গণমাধ্যমের শক্তি ভাষার প্রাণ by সৌমিত্র শেখর
এফএম রেডিওর ভাষা নিয়ে সমপ্রতি তথ্যসচিবের একটি বক্তব্য বেশ আলোচিত হচ্ছে। কেউ তাঁর বক্তব্য সমর্থন করছেন, কেউ বা বলছেন সরকারি খবরদারি। যাঁরা খবরদারি বলছেন, তাঁদের কেউ অবশ্য তথ্যসচিবের বক্তব্য সংবাদপত্রের পাতা থেকে উদ্ধার না করে টেলিভিশনের প্রচারটাই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কোনো টেলিভিশনে নাকি তথ্যসচিবের বক্তব্যকে ‘কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি’ বলে প্রচার করা হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি পত্রিকান্তরে ছাপা হয়েছে: ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ে বেসরকারি মালিকানাধীন এফএম বেতার কেন্দ্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তথ্যসচিব কামাল আ. নাসের চৌধুরী বৈঠক করেন। তথ্যসচিব উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বেসরকারি রেডিওতে বাংলা ভাষাকে ইংরেজি-করণের চেষ্টা চলছে। বাংলা ভাষাকে বিকৃত ও জগাখিচুড়ি করে ফেলায় বাংলার মূল রূপ হারিয়ে যাচ্ছে। এটি অবমাননাকর ও দুর্ভাগ্যজনক।’ এই সংবাদের প্রথমে অবশ্য বলা হয়েছে: ‘বেসরকারি মালিকানাধীন এফএম বেতার কেন্দ্র ও টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করে শুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।’ এই তাগিদকেই বোধ করি টেলিভিশন প্রচার করে বলেছে ‘কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি’। আর এই প্রচার শুনে অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এটাই গণমাধ্যমের শক্তি; এই শক্তি দিয়ে যে-কাউকে জাদু করে ফেলতে পারে গণমাধ্যম।
কিছু এফএম রেডিওর ভাষিক প্রয়োগ বা ঢাকা শহরের তরুণ প্রজন্মের ভাষায় সেই ভাষারীতির প্রাদুর্ভাব নিয়ে সমপ্রতি সুধীমহলে যে বিতর্কটি হচ্ছে, একে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ আছে। সেই এফএম রেডিওর বেতারসারথি (আরজে) যাঁরা, তাঁদের উচ্চারণে বাংলা ভাষায় অনুমোদিত ধ্বনিসমূহের অনেকগুলোই লোপ বা বিকৃতির শিকার। কিছু নাটক বা অনুদানপুষ্ট চলচ্চিত্রেও সেই ভাষারূপ ব্যবহার হওয়ার কারণে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশপথে তা কুপ্রভাব ফেলছে। মিডিয়ার যে শক্তি, সেই শক্তি বাংলা ভাষার প্রগতিমুখী অগ্রগতির পক্ষে কাজে না লাগিয়ে এর ব্যবহার হচ্ছে উল্টোপথে। এ জন্য আতঙ্কের কারণ আছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ও যদি এ কারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করে, তবে সেই উদ্বেগকে স্বাভাবিক বলতে হবে।
এ ভাষাকে ‘খিচুড়ি ভাষা’ না বলে ‘বিকট ভাষা’ বলাই শ্রেয়। খিচুড়ি বা বিকট যে নামেই বলি না কেন, এই ভাষারীতি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করলেই অনেকে আঞ্চলিক ভাষার দোহাই দেন। তাঁরা উদাহরণ আনেন নীল-দর্পণ, পদ্মানদীর মাঝি, হাতহদাই, আগুনপাখি, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ইত্যাদি নাটক ও উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষারীতি প্রয়োগের। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণে ‘দাবায়া’ শব্দ-প্রয়োগ বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের ভাষার প্রসঙ্গও উল্লেখ হিসেবে সামনে আনেন। এটা আসলে বিকট ভাষাকে আড়াল করার একটা কৌশল মাত্র। আঞ্চলিক ভাষা নয়, আজ বিপত্তি ও আপত্তি বিকট ভাষা নিয়ে। এফএম রেডিও বা অনুদানপুষ্ট নাটকে আজকাল যে ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, একে কি আঞ্চলিক ভাষা বলা যাবে? নাকি এটা বাংলা ভাষাকে অন্তঃসারশূন্য করে একটি কৃত্রিম ভাষারীতি তৈরির অপচেষ্টা? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রধান শত্রু টেলিভিশনের হিন্দি বা ইংরেজি চ্যানেলগুলো—এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা এই ভাষারীতিকে সামনে নিয়ে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি প্রচার বা বিকাশ করবেন কীভাবে?
একসময় সংস্কৃতানুসারে বাংলা লেখা ও বলার যে চেষ্টা, পরে আরবি-ফারসি শব্দ মিশ্রণ করে বাংলা লেখার প্রবণতা, পাকিস্তান আমলে উর্দুর প্রভাবসমেত আরবি বর্ণে বাংলা লেখার মানসিকতা ইত্যাদির সঙ্গে বর্তমানে বিকট ভাষারীতিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টাকে কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না। এ সবই হয়েছিল এবং হচ্ছে বাংলার স্বাভাবিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য। আঞ্চলিক ভাষার প্রাণপ্রবাহের কথা আমরা কে না জানি? রবীন্দ্র-ছোটগল্পেই শুধু নয়, জীবনানন্দের বহু কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ মুক্তার মতো দ্যুতি ছড়ায়, নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। কিন্তু সেগুলো শিল্পীর লেখনীতে প্রযুক্ত হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার বদল কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের মতো এ যুগেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অনেক লেখক আছেন, যাঁরা আঞ্চলিক ভাষার স্নিগ্ধতাকে সঞ্চারিত করেছেন প্রমিত ভাষার ধারায়। অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলারও প্রমিত রূপ আছে এবং এটিকে অব্যাহত রাখতে হলে এর চর্চা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব সম্পদ আছে; বাংলারও। বাংলা ভাষার ‘সহোদর’ শব্দটির কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। বাংলায় অর্থ ভিন্ন হলেও ‘অকৃতজ্ঞ’ ও ‘কৃতঘ্ন’ শব্দ দুটোর জন্য পৃথক ইংরেজি শব্দ পাওয়া যায় না। বাঙালিদের আত্মজনবাচক শব্দসমূহ (যেমন: খালা/মাসি, ফুফু/পিসি, চাচি/কাকি বা চাচা/কাকা-জেঠা ইত্যাদি) নির্দিষ্ট সম্পর্কজ্ঞাপক হলেও এগুলোর প্রতিটির জন্য যথাযথ কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ মেলে না। তাই বাংলা ভাষার প্রাণসম্পদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু এফএম রেডিও বা অনুদানপুষ্ট কিছু নাটকের সামপ্রতিক ভাষিক প্রবণতায় দেখা যায় এ রকম: ‘হাই আন্টি, নাও আপনার জন্য এ কাপ অব সং প্লে করছি।’ এ রকম বাংলা ভাষা ইদানীং শুনছি। ‘সো আমরাও ইন্সপায়ার্ড হই এসব আরজের স্পিস-স্টাইল নিয়ে টক করতে।’ অথচ মিডিয়ার এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষার কত উন্নতিই না করা যেত! ‘ক্লাসিক’ শব্দের পরিভাষা হিসেবে ‘ধ্রুপদ’ শুনতে ও মানতে আজ তো খারাপ লাগে না। যখন এ ধরনের পরিভাষা তৈরি হয়েছে, সেদিন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিল না। আজ মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিভাষা জনপ্রিয় করা অনেক সহজ। ‘আরজে’র বদলে আমরা যদি ‘বেতারসরথি’ বলি, খুব কি শ্রুতিকটু লাগে? সব বেতারকেন্দ্র থেকে একযোগে বলুক—এক মাসের মধ্যে আরজের বদলে বেতারসারথি সারা দেশে চালু হয়ে যাবে।
বেসরকারি মালিকানাধীন এফএম বেতারকেন্দ্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তথ্যসচিবের বৈঠক ও উদ্বেগ প্রকাশকে খবরদারি না বলে অনুযোগ প্রকাশ বলা ভালো। যে দেশ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সোপান তৈরি করেছে, সেই দেশের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় ভাষা ও সংস্কৃতি-বিকৃতির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাই সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবেচনা নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বাংলা বানানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু সুপারিশসহ অনুরোধ করেছিলেন। এ উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছিলেন শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। ওই প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিয়েছিল বলেই বাংলা ভাষায় একটি বানানরীতি পাওয়া গেছে। একটি বানানরীতি থাকার পরও বাঙালির বাংলা লেখার যে অবস্থা, যদি ধরে নিই, বাংলা বানানরীতি শুরু থেকেই ছিল না—কী হতো তাহলে? বানানের বিশৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে পৌঁছত! অর্থাত্ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও দেখভালের প্রয়োজন আছে। তথ্যসচিব যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এ উদ্বেগ প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ অথবা ‘বাংলা একাডেমী’র প্রকাশ করার কথা ছিল। তারা করেনি, তথ্যসচিব করলেন—এতে তো ক্ষতি কিছু নেই। মিডিয়া-বিপ্লবের এই যুগে এখন প্রয়োজন মিডিয়ার শক্তি ব্যবহার করে বাঙালির সংস্কৃতি ও ভাষার প্রাণসম্পদ বৃদ্ধি করা।
ড. সৌমিত্র শেখর: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কিছু এফএম রেডিওর ভাষিক প্রয়োগ বা ঢাকা শহরের তরুণ প্রজন্মের ভাষায় সেই ভাষারীতির প্রাদুর্ভাব নিয়ে সমপ্রতি সুধীমহলে যে বিতর্কটি হচ্ছে, একে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ আছে। সেই এফএম রেডিওর বেতারসারথি (আরজে) যাঁরা, তাঁদের উচ্চারণে বাংলা ভাষায় অনুমোদিত ধ্বনিসমূহের অনেকগুলোই লোপ বা বিকৃতির শিকার। কিছু নাটক বা অনুদানপুষ্ট চলচ্চিত্রেও সেই ভাষারূপ ব্যবহার হওয়ার কারণে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বিকাশপথে তা কুপ্রভাব ফেলছে। মিডিয়ার যে শক্তি, সেই শক্তি বাংলা ভাষার প্রগতিমুখী অগ্রগতির পক্ষে কাজে না লাগিয়ে এর ব্যবহার হচ্ছে উল্টোপথে। এ জন্য আতঙ্কের কারণ আছে। তথ্য মন্ত্রণালয়ও যদি এ কারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করে, তবে সেই উদ্বেগকে স্বাভাবিক বলতে হবে।
এ ভাষাকে ‘খিচুড়ি ভাষা’ না বলে ‘বিকট ভাষা’ বলাই শ্রেয়। খিচুড়ি বা বিকট যে নামেই বলি না কেন, এই ভাষারীতি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করলেই অনেকে আঞ্চলিক ভাষার দোহাই দেন। তাঁরা উদাহরণ আনেন নীল-দর্পণ, পদ্মানদীর মাঝি, হাতহদাই, আগুনপাখি, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় ইত্যাদি নাটক ও উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষারীতি প্রয়োগের। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণে ‘দাবায়া’ শব্দ-প্রয়োগ বা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের ভাষার প্রসঙ্গও উল্লেখ হিসেবে সামনে আনেন। এটা আসলে বিকট ভাষাকে আড়াল করার একটা কৌশল মাত্র। আঞ্চলিক ভাষা নয়, আজ বিপত্তি ও আপত্তি বিকট ভাষা নিয়ে। এফএম রেডিও বা অনুদানপুষ্ট নাটকে আজকাল যে ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, একে কি আঞ্চলিক ভাষা বলা যাবে? নাকি এটা বাংলা ভাষাকে অন্তঃসারশূন্য করে একটি কৃত্রিম ভাষারীতি তৈরির অপচেষ্টা? বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রধান শত্রু টেলিভিশনের হিন্দি বা ইংরেজি চ্যানেলগুলো—এ কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা এই ভাষারীতিকে সামনে নিয়ে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি প্রচার বা বিকাশ করবেন কীভাবে?
একসময় সংস্কৃতানুসারে বাংলা লেখা ও বলার যে চেষ্টা, পরে আরবি-ফারসি শব্দ মিশ্রণ করে বাংলা লেখার প্রবণতা, পাকিস্তান আমলে উর্দুর প্রভাবসমেত আরবি বর্ণে বাংলা লেখার মানসিকতা ইত্যাদির সঙ্গে বর্তমানে বিকট ভাষারীতিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টাকে কোনোভাবেই আলাদা করা যায় না। এ সবই হয়েছিল এবং হচ্ছে বাংলার স্বাভাবিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করার জন্য। আঞ্চলিক ভাষার প্রাণপ্রবাহের কথা আমরা কে না জানি? রবীন্দ্র-ছোটগল্পেই শুধু নয়, জীবনানন্দের বহু কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ মুক্তার মতো দ্যুতি ছড়ায়, নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে। কিন্তু সেগুলো শিল্পীর লেখনীতে প্রযুক্ত হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভাষার বদল কাম্য নয়। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের মতো এ যুগেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসসহ অনেক লেখক আছেন, যাঁরা আঞ্চলিক ভাষার স্নিগ্ধতাকে সঞ্চারিত করেছেন প্রমিত ভাষার ধারায়। অন্যান্য ভাষার মতোই বাংলারও প্রমিত রূপ আছে এবং এটিকে অব্যাহত রাখতে হলে এর চর্চা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব সম্পদ আছে; বাংলারও। বাংলা ভাষার ‘সহোদর’ শব্দটির কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। বাংলায় অর্থ ভিন্ন হলেও ‘অকৃতজ্ঞ’ ও ‘কৃতঘ্ন’ শব্দ দুটোর জন্য পৃথক ইংরেজি শব্দ পাওয়া যায় না। বাঙালিদের আত্মজনবাচক শব্দসমূহ (যেমন: খালা/মাসি, ফুফু/পিসি, চাচি/কাকি বা চাচা/কাকা-জেঠা ইত্যাদি) নির্দিষ্ট সম্পর্কজ্ঞাপক হলেও এগুলোর প্রতিটির জন্য যথাযথ কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ মেলে না। তাই বাংলা ভাষার প্রাণসম্পদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু এফএম রেডিও বা অনুদানপুষ্ট কিছু নাটকের সামপ্রতিক ভাষিক প্রবণতায় দেখা যায় এ রকম: ‘হাই আন্টি, নাও আপনার জন্য এ কাপ অব সং প্লে করছি।’ এ রকম বাংলা ভাষা ইদানীং শুনছি। ‘সো আমরাও ইন্সপায়ার্ড হই এসব আরজের স্পিস-স্টাইল নিয়ে টক করতে।’ অথচ মিডিয়ার এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলা ভাষার কত উন্নতিই না করা যেত! ‘ক্লাসিক’ শব্দের পরিভাষা হিসেবে ‘ধ্রুপদ’ শুনতে ও মানতে আজ তো খারাপ লাগে না। যখন এ ধরনের পরিভাষা তৈরি হয়েছে, সেদিন মিডিয়া এত শক্তিশালী ছিল না। আজ মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিভাষা জনপ্রিয় করা অনেক সহজ। ‘আরজে’র বদলে আমরা যদি ‘বেতারসরথি’ বলি, খুব কি শ্রুতিকটু লাগে? সব বেতারকেন্দ্র থেকে একযোগে বলুক—এক মাসের মধ্যে আরজের বদলে বেতারসারথি সারা দেশে চালু হয়ে যাবে।
বেসরকারি মালিকানাধীন এফএম বেতারকেন্দ্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর মালিক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও তাঁদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তথ্যসচিবের বৈঠক ও উদ্বেগ প্রকাশকে খবরদারি না বলে অনুযোগ প্রকাশ বলা ভালো। যে দেশ ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সোপান তৈরি করেছে, সেই দেশের সংস্কৃতি ও তথ্য মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রীয় ভাষা ও সংস্কৃতি-বিকৃতির প্রশ্নে উদ্বিগ্ন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাই সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিবেচনা নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বাংলা বানানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কিছু সুপারিশসহ অনুরোধ করেছিলেন। এ উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছিলেন শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। ওই প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নিয়েছিল বলেই বাংলা ভাষায় একটি বানানরীতি পাওয়া গেছে। একটি বানানরীতি থাকার পরও বাঙালির বাংলা লেখার যে অবস্থা, যদি ধরে নিই, বাংলা বানানরীতি শুরু থেকেই ছিল না—কী হতো তাহলে? বানানের বিশৃঙ্খলা কোন পর্যায়ে পৌঁছত! অর্থাত্ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ ও দেখভালের প্রয়োজন আছে। তথ্যসচিব যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এ উদ্বেগ প্রাথমিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ অথবা ‘বাংলা একাডেমী’র প্রকাশ করার কথা ছিল। তারা করেনি, তথ্যসচিব করলেন—এতে তো ক্ষতি কিছু নেই। মিডিয়া-বিপ্লবের এই যুগে এখন প্রয়োজন মিডিয়ার শক্তি ব্যবহার করে বাঙালির সংস্কৃতি ও ভাষার প্রাণসম্পদ বৃদ্ধি করা।
ড. সৌমিত্র শেখর: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments