ব্যাংকগুলোর শেয়ার ব্যবসা এবং অপেক্ষাধীন বিপদ by আবু আহমেদ
আমাদের ব্যাংকগুলো এখন বর্ধিত হারে শেয়ার ব্যবসায় নেমে পড়েছে। তারা দুইভাবে ব্যবসা করছে, এক. হাজার হাজার অন্য শেয়ার ব্যবসায়ীদের, বিশেষ করে ব্যক্তি শেয়ার ব্যবসায়ীদের কাছে ঋণ বিক্রয় করে। এই ঋণ বেচার অন্য নাম হলো মার্জিন সুবিধা। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করে বলি। এ ক্ষেত্রে শেয়ার ব্যবসায়ী পকেট থেকে এক লাখ টাকা দিলে ব্যাংকগুলো দিচ্ছে আরও দেড় লাখ টাকা। ব্যাংকগুলো কোন অনুপাতে শেয়ার কিনতে ঋণ বেচতে পারে, সেটা নির্ভর করছে রেগুলেটর এসইসির রেগুলেশন তথা নির্দেশনার ওপর। একটা সময় ছিল যখন ঋণ প্রদানের অনুপাত আরও বেশি ছিল। এরই পাশাপাশি অন্য ব্রোকার হাউসগুলোও ঋণ বেচার সুবিধা চাইল এবং রেগুলেটর সেটা মঞ্জুর করল। এত দিন জানতাম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান না হলে ঋণ বেচা যায় না, এখন শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। শুনেছি ব্রোকার হাউসগুলোর ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানের ক্ষমতা আরও বেশি। সবকিছু মিলিয়ে এখন ঋণের মাধ্যমে যে তারল্য প্রবাহ আমাদের শেয়ারবাজারে ঘটছে, তা এক অর্থে শেয়ারের সরবরাহের তুলনায় বিশাল। ফল হয়েছে, এখন অনেক ‘জেড’ গ্রুপের শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত ৫০-এর ওপরে। ঋণের প্রবাহের ওপর একটু কড়াকড়ি আরোপ করলে বাজারে অতি তেজিভাব থেকে উদ্ভূত শঙ্কাটা কিছুটা হলেও স্তিমিত হতো।
তবে এখন শেয়ারবাজারে ঋণ বেচা ব্যাংকগুলোর জন্য একটা বড় ব্যবসা। যেসব ব্যাংক শেয়ারবাজার ব্যবসায় সফল, ওই সব ব্যাংকের আয় বা ‘ইপিএস’ও ভালো। বিগত দুই বছর বিনিয়োগ ও ব্যবসায় অন্যত্র খরা যাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই শেয়ার ব্যবসা এবং শেয়ার কেনার ঋণ প্রদানের ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ঝুঁকে পড়ে অবশ্যই তারা লাভও করেছে। যদিও অনেকেই মনে করছেন, সেই লাভ আপাতত। তাদের লাভের প্রমাণ হলো, যেসব ব্যাংক শেয়ারবাজারে ঋণ বেচায় সফল হয়েছে, ওই সব ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক ওপরে।
ঋণ বেচার সুবিধা হয় যখন ব্যাংকের নিজস্ব ব্রোকারশিপ বা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যপদ থাকে। স্বাভাবিকভাবে তাদের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দিক দিয়ে অন্য ধাঁচের ব্রোকারেরা কুলিয়ে উঠতে পারবে না। একদিকে সামান্য কাগজপত্র সইয়ের বিপরীতে ঋণ সুবিধা, অন্য দিকে ভালো আদর-আপ্যায়ন, সবকিছু মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর মার্চেন্ট ব্যাংক শাখার ব্যবসা রমরমা। তবে এসব ব্যাংক বা তাদেরই সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো কী হারে ঋণের মূল্য তথা সুদ আদায় করছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্য রেগুলেটর এসইসি একেবারেই অমনোযোগী। আমাকে কিছু গ্রাহক বলল, ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনার বিপরীতে দেয় ঋণে ১৬ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করছে। এর ওপর আছে নানাবিধ সার্ভিস চার্জ। সবকিছু মিলিয়ে এর সুদ এসে পড়ে ১৮ শতাংশ। ব্যাপারটি ঠিক কি না সেটা রেগুলেটর দেখতে পারে। তবে আমাদের অর্থনীতিতে রেগুলেটর সময় থাকতে যেমন অমনোযোগী থাকে, আবার ভাবটা দেখায় এটা দেখা তাদের কাজ নয়। তাহলে কি ঋণের চাহিদাই ঋণের মূল্য, তথা সুদ নির্ধারণ করবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কেনই বা চেঁচামেচি করছে, সুদ কমাও।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটা হুকুম জারি করেছে যে ব্যাংকগুলোকে ব্রোকিং সেবা দিতে হলে, শেয়ার কেনার ঋণের জোগানদার হতে গেলে আলাদা সাবসিডিয়ারি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক করে নিতে হবে। হুকুম দেওয়ায় প্রায় সব ব্যাংকই ইতিমধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। এটা করতে তাদের এতটুকুও অসুবিধা হয়নি। কারণ, পুঁজি তো আগে থেকেই এসব কাজ-কারবারে খাটছিল। সেই পুঁজিকে আরও বৃদ্ধি করে পুরনো পুঁজির সঙ্গে একত্র করে তারা মার্চেন্ট ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত মূলধন জোগান দিয়েছে। হুকুমমতো কিছুটা আলাদা একটা পরিচালনা পর্ষদও দাঁড় করানো তেমন কঠিন কোনো বিষয় হয়নি। তবে যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে লেন-দেনের ক্ষেত্রে আলাদা সাবসিডিয়ারি করতে বলেছে, সেই উদ্দেশ্যটা অর্জিত হচ্ছে কি না সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকই ভালো বলতে পারে।
আলাদাকরণের তাগিদটা এসেছে এ ক্ষেত্রে ইতিহাস থেকে। ১৯২৯ সালে মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নামে। এর তিন-চার বছরের মধ্যে ওদের পুরো অর্থনীতিই মন্দাক্রান্ত হয়। সেই মন্দার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মহামন্দা’। আজও সেই মহামন্দাকে অন্য মন্দাগুলো ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সেই মন্দা কেন হলো এ নিয়ে গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার রচনা-প্রতিবেদন লিখেছেন। মন্দা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে নীতি-নির্ধারকদেরকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। সেই মহামন্দার আগের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেল, মন্দার আগের দশকে ব্যাংকগুলো অতি উদারভাবে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করছিল। ঋণের অর্থে শেয়ার কিনতে গিয়ে অনেকে ঝুঁকির ব্যাপারটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। শেয়ারবাজারে ধস নামার কারণে ব্যাংক ঋণের অর্থ আর পুরোটা ফেরত পায়নি। আর শেয়ারবাজারে ধসের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও ধস শুরু হয়ে গেল। তবে সে ধস প্রকৃত তথা উত্পাদনের অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ল। আর সেই সঙ্গে শুরু হলো মহামন্দার শুরু। মন্দার মাঝামাঝি সময় গিয়ে আমেরিকানদের মনে হলো, তারা দুই ক্ষেত্রে ভুল করে ফেলেছে। এক. তারা শেয়ারবাজারের জন্য কোনো রেগুলেটর স্থাপন করেনি। তাই তারা ১৯৩৩ সালে শেয়ারবাজার রেগুলেটর এসইসিকে স্থাপন করল। দুই. তারা ব্যাংকগুলোকে অবাধে শেয়ারবাজারে ঋণ বেচার অনুমতি দিয়েছে। সেই ঋণপ্রবাহ শেয়ারের মূল্যকে আয়ের তুলনায় ৩৫ গুণ ওপরে নিয়ে গিয়েছিল। তাই তারাও হুকুম জারি করল, এখন থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আর শেয়ারবাজারে ঋণ বেচতে পারবে না। ঋণ বেচতে হলে আলাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তাদের অর্থনীতিতে, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা বিনিয়োগ ব্যাংক নামে পরিচিত, প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের কাজগুলো আলাদা হয়ে গেল, যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্রায় একই কাজ দুই ব্যাংকই করে আসছিল।
আমাদের অর্থনীতিতে মার্চেন্ট ব্যাংক স্থাপনের হুকুম জারি হয়েছে সত্যি, তবে তাদের অর্থের উত্স কী, এই ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের প্রধান মালিক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ এনে আবার কিছু মার্জিন রেখে সেই ঋণ বিক্রয় করছে ওই হাজার হাজার শেয়ার ব্যবসায়ীর কাছে। আইএমএফ ইতিমধ্যে বলে দিয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত শেয়ারবাজারমুখিতা তাদেরকে বিপদে ফেলতে পারে। তবে ব্যাংকাররা এই ঋণ বেচার মধ্যে বিপদ দেখেন না। কারণ, তাঁরা ঋণ দিচ্ছেন এক লাখ টাকা, জামানত রাখছেন এক লাখ টাকার বা আরও বেশী মূল্যের শেয়ার। বাজার পড়তে শুরু করলে ব্যাংকার ঋণ ক্রেতার শেয়ার বেচে পাওনাকে অতি দ্রুত সমন্বয় করে নেবেন। আসলে বিপদটা ব্যাংকের জন্য নয়। বিপদটা বেশি হলো ঋণ ক্রেতার জন্য, যিনি উঠতি বাজারে অনেক লাভ করছেন ভাবেন। বিপদটা তো আসবে পড়তি বাজারে, যেমন করে ১৯২৯ সালে লাখ লাখ আমেরিকান তাদের পকেট থেকে দেয় অর্থের পুরোটাই হারিয়েছিল।
শেয়ারবাজারে ধস নামলে বা বড় রকমের সংশোধন হতে গেলে তখন সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। তখন কিন্তু শেয়ার সরবরাহের অভাব হবে না। ব্যাংকগুলো অন্য যে কাজটি করছে, সেটা হলো নিজেদের বিনিয়োগ হিসেবে শেয়ার বেচাকেনা। এটাও তারা রেগুলেশন মেনে করতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর জন্য এ ক্ষেত্রে বিপদ আছে। ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনতে গিয়ে যদি বাজার উত্থান-পতনে ২০০ কোটি টাকা হারিয়ে যায়, তাহলে লাভ-লোকসান হিসেবে ওই হারানোকে প্রভিশনিং করে শেয়ার মালিকদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। যে ব্যাংকের পুঁজি ৪০০ কোটি টাকা, সেই ব্যাংক যদি নিজের পোর্টফলিওতে শেয়ার বেচাকেনা করতে গিয়ে ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে দেয়, তাহলে শেয়ারপ্রতি আয় কতটা কমবে, সেটা ব্যাংকের মালিকেরাও সহজে হিসাব করে ফেলতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রেই আইএমএফের বেশি উদ্বেগ।
বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংকিং কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে শেয়ারবাজারে বেচাকেনা করতে গিয়ে। ঋণ বেচতে গিয়েও নিঃস্ব হয়েছে, তার নজিরও অনেক আছে। শেষ পর্যন্ত জামানত সম্পত্তির মূল্য কমে গিয়ে ব্যাংক আর তার ঋণকে তুলতে পারেনি। আমাদের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থাকে সাময়িক মনে হয়। অতি দ্রুত অতি উঁচুতে এই বাজার পৌঁছে গেছে। কোনো বড় রকমের সংশোধন হলে তার মাসুল দিতে হবে কিন্তু লাখ লাখ ঋণ ক্রেতাকে, যে ঋণ তাঁদেরকে বিনিয়োগকারী না বানিয়ে শেয়ার ব্যবসায়ী বানিয়েছে। তাঁরা চলে গেলে ঋণ বেচা যেমন বন্ধ হবে, তেমনি অন্যত্রও শীতলতা নেমে আসবে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাবি।
তবে এখন শেয়ারবাজারে ঋণ বেচা ব্যাংকগুলোর জন্য একটা বড় ব্যবসা। যেসব ব্যাংক শেয়ারবাজার ব্যবসায় সফল, ওই সব ব্যাংকের আয় বা ‘ইপিএস’ও ভালো। বিগত দুই বছর বিনিয়োগ ও ব্যবসায় অন্যত্র খরা যাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই শেয়ার ব্যবসা এবং শেয়ার কেনার ঋণ প্রদানের ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ঝুঁকে পড়ে অবশ্যই তারা লাভও করেছে। যদিও অনেকেই মনে করছেন, সেই লাভ আপাতত। তাদের লাভের প্রমাণ হলো, যেসব ব্যাংক শেয়ারবাজারে ঋণ বেচায় সফল হয়েছে, ওই সব ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস অন্য ব্যাংকগুলোর তুলনায় অনেক ওপরে।
ঋণ বেচার সুবিধা হয় যখন ব্যাংকের নিজস্ব ব্রোকারশিপ বা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যপদ থাকে। স্বাভাবিকভাবে তাদের সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দিক দিয়ে অন্য ধাঁচের ব্রোকারেরা কুলিয়ে উঠতে পারবে না। একদিকে সামান্য কাগজপত্র সইয়ের বিপরীতে ঋণ সুবিধা, অন্য দিকে ভালো আদর-আপ্যায়ন, সবকিছু মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর মার্চেন্ট ব্যাংক শাখার ব্যবসা রমরমা। তবে এসব ব্যাংক বা তাদেরই সাবসিডিয়ারি মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো কী হারে ঋণের মূল্য তথা সুদ আদায় করছে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্য রেগুলেটর এসইসি একেবারেই অমনোযোগী। আমাকে কিছু গ্রাহক বলল, ব্যাংকগুলো শেয়ার কেনার বিপরীতে দেয় ঋণে ১৬ শতাংশ হারে সুদ চার্জ করছে। এর ওপর আছে নানাবিধ সার্ভিস চার্জ। সবকিছু মিলিয়ে এর সুদ এসে পড়ে ১৮ শতাংশ। ব্যাপারটি ঠিক কি না সেটা রেগুলেটর দেখতে পারে। তবে আমাদের অর্থনীতিতে রেগুলেটর সময় থাকতে যেমন অমনোযোগী থাকে, আবার ভাবটা দেখায় এটা দেখা তাদের কাজ নয়। তাহলে কি ঋণের চাহিদাই ঋণের মূল্য, তথা সুদ নির্ধারণ করবে? যদি তা-ই হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক কেনই বা চেঁচামেচি করছে, সুদ কমাও।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটা হুকুম জারি করেছে যে ব্যাংকগুলোকে ব্রোকিং সেবা দিতে হলে, শেয়ার কেনার ঋণের জোগানদার হতে গেলে আলাদা সাবসিডিয়ারি এবং মার্চেন্ট ব্যাংক করে নিতে হবে। হুকুম দেওয়ায় প্রায় সব ব্যাংকই ইতিমধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। এটা করতে তাদের এতটুকুও অসুবিধা হয়নি। কারণ, পুঁজি তো আগে থেকেই এসব কাজ-কারবারে খাটছিল। সেই পুঁজিকে আরও বৃদ্ধি করে পুরনো পুঁজির সঙ্গে একত্র করে তারা মার্চেন্ট ব্যাংকের পেইড আপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত মূলধন জোগান দিয়েছে। হুকুমমতো কিছুটা আলাদা একটা পরিচালনা পর্ষদও দাঁড় করানো তেমন কঠিন কোনো বিষয় হয়নি। তবে যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে লেন-দেনের ক্ষেত্রে আলাদা সাবসিডিয়ারি করতে বলেছে, সেই উদ্দেশ্যটা অর্জিত হচ্ছে কি না সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকই ভালো বলতে পারে।
আলাদাকরণের তাগিদটা এসেছে এ ক্ষেত্রে ইতিহাস থেকে। ১৯২৯ সালে মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নামে। এর তিন-চার বছরের মধ্যে ওদের পুরো অর্থনীতিই মন্দাক্রান্ত হয়। সেই মন্দার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মহামন্দা’। আজও সেই মহামন্দাকে অন্য মন্দাগুলো ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। সেই মন্দা কেন হলো এ নিয়ে গবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার রচনা-প্রতিবেদন লিখেছেন। মন্দা যাতে ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে নীতি-নির্ধারকদেরকে অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। সেই মহামন্দার আগের অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা গেল, মন্দার আগের দশকে ব্যাংকগুলো অতি উদারভাবে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করছিল। ঋণের অর্থে শেয়ার কিনতে গিয়ে অনেকে ঝুঁকির ব্যাপারটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। শেয়ারবাজারে ধস নামার কারণে ব্যাংক ঋণের অর্থ আর পুরোটা ফেরত পায়নি। আর শেয়ারবাজারে ধসের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়ও ধস শুরু হয়ে গেল। তবে সে ধস প্রকৃত তথা উত্পাদনের অর্থনীতিতেও ছড়িয়ে পড়ল। আর সেই সঙ্গে শুরু হলো মহামন্দার শুরু। মন্দার মাঝামাঝি সময় গিয়ে আমেরিকানদের মনে হলো, তারা দুই ক্ষেত্রে ভুল করে ফেলেছে। এক. তারা শেয়ারবাজারের জন্য কোনো রেগুলেটর স্থাপন করেনি। তাই তারা ১৯৩৩ সালে শেয়ারবাজার রেগুলেটর এসইসিকে স্থাপন করল। দুই. তারা ব্যাংকগুলোকে অবাধে শেয়ারবাজারে ঋণ বেচার অনুমতি দিয়েছে। সেই ঋণপ্রবাহ শেয়ারের মূল্যকে আয়ের তুলনায় ৩৫ গুণ ওপরে নিয়ে গিয়েছিল। তাই তারাও হুকুম জারি করল, এখন থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আর শেয়ারবাজারে ঋণ বেচতে পারবে না। ঋণ বেচতে হলে আলাদা আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যা তাদের অর্থনীতিতে, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা বিনিয়োগ ব্যাংক নামে পরিচিত, প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেই থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যাংকের কাজগুলো আলাদা হয়ে গেল, যদিও অনেক ক্ষেত্রে প্রায় একই কাজ দুই ব্যাংকই করে আসছিল।
আমাদের অর্থনীতিতে মার্চেন্ট ব্যাংক স্থাপনের হুকুম জারি হয়েছে সত্যি, তবে তাদের অর্থের উত্স কী, এই ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের প্রধান মালিক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ এনে আবার কিছু মার্জিন রেখে সেই ঋণ বিক্রয় করছে ওই হাজার হাজার শেয়ার ব্যবসায়ীর কাছে। আইএমএফ ইতিমধ্যে বলে দিয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত শেয়ারবাজারমুখিতা তাদেরকে বিপদে ফেলতে পারে। তবে ব্যাংকাররা এই ঋণ বেচার মধ্যে বিপদ দেখেন না। কারণ, তাঁরা ঋণ দিচ্ছেন এক লাখ টাকা, জামানত রাখছেন এক লাখ টাকার বা আরও বেশী মূল্যের শেয়ার। বাজার পড়তে শুরু করলে ব্যাংকার ঋণ ক্রেতার শেয়ার বেচে পাওনাকে অতি দ্রুত সমন্বয় করে নেবেন। আসলে বিপদটা ব্যাংকের জন্য নয়। বিপদটা বেশি হলো ঋণ ক্রেতার জন্য, যিনি উঠতি বাজারে অনেক লাভ করছেন ভাবেন। বিপদটা তো আসবে পড়তি বাজারে, যেমন করে ১৯২৯ সালে লাখ লাখ আমেরিকান তাদের পকেট থেকে দেয় অর্থের পুরোটাই হারিয়েছিল।
শেয়ারবাজারে ধস নামলে বা বড় রকমের সংশোধন হতে গেলে তখন সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। তখন কিন্তু শেয়ার সরবরাহের অভাব হবে না। ব্যাংকগুলো অন্য যে কাজটি করছে, সেটা হলো নিজেদের বিনিয়োগ হিসেবে শেয়ার বেচাকেনা। এটাও তারা রেগুলেশন মেনে করতে পারে। তবে ব্যাংকগুলোর জন্য এ ক্ষেত্রে বিপদ আছে। ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার কিনতে গিয়ে যদি বাজার উত্থান-পতনে ২০০ কোটি টাকা হারিয়ে যায়, তাহলে লাভ-লোকসান হিসেবে ওই হারানোকে প্রভিশনিং করে শেয়ার মালিকদের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। যে ব্যাংকের পুঁজি ৪০০ কোটি টাকা, সেই ব্যাংক যদি নিজের পোর্টফলিওতে শেয়ার বেচাকেনা করতে গিয়ে ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে দেয়, তাহলে শেয়ারপ্রতি আয় কতটা কমবে, সেটা ব্যাংকের মালিকেরাও সহজে হিসাব করে ফেলতে পারেন। আর এ ক্ষেত্রেই আইএমএফের বেশি উদ্বেগ।
বিশ্বের অনেক দেশেই ব্যাংকিং কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে শেয়ারবাজারে বেচাকেনা করতে গিয়ে। ঋণ বেচতে গিয়েও নিঃস্ব হয়েছে, তার নজিরও অনেক আছে। শেষ পর্যন্ত জামানত সম্পত্তির মূল্য কমে গিয়ে ব্যাংক আর তার ঋণকে তুলতে পারেনি। আমাদের অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থাকে সাময়িক মনে হয়। অতি দ্রুত অতি উঁচুতে এই বাজার পৌঁছে গেছে। কোনো বড় রকমের সংশোধন হলে তার মাসুল দিতে হবে কিন্তু লাখ লাখ ঋণ ক্রেতাকে, যে ঋণ তাঁদেরকে বিনিয়োগকারী না বানিয়ে শেয়ার ব্যবসায়ী বানিয়েছে। তাঁরা চলে গেলে ঋণ বেচা যেমন বন্ধ হবে, তেমনি অন্যত্রও শীতলতা নেমে আসবে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাবি।
No comments