নারী লেখক, নর লেখক -আন্তর্জাতিক নারী দিবস by শামীম আজাদ

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পর এলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর আমি এখনো ঢাকায়। আমি এখনো ঘোরে। কী করে একটি অখণ্ড ফেব্রুয়ারি মাস পেলাম! প্রতিদিন ঢাকার ধুলোয় ধরাশায়ী অবস্থায় বাংলা একাডেমী বইমেলায় ঢুকেছি, তবু মনে হয়েছে এ আমাদের এক আশ্চর্য মোকাম। উড়ছে ধুলো, ঘুরছে পাঠক, লেখক, চিত্রক, চিত্রধারক, প্রকাশক, পাওনাদার, প্রতারক। বক্তৃতা হচ্ছে সেখানে! শ্রোতার আসনে অর্ধেক পুলিশ আর অর্ধেক মানুষ। বাংলাবাজার থেকে জ্যাম আর ঘামে বিরক্ত হয়ে আসছেন প্রকাশক। কিন্তু নজরুল মঞ্চে টিভি ক্যামেরা ও সাংবাদিকদের সামনে তারা হাসছেন। মজুরদের মাথায় করে আসছে তিনতলা বইয়ের দালান। মেলায় চিত্রগ্রাহকদের কাঁধে ঘুরছে আধাডজন টিভি ক্যামেরা। ঘাড় ফেরালেই সাংবাদিক। যাঁরা মেলায় আসেননি বা এসেছেন, তাঁদের জন্য কেবলই সন্দেশ চাই-সংবাদ চাই। মাথার ক্ষুধা এমনই এক গনগনে তাওয়া, সাংবাদিকদের এ মেলা থেকেই পরের মেলার বিষয় তুলে নিতে হবে ক্যামেরা, মোবাইলে অথবা নোটবুকে টুকে টুকে।
বাংলা একাডেমীর বইমেলায় হাত বাড়ালেই কবি-লেখক-প্রাবন্ধিক। তাঁরা নর কিংবা নারী। কেউ কেউ নতুন হলেও নন খুব একটা আনাড়ি। এমন সুযোগ যখন, তখন নারী দিবসের জন্য সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও হাতে ‘অতএব ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার’-এর মতোই নারীধরা হয়ে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছেন। নারী লেখক কম কেন? নারীদের লেখা পুরুষ লেখকদের তুলনায় মানুষ কম পড়ছে কি? কেন? নারী কবিদের নাম করতে গেলে মাত্র কয়েকজন কেন পাওয়া যায়? বলা বাহুল্য, শেষ প্রশ্নটির টোপে গেঁথে গেলাম।
আমি তখন লিটলম্যাগ কর্নারে লেখকদের বসার জন্য আল্পনা আঁকা যুগল আমগাছের গোড়ায় বসে পড়েছি। আমি বসার পর সেই সাংবাদিক ভগ্নী-ভ্রাতারাও বসলেন। তখন হঠাত্ করেই আমার একটি তুলনা মাথায় এল। তা গতবারের অলিম্পিক গেমের কথা। লম্বা একটা দৌড় হচ্ছে। সব দেশের প্রতিনিধি এসে দাঁড়িয়েছেন। সেসব প্রতিনিধির সবাই পুরুষ। সংকেত বাজার পর সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। কালো, হলুদ, সাদা, গোলাপি, বাদামি রঙের সব দৌড়বিদ জীবন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টিভি পর্দায় সে দৌড়ের সঙ্গে উড়ছে আমাদের চোখ। কিন্তু দৌড় শুরু হওয়ার পরপরই কিছু দেশের প্রতিনিধি বরাবরের মতোই ভীষণ পেছনে পড়ে গেল। কারণটা কী? এরা তো নারী নয়। তাহলে? দর্শকদের একজন বললেন, সমান পুরুষ হলেও কি এদের অলিম্পিকে খেলার তেমন অভিজ্ঞতা আছে? আরেক জন বললেন, এদের বেশিরভাগই জাতিগতভাবে বেশ দরিদ্র, তাই ছোটবেলা থেকে তেমন পুষ্টিকর খাওয়া হয়নি। একে তো এদের বলহীন দেহ, তার ওপরে এসব দেশে নেই সর্বশেষ প্রযুক্তি, তথ্য ও বিজ্ঞান। বেড়ে ওঠাটা সমান মাপের হয়নি, এমনকি অনুশীলন-কালেও। একজন বললেন, বাংলাদেশের কথা ভাবো, আমরা ভালো খাবার দূরে থাকুক, ভালো ওষুধও তো পাই না। আর এরা প্রাকটিস করবে কী, সংসারের চাপে অন্য কাজ করেই কুল পায় না। এরা অনেকেই হয়তো পার্টটাইমার। ওই পিছিয়ে পড়া পুরুষদের স্থানেই আমাদের দেশের নারী। সমপর্যায়ে সুযোগ-সুবিধা ও অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা করে একবার, কোনো একবারও কি তা যাচাই করা হয়েছে?
এ গল্প বলার পর আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠল। তবে শারীরিকভাবে তারা বলশালী এটা মানি। বুদ্ধিতে নয়, কল্পনায় নয়। লেখক তো তাঁর অভিজ্ঞতাই লেখেন। যেকোনো অভিজ্ঞতা যা কিনা তাঁরা সর্বতোভাবে গবেষণা করেছেন, তাই লেখেন নারী লেখক ও পুরুষ লেখক উভয়েই। কিন্তু তা লেখার জন্য সার্বিক যোগ্যতা অর্জন করার সুযোগ নারী কবি বা লেখকের চেয়ে পুরুষের বেশি।
একবার বইমেলায় যদি লেখকের নাম ঢেকে কেবলমাত্র শিরোনাম দিয়ে তা বিক্রি করা হতো, তাহলে একটা মজা হতো নির্ঘাত। যে যে লেখকের নামে তিনি নারী বা পুরুষ বোঝা যায় না, বিষয়বস্তুতেও যদি থাকে না ‘মেয়েদের বিষয়’—এমন নব্য নারী লেখক যে বস্তুগুণে আদৃত হয়েছেন, তার প্রমাণ আছে এন্তার। আর নারী নামে যাঁরা খ্যাত হয়েছেন, ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই হয় সমান মাপের পুরুষ লেখকদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন, নয়তো কারও (বাবা, বন্ধু, স্বামী) হাতে ধরেই তবে এসেছেন। তবে নারী লেখক যে কম, তাতে আমার কোনো দ্বিমত নেই। যাঁরা আগে মাঠে নামবেন, তাঁরা তো আগে যাবেনই। এ ক্ষেত্রে পুত্রদের নামানো হয় আগে। যে পরিবারে দুজনই কন্যা, তাদের অবস্থানের পরিসংখ্যান নিয়েছি?
আড্ডা আরও জমে উঠল এবং এসে গেল আশির দশকের গোড়ার কথা। আমি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতাম। টিমের মধ্যে একমাত্র নিয়মিত নারী সাংবাদিক। লিখি মধ্যবিত্তের জীবনযাপন, নারী নির্যাতন, খাদ্যাভ্যাস, দেশি ফ্যাশন, ঈদের বাজার, ও বড়জোর দেশের শিক্ষালয়গুলোর ব্যবস্থা, কিংবা ঢাকার বিনোদন এসব নিয়ে। আর এসব গতানুগতিক বিষয়ে কাব্য এনে, রোদে রোদে টাঙ্গাইল, রাজশাহী ঘুরে দেশের জাতীয় চরিত্রে দেশি পোশাক আনার জন্য প্রাণান্ত। আর তখনই কি না আমার পুরুষ সহকর্মীরা ধমাধম পোর্ট আনোয়ারা অথবা যুদ্ধাপরাধীরা কে কোথায় আছে অথবা বিমানের কারচুপি লিখে হিরো। শাহাদত চৌধুরী আমাকে তেমন কোনো রিপোর্ট করতে দিতে পেরেছেন কি? আমি তো আর পারব না ক্রিমিনাল শিবিরে ঢুকে এক টেবিলে চা সিগারেট খেয়ে তাঁর কথা বের করতে। অথবা কাজ সেরে রাত দুটো-তিনটায় মতিঝিল থেকে একা রিকশায় ফিরতে। মানলাম, এ আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা।
সে সময় সত্তরের শেষার্ধ থেকে আশির পুরোটা দশক আমি যেভাবে যে বিষয় দেখেছি ও লিখেছি, তখন ঢাকার কোনো পুরুষ সহকর্মী হয়তো তা করেননি। কারণ তাদের তো আর ছোটবেলা থেকে নারী অথবা গৃহজীবনের সেসব অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়নি। তাই তাঁরা কই মাছের কোরমা কিংবা আরেক জন কিশোরীর কষ্ট জানবেন কী করে? এমনকি আজ অবধি বাংলাদেশি খুব নগণ্য সংখ্যক পুরুষই আছেন, যাঁরা তাঁর স্ত্রীর প্রসবকালে সামনে থেকে সে কষ্টটুকু অন্তত চাক্ষুষ করেছেন। তাহলে এসব সুবিধাবঞ্চিত পুরুষেরা কি করছে? এসব বিষয়ে পিছিয়ে আছে। তাহলে এ ব্যাপারে তাদের পশ্চাত্পদতা নিয়ে কে তাঁদের বকছে! নাকি এ বিষয়গুলো কেবল নারী জাতির বিষয়। একটা প্রচলিত ইংরেজি কথা আছে, ‘যাকে সমালোচনা করছ, তার জুতোয় নিজের পা গলিয়ে দেখ তো দেখি হাঁটতে পার কি না?’ হয় প্রচণ্ড ব্যথা পাবে, পায়ে তোমার ফোস্কা হবে, কোমরে হবে ব্যথা। সে কি আর যা-তা কথা। ‘পুরুষের জন্য সে জুতো মানানসইও তো হতে হবে।’
হাসতে হাসতেই তাই বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন-এর কথা বলি। সেখানে সুস্পষ্ট দেখা যায়, নারীকে অবরুদ্ধ রাখলে তার শক্তি ক্ষয় হয় না, ক্ষয় হয় দেশের। লেখককে নারী বলে খুঁজে পেতে বের করলে নিজেদের অসম্পূর্ণতাই আরও সম্পন্ন হয়ে ওঠে।
শামীম আজাদ: কবি, লেখক ও সাংবাদিক
shetuli@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.