ভাষাশহীদ সালামের কথা by দীপংকর চন্দ
‘আমার জন্ম ১৯৪৭ সালের সংশয়াকীর্ণ সময়ে। আসন্ন দেশভাগ নিয়ে তখন উৎকণ্ঠিত অবিভক্ত বাংলার মানুষ। আমার কৃষিজীবী বাবা মো. ফাজিল মিয়াও অন্য সবার মতোই আসন্ন দেশভাগের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে হিসাব কষছিলেন। ঠিক ওই সময়ই আমার মা দৌলতুন্নেসা জন্ম দিলেন আমাকে।’ বলতে বলতে একটু থামলেন ষাটোর্ধ্ব আবদুল করিম, তারপর কথা শুরু করলেন আবার।
‘ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম লক্ষ্মণপুরে থাকি আমরা। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তান আমি। স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে এই সব রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচের বিন্দুবিসর্গ বোঝা সম্ভব ছিল না তখন। আমাদের সংসারে বাবা ছাড়া দেশ ও দশের খবরে উত্সাহী ছিলেন আমার বড় ভাই আবদুস সালাম। হ্যাঁ, বায়ান্নর ভাষাশহীদ আবদুস সালামের কথাই বলছি আমি। নানা সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে আমার অকৃতদার বড় ভাইয়ের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর দাগনভূঞা উপজেলার বেকের বাজার সংলগ্ন লক্ষ্মণপুর গ্রামেই।
‘আমার বাবা কৃষিজীবী হলেও প্রকৃতই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তিনি আমার বড় ভাই আবদুস সালামকে লক্ষ্মণপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে অবস্থিত কৃষ্ণরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর আবদুস সালাম ভর্তি হন মাতুভূঞা করিমউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরের এই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী অবধি শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। তারপর আবদুস সালাম বিদ্যালয় পরিবর্তন করেন। প্রায় তিন মাইল দূরের উপজেলা সদরে অবস্থিত দাগনভূঞা কামাল আতাতুর্ক উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। এই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা নিলেও কেবল সাংসারিক অসচ্ছলতার কারণেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে ব্যর্থ হন আবদুস সালাম। এরপর বেশ কিছুদিন গ্রামের কর্মহীন পরিবেশে জীবন অতিবাহিত হয় তাঁর। কিন্তু এই কর্মহীন জীবন যাপন নিরর্থক মনে হয় সালামের কাছে। জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতেই একদিন তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে ভাগ্যান্বেষণের একপর্যায়ে শিল্প দপ্তরে রেকর্ড-কিপার হিসেবে চাকরিও জুটে যায় তাঁর। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বিনষ্ট করে কলকাতায় সালামের চাকরির ভবিষ্যৎ। ভাগ্যবিড়ম্বিত সালাম শূন্য হাতে ফিরে আসেন গ্রামে। তারপর অন্তরে অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন একদিন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল আবদুস সালামের। অল্প দিনের চেষ্টায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজে রেকর্ড-কিপার হিসেবেই চাকরি পেলেন আবার। দিলকুশায় অফিস ভবনে আবার শুরু হলো তাঁর কর্মব্যস্ত জীবন। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না আবদুস সালামের। এবার তিনি বাসস্থান অনুসন্ধানে সচেষ্ট হলেন। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে আবদুস সালাম নীলক্ষেতে অবস্থিত সরকারি ব্যারাকে একটি ব্যাচেলর সিট পেলেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম পাদে নীলক্ষেত সরকারি ব্যারাকে উঠে এলেন আবদুস সালাম এবং এ বছরের সূচনালগ্নেই ঢাকায় শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে তীব্র আন্দোলন।
‘আমার বড় ভাই আবদুস সালাম ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি-সচেতন। কিন্তু কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে জড়ানোর প্রত্যক্ষ সুযোগ তাঁর ঘটেনি কোনোকালেই। চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস এবার সে সুযোগ সৃষ্টি করল সালামের জীবনে। তিনি দেখলেন, ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে জোয়ার তৈরি হলো বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার প্রেক্ষাপটে, পরবর্তী বছরগুলোতেও কী দারুণভাবে তা সক্রিয় রইল!
‘এভাবেই ১৯৫২ সাল এল। ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল সেদিন। কিন্তু পূর্বঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্ররাও জড়ো হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হলো বেলা ১১টায়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে দলে দলে ছাত্ররা এগিয়ে গেল ১৪৪ ধারা ভাঙতে। পুলিশ বাধা দিল, গ্রেপ্তার করল অনেককে। কিন্তু এতেও যখন নিবৃত্ত করা গেল না ছাত্রদের, তখন তারা লাঠিচার্জ করল, নিক্ষেপ করল কাঁদানে গ্যাস। ছাত্রদের প্রতি পুলিশের এই অন্যায় আচরণ ব্যথিত করল উপস্থিত জনতাকে। আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করল তারা। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হলো। অপরাহ্নে ছাত্র-জনতা অবস্থান নিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনে।
‘আবদুস সালাম সেদিন কর্মস্থল থেকে নীলক্ষেতের সরকারি ব্যারাকে ফিরেছিলেন তাড়াতাড়িই। ফিরেই উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য দ্রুত ছুটে গিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে। সেখানে পৌঁছে তিনি শাসকগোষ্ঠীর বিরূপ আচরণে ব্যথিত হলেন। সালামের সেই ব্যথা একসময় পরিণত হলো বিক্ষুব্ধতায়। বিক্ষুব্ধ সালাম রাজপথ বিদীর্ণ করা চিত্কার করতে করতে আন্দেলনরত ছাত্র-জনতার সঙ্গে অজান্তেই মিশে গেলেন। পুলিশ সচেতনভাবেই গুলি ছুড়ল ছাত্র-জনতার মিছিলে। সেই মিছিলের অবিভাজ্য অংশ আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হলেন নৃশংসভাবে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হলো তাঁকে। চিকিৎসাও দেওয়া হলো যথোপযুক্ত। কিন্তু প্রায় দেড় মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আমার বড় ভাই। যত দূর মনে পড়ে, সেই দিনটি ছিল বায়ান্নর ৭ এপ্রিল।’ বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে আবদুল করিমের কণ্ঠস্বর।
‘ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের ছোট্ট গ্রাম লক্ষ্মণপুরে থাকি আমরা। চার ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সন্তান আমি। স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে এই সব রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচের বিন্দুবিসর্গ বোঝা সম্ভব ছিল না তখন। আমাদের সংসারে বাবা ছাড়া দেশ ও দশের খবরে উত্সাহী ছিলেন আমার বড় ভাই আবদুস সালাম। হ্যাঁ, বায়ান্নর ভাষাশহীদ আবদুস সালামের কথাই বলছি আমি। নানা সূত্রে পাওয়া তথ্যানুসারে আমার অকৃতদার বড় ভাইয়ের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর দাগনভূঞা উপজেলার বেকের বাজার সংলগ্ন লক্ষ্মণপুর গ্রামেই।
‘আমার বাবা কৃষিজীবী হলেও প্রকৃতই বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তিনি আমার বড় ভাই আবদুস সালামকে লক্ষ্মণপুর থেকে মাইল দেড়েক দূরে অবস্থিত কৃষ্ণরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পর আবদুস সালাম ভর্তি হন মাতুভূঞা করিমউল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়ে। বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরের এই বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী অবধি শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। তারপর আবদুস সালাম বিদ্যালয় পরিবর্তন করেন। প্রায় তিন মাইল দূরের উপজেলা সদরে অবস্থিত দাগনভূঞা কামাল আতাতুর্ক উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন তিনি। এই বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা নিলেও কেবল সাংসারিক অসচ্ছলতার কারণেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে ব্যর্থ হন আবদুস সালাম। এরপর বেশ কিছুদিন গ্রামের কর্মহীন পরিবেশে জীবন অতিবাহিত হয় তাঁর। কিন্তু এই কর্মহীন জীবন যাপন নিরর্থক মনে হয় সালামের কাছে। জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতেই একদিন তিনি পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে ভাগ্যান্বেষণের একপর্যায়ে শিল্প দপ্তরে রেকর্ড-কিপার হিসেবে চাকরিও জুটে যায় তাঁর। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বিনষ্ট করে কলকাতায় সালামের চাকরির ভবিষ্যৎ। ভাগ্যবিড়ম্বিত সালাম শূন্য হাতে ফিরে আসেন গ্রামে। তারপর অন্তরে অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন একদিন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল আবদুস সালামের। অল্প দিনের চেষ্টায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজে রেকর্ড-কিপার হিসেবেই চাকরি পেলেন আবার। দিলকুশায় অফিস ভবনে আবার শুরু হলো তাঁর কর্মব্যস্ত জীবন। চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঢাকায় নির্দিষ্ট বাসস্থান ছিল না আবদুস সালামের। এবার তিনি বাসস্থান অনুসন্ধানে সচেষ্ট হলেন। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে আবদুস সালাম নীলক্ষেতে অবস্থিত সরকারি ব্যারাকে একটি ব্যাচেলর সিট পেলেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম পাদে নীলক্ষেত সরকারি ব্যারাকে উঠে এলেন আবদুস সালাম এবং এ বছরের সূচনালগ্নেই ঢাকায় শুরু হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে তীব্র আন্দোলন।
‘আমার বড় ভাই আবদুস সালাম ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি-সচেতন। কিন্তু কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে জড়ানোর প্রত্যক্ষ সুযোগ তাঁর ঘটেনি কোনোকালেই। চাকরিসূত্রে ঢাকায় বসবাস এবার সে সুযোগ সৃষ্টি করল সালামের জীবনে। তিনি দেখলেন, ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে জোয়ার তৈরি হলো বাঙালির রাজনৈতিক চেতনার প্রেক্ষাপটে, পরবর্তী বছরগুলোতেও কী দারুণভাবে তা সক্রিয় রইল!
‘এভাবেই ১৯৫২ সাল এল। ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি ছিল সেদিন। কিন্তু পূর্বঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ছাত্ররাও জড়ো হলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হলো বেলা ১১টায়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে দলে দলে ছাত্ররা এগিয়ে গেল ১৪৪ ধারা ভাঙতে। পুলিশ বাধা দিল, গ্রেপ্তার করল অনেককে। কিন্তু এতেও যখন নিবৃত্ত করা গেল না ছাত্রদের, তখন তারা লাঠিচার্জ করল, নিক্ষেপ করল কাঁদানে গ্যাস। ছাত্রদের প্রতি পুলিশের এই অন্যায় আচরণ ব্যথিত করল উপস্থিত জনতাকে। আন্দোলনরত ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করল তারা। পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া শুরু হলো। অপরাহ্নে ছাত্র-জনতা অবস্থান নিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাকের সামনে।
‘আবদুস সালাম সেদিন কর্মস্থল থেকে নীলক্ষেতের সরকারি ব্যারাকে ফিরেছিলেন তাড়াতাড়িই। ফিরেই উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য দ্রুত ছুটে গিয়েছিলেন মেডিকেল কলেজ হোস্টেল ব্যারাক প্রাঙ্গণে। সেখানে পৌঁছে তিনি শাসকগোষ্ঠীর বিরূপ আচরণে ব্যথিত হলেন। সালামের সেই ব্যথা একসময় পরিণত হলো বিক্ষুব্ধতায়। বিক্ষুব্ধ সালাম রাজপথ বিদীর্ণ করা চিত্কার করতে করতে আন্দেলনরত ছাত্র-জনতার সঙ্গে অজান্তেই মিশে গেলেন। পুলিশ সচেতনভাবেই গুলি ছুড়ল ছাত্র-জনতার মিছিলে। সেই মিছিলের অবিভাজ্য অংশ আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হলেন নৃশংসভাবে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হলো তাঁকে। চিকিৎসাও দেওয়া হলো যথোপযুক্ত। কিন্তু প্রায় দেড় মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আমার বড় ভাই। যত দূর মনে পড়ে, সেই দিনটি ছিল বায়ান্নর ৭ এপ্রিল।’ বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে আবদুল করিমের কণ্ঠস্বর।
No comments