমে দোয়েল চত্বর দক্ষিণে শিক্ষাভবন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। জানাজায় সমবেত লোকের ভিড়ের কারণে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর ও দৈনিক বাংলা মোড় পর্যন্ত পুরো রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে জানাজা শেষে জাতীয় ঈদগাহ্ ময়দান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কওমি মাদ্রাসার বেশকিছু ছাত্র আমিনীর মৃত্যুর জন্য বর্তমান সরকারকে দায়ী করে সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দেয়। তারা দাবি করেন- সরকারের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণেই মুফতি আমিনীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে। অবশ্য জানাজার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আমিনীর দীর্ঘ বন্দি জীবনের জন্য সরকারের সমালোচনা করেন। সরকারের পতন এবং আমিনীর রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা ঘরে ফিরবেন না বলে শপথ নেন। এতে জানাজা এক রকম প্রতিবাদ সমাবেশে রূপলাভ করে।
দেশবরেণ্য আলেম, সংগ্রামী রাজনীতিক, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি, লালবাগ জামেয়া ও বড় কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, সাবেক এমপি, মুফতি ফজলুল হক আমিনী মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাজধানীর লালবাগের বাসায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত তাকে ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গভীর রাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর দেশে ও বহির্বিশ্বে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। ধানমন্ডি ইব্নে সিনা হাসপাতালে ও লালবাগ মাদ্রাসায় আলেম-উলামা ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে যান। ইসলামী আন্দোলন ও কওমি মাদ্রাসা অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রাতেই লালবাগ মাদ্রাসায় ভিড় করেন। ফজরের আগেই গোসল দিয়ে দর্শনার্থীদের জন্য তার লাশ লালবাগের দারুল হাদীসে রাখা হয়। হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ কাতারবান্দি হয়ে তার লাশ দেখেন। ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আমিনী প্রায় ২১ মাস ধরে গৃহবন্দি ছিলেন। এই সময়ে তিনি নিয়মিত হাদিসের ক্লাস, ইসলাহী মজলিস ও বিভিন্ন্ন অঞ্চল থেকে আগত রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন। সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে মাঠে ময়দানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কোন ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। ইন্তেকালের দিন মাগরিবের পর বুখারী শরীফের হাদিসের দরস দেন। এশার পর লালবাগ শাহী মসজিদে একটি জানাজা নামাজের ইমামতিও করেন। মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। রাতে বাসায় যাওয়ার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ৬৭ বছর বয়স্ক মুফতি আমিনী আগে থেকেই ছিলেন ডায়বেটিস রোগে আক্রান্ত। ২০০৭ সালে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। গতকাল জাতীয় ঈদগাহে নামাজে জানাজা শেষে তার মরদেহ লালবাগ শাহী মসজিদের সংরক্ষিত কবরস্থানে দাফন করা হয় ।
১৯৪৫ সালের ১৫ই নভেম্বর বি-বাড়িয়া জেলার আমীনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জন্ম। পিতা-আলহাজ মরহুম ওয়ায়েজ উদ্দীন, মাতা- মোছা. ফুলবানুন্নেছা। বি. বাড়িয়া জামেয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মুফতি আমিনী মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় তিন বছর পড়াশুনা করেন। তারপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর, হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ, আরেফ বিল্লাহ মাওলানা সালাহ উদ্দীন, হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ ঢাকুবী এবং শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হকের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদ লাভ করেন। ১৯৬৯ ইংরেজি সালে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে হাদিস ও ফিকাহ্ তথা ইসলামী আইনের উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশে পাকিস্তান করাচি নিউ টাউন মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানে তিনি উলুমুল হাদিস ও ইসলামী আইনের উপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে। প্রথমে মাদরাসা-ই-নূরীয়া কামরাঙ্গীরচরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তিনি হজরত হাফেজ্জী হুজুরের কন্যার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে মাত্র নয় মাসে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ হেফ্জ করেন। এ সময় তিনি ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে আলু বাজার মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক ও সহকারী মুফতি নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপ্যাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পান। ইন্তেকালের আগ পর্যন্তই এই দু’টি মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদ্রাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
রাজনৈতিক ভূমিকা: ইসলামী আইন ও আদর্শের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল মুফতি আমিনীর সরব পদচারণা। দুই যুগ ধরে আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল সরব ও সোচ্চার কণ্ঠ হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮১ সালে খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলে তিনি মনোনীত হন এ সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ইন্তেকালের পর তিনি দেশে অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ লংমার্চসহ, ১৯৯৪ সালে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। বর্তমানে তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, উলামা কমিটি বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা ও খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোটের অন্যতম প্রধান রূপকার ও শীর্ষ নেতা।
২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’- সংক্রান্ত কোরআন-হাদীস বিরোধী রায় ঘোষিত হওয়ার পর তিনি প্রথম গর্জে উঠেছিলেন। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতিকে শরীয়তের আলোকে তিনি মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। আান্দোলন তুঙ্গে উঠলে তিনি আওয়ামী দুঃশাসনের কোপানলে পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চার মাস তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চারদলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বি. বাড়িয়া-২ [সরাইল ও সদরের আংশিক] নির্বাচনী আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন।
বেশ কয়েকবার হজ-ওমরাহ্ পালনসহ তিনি লন্ডন, সিরিয়া, ভারত, কুয়েত ও পাকিস্তান সফর করেছেন। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে ১৯৮৪ ইং সালে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের শান্তি মিশনের সদস্য ছিলেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মুফতি আমিনী ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ‘মুজাযে সুহবত’। পরবর্তী সময়ে তাকে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল কবীরসহ হযরত হাফেজ্জী হুজুর-এর আরও কয়েকজন বিশিষ্ট খলিফা বাইয়াত করার অনুমতি প্রদান করেন।
মুফতি আমিনীর আকস্মিক মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মসজিদ মিশনের সভাপতি মাওলানা যইনুল আবেদীন, সেক্রেটারি ড. খলিলুর রহমান মাদানী, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, মিরশরাই পীর মাওলানা আবদুল মোমেন নাছেরী শোক প্রকাশ করেন।
দেশবরেণ্য আলেম, সংগ্রামী রাজনীতিক, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি, লালবাগ জামেয়া ও বড় কাটারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, সাবেক এমপি, মুফতি ফজলুল হক আমিনী মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ১৫ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। রাজধানীর লালবাগের বাসায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত তাকে ধানমন্ডি ইবনে সিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গভীর রাতে তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর দেশে ও বহির্বিশ্বে ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। ধানমন্ডি ইব্নে সিনা হাসপাতালে ও লালবাগ মাদ্রাসায় আলেম-উলামা ও সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মানুষ ছুটে যান। ইসলামী আন্দোলন ও কওমি মাদ্রাসা অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রাতেই লালবাগ মাদ্রাসায় ভিড় করেন। ফজরের আগেই গোসল দিয়ে দর্শনার্থীদের জন্য তার লাশ লালবাগের দারুল হাদীসে রাখা হয়। হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘ কাতারবান্দি হয়ে তার লাশ দেখেন। ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি আমিনী প্রায় ২১ মাস ধরে গৃহবন্দি ছিলেন। এই সময়ে তিনি নিয়মিত হাদিসের ক্লাস, ইসলাহী মজলিস ও বিভিন্ন্ন অঞ্চল থেকে আগত রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন। সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণে মাঠে ময়দানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কোন ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। ইন্তেকালের দিন মাগরিবের পর বুখারী শরীফের হাদিসের দরস দেন। এশার পর লালবাগ শাহী মসজিদে একটি জানাজা নামাজের ইমামতিও করেন। মাদ্রাসার ক্যাম্পাসে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন। রাতে বাসায় যাওয়ার পর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ৬৭ বছর বয়স্ক মুফতি আমিনী আগে থেকেই ছিলেন ডায়বেটিস রোগে আক্রান্ত। ২০০৭ সালে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। গতকাল জাতীয় ঈদগাহে নামাজে জানাজা শেষে তার মরদেহ লালবাগ শাহী মসজিদের সংরক্ষিত কবরস্থানে দাফন করা হয় ।
১৯৪৫ সালের ১৫ই নভেম্বর বি-বাড়িয়া জেলার আমীনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জন্ম। পিতা-আলহাজ মরহুম ওয়ায়েজ উদ্দীন, মাতা- মোছা. ফুলবানুন্নেছা। বি. বাড়িয়া জামেয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মুফতি আমিনী মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন বিক্রমপুরের মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় তিন বছর পড়াশুনা করেন। তারপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে তিনি হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী ও হযরত হাফেজ্জী হুজুর, হযরত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ, আরেফ বিল্লাহ মাওলানা সালাহ উদ্দীন, হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ ঢাকুবী এবং শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আজিজুল হকের বিশেষ তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদ লাভ করেন। ১৯৬৯ ইংরেজি সালে আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরীর কাছে হাদিস ও ফিকাহ্ তথা ইসলামী আইনের উপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশে পাকিস্তান করাচি নিউ টাউন মাদ্রাসায় গমন করেন। সেখানে তিনি উলুমুল হাদিস ও ইসলামী আইনের উপর বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে। প্রথমে মাদরাসা-ই-নূরীয়া কামরাঙ্গীরচরে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তিনি হজরত হাফেজ্জী হুজুরের কন্যার সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে মাত্র নয় মাসে তিনি সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ হেফ্জ করেন। এ সময় তিনি ঢাকার আলু বাজারে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে আলু বাজার মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক ও সহকারী মুফতি নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি লালবাগ জামেয়ার ভাইস প্রিন্সিপ্যাল ও প্রধান মুফতির দায়িত্ব পান। ১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপ্যাল ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালে বড়কাটারা হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল ও মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পান। ইন্তেকালের আগ পর্যন্তই এই দু’টি মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি ঢাকার কাকরাইল, দাউদকান্দির গৌরীপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মাদ্রাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
রাজনৈতিক ভূমিকা: ইসলামী আইন ও আদর্শের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল মুফতি আমিনীর সরব পদচারণা। দুই যুগ ধরে আলেম সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল সরব ও সোচ্চার কণ্ঠ হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮১ সালে খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলে তিনি মনোনীত হন এ সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল। হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ইন্তেকালের পর তিনি দেশে অধিকাংশ ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ লংমার্চসহ, ১৯৯৪ সালে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। বর্তমানে তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, উলামা কমিটি বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা ও খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান। তিনি ছিলেন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা চারদলীয় জোটের অন্যতম প্রধান রূপকার ও শীর্ষ নেতা।
২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে ‘সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ’- সংক্রান্ত কোরআন-হাদীস বিরোধী রায় ঘোষিত হওয়ার পর তিনি প্রথম গর্জে উঠেছিলেন। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতিকে শরীয়তের আলোকে তিনি মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। আান্দোলন তুঙ্গে উঠলে তিনি আওয়ামী দুঃশাসনের কোপানলে পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চার মাস তিনি কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চারদলীয় ঐক্যজোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বি. বাড়িয়া-২ [সরাইল ও সদরের আংশিক] নির্বাচনী আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন।
বেশ কয়েকবার হজ-ওমরাহ্ পালনসহ তিনি লন্ডন, সিরিয়া, ভারত, কুয়েত ও পাকিস্তান সফর করেছেন। ইরান-ইরাক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে ১৯৮৪ ইং সালে তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুরের শান্তি মিশনের সদস্য ছিলেন। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মুফতি আমিনী ছিলেন হযরত হাফেজ্জী হুজুর এর ‘মুজাযে সুহবত’। পরবর্তী সময়ে তাকে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা আবদুল কবীরসহ হযরত হাফেজ্জী হুজুর-এর আরও কয়েকজন বিশিষ্ট খলিফা বাইয়াত করার অনুমতি প্রদান করেন।
মুফতি আমিনীর আকস্মিক মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মসজিদ মিশনের সভাপতি মাওলানা যইনুল আবেদীন, সেক্রেটারি ড. খলিলুর রহমান মাদানী, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, মিরশরাই পীর মাওলানা আবদুল মোমেন নাছেরী শোক প্রকাশ করেন।
No comments