নদীর কান্না আমরা শুনতে পাই না by আহমদ রফিক
আপাত গুরুত্বহীন একটি সংবাদ শিরোনাম ‘আবার নদী দখল, বালুর ব্যবসা’। সচিত্র এ প্রতিবেদনে জানা গেছে, ‘কাঁচপুর সেতু এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী দখল ও ভরাট করে তৈরি ১০ একর জায়গায় আবার বালু ও পাথর ব্যবসা শুরু হয়েছে।...বছর দেড়েক আগে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ জায়গাটি উদ্ধার করেছিল।’ সে নদী এখন আবার বেদখল হয়ে দুর্বৃত্তদের হাতে বন্দী। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বিত্তের প্রভাব এসব দুর্ঘটনার পেছনে কাজ করে।
শুধু শীতলক্ষ্যা নয়, বুড়িগঙ্গা ও এর শাখানদীসহ বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে দুর্বল স্রোতের নদীগুলো দুর্বৃত্তদের লোভ-লালসার শিকার। ফলে নদীর ছোটখাটো শাখা বা সংলগ্ন খাল-বিল ভরাট হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, এমনকি বহুতল ভবনরূপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নদী তো বটেই, রাজধানীর জলাশয় ও হ্রদ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বছর কয়েক আগে গুলশান লেক ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে জমজমাট বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্যার সুরাহা হয়নি। গুলশান হ্রদের একাংশ তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। এ ধরনের অনাচার অব্যাহত ধারায় চলছে। বলা যায়, প্রতিকারহীন অপরাধ।
বিভিন্ন সময় কাগজে এ-জাতীয় খবর পড়তে পড়তে মনে এল একটি গানের পঙিক্ত, ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা’। একসময় পাগলপারা নদীর স্বচ্ছন্দ স্রোত ছিল নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ। একদা উচ্চারিত, ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ’ কথাগুলো এখন কিছুটা হলেও উপহাসের মতো শোনাবে। অথচ আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে বড় বড় নদীগুলোয় চরের উপস্থিতি সত্ত্বেও জলস্রোত ছিল যথেষ্ট সচল। দুরন্ত পদ্মা, গভীর স্রোতে মেঘনা-যমুনা তখনো স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় মেঘনার ধসনামা পাড়ে দাঁড়ালে ওপারটা আবছা নীলাভ দিগন্তরেখার মতো দেখা যেত। বোঝা যেত না ওপারের অস্তিত্ব। ছোট নদী হলেও খরস্রোতা মধুমতী ছিল আকর্ষণীয়। পাড়ভাঙা ধলেশ্বরীই বা কম কিসে? বাঁকফেরা শীর্ণ নাগর নদেও বৈশাখী গ্রীষ্মে ‘হাঁটুজল থেকেছে’। এখন তার বুকে বৈশাখে ফুটিফাটা হেঁটে পার হওয়া যায়। যেমন—কুষ্টিয়ার গড়াই নদী। আর চরে চরে দুস্থ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার স্রোত।
শুধু বাণিজ্যবন্দর নয়, নদীর পরিবহন দক্ষতা ও নাব্যতা একদিক থেকে দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করেছে। জমিদারি চালে ধীরেসুস্থে চলা মহাজনি নৌকা, দ্রুতবেগে চলা জেলে ডিঙি এবং ছোট-বড় স্টিমার ও লঞ্চ নিয়ে নদীর বা জলস্রোতের আগেকার গর্বিত চেহারা অনেকটাই নেই। অনেক নদীতীরে জেলেপাড়ার মানুষগুলো আর্থিক কষ্টের দরুন জীবিকা বদল করেছে। অর্থাৎ অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পিতা-পিতামহদের জীবিকা ছেড়ে সবাই খুব যে ভালো আছে, তা নয়।
ভাটির নদী অনেক সময়ই উজানি অত্যাচারের শিকার। সেসবের সমাধান সহজ নয়। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের চাপ সাধারণত নদীর নিজস্ব নিয়মে সুসহ হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের স্বার্থপ্রসূত অত্যাচার এমনই যে, তা নদীর অস্তিত্বে আঘাত করে, বিশেষ করে ছোট ও দুর্বল নদীর ক্ষেত্রে। বেশ কিছুকাল থেকে নদী ও পরিবেশের ওপর মানুষের তৈরি উপদ্রব জলস্রোতের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। যেমন, পাড়ঘেঁষে নদী দখল, নদী ভরাট, জলস্রোত বয়ে আনা খাল আর বিল ভরাট।
এসবই জলদস্যু, ভূমিদস্যুদের স্বার্থপর কারসাজি, তাই দেশের খাল-বিল নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা গ্রাম-নগরের নানান জায়গায়। বাদ ছিল না রাজধানী ঢাকাও। ঢাকার বদ্ধজল টেনে নদীতে নিয়ে যেত যে ধোলাই খাল, এক সামরিক রাষ্ট্রপতির তুঘলকি নির্দেশে সে খাল কংক্রিটে চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেছে। বিশাল চলনবিল এখন আর জলাধার নয়। অথচ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে সচল নদী ও খাল-বিলের উপস্থিতি জরুরি। আমাদের সামাজিক প্রবণতা বুঝি নিজ স্বার্থে পরিবেশদূষণ, পরিবেশের বিনাশ, সুস্থকে অসুস্থ, দুস্থকে অধিকতর দুস্থ করে তোলা।
ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপর চাপ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এবং তা রাজধানী শহরের সংলগ্ন বলে। এখানে জমির বিনিময়মূল্য সর্বোচ্চ। একবার বুড়িগঙ্গায় ভেসে দেখে আসুন, এপাশ থেকে ওপাশ। দেখবেন, কত টং, কত মাচা, কত টিনের চালা, আরও কত কী। দুর্বৃত্তদের থাবায় নদী ক্রমশ শীর্ণ হতে চলেছে। কান পাতলে শোনা যাবে, জলস্রোতের চাপাকান্না। এ কান্না অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে।
কিছুদিন আগে বুড়িগঙ্গায় অবৈধ দখল ও স্থাপনা থেকে বুড়িগঙ্গাকে মুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছিল বেশ জোরেশোরে, মূলত সরকারি সদিচ্ছায়। কিন্তু তা পুরোপুরি সফল হয়নি, অনেকটা ওই কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যার মতোই। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন তাদের পরোক্ষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে কাজটা কর্তৃপক্ষের জন্য সহজ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের আশা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে দেখিনি।
কারণ সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে অনেক সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক শক্তি এঁটে উঠতে পারে না, সদিচ্ছা তখন পিছু হটে। তাই আমার বিশ্বাস, সমাজের পরিবর্তন এবং তাতে সুস্থ মূল্যবোধের বিকাশ সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু সে কাজ সহজ নয় এবং তা সময়সাপেক্ষ। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের সুবুদ্ধি ও সমাজের সচেতন অংশের সমর্থন ও সহায়তা জলাবদ্ধতার কারণ দূর করার সফল সূচনা ঘটাতে পারে।
ঢাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের মনে থাকার কথা, একসময় এই ঢাকা শহরে ধোলাই খালই নয়, কথিত নতুন ঢাকায় পুকুরের কথা, প্রতিটি পাড়ায় দু-তিনটি করে পুকুর, যেগুলো বাড়তি পানি ধরে রাখতে সাহায্য করত, সেসব এখন উধাও। এর দায় অবশ্য কোনো সরকারের নয়, ব্যক্তিমালিকদের; তাদের প্রয়োজনের টানে হারিয়ে গেছে সেসব জলাশয়। পরবর্তী সময় ঢাকা নগর প্লাবিত হওয়া, ভেসে যাওয়ার ঘটনা এবং নগরবাসীর দুর্ভোগ আমাদের মনে থাকার কথা। স্বীকার করতে হয়, ঢাকার চারদিকে বেড়িবাঁধ দেওয়া না হলে ঢাকার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! তখন হয়তো সচেতন নগরবাসী বুঝতে পারতেন, নদীর নাব্যতা, তার জলটানার ক্ষমতা এবং খাল-বিল ও জলাধারগুলোর গুরুত্ব কতটা। তার কিছুটা বুঝে নেওয়া এখনকার পরিস্থিতিতেও সম্ভব।
আজকে যে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে, যখন-তখন বর্ষায় শহরতলি ডুবে যাচ্ছে, ময়লার পচা গন্ধে এবং দূষিত পানির কারণে জীবনযাত্রা যে অসহনীয় হয়ে উঠছে, এর সচিত্র প্রতিবেদন মাঝেমধ্যে আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাই। দেখে উদ্বিগ্ন হই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাতে টনক নড়ে না। আমরা জানি, এর বাস্তব সমাধান মোটেই সহজ নয়। দীর্ঘ সময়ের অবহেলা ও অনাচার এ দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। পরিবেশগত স্বাস্থ্যরক্ষা ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তির কাজ যেখান থেকেই হোক শুরু করতে হবে। নগরের পুকুর ভরাট বন্ধ করতে না পারা গেলেও খাল-বিল ভরাট বন্ধ করার চেষ্টা শুরু করতে তো কোনো বাধা নেই; অসুবিধাজনক হলেও অসম্ভব নয়, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বাড়ানো এবং জলস্রোতের স্বচ্ছন্দ গতি অক্ষুণ্ন রাখার কাজ হাতে নেওয়া। গ্রামের ভরাট খালগুলো সংস্কার করে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত পানি ধারণের জলাধারগুলোকে স্বাভাবিক করা এবং নতুন করে তেমন জলাধার তৈরির কাজ হাতে নেওয়া।
কিন্তু সবচেয়ে বড় দরকার নদীর ওপর অত্যাচার বন্ধ করা এবং অবৈধ দখলদারি ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা। এ কাজটাতে সদিচ্ছা এবং দৃঢ় ও নিরপেক্ষ মানসিকতার প্রয়োজন। দিন কয়েক আগের একটি সংবাদ প্রতিবেদন পড়ে কিছুটা হলেও স্বস্তির আভাস মিলেছে। খবরে প্রকাশ, ‘সংসদে পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল অনুমোদন এবং সেই সূত্রে জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সুখবর, তবে তা কতটা কার্যকর করা যাবে, সেটাই বড় কথা।
কারণ আমাদের আইনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর তা বাস্তবায়নে অনেক ফারাক। আইন হলেই যদি সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে গ্রামাঞ্চলে তথা মফস্বলে (মফস্বল কথাটাতে কারও কারও আপত্তি, চিঠিতে তা প্রকাশ পেয়েছিল) ফতোয়াবাজি বন্ধ হয়ে যেত হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তা হয়নি এবং নির্বাহী তথা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রকার সদিচ্ছা দেখায়নি। তাই এখনো ফতোয়াবাজি, দোররা এবং একতরফাভাবে নারীর ওপর অন্যায় ও অনধিকারমূলক গ্রাম্য শাস্তির খবর আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পাই।
ওই প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ওই আইনে জলাধার সংরক্ষণ অর্থাৎ জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ করা ছাড়াও পরিবেশ রক্ষার জন্য পাহাড় কাটার ওপরও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এ বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি, পাহাড় কাটার ধুম, সমাজবিরোধীদের অন্যায় লোভ-লালসার প্রকাশ এবং পাহাড় ও টিলা কাটার কারণে ধস, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর। ঢালের অসহায় বাসিন্দাদের প্রতিবাদ কোনো কাজে আসেনি। তাই আমরা আশা করব, এ আইন দ্রুত কাজে লাগানো হবে।
আর এ উপলক্ষে আমরা বলব, বুড়িগঙ্গাসহ শীতলক্ষ্যা এবং অন্যান্য নদীর ওপর দখলদারি ও অবৈধ স্থাপনা স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। প্রধানমন্ত্রী এই কদিন হলো বাংলাদেশের পক্ষে ‘এমডিজি’ পুরস্কার নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরেছেন। নদীর অপমৃত্যু রোধ, নদীর সুস্বাস্থ্য রক্ষার কাজ জাতীয় পরিসরে একই রকম জরুরি। নদীর অপমৃত্যু জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। ব্যক্তির লোভ ও স্বার্থে নদীর এ বলিদান কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু সমাজমনস্ক ব্যক্তিই নন, গোটা জাতিকে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।
সবশেষে তাই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যাসহ সব নদীর বুকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদীকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা জানি, এর আগেকার শাসনামলে এক প্রতিমন্ত্রীর বুড়িগঙ্গার এক শীর্ণ শাখা দখলে নেওয়ার দুর্বুদ্ধির কথা, যে ঘটনার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রসহ সর্বত্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুস্থ মানবিক হস্তক্ষেপে ওই দুর্দান্ত ক্ষমতাবান ব্যক্তিটির লালসা ঠেকানো সম্ভব হয়। তাই ঘটনা ও জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক স্বার্থ রক্ষার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী যেন জরুরিভিত্তিতে উল্লিখিত বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেন। আমরা অপেক্ষায় আছি, নদীর কন্না বন্ধ করার উদ্যোগের পরিণাম দেখার জন্য।
আহমদ রফিক: প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক।
শুধু শীতলক্ষ্যা নয়, বুড়িগঙ্গা ও এর শাখানদীসহ বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে দুর্বল স্রোতের নদীগুলো দুর্বৃত্তদের লোভ-লালসার শিকার। ফলে নদীর ছোটখাটো শাখা বা সংলগ্ন খাল-বিল ভরাট হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র, এমনকি বহুতল ভবনরূপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। নদী তো বটেই, রাজধানীর জলাশয় ও হ্রদ তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বছর কয়েক আগে গুলশান লেক ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে জমজমাট বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্যার সুরাহা হয়নি। গুলশান হ্রদের একাংশ তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। এ ধরনের অনাচার অব্যাহত ধারায় চলছে। বলা যায়, প্রতিকারহীন অপরাধ।
বিভিন্ন সময় কাগজে এ-জাতীয় খবর পড়তে পড়তে মনে এল একটি গানের পঙিক্ত, ‘নদী আপন বেগে পাগলপারা’। একসময় পাগলপারা নদীর স্বচ্ছন্দ স্রোত ছিল নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাণ। একদা উচ্চারিত, ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশ’ কথাগুলো এখন কিছুটা হলেও উপহাসের মতো শোনাবে। অথচ আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে বড় বড় নদীগুলোয় চরের উপস্থিতি সত্ত্বেও জলস্রোত ছিল যথেষ্ট সচল। দুরন্ত পদ্মা, গভীর স্রোতে মেঘনা-যমুনা তখনো স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত।
মনে পড়ে, ছোটবেলায় মেঘনার ধসনামা পাড়ে দাঁড়ালে ওপারটা আবছা নীলাভ দিগন্তরেখার মতো দেখা যেত। বোঝা যেত না ওপারের অস্তিত্ব। ছোট নদী হলেও খরস্রোতা মধুমতী ছিল আকর্ষণীয়। পাড়ভাঙা ধলেশ্বরীই বা কম কিসে? বাঁকফেরা শীর্ণ নাগর নদেও বৈশাখী গ্রীষ্মে ‘হাঁটুজল থেকেছে’। এখন তার বুকে বৈশাখে ফুটিফাটা হেঁটে পার হওয়া যায়। যেমন—কুষ্টিয়ার গড়াই নদী। আর চরে চরে দুস্থ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার স্রোত।
শুধু বাণিজ্যবন্দর নয়, নদীর পরিবহন দক্ষতা ও নাব্যতা একদিক থেকে দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করেছে। জমিদারি চালে ধীরেসুস্থে চলা মহাজনি নৌকা, দ্রুতবেগে চলা জেলে ডিঙি এবং ছোট-বড় স্টিমার ও লঞ্চ নিয়ে নদীর বা জলস্রোতের আগেকার গর্বিত চেহারা অনেকটাই নেই। অনেক নদীতীরে জেলেপাড়ার মানুষগুলো আর্থিক কষ্টের দরুন জীবিকা বদল করেছে। অর্থাৎ অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পিতা-পিতামহদের জীবিকা ছেড়ে সবাই খুব যে ভালো আছে, তা নয়।
ভাটির নদী অনেক সময়ই উজানি অত্যাচারের শিকার। সেসবের সমাধান সহজ নয়। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের চাপ সাধারণত নদীর নিজস্ব নিয়মে সুসহ হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের স্বার্থপ্রসূত অত্যাচার এমনই যে, তা নদীর অস্তিত্বে আঘাত করে, বিশেষ করে ছোট ও দুর্বল নদীর ক্ষেত্রে। বেশ কিছুকাল থেকে নদী ও পরিবেশের ওপর মানুষের তৈরি উপদ্রব জলস্রোতের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। যেমন, পাড়ঘেঁষে নদী দখল, নদী ভরাট, জলস্রোত বয়ে আনা খাল আর বিল ভরাট।
এসবই জলদস্যু, ভূমিদস্যুদের স্বার্থপর কারসাজি, তাই দেশের খাল-বিল নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা গ্রাম-নগরের নানান জায়গায়। বাদ ছিল না রাজধানী ঢাকাও। ঢাকার বদ্ধজল টেনে নদীতে নিয়ে যেত যে ধোলাই খাল, এক সামরিক রাষ্ট্রপতির তুঘলকি নির্দেশে সে খাল কংক্রিটে চাপা পড়ে শেষ হয়ে গেছে। বিশাল চলনবিল এখন আর জলাধার নয়। অথচ স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে সচল নদী ও খাল-বিলের উপস্থিতি জরুরি। আমাদের সামাজিক প্রবণতা বুঝি নিজ স্বার্থে পরিবেশদূষণ, পরিবেশের বিনাশ, সুস্থকে অসুস্থ, দুস্থকে অধিকতর দুস্থ করে তোলা।
ঢাকার বুড়িগঙ্গার ওপর চাপ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি এবং তা রাজধানী শহরের সংলগ্ন বলে। এখানে জমির বিনিময়মূল্য সর্বোচ্চ। একবার বুড়িগঙ্গায় ভেসে দেখে আসুন, এপাশ থেকে ওপাশ। দেখবেন, কত টং, কত মাচা, কত টিনের চালা, আরও কত কী। দুর্বৃত্তদের থাবায় নদী ক্রমশ শীর্ণ হতে চলেছে। কান পাতলে শোনা যাবে, জলস্রোতের চাপাকান্না। এ কান্না অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে।
কিছুদিন আগে বুড়িগঙ্গায় অবৈধ দখল ও স্থাপনা থেকে বুড়িগঙ্গাকে মুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছিল বেশ জোরেশোরে, মূলত সরকারি সদিচ্ছায়। কিন্তু তা পুরোপুরি সফল হয়নি, অনেকটা ওই কাঁচপুরে শীতলক্ষ্যার মতোই। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্র ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন তাদের পরোক্ষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, যাতে কাজটা কর্তৃপক্ষের জন্য সহজ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের আশা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে দেখিনি।
কারণ সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে অনেক সময় রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক শক্তি এঁটে উঠতে পারে না, সদিচ্ছা তখন পিছু হটে। তাই আমার বিশ্বাস, সমাজের পরিবর্তন এবং তাতে সুস্থ মূল্যবোধের বিকাশ সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু সে কাজ সহজ নয় এবং তা সময়সাপেক্ষ। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের সুবুদ্ধি ও সমাজের সচেতন অংশের সমর্থন ও সহায়তা জলাবদ্ধতার কারণ দূর করার সফল সূচনা ঘটাতে পারে।
ঢাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের মনে থাকার কথা, একসময় এই ঢাকা শহরে ধোলাই খালই নয়, কথিত নতুন ঢাকায় পুকুরের কথা, প্রতিটি পাড়ায় দু-তিনটি করে পুকুর, যেগুলো বাড়তি পানি ধরে রাখতে সাহায্য করত, সেসব এখন উধাও। এর দায় অবশ্য কোনো সরকারের নয়, ব্যক্তিমালিকদের; তাদের প্রয়োজনের টানে হারিয়ে গেছে সেসব জলাশয়। পরবর্তী সময় ঢাকা নগর প্লাবিত হওয়া, ভেসে যাওয়ার ঘটনা এবং নগরবাসীর দুর্ভোগ আমাদের মনে থাকার কথা। স্বীকার করতে হয়, ঢাকার চারদিকে বেড়িবাঁধ দেওয়া না হলে ঢাকার অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! তখন হয়তো সচেতন নগরবাসী বুঝতে পারতেন, নদীর নাব্যতা, তার জলটানার ক্ষমতা এবং খাল-বিল ও জলাধারগুলোর গুরুত্ব কতটা। তার কিছুটা বুঝে নেওয়া এখনকার পরিস্থিতিতেও সম্ভব।
আজকে যে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে, যখন-তখন বর্ষায় শহরতলি ডুবে যাচ্ছে, ময়লার পচা গন্ধে এবং দূষিত পানির কারণে জীবনযাত্রা যে অসহনীয় হয়ে উঠছে, এর সচিত্র প্রতিবেদন মাঝেমধ্যে আমরা সংবাদপত্রে দেখতে পাই। দেখে উদ্বিগ্ন হই, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তাতে টনক নড়ে না। আমরা জানি, এর বাস্তব সমাধান মোটেই সহজ নয়। দীর্ঘ সময়ের অবহেলা ও অনাচার এ দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। পরিবেশগত স্বাস্থ্যরক্ষা ও দুর্ভোগ থেকে মুক্তির কাজ যেখান থেকেই হোক শুরু করতে হবে। নগরের পুকুর ভরাট বন্ধ করতে না পারা গেলেও খাল-বিল ভরাট বন্ধ করার চেষ্টা শুরু করতে তো কোনো বাধা নেই; অসুবিধাজনক হলেও অসম্ভব নয়, ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বাড়ানো এবং জলস্রোতের স্বচ্ছন্দ গতি অক্ষুণ্ন রাখার কাজ হাতে নেওয়া। গ্রামের ভরাট খালগুলো সংস্কার করে পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত পানি ধারণের জলাধারগুলোকে স্বাভাবিক করা এবং নতুন করে তেমন জলাধার তৈরির কাজ হাতে নেওয়া।
কিন্তু সবচেয়ে বড় দরকার নদীর ওপর অত্যাচার বন্ধ করা এবং অবৈধ দখলদারি ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা। এ কাজটাতে সদিচ্ছা এবং দৃঢ় ও নিরপেক্ষ মানসিকতার প্রয়োজন। দিন কয়েক আগের একটি সংবাদ প্রতিবেদন পড়ে কিছুটা হলেও স্বস্তির আভাস মিলেছে। খবরে প্রকাশ, ‘সংসদে পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল অনুমোদন এবং সেই সূত্রে জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ’ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা সুখবর, তবে তা কতটা কার্যকর করা যাবে, সেটাই বড় কথা।
কারণ আমাদের আইনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর তা বাস্তবায়নে অনেক ফারাক। আইন হলেই যদি সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে গ্রামাঞ্চলে তথা মফস্বলে (মফস্বল কথাটাতে কারও কারও আপত্তি, চিঠিতে তা প্রকাশ পেয়েছিল) ফতোয়াবাজি বন্ধ হয়ে যেত হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তা হয়নি এবং নির্বাহী তথা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রকার সদিচ্ছা দেখায়নি। তাই এখনো ফতোয়াবাজি, দোররা এবং একতরফাভাবে নারীর ওপর অন্যায় ও অনধিকারমূলক গ্রাম্য শাস্তির খবর আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পাই।
ওই প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ওই আইনে জলাধার সংরক্ষণ অর্থাৎ জলাধার ভরাট নিষিদ্ধ করা ছাড়াও পরিবেশ রক্ষার জন্য পাহাড় কাটার ওপরও বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এ বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। বেশ কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি, পাহাড় কাটার ধুম, সমাজবিরোধীদের অন্যায় লোভ-লালসার প্রকাশ এবং পাহাড় ও টিলা কাটার কারণে ধস, দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবর। ঢালের অসহায় বাসিন্দাদের প্রতিবাদ কোনো কাজে আসেনি। তাই আমরা আশা করব, এ আইন দ্রুত কাজে লাগানো হবে।
আর এ উপলক্ষে আমরা বলব, বুড়িগঙ্গাসহ শীতলক্ষ্যা এবং অন্যান্য নদীর ওপর দখলদারি ও অবৈধ স্থাপনা স্থায়ীভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। প্রধানমন্ত্রী এই কদিন হলো বাংলাদেশের পক্ষে ‘এমডিজি’ পুরস্কার নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরেছেন। নদীর অপমৃত্যু রোধ, নদীর সুস্বাস্থ্য রক্ষার কাজ জাতীয় পরিসরে একই রকম জরুরি। নদীর অপমৃত্যু জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। ব্যক্তির লোভ ও স্বার্থে নদীর এ বলিদান কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু সমাজমনস্ক ব্যক্তিই নন, গোটা জাতিকে এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।
সবশেষে তাই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যাসহ সব নদীর বুকের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদীকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যাতে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমরা জানি, এর আগেকার শাসনামলে এক প্রতিমন্ত্রীর বুড়িগঙ্গার এক শীর্ণ শাখা দখলে নেওয়ার দুর্বুদ্ধির কথা, যে ঘটনার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রসহ সর্বত্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সুস্থ মানবিক হস্তক্ষেপে ওই দুর্দান্ত ক্ষমতাবান ব্যক্তিটির লালসা ঠেকানো সম্ভব হয়। তাই ঘটনা ও জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক স্বার্থ রক্ষার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী যেন জরুরিভিত্তিতে উল্লিখিত বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেন। আমরা অপেক্ষায় আছি, নদীর কন্না বন্ধ করার উদ্যোগের পরিণাম দেখার জন্য।
আহমদ রফিক: প্রাবন্ধিক, রবীন্দ্র গবেষক।
No comments