৫ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা জগন্নাথের

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কব্জায় বিশ্বজিৎ দাসের ১২ কিলার। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিন কিলারের গ্রেপ্তার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। বাকিদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দারা।
এদিকে গণমাধ্যমের প্রকাশিত তথ্য ও ছবির ভিত্তিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্বজিতের ৫ কিলারকে শনাক্ত করে তাদের সার্টিফিকেট ও ছাত্রত্ব বাতিল করেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিশ্বজিতের ১২ কিলারকে শনাক্ত করা হয়েছে।
একইসঙ্গে তাদের সম্ভাব্য সকল গোপন আস্তানা ঘিরে রাখা হয়েছে। যাতে অন্য কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে। র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ৫টি টিম কিলারদের গতিবিধি অনুসরণ করছে। তাদের গ্রেপ্তার এখন সময়ের ব্যাপার। যে কোন মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার খবর জানানো হবে। এদিকে মঙ্গলবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৮ জন গ্রেপ্তারের ঘোষণা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত বিভ্রান্তি কাটেনি। সারাদিন অস্বীকার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান রাত ১০টায় মোবাইল ফোনে ৮ জন আটক করা হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই গ্রেপ্তারকৃতদের নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি। এমনকি আদালতে হাজির করা হয়নি। এরইমধ্যে গতকাল দ্বিতীয় দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে আবারও দাবি করেছেন, ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন ঘোষণার রহস্য জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ডিসি বলেন, গণমাধ্যম ও দেশবাসীর সমালোচনা সামলাতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। সূত্র জানায়, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ভিডিও ফুটেজ, পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রকৃত কিলারদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। শনাক্ত হওয়া কিলারদের প্রধান হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ইউনুছের নাম প্রকাশ হয়েছে। তার সরাসরি নির্দেশে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, সাইফুল ইসলাম, কিবরিয়া, কামরুল ইসলাম, শাওন, মীর মো. নূরে আলম লিমন, ইমদাদুল হক, সুমন, ওবায়দুল কাদের ও রাজন। এদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান নাহিদ ও কিবরিয়া রাজধানীতেই আত্মগোপন করে আছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম শাকিল, সাইফুল, কামরুল, শাওন ঢাকার বাইরে পালিয়ে গেছে। জবি সূত্র জানায়,  মাহফুজুর রহমান নাহিদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অষ্টম সেমিস্টারের ছাত্র। তার পিতার নাম মাওলানা মহীউদ্দীন। বাড়ি হাতিয়ার চরকৈলাশ এলাকায়। সে বিশ্বজিতের শরীরে রড ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। চাপাতি হাতে সাদা শার্টের ঘাতকের নাম রফিকুল ইসলাম শাকিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। তার বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা রয়েছে। তার পিতার নাম আনছার আলী। বাড়ি পটুয়াখালী জেলা সদরে। বর্তমানে সে ঢাকার বাইরে পালিয়ে আছে। ওদিকে শনাক্ত হওয়া ১২ কিলারের গোপন আস্তানার বিষয়ে তথ্য জানতে গতকাল পর্যন্ত ২৫-৩০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
এছাড়া হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, শনাক্ত হওয়া ছাত্রলীগের ১২ কিলার বিভিন্ন এলাকার ছাত্রলীগের নেতাদের আশ্রয়ে রয়েছে। গ্রেপ্তার এড়াতেই তারা প্রভাবশালী নেতাদের ছায়াতলে গা ঢাকা দিয়েছে।
গ্রেপ্তার গুঞ্জন: এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ৮ জন গ্রেপ্তার ঘোষণার পর গতকাল রাত পর্যন্ত আরও তিনজন গ্রেপ্তারের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। খোদ ছাত্রলীগের নেতারাই জানিয়েছেন, শনাক্ত হওয়া তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এরা হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান নাহিদ, মনোবিজ্ঞান বিভাগের তাহসিন কাদের ও কিবরিয়া। রাজধানীর পাশে সাভার এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার রাতে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের সেগুনবাগিচার আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের বাড়ি থেকে সন্দেহভাজন আরও একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ওই ব্যক্তির সঙ্গে শনাক্ত হওয়া কিলারদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়ার পরই তাকে আটক করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি মো. মাসুদুর রহমান বলেন, বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে আশা করছি শিগগিরই আসল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
জবি’র ৫ কিলারের বিরুদ্ধে শাস্তি: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন কিলারকে স্থায়ী বহিষ্কার ও সাবেক দুই ছাত্রের সনদপত্র বাতিল করেছে। বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকারী হিসেবে তাদের শনাক্ত করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গতকাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকারী হিসেবে ৫ জনকে শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে অধ্যয়নরত তিন ছাত্রকে শনাক্ত করে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। এরা হচ্ছে- মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ওবায়দুল কাদের, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মীর মো. নূরে আলম লিমন এবং ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মো. রফিকুল ইসলাম শাকিল। এছাড়া সাবেক দুই ছাত্রের সনদপত্র বাতিল করা হয়েছে। এরা হচ্ছে- দর্শন বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ইমদাদুল হক ও বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মাহফুজুর রহমান। ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ চলাকালীন এরা ছাত্রলীগের ব্যানারে বিশ্বজিৎকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে। এ সংক্রান্তে তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই ৫ অপরাধীর বিরুদ্ধে এ সিদ্ধান্ত নেয়।
খুন শেষে ফুর্তি করে: নিরপরাধ বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগের ১২ কিলার জবি ছাত্রলীগ সভাপতির জন্মদিনের পার্টিতে ফুর্তি করেছে। সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলামের শুভ কামনায় তারা একে অপরকে কেক কেটে খাইয়েছে। জড়িয়ে ধরে উল্লাস করেছে। জবি সূত্র জানায়, হামলাকারীরা আগে থেকেই তারা ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এলাকায় ছাত্রলীগের পরিচয়ে তাদের চাঁদাবাজির তথ্যও পাওয়া গেছে। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন ঘোষণায় বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে স্বরাষ্টমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর দাবি করেন, বিশ্বজিৎ দাসকে হত্যায় জড়িতরা কেউই ছাত্রলীগের ‘সক্রিয়’ কর্মী নয়। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দীয় কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির পক্ষে কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্বজিৎ দাস হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের নাম এসেছে তারা ছাত্রলীগের কর্মী নয়। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও ভিডিও ফুটেছে যাদের নাম এবং চেহারা প্রকাশিত হয়েছে তাদের অন্যতম হলো রফিকুল ইসলাম শাকিল, নূরে আলম লিমন, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক, তাহসিন কাদের ও  রাজন । এদের মধ্যে শাকিলসহ দুজনকে ২০০৯ সালে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হলেও কার্যত তা ছিল কাগজ-কলমে। ক্যাম্পাসে তারা আগের আহ্বায়ক কমিটি এবং বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি গ্রুপে সক্রিয় রাজনীতি করছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, রফিকুল ইসলাম শাকিল ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপনাট্য সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবরের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে নূরে আলম লিমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাহফুজুর রহমান নাহিদ ছাত্রলীগের কোন পদে না থাকলেও সে বর্তমান সভাপতি শরীফুল ইসলামের আস্থাভাজন কর্মী। ইমদাদুল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণ ও বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির উপনাট্য সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবরের ক্যাডার। এছাড়া তাহসিন কাদের এবং রাজন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে সম্ভাব্য নামের তালিকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকারীদের নাম রয়েছে।
খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে বিক্ষোভ: এদিকে  বিশ্বজিৎ হত্যায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পুরান ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল দুপুরে ‘বিশ্বজিতের বন্ধু মহল ও ব্যবসায়ী সমিতি’র ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিলটি বিশ্বজিৎ দাসের আমন্ত্রণ টেইলার্স-এর সামনে থেকে বের হয়। সেখান থেকে জজ কোর্ট, রায় সাহেবের বাজার হয়ে ফের ওই দোকানের সামনে এসে শেষ হয়। এ সময় বিশ্বজিতের ব্যবসায়ী সহকর্মী এবং বন্ধুরা বক্তব্য দেন। সুবির নন্দী নামে বিশ্বজিতের এক বন্ধু বলেন, হত্যাকারীরা যেই হোক না কেন, যে দলের  হোক না কেন তাদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.