গণমাধ্যম নিয়ে দিশেহারা সরকার by এবিএম মূসা
সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বিবিসি একটি টেলি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমার ভালো লাগল, তিনি সপ্রতিভভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর প্রতিটি জিজ্ঞাসার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যাসূচক উত্তর দিয়েছেন। তাঁর সরকারের কতিপয় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসূচি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আলোচিত সব প্রসঙ্গের মধ্যে বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার নিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর জেরায় বিব্রত হননি। এতদসংক্রান্ত বিচারিক পদক্ষেপের সঠিক তথ্য তুলে ধরার সুযোগ নিয়েছেন। বহির্বিশ্বে এ নিয়ে যেসব অপপ্রচার হচ্ছে, তার জবাব দিয়েছেন। সবশেষে তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, ‘বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে কেন সরকারি বিটিভির সংবাদ প্রচারে বাধ্য করা হচ্ছে?’ আমার দেখার বা শোনার ভুল হতে পারে, মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী এ প্রশ্নে একটুখানি বেকায়দায় পড়লেন। তিনি সরকারি টেলিভিশনে সম্প্রচার-সম্পর্কিত বিধিমালার উল্লেখ করলেন। যাঁরা বেসরকারি সম্প্রচারের অনুমতি নিয়েছেন, তাঁদের নাকি এ সম্পর্কে একটি অঙ্গীকার রয়েছে। বাস্তবে ১৯৯৬ সালে প্রণীত বেসরকারি টেলিভিশন-সম্পর্কিত একটি বিধিমালা তৈরি হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত হয়নি বলে জানি। কয়েক মাস আগেও তথ্যমন্ত্রী চূড়ান্ত বিধিমালা প্রস্তুতির ঘোষণা দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বোধ হয় এতদসম্পর্কিত সব তথ্য জানানো হয়নি। আশা করি, বিবিসি সঞ্চালকের প্রশ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা অনুধাবন করতে পেরেছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমে সরকারের নাক গলানো বাইরে আলোচিত হচ্ছে।
বেসরকারি টিভি সম্প্রচারকদের যে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেলা দুইটা ও রাত আটটার খবর প্রচার করতে বলা হবে, সরকারের ‘নাক গলানোর’ এ তথ্যটি আমাদের গণমাধ্যমে আগেই প্রকাশিত হয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর কর্তাব্যক্তিরা এ নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ একটি ‘সমঝোতা’ হয়েছে বলে শুনেছি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কোনো ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ না করে কি পার পাওয়া যায়? অতঃপর রাত আটটায় না হলেও দুপুর দুইটায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব বেসরকারি টেলিভিশন ‘সরকারি’ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন বেলা দুইটায় বিটিভির সংবাদ সম্প্রচারে অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছে। দুইটার সেই সংবাদ শ্রোতা-দর্শক দেখবেন-শুনবেন কি না, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবেন না। মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় কোনো কোনো বেসরকারি চ্যানেলে। এর মধ্যে বিটিভির সংবাদ না হয় একটুখানি জায়গা করে নিল।
তার পরও প্রশ্ন করা যেতে পারে, এ নির্দেশ অথবা একটি ‘কথিত প্রদত্ত অঙ্গীকার’ পালনের জন্য সরকারের আকস্মিক তাগাদা কেন? নির্জলা সত্যটি হচ্ছে, একটি অলিখিত নির্দেশ দিয়ে বিকল্পে অনুরোধ করে অথবা চ্যানেলের লাইসেন্স নেওয়ার সময় একটি প্রতিশ্রুতি পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে ‘বিটিভির সংবাদ কেউ দেখেন না।’ এখন বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে তাই সরকারি কর্মকাণ্ড প্রচারের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাতে চায়। সরাসরি বলতে হয়, ‘বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে সরকার নিজেদের “বস্তুনিষ্ঠ” খবর গেলাতে চায়।’ জনগণ গিলবে কি না, তাদের সে ভাবনা নেই।
আমার তো মনে হয়, ‘সমঝোতার’ একটি ইতিবাচক দিক আছে। দুপুরবেলায় যাঁরা টেলিভিশন দেখেন, তাঁরা এ সময়টুকুতে মধ্যাহ্নভোজের পর্বটি সেরে নিতে পারবেন। অথবা সে সময়টিতে টেলিভিশন বন্ধ রেখে বিদ্যুতের সাশ্রয় করবেন। অবশ্য যেভাবে লোডশেডিংয়ের সময় বাড়ছে, তাতে হয়তো সে প্রয়োজন পড়বে না। পাকিস্তান আমলে পিটিভি সংবাদ প্রচারকালে আমরা যা করতাম, তাও করতে পারে। তখন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র থেকে ‘১০ মিনিট’ উর্দুতে খবর প্রচার করা হতো। যেই মাত্র ঘোষণা হতো ‘ওয়াহিদ কায়সার নদভিসে উর্দুমে খবরে শুনিয়ে’, আমার মেয়ে টেলিভিশন ‘বোবা’ করে দিত। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে অনুরোধ, আটটার খবর প্রচারেও সমঝোতা মেনে নিন। সেই সময় তারা সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচার করায় নৈশভোজ সারতে বিলম্ব হয়। আমার অনুরোধটি গ্রহণ করলে সরকারও খুশি হবে, দর্শকও ‘প্রাইম টাইমে’ কোনো অনুষ্ঠান দেখা থেকে বঞ্চিত না হয়ে নৈশভোজ সেরে ফেলবে। এবার পাঠক যা পড়তে চায় না, সংবাদপত্র যা নিয়ম রক্ষার খাতিরে সরকারি বরাত দিয়ে ছাপে, তা গণমাধ্যমের ওপর চাপানোর অতীতের আরেকটি উদাহরণ দেব।
১৯৬২ সাল, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবাদপত্রে খবর প্রচারে ‘সমঝোতা’ নয়, কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। একই সঙ্গে এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, ‘সরকারি প্রেসনোট ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ ছাপা বাধ্যতামূলক এবং কোনো ধরনের ‘এডিটিং’ অথবা কাটছাঁট না করে পুরো ছাপতে হবে। সাংবাদিক, সম্পাদক ও মালিকদের প্রতিষ্ঠানগুলো মূল অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সমগ্র পাকিস্তানে ১০ দিন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। অতঃপর আইয়ুব সরকার অধ্যাদেশটি সংশোধন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আইয়ুবের নতিস্বীকারের আগে আমি তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার-এর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে একটি মজাদার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। সব সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও নির্দেশাবলি, সরকারি বক্তব্যসংবলিত খবরাদি একনাগাড়ে একটি পৃষ্ঠায় শিরোনামহীন শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের ধারায় ছাপতে থাকলাম। সরকারের ‘ছাপতে বাধ্য’ এমন সব বিজ্ঞপ্তি অথবা প্রেসনোট পৃষ্ঠাব্যাপী একের পর এক শিরোনামহীন ও প্যারাহীনভাবে অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের আকারে ছাপা হলো। সংবাদপত্রের ‘কম্পোজ’কর্মীরা একে বলেন ‘রানিং কম্পোজ’। একটি সংবাদ থেকে অন্যটি আলাদা করা হতো না। সরকারের নির্দেশ পালন করা হলো। পাঠক পড়তে পারল কি না অথবা পড়বে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার।
উপরিউক্ত প্রসঙ্গটি বর্ণনা করলাম সরকারের সঙ্গে আমরা অতীতে কীভাবে ‘সমঝোতা’ কার্যকর করতাম তা বোঝাতে। সাম্প্রতিক ‘সমঝোতা’ অনুসরণে একইভাবে ‘বিটিভির সংবাদটি’ বেসরকারি টেলিভিশনের কক্ষের প্রকৌশলী যদি বিটিভির সংবাদ দ্রুতপঠন-পদ্ধতিতে সম্প্রচার করেন, তাহলে কেমন হয়? দর্শক-শ্রোতাদের পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করছি। আদিতে বিটিভিতে দৃশ্য গ্রহণ ও শব্দ ধারণ ছিল অতি মান্ধাতা আমলের। কোনো অনুষ্ঠান ভিটিআর তথা টেপে ধারণের পর ভিডিও বা সংলাপ কাটছাঁট বা এডিটিং করার কারিগরি পদ্ধতি ছিল না। কোনো নাটক বা গানের অনুষ্ঠানে যদি মাঝখানে কেউ উল্টাপাল্টা সংলাপ বলতেন, তবে ‘ফের বিসমিল্লাহসে’ শুরু করতে হতো। এ জন্য আমি বিটিভির মহাপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে বাইরের যেসব অনুষ্ঠান ওটি ভ্যানে (বাইরের অনুষ্ঠান ধারণের জন্য ব্যবহূত গাড়ি) ভিটিআর করে আনা হতো অথবা যেসব সিনেমা সেন্সর বা কাটছাঁট করে দেখাতে হতো, সে ক্ষেত্রে পুনর্ধারণ এড়ানোর জন্য বিশেষ প্রণালিতে ‘সম্পাদনা’ করতাম। সেগুলোর আপত্তিকর অংশ ‘জার্কিং’ করতাম। অর্থাৎ টেপের সেই অংশটি প্রচারযন্ত্রে গড়গড় করে দ্রুতগতিতে পার করে দেওয়া হতো। দর্শক সংলাপগুলো শুধু ‘করর-করর’ শব্দে শুনত, কথিত দৃশ্যের লাফানো ছবি দেখত।
আশা করি, সরকারি নীতিনির্ধারকেরা আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি বেসরকারি সম্প্রচারকদের বিটিভির বাধ্যতামূলক সংবাদ সম্প্রচারে উপরিউক্ত ‘অপকৌশল প্রয়োগের বদবুদ্ধি দিচ্ছি না’। শুধু সরকারের নীতিনির্ধারকদের ‘সমঝোতাভিত্তিক নির্দেশ’ নিয়ে একটুখানি রসিকতা করলাম। যাকগে, এবার একটুখানি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা যাক। সরকারের তথ্য ‘গেলানোর’ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের জানাচ্ছি, আমাদের কালের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ে সামরিক আইন, জিয়া-এরশাদের ‘প্রেস অ্যাডভাইস’, মানে পরোক্ষ আদেশ মানতে হয়েছে। পেশাজীবনের শেষ সময়ে এসে একই আলামত দেখছি। তাও আবার একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনাদিকালের সংগ্রামী রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সরকারের আমলে। সর্বোপরি কোটি টাকার তথা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি মদদে আরও কয়েকটি নিজস্ব ধারার চ্যানেলের অনুমতি দেওয়ার পরও বিদ্যমান স্বাধীন চ্যানেলে এই আগ্রাসন কেন? আপনজনদের ১২টি সম্প্রচার অনুমতি দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না কেন?
উপরিউক্ত বিষয়ে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো আমার প্রবাসী বন্ধু কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে। আমরা দুজন একমত হলাম, বিদেশি মিডিয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক অনেক খবর বের হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেশ ও সরকার পরিচালনার সাফল্য, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি বিদেশি মিডিয়ায় প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছেন। জাতিসংঘে তাঁর ভাষণ, টাইম ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে দীর্ঘ প্রতিবেদন পড়ে আমরা উভয়ে মোহিত হয়েছি। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, সরকার পরিচালনা ইত্যাদি নিয়ে গণমাধ্যমে গত দেড় বছরে ‘সুসংবাদ’ খুব কমই ছাপা হচ্ছে। এর কারণ কি সরকারের বা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘কর্মকাণ্ড’ বহির্বিশ্বে প্রচারিত সুকর্মের ফিরিস্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়? প্রসঙ্গত বলছি, আমি দু-চারটি বেসরকারি চ্যানেলে মধ্যরাতের সংবাদ পর্যালোচনা করি। পর্যালোচনার শুরুতে সঞ্চালক অনেক পত্রিকার খবরের শিরোনাম পড়েন। এক রাতে চ্যানেল আইয়ের সঞ্চালক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দুঃখ করে বললাম, ‘সবই তো খারাপ খবর, ক্ষমতাসীনদের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অথবা সরকার-পরিচালকদের কারও কারও কীর্তিকাহিনির আলোচনায় যে হাঁপিয়ে উঠলাম।’ পরে অবশ্য একটি ব্যাখ্যা দিলাম। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, দখলদারি-চাঁদাবাজি, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির জন্য হাহাকারের নিচে সরকারের ‘সুকর্মের’ খবরগুলো চাপা পড়ে গেছে।
এখন শুনছি গণমাধ্যমের জন্য ‘নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হবে। চাপা পড়া ‘সুসংবাদ’ বিতরণে ‘সমঝোতা’ হবে। আমাদের সাংবাদিকবান্ধব তথ্যমন্ত্রী সংসদে গণমাধ্যমে ‘অতিরঞ্জিত সংবাদ’ তথাকথিত অপকীর্তির অবারিত মত প্রকাশে ক্ষুব্ধ বিব্রত সাংসদদের এ আশ্বাসটি দিয়েছেন। আশঙ্কা হচ্ছে, অতীতের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের এর আগে অগণতান্ত্রিক সরকার আরোপিত প্রণালিগুলো কি নীতিমালার রূপ ধরে ফিরে আসছে? মাননীয় তথ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা, ‘কোন বন্ধনে জড়াবেন গো, বন্ধু!’ সামরিক শাসনামলে ছিল সরাসরি ‘সেন্সরশিপ’ তথা নিষেধাজ্ঞা। সেনাশাসক জিয়া-এরশাদ আমলে নতুন নামকরণ হলো ‘প্রেস অ্যাডভাইস’। এর মানে এ খবরটি না ছাপলে অথবা অমুক বিষয়ে মন্তব্য না করার ‘পরামর্শ’ দেওয়া হলো। মানলে ভালো, না মানলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা যথাসময়ে টের পাবেন। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সরাসরি গণমাধ্যমের ওপর প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অনুচিত হবে। আবার হয়তো কোনো একসময় আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিবিসির কোনো সঞ্চালক গণমাধ্যমের নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে পারেন।
আগেই বলেছি, বন্ধু গাফ্ফারের সঙ্গে সমঝোতার অছিলায় ‘গণমাধ্যমে আগ্রাসন’ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি আমার সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করে বললেন, ‘বন্ধু, আমার দীর্ঘ সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতা হলো, একটি সরকার যখন গণমাধ্যম নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাথা ঘামায় অথবা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তখন বুঝতে হবে তারা দিশেহারা অর্থাৎ “নার্ভাস” হয়ে পড়েছে। তবে একটি ইতিবাচক দিকও আছে। গণমাধ্যম সরকারে টনক নাড়িয়েছে, এ সত্যটি প্রতিভাত হয়েছে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
বেসরকারি টিভি সম্প্রচারকদের যে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বেলা দুইটা ও রাত আটটার খবর প্রচার করতে বলা হবে, সরকারের ‘নাক গলানোর’ এ তথ্যটি আমাদের গণমাধ্যমে আগেই প্রকাশিত হয়েছে। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোর কর্তাব্যক্তিরা এ নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সর্বশেষ একটি ‘সমঝোতা’ হয়েছে বলে শুনেছি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কোনো ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ না করে কি পার পাওয়া যায়? অতঃপর রাত আটটায় না হলেও দুপুর দুইটায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব বেসরকারি টেলিভিশন ‘সরকারি’ হয়ে যাবে। এরই মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন বেলা দুইটায় বিটিভির সংবাদ সম্প্রচারে অনুরোধের ঢেঁকি গিলেছে। দুইটার সেই সংবাদ শ্রোতা-দর্শক দেখবেন-শুনবেন কি না, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবেন না। মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় কোনো কোনো বেসরকারি চ্যানেলে। এর মধ্যে বিটিভির সংবাদ না হয় একটুখানি জায়গা করে নিল।
তার পরও প্রশ্ন করা যেতে পারে, এ নির্দেশ অথবা একটি ‘কথিত প্রদত্ত অঙ্গীকার’ পালনের জন্য সরকারের আকস্মিক তাগাদা কেন? নির্জলা সত্যটি হচ্ছে, একটি অলিখিত নির্দেশ দিয়ে বিকল্পে অনুরোধ করে অথবা চ্যানেলের লাইসেন্স নেওয়ার সময় একটি প্রতিশ্রুতি পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সরকার স্বীকার করে নিয়েছে যে ‘বিটিভির সংবাদ কেউ দেখেন না।’ এখন বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে তাই সরকারি কর্মকাণ্ড প্রচারের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাতে চায়। সরাসরি বলতে হয়, ‘বেসরকারি সম্প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে সরকার নিজেদের “বস্তুনিষ্ঠ” খবর গেলাতে চায়।’ জনগণ গিলবে কি না, তাদের সে ভাবনা নেই।
আমার তো মনে হয়, ‘সমঝোতার’ একটি ইতিবাচক দিক আছে। দুপুরবেলায় যাঁরা টেলিভিশন দেখেন, তাঁরা এ সময়টুকুতে মধ্যাহ্নভোজের পর্বটি সেরে নিতে পারবেন। অথবা সে সময়টিতে টেলিভিশন বন্ধ রেখে বিদ্যুতের সাশ্রয় করবেন। অবশ্য যেভাবে লোডশেডিংয়ের সময় বাড়ছে, তাতে হয়তো সে প্রয়োজন পড়বে না। পাকিস্তান আমলে পিটিভি সংবাদ প্রচারকালে আমরা যা করতাম, তাও করতে পারে। তখন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্র থেকে ‘১০ মিনিট’ উর্দুতে খবর প্রচার করা হতো। যেই মাত্র ঘোষণা হতো ‘ওয়াহিদ কায়সার নদভিসে উর্দুমে খবরে শুনিয়ে’, আমার মেয়ে টেলিভিশন ‘বোবা’ করে দিত। বেসরকারি টেলিভিশনগুলোকে অনুরোধ, আটটার খবর প্রচারেও সমঝোতা মেনে নিন। সেই সময় তারা সব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচার করায় নৈশভোজ সারতে বিলম্ব হয়। আমার অনুরোধটি গ্রহণ করলে সরকারও খুশি হবে, দর্শকও ‘প্রাইম টাইমে’ কোনো অনুষ্ঠান দেখা থেকে বঞ্চিত না হয়ে নৈশভোজ সেরে ফেলবে। এবার পাঠক যা পড়তে চায় না, সংবাদপত্র যা নিয়ম রক্ষার খাতিরে সরকারি বরাত দিয়ে ছাপে, তা গণমাধ্যমের ওপর চাপানোর অতীতের আরেকটি উদাহরণ দেব।
১৯৬২ সাল, স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবাদপত্রে খবর প্রচারে ‘সমঝোতা’ নয়, কতিপয় বিধিনিষেধ আরোপ করেছিলেন। একই সঙ্গে এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, ‘সরকারি প্রেসনোট ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’ ছাপা বাধ্যতামূলক এবং কোনো ধরনের ‘এডিটিং’ অথবা কাটছাঁট না করে পুরো ছাপতে হবে। সাংবাদিক, সম্পাদক ও মালিকদের প্রতিষ্ঠানগুলো মূল অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সমগ্র পাকিস্তানে ১০ দিন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। অতঃপর আইয়ুব সরকার অধ্যাদেশটি সংশোধন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আইয়ুবের নতিস্বীকারের আগে আমি তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার-এর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে একটি মজাদার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। সব সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ও নির্দেশাবলি, সরকারি বক্তব্যসংবলিত খবরাদি একনাগাড়ে একটি পৃষ্ঠায় শিরোনামহীন শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের ধারায় ছাপতে থাকলাম। সরকারের ‘ছাপতে বাধ্য’ এমন সব বিজ্ঞপ্তি অথবা প্রেসনোট পৃষ্ঠাব্যাপী একের পর এক শিরোনামহীন ও প্যারাহীনভাবে অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের আকারে ছাপা হলো। সংবাদপত্রের ‘কম্পোজ’কর্মীরা একে বলেন ‘রানিং কম্পোজ’। একটি সংবাদ থেকে অন্যটি আলাদা করা হতো না। সরকারের নির্দেশ পালন করা হলো। পাঠক পড়তে পারল কি না অথবা পড়বে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার।
উপরিউক্ত প্রসঙ্গটি বর্ণনা করলাম সরকারের সঙ্গে আমরা অতীতে কীভাবে ‘সমঝোতা’ কার্যকর করতাম তা বোঝাতে। সাম্প্রতিক ‘সমঝোতা’ অনুসরণে একইভাবে ‘বিটিভির সংবাদটি’ বেসরকারি টেলিভিশনের কক্ষের প্রকৌশলী যদি বিটিভির সংবাদ দ্রুতপঠন-পদ্ধতিতে সম্প্রচার করেন, তাহলে কেমন হয়? দর্শক-শ্রোতাদের পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করছি। আদিতে বিটিভিতে দৃশ্য গ্রহণ ও শব্দ ধারণ ছিল অতি মান্ধাতা আমলের। কোনো অনুষ্ঠান ভিটিআর তথা টেপে ধারণের পর ভিডিও বা সংলাপ কাটছাঁট বা এডিটিং করার কারিগরি পদ্ধতি ছিল না। কোনো নাটক বা গানের অনুষ্ঠানে যদি মাঝখানে কেউ উল্টাপাল্টা সংলাপ বলতেন, তবে ‘ফের বিসমিল্লাহসে’ শুরু করতে হতো। এ জন্য আমি বিটিভির মহাপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালে বাইরের যেসব অনুষ্ঠান ওটি ভ্যানে (বাইরের অনুষ্ঠান ধারণের জন্য ব্যবহূত গাড়ি) ভিটিআর করে আনা হতো অথবা যেসব সিনেমা সেন্সর বা কাটছাঁট করে দেখাতে হতো, সে ক্ষেত্রে পুনর্ধারণ এড়ানোর জন্য বিশেষ প্রণালিতে ‘সম্পাদনা’ করতাম। সেগুলোর আপত্তিকর অংশ ‘জার্কিং’ করতাম। অর্থাৎ টেপের সেই অংশটি প্রচারযন্ত্রে গড়গড় করে দ্রুতগতিতে পার করে দেওয়া হতো। দর্শক সংলাপগুলো শুধু ‘করর-করর’ শব্দে শুনত, কথিত দৃশ্যের লাফানো ছবি দেখত।
আশা করি, সরকারি নীতিনির্ধারকেরা আমায় ভুল বুঝবেন না। আমি বেসরকারি সম্প্রচারকদের বিটিভির বাধ্যতামূলক সংবাদ সম্প্রচারে উপরিউক্ত ‘অপকৌশল প্রয়োগের বদবুদ্ধি দিচ্ছি না’। শুধু সরকারের নীতিনির্ধারকদের ‘সমঝোতাভিত্তিক নির্দেশ’ নিয়ে একটুখানি রসিকতা করলাম। যাকগে, এবার একটুখানি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা যাক। সরকারের তথ্য ‘গেলানোর’ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের জানাচ্ছি, আমাদের কালের দুই-তৃতীয়াংশ সময়ে সামরিক আইন, জিয়া-এরশাদের ‘প্রেস অ্যাডভাইস’, মানে পরোক্ষ আদেশ মানতে হয়েছে। পেশাজীবনের শেষ সময়ে এসে একই আলামত দেখছি। তাও আবার একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনাদিকালের সংগ্রামী রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সরকারের আমলে। সর্বোপরি কোটি টাকার তথা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি মদদে আরও কয়েকটি নিজস্ব ধারার চ্যানেলের অনুমতি দেওয়ার পরও বিদ্যমান স্বাধীন চ্যানেলে এই আগ্রাসন কেন? আপনজনদের ১২টি সম্প্রচার অনুমতি দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না কেন?
উপরিউক্ত বিষয়ে টেলিফোনে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হলো আমার প্রবাসী বন্ধু কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সঙ্গে। আমরা দুজন একমত হলাম, বিদেশি মিডিয়ায় বর্তমানে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক অনেক খবর বের হচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেশ ও সরকার পরিচালনার সাফল্য, বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি বিদেশি মিডিয়ায় প্রশংসিত হচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়েছেন। জাতিসংঘে তাঁর ভাষণ, টাইম ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এ প্রকাশিত বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে দীর্ঘ প্রতিবেদন পড়ে আমরা উভয়ে মোহিত হয়েছি। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, সরকার পরিচালনা ইত্যাদি নিয়ে গণমাধ্যমে গত দেড় বছরে ‘সুসংবাদ’ খুব কমই ছাপা হচ্ছে। এর কারণ কি সরকারের বা সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ‘কর্মকাণ্ড’ বহির্বিশ্বে প্রচারিত সুকর্মের ফিরিস্তির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়? প্রসঙ্গত বলছি, আমি দু-চারটি বেসরকারি চ্যানেলে মধ্যরাতের সংবাদ পর্যালোচনা করি। পর্যালোচনার শুরুতে সঞ্চালক অনেক পত্রিকার খবরের শিরোনাম পড়েন। এক রাতে চ্যানেল আইয়ের সঞ্চালক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দুঃখ করে বললাম, ‘সবই তো খারাপ খবর, ক্ষমতাসীনদের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অথবা সরকার-পরিচালকদের কারও কারও কীর্তিকাহিনির আলোচনায় যে হাঁপিয়ে উঠলাম।’ পরে অবশ্য একটি ব্যাখ্যা দিলাম। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, দখলদারি-চাঁদাবাজি, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির জন্য হাহাকারের নিচে সরকারের ‘সুকর্মের’ খবরগুলো চাপা পড়ে গেছে।
এখন শুনছি গণমাধ্যমের জন্য ‘নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হবে। চাপা পড়া ‘সুসংবাদ’ বিতরণে ‘সমঝোতা’ হবে। আমাদের সাংবাদিকবান্ধব তথ্যমন্ত্রী সংসদে গণমাধ্যমে ‘অতিরঞ্জিত সংবাদ’ তথাকথিত অপকীর্তির অবারিত মত প্রকাশে ক্ষুব্ধ বিব্রত সাংসদদের এ আশ্বাসটি দিয়েছেন। আশঙ্কা হচ্ছে, অতীতের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের এর আগে অগণতান্ত্রিক সরকার আরোপিত প্রণালিগুলো কি নীতিমালার রূপ ধরে ফিরে আসছে? মাননীয় তথ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা, ‘কোন বন্ধনে জড়াবেন গো, বন্ধু!’ সামরিক শাসনামলে ছিল সরাসরি ‘সেন্সরশিপ’ তথা নিষেধাজ্ঞা। সেনাশাসক জিয়া-এরশাদ আমলে নতুন নামকরণ হলো ‘প্রেস অ্যাডভাইস’। এর মানে এ খবরটি না ছাপলে অথবা অমুক বিষয়ে মন্তব্য না করার ‘পরামর্শ’ দেওয়া হলো। মানলে ভালো, না মানলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা যথাসময়ে টের পাবেন। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সরাসরি গণমাধ্যমের ওপর প্রকাশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অনুচিত হবে। আবার হয়তো কোনো একসময় আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে বিবিসির কোনো সঞ্চালক গণমাধ্যমের নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন করে বিব্রত করতে পারেন।
আগেই বলেছি, বন্ধু গাফ্ফারের সঙ্গে সমঝোতার অছিলায় ‘গণমাধ্যমে আগ্রাসন’ নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি আমার সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করে বললেন, ‘বন্ধু, আমার দীর্ঘ সাংবাদিকজীবনের অভিজ্ঞতা হলো, একটি সরকার যখন গণমাধ্যম নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত মাথা ঘামায় অথবা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, তখন বুঝতে হবে তারা দিশেহারা অর্থাৎ “নার্ভাস” হয়ে পড়েছে। তবে একটি ইতিবাচক দিকও আছে। গণমাধ্যম সরকারে টনক নাড়িয়েছে, এ সত্যটি প্রতিভাত হয়েছে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments