নীরবেই চলে গেলেন ডা. সোফিয়া খাতুন by শুভা জিনিয়া চৌধুরী
১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো পার হচ্ছিল একে একে। চারদিকে শঙ্কা, ভয় আর উত্তেজনা। ঢাকার অধিকাংশ মানুষই তখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রামের পথে যাত্রা করেছে। সে সময় ধানমন্ডির একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছিলেন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ডা. সোফিয়া খাতুন। ঢাকার অনেক বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানই তখন বন্ধ ছিল। কিন্তু সব ভয়ভীতিকে জয় করে যুদ্ধের অস্থিরতা আর উত্তেজনার মধ্যেও নিজের প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকটি চালু রেখেছিলেন ডা. সোফিয়া, রোগীদের চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে যাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাও (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) তখন ডা. ওয়াদুদ ও ডা. সোফিয়ার তত্ত্বাবধানে ছিলেন। পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার চিকিৎসায় এগিয়ে আসেননি। কিন্তু ডা. সোফিয়া পিছিয়ে যাননি। বিপদ আসতে পারে, সে কথা মাথায় রেখেই শেখ হাসিনার সমস্ত চিকিৎসার ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডা. সোফিয়া। এই দুই চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানেই জন্ম হয়েছিল শেখ হাসিনার ছেলে ও বঙ্গবন্ধুর প্রথম নাতি সজীব ওয়াজেদ জয়ের। ডা. সোফিয়ার এই সহযোগিতার কথা পরে ভুলে যাননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ডা. সোফিয়াকে তিনি ‘বোন’ বলে ডাকতেন। ভোলেননি শেখ হাসিনাও। তাঁর দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় সোফিয়া ক্লিনিকে ডা. সোফিয়া খাতুনের তত্ত্বাবধানে। পরবর্তী সময়ে সোফিয়ার হাতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অনেক সদস্যেরই সন্তানের জন্ম হয়।
ডা. সোফিয়া কেবল একজন দক্ষ চিকিৎসকই ছিলেন না, সবাইকে আপন করে নেওয়ারও অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও তাঁর রোগীরা সে কথাই বলেন তাঁর সম্পর্কে। সোফিয়া ক্লিনিকে শুধু বিখ্যাত ব্যক্তিরাই চিকিৎসা ও সেবা পেতেন না। এই ক্লিনিকে অনেক দরিদ্রকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন ডা. সোফিয়া। কিন্তু হাসিখুশি এই মানুষটি সব সময়ই ছিলেন প্রচারবিমুখ। চুপচাপ নিজের কাজ ও দায়িত্ব পালন করে যেতেই তিনি পছন্দ করতেন। কাজের বাইরে যেটুকু অবসর পেতেন, অন্যের জীবনের সুখদুঃখের গল্প শুনতেন। সারা জীবন অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে ডা. সোফিয়াকে। তাঁর জীবনে চলার পথটা খুব সুগম ছিল না। কিন্তু তিনি কখনো তাঁর আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। বরং সংগ্রাম করে জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের দাউদকান্দিতে জন্ম হয় ডা. সোফিয়া খাতুনের। সে সময় নারীশিক্ষার হার ছিল খুবই কম। আর দাউদকান্দির মতো ছোট একটি গ্রামের মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ করাটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। নিজের বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লেখাপড়া করা ছিল নিতান্তই সাহসের ব্যাপার। ডা. সোফিয়া সেই সাহসটা দেখাতে পেরেছিলেন খুব অল্প বয়সেই। তিনি ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরে কলকাতায় গিয়ে লেডি ব্র্যাবোন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন। ডা. সোফিয়ার শিক্ষাজীবনটা স্বাভাবিকভাবেই ছিল ঘটনাবহুল। কারণ চারপাশের পৃথিবীটা তখন বদলাচ্ছিল। সময়টা ছিল অস্থির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির উত্তেজনা খুব কাছ থেকে দেখেন ডা. সোফিয়া। একসময় যে শহর, যে দেশ ছিল তাঁর একান্তই নিজের, সেখানেই শুরু হয় দাঙ্গা, হানাহানি আর রক্তপাত। নিমিষেই সেই দেশটাকে আলাদা হয়ে যেতে দেখেন সোফিয়া। আর এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবনে এসে পড়ে। দেশ বিভক্তির পর ডা. সোফিয়াকে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। তবে এত সব অস্থিরতার মধ্যেও মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাননি তিনি। সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধ আর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। তাই লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছেন ভালোভাবেই। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বৃত্তি অর্জন করেন সোফিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারী শিক্ষার্থীদের প্রথম ব্যাচ থেকে তিনি অর্জন করেন এমবিবিএস ডিগ্রি। বাড়ি থেকে দূরে এসে নারী হিসেবে লেখাপড়া করা যে কত সমস্যাসংকুল, তা বুঝতে পেরেছিলেন সোফিয়া। আর তাই নারীদের শিক্ষাগ্রহণের পথটা কীভাবে আরেকটু সহজ করা যায়, সে ভাবনাটা শুরু থেকেই তাঁর মাথায় ছিল। তাই তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য প্রথম আবাসিক হোস্টেল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। সোফিয়াই ছিলেন এই হোস্টেলের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট। ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই চলে তাঁর কর্মজীবন।
১৯৫৮ সালে ডা. এম এ ওয়াদুদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডা. সোফিয়া। বিয়ের পর ১৯৬৩ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ব্রিটেনে যান তিনি। এরপর ১৯৬৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ থেকে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় এমআরসিওজি ডিগ্রি অর্জন করেন। স্যার সলিমুল্লাহ কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। পরে সেখানেই তিনি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
১৯৬৮ সালে সোফিয়া ও তাঁর জীবনসঙ্গী ওয়াদুদ ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠা করেন সোফিয়া ক্লিনিক। ক্লিনিকটি অল্পদিনের মধ্যেই সুনাম অর্জন করে। এরই মধ্যে ১৯৮২ সালে আবার লন্ডনের রয়্যাল কলেজ থেকে সোফিয়া এফআরসিওজি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও সাফল্যের কমতি ছিল না সোফিয়ার। মায়ের পথ ধরে তাঁর মেয়ে ডা. রুবিনাও পেশাগত জীবনে চিকিৎসক। ছেলে আহমেদ ফয়সাল মালিক একজন প্রকৌশলী। চারজন নাতি-নাতনি নিয়ে ভরপুর সংসার। সংগ্রামী এই নারীর পথ ধরে পরিবারের অনেকেই এসেছেন চিকিৎসা পেশায়। তাঁর ভাগনি সেহেরিন এফ সিদ্দিকাও স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন।
নিভৃতচারী এই নারী গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ডা. সোফিয়া কেবল একজন দক্ষ চিকিৎসকই ছিলেন না, সবাইকে আপন করে নেওয়ারও অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও তাঁর রোগীরা সে কথাই বলেন তাঁর সম্পর্কে। সোফিয়া ক্লিনিকে শুধু বিখ্যাত ব্যক্তিরাই চিকিৎসা ও সেবা পেতেন না। এই ক্লিনিকে অনেক দরিদ্রকে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন ডা. সোফিয়া। কিন্তু হাসিখুশি এই মানুষটি সব সময়ই ছিলেন প্রচারবিমুখ। চুপচাপ নিজের কাজ ও দায়িত্ব পালন করে যেতেই তিনি পছন্দ করতেন। কাজের বাইরে যেটুকু অবসর পেতেন, অন্যের জীবনের সুখদুঃখের গল্প শুনতেন। সারা জীবন অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে ডা. সোফিয়াকে। তাঁর জীবনে চলার পথটা খুব সুগম ছিল না। কিন্তু তিনি কখনো তাঁর আদর্শ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সমঝোতা করেননি। বরং সংগ্রাম করে জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯২৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের দাউদকান্দিতে জন্ম হয় ডা. সোফিয়া খাতুনের। সে সময় নারীশিক্ষার হার ছিল খুবই কম। আর দাউদকান্দির মতো ছোট একটি গ্রামের মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিসেবে শিক্ষাগ্রহণ করাটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। নিজের বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে লেখাপড়া করা ছিল নিতান্তই সাহসের ব্যাপার। ডা. সোফিয়া সেই সাহসটা দেখাতে পেরেছিলেন খুব অল্প বয়সেই। তিনি ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরে কলকাতায় গিয়ে লেডি ব্র্যাবোন কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন। ডা. সোফিয়ার শিক্ষাজীবনটা স্বাভাবিকভাবেই ছিল ঘটনাবহুল। কারণ চারপাশের পৃথিবীটা তখন বদলাচ্ছিল। সময়টা ছিল অস্থির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির উত্তেজনা খুব কাছ থেকে দেখেন ডা. সোফিয়া। একসময় যে শহর, যে দেশ ছিল তাঁর একান্তই নিজের, সেখানেই শুরু হয় দাঙ্গা, হানাহানি আর রক্তপাত। নিমিষেই সেই দেশটাকে আলাদা হয়ে যেতে দেখেন সোফিয়া। আর এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর জীবনে এসে পড়ে। দেশ বিভক্তির পর ডা. সোফিয়াকে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসতে হয়। তবে এত সব অস্থিরতার মধ্যেও মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাননি তিনি। সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধ আর চোখরাঙানি উপেক্ষা করে শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন। তাই লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছেন ভালোভাবেই। ১৯৪৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বৃত্তি অর্জন করেন সোফিয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারী শিক্ষার্থীদের প্রথম ব্যাচ থেকে তিনি অর্জন করেন এমবিবিএস ডিগ্রি। বাড়ি থেকে দূরে এসে নারী হিসেবে লেখাপড়া করা যে কত সমস্যাসংকুল, তা বুঝতে পেরেছিলেন সোফিয়া। আর তাই নারীদের শিক্ষাগ্রহণের পথটা কীভাবে আরেকটু সহজ করা যায়, সে ভাবনাটা শুরু থেকেই তাঁর মাথায় ছিল। তাই তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারীদের জন্য প্রথম আবাসিক হোস্টেল প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। সোফিয়াই ছিলেন এই হোস্টেলের প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট। ইন্টার্নশিপ শেষ করার পরই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই চলে তাঁর কর্মজীবন।
১৯৫৮ সালে ডা. এম এ ওয়াদুদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ডা. সোফিয়া। বিয়ের পর ১৯৬৩ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ব্রিটেনে যান তিনি। এরপর ১৯৬৭ সালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ থেকে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় এমআরসিওজি ডিগ্রি অর্জন করেন। স্যার সলিমুল্লাহ কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। পরে সেখানেই তিনি স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
১৯৬৮ সালে সোফিয়া ও তাঁর জীবনসঙ্গী ওয়াদুদ ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠা করেন সোফিয়া ক্লিনিক। ক্লিনিকটি অল্পদিনের মধ্যেই সুনাম অর্জন করে। এরই মধ্যে ১৯৮২ সালে আবার লন্ডনের রয়্যাল কলেজ থেকে সোফিয়া এফআরসিওজি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও সাফল্যের কমতি ছিল না সোফিয়ার। মায়ের পথ ধরে তাঁর মেয়ে ডা. রুবিনাও পেশাগত জীবনে চিকিৎসক। ছেলে আহমেদ ফয়সাল মালিক একজন প্রকৌশলী। চারজন নাতি-নাতনি নিয়ে ভরপুর সংসার। সংগ্রামী এই নারীর পথ ধরে পরিবারের অনেকেই এসেছেন চিকিৎসা পেশায়। তাঁর ভাগনি সেহেরিন এফ সিদ্দিকাও স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন।
নিভৃতচারী এই নারী গত ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
No comments