নারীমুক্তির আইনি কিছু উপায় -আন্তর্জাতিক নারী দিবস by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
আজ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। শুধু তা-ই নয়, দিবসটি আজ শত বছরের পূর্ণবয়স্ক। কিন্তু সেটা অঙ্কের হিসাব, বাস্তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামো কোথাও জ্ঞাতসারে কিংবা কোথাও অজ্ঞাতসারে আজও সমাজে খুঁটা গেড়ে আছে। বর্তমান সময়ে মানুষ-উত্পাদনের যন্ত্র হিসেবে নারীদের কাজ কমেছে যেহেতু একালে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন জরুরি হয়ে পড়েছে। সন্তানের জন্ম দেওয়া ও তার লালন-পালনের কাজে একজন নারীকে তাঁর বিবাহিত জীবনের পুরোটা ব্যয় করা এখন অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক। তাহলে এটা ভাবতে কিংবা ধরে নিতে কঠিন না হয়ে সহজ হচ্ছে না কেন যে নারী কিংবা পুরুষ উভয়েই ব্যক্তিমানুষ, তাদের প্রত্যেকের রয়েছে পূর্ণ মানবিক মর্যাদা লাভের অধিকার, সঠিক বলতে শুধু অধিকারই নয়, স্বাধীনতাও। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চারিত হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ এ বাক্যটি উচ্চারণ করার সময়ে এই দিবসে আশা করব, অতঃপর উচ্চারিত হবে জনগণ, যার অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, শিরোনাম পড়ে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে আপনার ধারণা হয়েছে এ লেখাটির পরিসর একটি বিষয়ে নির্দিষ্ট। আবার এখান থেকে পড়তে শুরু করার আগে জানিয়ে দিচ্ছি, লেখাটির বিষয় অত্যন্ত স্বল্পপরিসরে নির্দিষ্ট রাখতে চাই ১৯৬৯ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অর্ডিন্যান্সের কয়েকটি ধারার সংশোধন বিষয়ে। এই সঙ্গে আশা করব, জাতীয় সংসদের সদস্যরা সেইমতো অর্ডিন্যান্সটি সংশোধন করবেন এবং আমার সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নারীমুক্তির আইনি কিছু উপায় কি না, সেটা বিবেচনার ভার পাঠক-পাঠিকাদের ওপর দিলাম।
উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারার বঙ্গানুবাদ এই: ‘তালাক-৭ (১) কোনো ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে ইচ্ছে করলে যেকোনোভাবে তালাক উচ্চারণ করার পর পরই এরূপ কাজ করেছেন জানিয়ে চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশ দেবেন এবং তার একটি অনুলিপি স্ত্রীকে সরবরাহ করবেন। (২) কেউ উপধারা (১)-এর শর্ত লঙ্ঘন করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে বিনাশ্রম কারাদণ্ড, যার মেয়াদ হতে পারে এক বছর পর্যন্ত কিংবা অর্থদণ্ড যা হতে পারে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কিংবা উভয়বিধ দণ্ড। (৩) উপধারা (৫)-এ বর্ণিত সাপেক্ষে কোনো তালাক স্পষ্টভাবে কিংবা অন্যভাবে প্রত্যাহার করা না হলে, তা কার্যকর হবে না যদি না উপধারা (১) অনুযায়ী চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিন অতিক্রান্ত হয়। (৪) উপধারা (১) অনুযায়ী নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে একটি সালিস পরিষদ গঠন করবেন এবং সেই সালিস পরিষদ সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। (৫) যদি তালাক উচ্চারণের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকেন, তাহলে তালাক ওই সময় পর্যন্ত কার্যকর হবে না যদি উপধারা (৩)-এ উল্লিখিত মেয়াদ কিংবা গর্ভকালীন সময় (যেটা পরে হয়) শেষ না হয়। (৬) এই ধারা অনুযায়ী তালাক দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন একজন স্ত্রীর তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই একই স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ হতে কোনো বাধা থাকবে না। যদি না এরূপ বিবাহবিচ্ছেদ তৃতীয়বারের মতো কার্যকর হয়।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, (৪) উপধারাটি লক্ষ করুন। সালিস পরিষদের কার্যপরিধি ও ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। চেয়ারম্যানের একমাত্র কাজটি হচ্ছে উভয় পক্ষকে তাদের পক্ষে সালিস পরিষদে একজন করে প্রতিনিধির নাম দেওয়ার জন্য নোটিশ প্রেরণ করা এবং সালিস পরিষদের একমাত্র কাজ হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা। একজন দুর্বিনীত স্বামী যদি সালিস পরিষদে তাঁর প্রতিনিধি না দেন এবং সেটাই স্বাভাবিক, তাহলে (৩) উপধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে তালাক আপনা-আপনি কার্যকর হয়ে যাবে। অর্ডিন্যান্সটির (২) ধারার (খ) উপধারায় সালিস পরিষদের চেয়ারম্যান কোন এলাকায় কে হবেন তা বলা আছে। কিন্তু (ক) উপধারায় সালিস পরিষদ গঠনের যে নিয়ম আছে অর্থাত্ চেয়ারম্যান। স্বামীর পক্ষে একজন প্রতিনিধি ও স্ত্রীর পক্ষে একজন প্রতিনিধি নিয়ে সেটা গঠন করা হবে, সেটা নিম্নরূপ সংশোধন করার জন্য আমি প্রস্তাব রাখছি:
‘২ (ক) ৭ ধারার ১ উপধারা অনুযায়ী দেওয়া নোটিশের নিষ্পত্তির জন্য চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে দুজন মহিলা ও দুজন পুরুষ সদস্যের মনোনয়ন দেবেন এবং পাঁচ সদস্যর একটি সালিস পরিষদ গঠিত হবে। তবে শর্ত থাকে ২ (খ) ধারায় উল্লিখিত চেয়ারম্যানরা সালিস পরিষদের সদস্য মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তাঁদের স্ব-স্ব এলাকায় উপযুক্ত আস্থাবান অন্যূন ১৫ জন সমসংখ্যক মহিলা ও পুরুষের তালিকা প্রস্তুত রাখবেন। আরও শর্ত থাকে যে শুনানির প্রথম তারিখে পক্ষগণের মধ্যে কেউ মনোনীত এক কিংবা একাধিক কোনো সদস্যের মনোনয়নে আপত্তি করলে চেয়ারম্যান অন্য সদস্য কিংবা সদস্যদের মনোনয়ন দেবেন।’
উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের (৩) ও (৪) ধারা দুটি বাতিল হবে এবং ৭ উপধারা হিসেবে যোগ হবে এই বিষয়গুলো: ‘৭ (১) সালিস পরিষদ সমঝোতার ভিত্তিতে তালাক অকার্যকর করতে ব্যর্থ হলে নিম্নলিখিত রোয়েদাদ দেবেন: (ক) দেনমোহরের পরিমাণ (যদি বকেয়া থাকে); (খ) ইদ্দতকালীন ভরণপোষণের জন্য অর্থের পরিমাণ (যদি ইতিপূর্বে না দেওয়া হয়); (গ) বিবাহকালীন স্বামীর নামে কিংবা স্ত্রীর নামে কিংবা উভয়ের নামে অর্জিত (কিন্তু দান কিংবা হেবামূলে প্রাপ্ত নয়) স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির তুলাংশ বণ্টন; (ঘ) প্রাপ্ত অংশ দ্বারা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ পর্যাপ্ত না হলে পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত তা পূরণের জন্য স্বামীর দেয় মাসিক কিংবা বাত্সরিক অর্থের পরিমাণ; এবং (ঙ) নাবালক সন্তান কিংবা সন্তানদের অভিভাবকত্ব সাব্যস্ত ও মাতা যদি অভিভাবক সাব্যস্ত হন তবে সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য পিতা কর্তৃক দেয় মাসিক কিংবা বাত্সরিক অর্থের পরিমাণ। (২) রোয়েদাদে প্রদত্ত অর্থের কিংবা সম্পত্তির মূল্যের পরিমাণ যা হোক না কেন, রোয়েদাদটি ওই এলাকার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের ডিক্রি গণ্যে সেই সহকারী জজ আদালত কর্তৃক দেওয়ানি কার্যবিধির ২১ আদেশের অন্তর্ভুক্ত নিয়মগুলোর মাধ্যমে রোয়েদাদটি কার্যকর করা যাবে।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে তালাক দিতে চাইলে তাঁকে কী করতে হবে। এই অর্ডিন্যান্সের ৮ ধারায় বলা আছে, স্ত্রীকে সে ক্ষেত্রে উপরিউক্ত ৭ ধারা অনুযায়ী নোটিশ দিতে হবে। এই অর্ডিন্যান্সের সবচেয়ে অবমাননাকর ও লজ্জাদায়ক ধারাটি হচ্ছে ৬ ধারা। সেটা হচ্ছে সালিস পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিক বিয়ে করা যাবে। অথচ সত্য কথাটি হচ্ছে, ইসলাম বহু বিবাহ সমর্থন করে না। অজ্ঞানতার যুগে বাধাহীন নারীকে বিয়ে করার পরিবর্তে সর্বাধিক স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা চার সীমিত করা হয় এই শর্তে যে স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম-আচরণ ও সুবিচার করতে হবে (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩)। এ আয়াতটি নাজিল হয় ওহুদ যুদ্ধের পরে। এই যুদ্ধে অনেক মুসলমান শহীদ হওয়ায় এতিম ও বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অতঃপর সূরা আন-নিসার ১২৯ আয়াতে বলা হয়: ‘এবং তোমরা যতই আগ্রহ করো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতে কখনোই পারবে না।’
সহিহ আল-বুখারির সপ্তম খণ্ডে ১৫৭ নম্বর হাদিসটি এই: ‘আল-মিসওয়ার বিন মাখরামা বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) -কে মিম্বর থেকে বলতে শুনেছি, ‘বনি হাসিম বিন আল-মুখিরা আমাকে অনুরোধ করেছেন যে আমি যেন তাদের কন্যার সঙ্গে আলি বিন তালিবের বিবাহে অনুমতি দিই। কিন্তু আমি অনুমতি দিইনি এবং অনুমতি দেব না যতক্ষণ না আলি আমার কন্যা ফাতিমাকে তালাক দেয়। কারণ, ফাতিমা আমার দেহের টুকরা এবং আমি ঘৃণা করি যা সে ঘৃণা করে আর যা তাকে ব্যথা দেয়, তা আমাকেও ব্যথা দেয়।’
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে সূরা আল-আহজাবের ৫২ নম্বর এই আয়াতটি নাজিল হয়: ‘অতঃপর তোমার (অর্থাত্ আল্লাহর রাসুল) জন্য কোনো নারী বৈধ নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নয়।’ সুতরাং স্ত্রীদের প্রতি সম-আচরণ করতে হবে এই শর্তটি পালন দুঃসাধ্য বিধায় ইসলাম এক বিয়েকে নির্দেশ দেয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর জামাতাকে আরেকটি বিয়ে করার প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করেছিলেন ওই একই কারণে যে হজরত আলি (রা.) দুই স্ত্রীর প্রতি সম-আচরণ করতে পারবেন না। তিউনিসিয়া ১৯৫৭ সালে আইন করে একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের ৬ ধারাটি অবশ্যই বিলুপ্ত করে তত্স্থলে একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করে একটি ধারা যোগ করতে হবে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, শিরোনাম পড়ে নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে আপনার ধারণা হয়েছে এ লেখাটির পরিসর একটি বিষয়ে নির্দিষ্ট। আবার এখান থেকে পড়তে শুরু করার আগে জানিয়ে দিচ্ছি, লেখাটির বিষয় অত্যন্ত স্বল্পপরিসরে নির্দিষ্ট রাখতে চাই ১৯৬৯ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অর্ডিন্যান্সের কয়েকটি ধারার সংশোধন বিষয়ে। এই সঙ্গে আশা করব, জাতীয় সংসদের সদস্যরা সেইমতো অর্ডিন্যান্সটি সংশোধন করবেন এবং আমার সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নারীমুক্তির আইনি কিছু উপায় কি না, সেটা বিবেচনার ভার পাঠক-পাঠিকাদের ওপর দিলাম।
উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারার বঙ্গানুবাদ এই: ‘তালাক-৭ (১) কোনো ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে ইচ্ছে করলে যেকোনোভাবে তালাক উচ্চারণ করার পর পরই এরূপ কাজ করেছেন জানিয়ে চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশ দেবেন এবং তার একটি অনুলিপি স্ত্রীকে সরবরাহ করবেন। (২) কেউ উপধারা (১)-এর শর্ত লঙ্ঘন করলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে বিনাশ্রম কারাদণ্ড, যার মেয়াদ হতে পারে এক বছর পর্যন্ত কিংবা অর্থদণ্ড যা হতে পারে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কিংবা উভয়বিধ দণ্ড। (৩) উপধারা (৫)-এ বর্ণিত সাপেক্ষে কোনো তালাক স্পষ্টভাবে কিংবা অন্যভাবে প্রত্যাহার করা না হলে, তা কার্যকর হবে না যদি না উপধারা (১) অনুযায়ী চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিন অতিক্রান্ত হয়। (৪) উপধারা (১) অনুযায়ী নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার লক্ষ্যে একটি সালিস পরিষদ গঠন করবেন এবং সেই সালিস পরিষদ সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। (৫) যদি তালাক উচ্চারণের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকেন, তাহলে তালাক ওই সময় পর্যন্ত কার্যকর হবে না যদি উপধারা (৩)-এ উল্লিখিত মেয়াদ কিংবা গর্ভকালীন সময় (যেটা পরে হয়) শেষ না হয়। (৬) এই ধারা অনুযায়ী তালাক দ্বারা বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে এমন একজন স্ত্রীর তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই একই স্বামীর সঙ্গে পুনর্বিবাহ হতে কোনো বাধা থাকবে না। যদি না এরূপ বিবাহবিচ্ছেদ তৃতীয়বারের মতো কার্যকর হয়।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, (৪) উপধারাটি লক্ষ করুন। সালিস পরিষদের কার্যপরিধি ও ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। চেয়ারম্যানের একমাত্র কাজটি হচ্ছে উভয় পক্ষকে তাদের পক্ষে সালিস পরিষদে একজন করে প্রতিনিধির নাম দেওয়ার জন্য নোটিশ প্রেরণ করা এবং সালিস পরিষদের একমাত্র কাজ হচ্ছে উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা। একজন দুর্বিনীত স্বামী যদি সালিস পরিষদে তাঁর প্রতিনিধি না দেন এবং সেটাই স্বাভাবিক, তাহলে (৩) উপধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে তালাক আপনা-আপনি কার্যকর হয়ে যাবে। অর্ডিন্যান্সটির (২) ধারার (খ) উপধারায় সালিস পরিষদের চেয়ারম্যান কোন এলাকায় কে হবেন তা বলা আছে। কিন্তু (ক) উপধারায় সালিস পরিষদ গঠনের যে নিয়ম আছে অর্থাত্ চেয়ারম্যান। স্বামীর পক্ষে একজন প্রতিনিধি ও স্ত্রীর পক্ষে একজন প্রতিনিধি নিয়ে সেটা গঠন করা হবে, সেটা নিম্নরূপ সংশোধন করার জন্য আমি প্রস্তাব রাখছি:
‘২ (ক) ৭ ধারার ১ উপধারা অনুযায়ী দেওয়া নোটিশের নিষ্পত্তির জন্য চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে দুজন মহিলা ও দুজন পুরুষ সদস্যের মনোনয়ন দেবেন এবং পাঁচ সদস্যর একটি সালিস পরিষদ গঠিত হবে। তবে শর্ত থাকে ২ (খ) ধারায় উল্লিখিত চেয়ারম্যানরা সালিস পরিষদের সদস্য মনোনীত করার উদ্দেশ্যে তাঁদের স্ব-স্ব এলাকায় উপযুক্ত আস্থাবান অন্যূন ১৫ জন সমসংখ্যক মহিলা ও পুরুষের তালিকা প্রস্তুত রাখবেন। আরও শর্ত থাকে যে শুনানির প্রথম তারিখে পক্ষগণের মধ্যে কেউ মনোনীত এক কিংবা একাধিক কোনো সদস্যের মনোনয়নে আপত্তি করলে চেয়ারম্যান অন্য সদস্য কিংবা সদস্যদের মনোনয়ন দেবেন।’
উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের (৩) ও (৪) ধারা দুটি বাতিল হবে এবং ৭ উপধারা হিসেবে যোগ হবে এই বিষয়গুলো: ‘৭ (১) সালিস পরিষদ সমঝোতার ভিত্তিতে তালাক অকার্যকর করতে ব্যর্থ হলে নিম্নলিখিত রোয়েদাদ দেবেন: (ক) দেনমোহরের পরিমাণ (যদি বকেয়া থাকে); (খ) ইদ্দতকালীন ভরণপোষণের জন্য অর্থের পরিমাণ (যদি ইতিপূর্বে না দেওয়া হয়); (গ) বিবাহকালীন স্বামীর নামে কিংবা স্ত্রীর নামে কিংবা উভয়ের নামে অর্জিত (কিন্তু দান কিংবা হেবামূলে প্রাপ্ত নয়) স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির তুলাংশ বণ্টন; (ঘ) প্রাপ্ত অংশ দ্বারা তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ পর্যাপ্ত না হলে পুনর্বিবাহ না করা পর্যন্ত তা পূরণের জন্য স্বামীর দেয় মাসিক কিংবা বাত্সরিক অর্থের পরিমাণ; এবং (ঙ) নাবালক সন্তান কিংবা সন্তানদের অভিভাবকত্ব সাব্যস্ত ও মাতা যদি অভিভাবক সাব্যস্ত হন তবে সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য পিতা কর্তৃক দেয় মাসিক কিংবা বাত্সরিক অর্থের পরিমাণ। (২) রোয়েদাদে প্রদত্ত অর্থের কিংবা সম্পত্তির মূল্যের পরিমাণ যা হোক না কেন, রোয়েদাদটি ওই এলাকার সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের ডিক্রি গণ্যে সেই সহকারী জজ আদালত কর্তৃক দেওয়ানি কার্যবিধির ২১ আদেশের অন্তর্ভুক্ত নিয়মগুলোর মাধ্যমে রোয়েদাদটি কার্যকর করা যাবে।’
প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে তালাক দিতে চাইলে তাঁকে কী করতে হবে। এই অর্ডিন্যান্সের ৮ ধারায় বলা আছে, স্ত্রীকে সে ক্ষেত্রে উপরিউক্ত ৭ ধারা অনুযায়ী নোটিশ দিতে হবে। এই অর্ডিন্যান্সের সবচেয়ে অবমাননাকর ও লজ্জাদায়ক ধারাটি হচ্ছে ৬ ধারা। সেটা হচ্ছে সালিস পরিষদের অনুমতি সাপেক্ষে একাধিক বিয়ে করা যাবে। অথচ সত্য কথাটি হচ্ছে, ইসলাম বহু বিবাহ সমর্থন করে না। অজ্ঞানতার যুগে বাধাহীন নারীকে বিয়ে করার পরিবর্তে সর্বাধিক স্ত্রী গ্রহণের সংখ্যা চার সীমিত করা হয় এই শর্তে যে স্ত্রীদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম-আচরণ ও সুবিচার করতে হবে (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩)। এ আয়াতটি নাজিল হয় ওহুদ যুদ্ধের পরে। এই যুদ্ধে অনেক মুসলমান শহীদ হওয়ায় এতিম ও বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অতঃপর সূরা আন-নিসার ১২৯ আয়াতে বলা হয়: ‘এবং তোমরা যতই আগ্রহ করো না কেন, তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি সমান ব্যবহার করতে কখনোই পারবে না।’
সহিহ আল-বুখারির সপ্তম খণ্ডে ১৫৭ নম্বর হাদিসটি এই: ‘আল-মিসওয়ার বিন মাখরামা বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) -কে মিম্বর থেকে বলতে শুনেছি, ‘বনি হাসিম বিন আল-মুখিরা আমাকে অনুরোধ করেছেন যে আমি যেন তাদের কন্যার সঙ্গে আলি বিন তালিবের বিবাহে অনুমতি দিই। কিন্তু আমি অনুমতি দিইনি এবং অনুমতি দেব না যতক্ষণ না আলি আমার কন্যা ফাতিমাকে তালাক দেয়। কারণ, ফাতিমা আমার দেহের টুকরা এবং আমি ঘৃণা করি যা সে ঘৃণা করে আর যা তাকে ব্যথা দেয়, তা আমাকেও ব্যথা দেয়।’
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে সূরা আল-আহজাবের ৫২ নম্বর এই আয়াতটি নাজিল হয়: ‘অতঃপর তোমার (অর্থাত্ আল্লাহর রাসুল) জন্য কোনো নারী বৈধ নয় এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নয়।’ সুতরাং স্ত্রীদের প্রতি সম-আচরণ করতে হবে এই শর্তটি পালন দুঃসাধ্য বিধায় ইসলাম এক বিয়েকে নির্দেশ দেয়। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর জামাতাকে আরেকটি বিয়ে করার প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করেছিলেন ওই একই কারণে যে হজরত আলি (রা.) দুই স্ত্রীর প্রতি সম-আচরণ করতে পারবেন না। তিউনিসিয়া ১৯৫৭ সালে আইন করে একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। উপরিউক্ত অর্ডিন্যান্সের ৬ ধারাটি অবশ্যই বিলুপ্ত করে তত্স্থলে একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করে একটি ধারা যোগ করতে হবে।
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments