রাজনৈতিক আলোচনা- গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক by ড. ইশা মোহাম্মদ

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় বারবার। '৪৭-এর পর ধরে নেয়া হয়েছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ বানাবে রাজনৈতিক নেতারা। সমাজতন্ত্র না গণতন্ত্র কোন্টি হবে জাতিগঠন প্রক্রিয়া। নাকি আদ্যিকালের আসন্ন তন্ত্র? হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদর্ী একবার বলেছিলেন কোনটিই চলবে না। না সমাজতন্ত্র না গণতন্ত্র। এ দেশের মানুষ কোনটির জন্যই প্রস্তুত নয়। তবে মন্দের ভাল হবে গণতন্ত্র।
একদিন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক হবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদর্ীকে বলা হয়, গণতন্ত্রের মানসপুত্র। ধারণা করা হয়েছিল যে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সোহরাওয়াদর্ীর চেয়েও উন্নত মানের রাজনীতিক ছিলেন। কিন্তু তিনি তার মনের বাসনা গোপন রাখার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে গেলেন। তাঁর কৃষক প্রজা পার্টি বিকশিত হলে বাঙালি জাতি অধিকতর লাভবান হতে পারত। কিন্তু তদানিন্তন কায়েমী স্বার্থবাদীরা অপপ্রচার করেছিল এই বলে যে, কৃষক প্রজা পার্টি গোপনে গোপনে সমাজতন্ত্রী। এরা ক্ষমতায় গেলে জোতদার, মহাজনদের লাতিসামন্তদের জমি কেড়ে নেবে এবং কৃষক প্রজাদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করে দেবে। আরো অপপ্রচার হয়েছিল যে, তারা মূলত নাস্তিক কমু্যনিস্টদের সাথে যোগ দিয়ে এ দেশের মুসলমানদের ধর্মহীন করে দেবে। মধ্যবিত্ত মুসলিমদের অকুষ্ঠ সমর্থন পেতে শেরে বাংলা পুনর্বার মুসলিম লীগে যোগ দিলেন এবং নিজের হাতে গড়া অমিত সম্ভাবনাময় কৃষক প্রজা পার্টিকে গলাটিপে মেরে ফেললেন। সেদিনও বলা হয়েছিল, আজও বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির এবং প্রজাসাধারণের বড় ক্ষতি হয়ে গেল। সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির জন্য প্রস্তুত নয়। এটি ধরে নিয়েই সোহরাওয়াদর্ী স্বৈরতন্ত্র সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি জনগণ প্রজাতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ তার জন্মলগ্ন থেকেই মনে মনে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করেছিল। চিন্তাটা কোনক্রমেই নতুন নয়। '৪৭-এর আগেই সোহরাওয়াদর্ী এবং আবুল হাশিম স্বতন্ত্র বাংলার দাবী ন্যায়সঙ্গত ভেবেছিলেন এবং দু'চারজন বড় হিন্দু নেতাদের সাথে যোগ দিয়ে বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। পরে ঐ সব বড় হিন্দু নেতারা কংগ্রেসের বড় নেতাদের ব্যক্তিত্বের কাছে মস্নান হয়ে গিয়েছিলেন এবং মধ্যবিত্ত হিন্দুরা তাদের মুসলিমঘেঁষা বলে গালমন্দ করে ঠাণ্ডা করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন আবুল হাশিম এবং সোহরাওয়াদর্ী" যদিও পাকিস্তান তাদের না-পছন্দ ছিল। কিন্তু মনের গোপন বাসনা আর গোপন থাকেনি। আওয়ামী লীগ সৃষ্টির মধ্যে সেই গোপন বাসনা প্রকাশিত হয়। পরে কাগমারীতে ভাসানী ছালাম জানিয়ে দেন। এ সবই হয়েছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। যদিও বাংলার স্বাধীনতার বিষয়টি পাকিস্তানী গণতান্ত্রিকতা নয়, বাঙালি গণতান্ত্রিকতা ছিল। যে কোন জাতিই স্বাধীনতা প্রত্যাশা করতে পারে। বাঙালি জাতিও তাই প্রত্যাশা করেছিল। যেহেতু আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পছন্দ করেছিল তাই প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নেও গণতান্ত্রিক কৌশলই ব্যবহার করে। পরে পরিস্থিতি আওয়ামী লীগকে সশস্ত্র পথে স্বাধীনতা অর্জনের সিদ্ধান্ত দেয়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর অর্থনৈতিক স্থাপনাগুলি ষড়যন্ত্রীদের লক্ষ্যবস্তু হয়। অসংখ্য পাটের গুদামে আগুন লাগে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই চুরি, ডাকাতি, ছ্যাচড়ামির শিকার হয়। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর অগণতান্ত্রিক পন্থায় দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের একে একে হত্যা করা হয়। দীর্ঘদিন যাবৎ অগণতান্ত্রিকতা অনুশীলন করার ফলে একটি গণবিরোধী শ্রেণী বাংলাদেশের প্রাধান্যে বিস্তার করে। এরা অগ্রবতর্ী অবস্থানে চলে আসায় জাতিগঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং অর্থনৈতিক খাতগুলি নানান সময়ে নানান উপায়ে নাশকতার শিকার হয়।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে হরতাল অবরোধ চালু আছে। কিন্তু এই হরতাল অবরোধের সুযোগ নিয়ে দেশবৈরীরা নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি নাশকতার শিকার হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই তাদের পছন্দমত 'সময়কে' শিক্ষাঘণ্টা হিসাবে ব্যবহার করতে পারে না। অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাস না করাটাকে স্বাভাবিক হিসাবে নিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা নিয়মিত না হলেই দেশ বৈরী শক্তি খুশি হয়। তারা জাতিকে অশিক্ষিত রাখতে চায় তাদের শ্রেণীস্বার্থের কারণে। একই সাথে এজেন্সিশিপ টিকিয়ে রাখার কারণে। সাম্রাজ্যবাদ- যারা চায় না বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক এবং একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিচিত হোক। সাম্রাজ্যবাদ ভালভাবেই জানে যে, জাতিগঠন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতিতে জাতি একটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক শক্তি হয়, যা সাম্রাজ্যবাদের মূল স্বার্থের পরিপন্থি। যে কারণে 'পাকিস্তান' অদ্যাবধি পর নির্ভরশীল এবং অকার্যকর রাষ্ট্র হিসাবে নিজের 'ঠিকানা' সংগ্রহ করেছে।
বাংলাদেশে জোরেশোরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সাধারণ মানুষ এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। মহাজোট সরকারের মহাবিজয়ের জন্য যে সব শর্ত কাজ করেছে- তার মধ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা একটি প্রধান শর্ত। গণবিরোধীরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসাবে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততাকে নাশকতার মাধ্যমে নৈরাজ্যে পরিণত করতে চায়। তারা হরতাল অবরোধ এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে নাশকতা চালিয়ে স্বাভাবিকতাকে বিঘ্ন করতে চায়। জনগণের স্বাভাবিক দাবী ও আন্দোলনকে নাশকতার মাত্রা দিয়ে কলুষিত করতে চায়। যে কারণে তৈরি পোশাক শিল্পে আগুন লাগছে বারবার। নিত্যপণ্যের বাজার বারবার অস্থির হচ্ছে। সরকার কষ্টে সৃষ্টে একটা জায়গায় নিয়ে আসে, আবার বিশেষ সিন্ডিকেট ভেঙ্গেচুরে দেয়। এদেশেই মনে হয় প্রথম এমন ঘটনা ঘটেছে যে, সরকার সাংবাদিক সম্মেলন করে সিন্ডিকেটের কাছে তার পরাজিত চেহারা দেখিয়েছে। এতে করে স্বার্থান্বেষী মহলের লাভ হয়েছে বেশি। তারা যখন তখন তাদের খেয়াল খুশিমত বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় কমায়। এই অস্থিরতাও গণতান্ত্রিক স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে।
বড় নাশকতার আগে ছোট নাশকতার ঘটনা ঘটছে। আরো অনেকগুলি, অসংখ্য নাশকতার ঘটনা ঘটবে। অতঃপর বড় নাশকতার মাধ্যমে হঠকারী ও অগণতান্ত্রিক রাজনীতিকরা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্র নোংরা করে দিয়ে একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করতে পারে। যা মূলত গণতান্ত্রিক পন্থায় জাতিগঠন প্রক্রিয়াকে নষ্ট করবে। সরকার পূর্বেকার মত নাশকতার ব্যাপারে নির্লিপ্ততা দেখাচ্ছে। মহাজোট সরকার যদি নাশকতা ও নৈরাজ্যমূলক কলাকৌশল অনুশীলনের পথ বন্ধ করে দিতে না পারে তবে দেশবৈরীরা মাথায় চড়ে বসবে এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে মারাত্মকভাবে।
==============================
কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা




দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ ড. ইশা মোহাম্মদ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.