বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বাড়ছে
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের কদর ক্রমেই বাড়ছে। প্রথমদিকে দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছিলেন এর একমাত্র ক্রেতা ও ভোক্তা। এখন এর প্রতি আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে বিদেশীদের। বাজার তৈরি হওয়ায় রপ্তানি আয়ও বাড়ছে এই খাতের। সরকার বেশ আগ থেকেই কৃষিখাতকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার (থ্রাস্ট) খাত ঘোষণা করেছে। এখন দ্রুত প্রসার ঘটছে এই খাতের।
বর্তমানে দেশের ৭০টি প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উ ৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই করছে। শুধু রপ্তানি করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৪৩। আর শুধু উৎপাদন করে ৩৩টি প্রতিষ্ঠান। গত চার বছরে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্প বেশ অগ্রসর হয়েছে। এই সময়ে নতুন করে ৭০টির বেশি প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠা করেছে শিল্প। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বর্তমানে এ খাতে সরাসরি জড়িত আছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ।বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের প্রধান প্রতিযোগী হচ্ছে ভারত। এ ছাড়া আছে ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলের মতো প্রতিপক্ষও। তাদের পণ্যের মান ও মোড়ক যেমন ভালো, তেমনি দামও কম। তারপরও রপ্তানিকারকেরা বলছেন, দেশের এই শিল্পটি সমৃদ্ধির পথেই রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালিদের কারণেই এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা পাওয়া গেলে এসব পণ্য বিশ্ব বাজারে আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে।
গোড়ার দিকে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ছিল সীমিত। ২০০১-০২ অর্থবছরে এ পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল দুই কোটি ১৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এরপর থেকেই বিশ্ব বাজারে প্রসার ঘটতে থাকে এসব পণ্যের। বাপার কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয় দুই কোটি ২৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ওই বছর এই পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ১১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। পরের বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় ৭৭ শতাংশ। আয় হয় চার কোটি ছয় লাখ ৫০ হাজার ডলার। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয় হয় চার কোটি ৬৬ লাখ ৮০ হাজার ডলার। পরবর্তী অর্থবছরে রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ৩১ লাখ ২০ হাজার ডলারে।
বাপার মহাসচিব রাজু আহমেদ বলেন, গত পাঁচ বছরে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের রপ্তানি ক্রমেই বেড়েছে। তা ছাড়া দেশের বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এ শিল্পে এগিয়ে আসছে।
বিশ্ববাজারে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে দেশের শীর্ষ অবস্থানে আছে প্রাণ-আরএফএল লিমিটেড। এ ছাড়া স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্টস, আজমি, ইউরেশিয়া, বোম্বে সুইটস, ইফকো, এসিআই, কাজী ফুডসও বেশ কয়েক ধরনের পণ্য রপ্তানি করছে।
দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানির রূপকার প্রাণ। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রাণ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি শুরু করে। বর্তমানে বিশ্বের ৭৭টি দেশে প্রতিষ্ঠানটির তৈরি খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে সৃষ্টি হয়েছে তাদের পণ্যের বেশ বড় বাজার।
প্রাণের পরিচালক (বিপণন) কামারুজ্জামান কামাল জানান, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে তিন কোটি ৬০ লাখ, ২০০৯ সালে দুই কোটি ৬০ লাখ ও ২০০৮ সালে দই কোটি ১০ লাখ ডলার আয় করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন নতুন বাজার তৈরি এবং বর্তমান বাজার সুসংহত করতে কাজ করছি। আগে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে পণ্য বিক্রির জন্য রপ্তানি করতাম, এখন ওইসব দেশের নাগরিকদের কাছে বিক্রির জন্যও রপ্তানি করছি। আমদানিকারক দেশগুলোতে প্রাণকে বাংলাদেশের একটা ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত করানোরও কাজ চলছে।’
বাজার সম্ভাবনা নিয়ে স্কয়ার কনজ্যুমার প্রোডাক্টের রপ্তানি বিভাগের প্রধান খুরশীদ আহম্মাদ বলেন, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেই বিরাট এক সম্ভাবনার বড় বাজার আছে। সরকারি পর্যায়ে যদি এসব দেশে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করা যায় তাহলেই বড় অগ্রগতি হবে এখাতে।’ তিনি বলেন, আর এখন যে দূর দেশের বাজার আছে তাতে আস্তে-ধীরে অগ্রসর হলেও চলে।
কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পকে সরকার অগ্রাধিকার খাত ঘোষণা করে ২০০৫ সালে। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে রপ্তানির বিপরীতে ২০ শতাংশ হারে সহায়তা (ইনসেনটিভ) দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে পণ্য উ ৎপাদন ও রপ্তানি দুটোই যারা করে শুধু এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকেই এই সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এ খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৫ সালে জারি হওয়া এক সার্কুলার (এফই-১৫) অনুযায়ী, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য উ ৎপাদন ও রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানই শুধু সহায়তা পাবে। এরপর থেকেই রপ্তানিকারকেরা সার্কুলারটি সংশোধনে অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন জানাতে থাকেন। কিন্তু তা না করে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্পষ্টিকরণ সার্কুলার জারি করে। তাতে বলা হয়, শুধু উ ৎপাদনকারী রপ্তানিকারক হলেই সহায়তা পাবে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিব অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্কুলারটি সংশোধনের দাবি জানান। অর্থমন্ত্রী তাঁদের দাবিকে যৌক্তিক মন্তব্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনো বিষয়টির সুরাহা হয়নি।
অনেক সম্ভাবনা থাকার পরও এ খাতের দ্রুত বিকাশ না হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে বাপা। এগুলো হলো কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বেশির ভাগ কাঁচামালই আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। গ্যাসের অভাবে সেখানে এসব শিল্প গড়ে ওঠছে না।
আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরীক্ষাগার (ল্যাবরেটরি) দেশে নেই। মান নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই অনেক দেশেই স্বীকৃত না। তাই এ দেশের পণ্য বিশ্ববাজারে গেলে স্বীকৃত পরীক্ষাগার থেকে পুনরায় পরীক্ষা করাতে হয়। তা ছাড়া সার্টিফিকেশনের কারণে দেশের অনেক পণ্যই অনেক দেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে প্রতিযোগী ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য শিল্পে পাঁচ শতাংশ সুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ঋণ সুবিধা পায় না। অবশ্য সমমূলধন তহবিল নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প আছে, যার আওতায় এ খাতের উদ্যোক্তারা যত টাকা বিনিয়োগ করবেন সমপরিমাণ বিনিয়োগ ব্যাংকও করে থাকে।
No comments