বাগাড়ম্বর, ভাবাবেগ ও শখ মেটানোর হুজুগ -যুক্তি তর্ক গল্প by আবুল মোমেন
আর দুদিন পরই একুশে ফেব্রুয়ারি। তবে আজকাল বইয়ের প্রকাশনা ও বইমেলা ঘিরে একুশের উত্সব ও আমেজ শুরু হয়ে যায় ফেব্রুয়ারির গোড়া থেকেই। ঢাকার মতো সারা দেশেই একুশের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে।
মূলে শহীদ দিবস হলেও একুশের চেতনায় বাঙালির অধিকার ও আত্মবিকাশের দৃপ্ত অঙ্গীকারই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমল জুড়ে একুশের ছিল প্রতিবাদী-সংগ্রামী রূপ। শহীদদের স্মরণ করা হয়, তবে তাঁদের ত্যাগের ফলে যে অর্জন, তা ঘিরে উত্সব ও আনন্দের আবহই প্রধান হয়ে উঠেছে এখন। এটা একুশের বিবর্তন, এমনকি উত্তরণও বলা যায়।
একুশকে ঘিরেই বাঙালির অধিকারের সংগ্রাম শুরু এবং তা ক্রমে স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একুশ যেন প্রেরণায় ও উদ্যাপনের আঙ্গিকে ছাপিয়ে গেছে স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকেও। একুশে উদ্যাপিত হয় মাসব্যাপী। বিজয় দিবসকে ঘিরে এ রকম প্রয়াস থাকলেও তা এখনো কি স্বতঃস্ফূর্ততায়, কি অংশগ্রহণে একুশের কাছাকাছি আসতে পারেনি।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় তার যেমন অর্জনের ব্যাপ্তি ঘটল, তেমনি তাত্পর্য ও উদ্যাপনের ক্ষেত্রেও কিছু নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
এত সব অর্জন, ব্যাপ্তি-উত্তরণের মধ্যে আমার ভাবনা ঘুরছে—এসবের পেছনে যে আবেগের ঢল দেখতে পাই তাকে ছাপিয়ে কাজের কাজ কতটা হচ্ছে—তা নিয়ে। ভয় এ জন্য বাড়ে যে ভাবনা-চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে আবেগে মাতামাতি করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও আমরা প্রায়ই খেলো করে ফেলি। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে ভাবাবেগপূর্ণ অনেক কথা বললেও নানাভাবে এসবকে খেলোও করেছি আমরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কীভাবে খেলো করা হলো, রাষ্ট্রপতির প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপি কীভাবে খেলো করল, সেসব একবার ভাবুন!
বহু বছর পর এবার বাংলা একাডেমীর বইমেলায় গিয়ে মনে হলো, বই লেখা, বই প্রকাশ করা—এ সবই নেহাত ছেলেখেলার বিষয় হয়ে যাচ্ছে। কেউ পাঁচটা, কেউ ছয়টা, কেউ এরও বেশি বই লিখে প্রকাশ করছেন এক বছরে! বঙ্গবন্ধুর নামকে যথেচ্ছ খেলো করার কাজে নেমেছে এক দল। তদ্রূপ জিয়া ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে চলছে ছেলেখেলা। অনেক কাল আগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশ বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ। কথাটা অসত্য নয়। তবে আজ মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ বহু মানুষের শখের দেশ—অর্থাত্ শখ পূরণের দেশ। এই শখের মধ্যে একটি সহজ খেলো শখ হচ্ছে বই লেখা ও লেখক হওয়া। অনেকের শখ মন্ত্রী হওয়া, ইদানীং অনেকে ভাবেন মন্ত্রীর চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার শখ পূরণ হলে মর্যাদা বেশি হবে। খালেদা জিয়া শখ করে ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি বানালেন, ইয়াজউদ্দিন শখ করে মফিজকে বানালেন প্রেস-সচিব।
একুশের প্রধান উত্সব বাংলা একাডেমীর বইমেলা। এটাই এখন শখ পূরণের প্রধান অঙ্গন। এ পর্যন্ত (১৬ ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১৮০০ নতুন বই এসেছে মেলায় আর দুই শতাধিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয়েছে। তাতে বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, সাংসদ, লেখক, সাহিত্যিকেরা অংশ নিয়েছেন। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে বাংলাদেশের সারস্বত সাধনা ও মনন-মনীষার চর্চা এবং সৃজন-সাহিত্যের বসন্তকাল যে চলছে, তা মানতেই হবে। দর্শনে একটা তত্ত্বে বলে appearance and reality, অর্থাত্ দৃশ্যত যে রকম কার্যত ব্যাপারটা তা নয় সব সময়। এই পৃথিবীটা দেখতে লাগে সমতল, কিন্তু কার্যত এটি গোল, আকাশটা দেখায় নীল কিন্তু বাস্তবে তার কোনো রং নেই। তো এই বিশাল মেলা, বিপুল প্রকাশনা, অসংখ্য নতুন বই, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এত আবেগ-ভালোবাসার কতটা বাস্তবে সত্য, এ প্রশ্ন কি তোলা যায় না?
কারণ বাংলা ভাষা চর্চার অবস্থাটা ভালো নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আধিপত্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাপিয়ে মফস্বলে পৌঁছেছে। এখন ক্রমে এর একটা করাপ্ট রূপ চালু হতে শুরু করেছে। এরও চেয়ে মারাত্মক হলো শিক্ষাভিমানী বাঙালির মনের অবস্থা। এখন ইংরেজিই তার সুয়োরানি, বাংলা দুয়ো। এত সাধের শখের মাতৃভাষা বাংলার বিনিময়ে হলেও সে সন্তানের ইংরেজি শেখার বিষয়ে তত্পর। ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু বর্তমান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অধিকাংশ সফল খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের সন্তান-সন্ততি যাচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, বেরোচ্ছে বাংলায় ভয়ংকর দুর্বলতা নিয়ে। তাতে ক্রিয়াত্মক শিল্প চলতে পারে, কিন্তু সাহিত্য ও মননসাধনার মতো ভাষানির্ভর কাজের কী হবে। এভাবে কি জাতি এগোবে?
এভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে মৌলিক গবেষণা, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা (এ নিয়ে বাংলা একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক অবশ্য একটা উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছেন), সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার সংকট ও সংস্কৃত জানা শিক্ষকের অভাব, স্কুল পর্যায়ে বাংলা শিক্ষকের মানের ক্রমাবনতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ তোলা যায়। এসব ক্ষেত্রে যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে, এর সঙ্গে মেলানো যাবে না বাগাড়ম্বর ও ভাবাবেগপূর্ণ সেমিনার, প্রকাশনা ও মেলার কার্যক্রমের চিত্রকে।
এরই সূত্র ধরে একটা কথা একটু ভাবার জন্য বলব। একুশে যদি আমার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির চেতনা এবং এগুলোকে অবলম্বন করে আত্মবিকাশের প্রেরণা হয়ে থাকে, তবে একুশের সূত্রে কেবল কি ভাষাশহীদেরাই আমাদের নায়ক থাকবেন? এঁরা বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের পুলিশি হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁরা শহীদ, সে কারণে তাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয়। তাঁদের কথা আমাদের ইতিহাসে অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং তাঁদের প্রসঙ্গে আমরা ইতিহাসে পাঠ করব।
একটু সংকোচের সঙ্গে বলি, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, শহীদ মাত্রেরই জীবন ছাত্র-শিশুদের জন্য কিছু স্মরণীয়-শিক্ষণীয় পাঠে সমৃদ্ধ নাও হতে পারে। আবারও বলছি, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো ও স্মরণ করা জাতির কর্তব্য। এ জন্য তাঁদের নামে স্কুল, কলেজ, পাঠাগারও হতে পারে। কিন্তু জীবনী পাঠের জন্য স্কুলছাত্রদের ওপর জবরদস্তি খাটানো উচিত কি না, ভেবে দেখা দরকার।
এ কথাটা আরও বিশেষভাবে বলছি, যদি একুশের চেতনা হয়ে থাকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ইত্যাদি, তাহলে এই চেতনা আমাদের কেন অনুপ্রাণিত করে না আধুনিক বাংলা গদ্যের নির্মাতা হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করতে, তিনি কেবল ভাষার ক্ষেত্রে নয়—সমাজ সংস্কার বাদ দিলাম—শিক্ষাবিস্তারে যে কাজ করেছেন, সে কারণে তাঁর নামে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম, কোনো মিলনায়তনের নাম হতে পারত না? এ গদ্যের ওপর যাঁরা সাহিত্যের সৌধ নির্মাণ করে যুগপত্ বাংলা ভাষা ও বাঙালি-মনীষার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, সেই বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের নামেও কি আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েছি? এভাবে বলা যাবে মাইকেল, লালন, নজরুল, জসীম, জয়নুল, আব্বাসউদ্দীনদের নামেই বা আমরা যথাযোগ্য কী করেছি?
একটা জাতি সালাম-জব্বার-রফিক-বরকতকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়, তাঁদের শ্রদ্ধা জানায় কিন্তু বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ হয়ে নজরুল-জসীম-জয়নুল-আব্বাসউদ্দীনদের বিস্মৃত হতে থাকলে তার সম্পর্কে কী ভাবব?
একই রকমের খটকা লাগে বীরশ্রেষ্ঠদের ব্যাপারেও। তাঁরা অবশ্যই আমাদের শ্রেষ্ঠবীর। তাঁরা অমর, তাঁদের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁদের নামে নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠবে নিশ্চয়। তাঁদের ত্যাগোদ্দীপ্ত বীরত্বব্যঞ্জক যুদ্ধগুলো নিয়ে সাহিত্যও রচিত হতে পারে, কিন্তু ঠিক স্বতন্ত্রভাবে জীবনীপাঠ্য করার কথা বললে মনে প্রশ্ন জাগে, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের মূল রূপকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্ত ও বিতর্কে লিপ্ত থাকে, মূল স্থপতি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে উদাসীন ও নির্লিপ্ত, তার জন্য এ কাজ কতটা যথার্থ হচ্ছে? এমনকি সে কেন মাস্টারদা সূর্য সেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা এবং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকবে?
তখন সংশয় হয়, আমরা ভাবনা-চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া হুজুগে মেতে উঠিনি তো?
বাংলাদেশ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই পথ হারাতে শুরু করেছিল। ১৯৭৫-এর পর থেকে সম্পূর্ণ বিপথগামী হয়ে গেল দেশ। আমরা মনে করছি বহুদিন বিপথে-বিপদে ঘুরপাক খেয়ে ভ্রান্তি-ব্যর্থতার গোলকধাঁধা পেরিয়ে এবার বোধহয় জাতি ঠিক পথে আসতে চাইছে। সে রকম কিছু লক্ষণ তত্ত্বাবধায়ক আমল থেকে দেখা যাচ্ছিল, এবং বিগত নির্বাচনে নতুন প্রজন্মসহ অধিকাংশ দেশবাসী সে রকম মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এই প্রত্যাশার দায় চেপেছে বর্তমান সরকারের ওপর, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের ওপর। একটু বলে নিতে চাই, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র অবশ্যই ছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা সফল হতে দিতে চায়নি, এসব কথা সত্য বটে, তবে সেই সঙ্গে এও সত্য যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে সেদিন সঠিক পথে চালাতে পারেনি।
এবার কিন্তু ব্যর্থ হলে চলবে না। নানা মানুষের শখ পূরণের কাজে যেন সরকার বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহূত না হয়। উচ্চাভিলাষী, শৌখিন, বিলাসী মানুষের শখ পূরণের কাজে আমাদের কোনো উপলক্ষ, অনুষ্ঠান যেন ছিনতাই হয়ে না যায়। লাখো মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণই বড় কথা।
ভাবাবেগ ও বাগাড়ম্বরে যেন আমরা গা না ভাসাই। এভাবে ভাঙা যায়, গড়া যায় না। গড়ে তোলা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিচারবোধ কাজ না করলে দেবতা গড়তে বাঁদর গড়া হয়ে যেতে পারে। আমার ভয়, আমাদের মজ্জাগত গা-ভাসানো স্বভাব, শখ মেটানোর দুর্বলতার ফলে আতিশয্য ও অতিশয়োক্তির চোরাবালিতে না আবার ডুবে মরি।
দ্রুত, দ্রুত আমাদের শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়াতে হবে। যেটি যেমন হওয়া উচিত, যাকে যেভাবে স্বীকৃতি দিতে ও জানতে হবে, মোট কথা যে কাজ যেভাবে করণীয় তা সেভাবেই করতে হবে। যুক্তিহীন ভাবের ঘোরে পড়লে দশায় পাবে। ব্যক্তির এমন অবস্থা হলে ক্ষতি সামান্য—সেই ক্ষতি ব্যক্তি ও তার পরিবারের, কিন্তু জাতি ঘোরে কাটালে, দশায় পড়লে সমূহ বিপদ।
একুশ আমাদের অমূল্য সম্পদ, এর যেন ভাবের ঘোরে দশাপ্রাপ্তি না ঘটে, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
মূলে শহীদ দিবস হলেও একুশের চেতনায় বাঙালির অধিকার ও আত্মবিকাশের দৃপ্ত অঙ্গীকারই মুখ্য হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমল জুড়ে একুশের ছিল প্রতিবাদী-সংগ্রামী রূপ। শহীদদের স্মরণ করা হয়, তবে তাঁদের ত্যাগের ফলে যে অর্জন, তা ঘিরে উত্সব ও আনন্দের আবহই প্রধান হয়ে উঠেছে এখন। এটা একুশের বিবর্তন, এমনকি উত্তরণও বলা যায়।
একুশকে ঘিরেই বাঙালির অধিকারের সংগ্রাম শুরু এবং তা ক্রমে স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ধীরে ধীরে একুশ যেন প্রেরণায় ও উদ্যাপনের আঙ্গিকে ছাপিয়ে গেছে স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসকেও। একুশে উদ্যাপিত হয় মাসব্যাপী। বিজয় দিবসকে ঘিরে এ রকম প্রয়াস থাকলেও তা এখনো কি স্বতঃস্ফূর্ততায়, কি অংশগ্রহণে একুশের কাছাকাছি আসতে পারেনি।
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় তার যেমন অর্জনের ব্যাপ্তি ঘটল, তেমনি তাত্পর্য ও উদ্যাপনের ক্ষেত্রেও কিছু নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
এত সব অর্জন, ব্যাপ্তি-উত্তরণের মধ্যে আমার ভাবনা ঘুরছে—এসবের পেছনে যে আবেগের ঢল দেখতে পাই তাকে ছাপিয়ে কাজের কাজ কতটা হচ্ছে—তা নিয়ে। ভয় এ জন্য বাড়ে যে ভাবনা-চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে আবেগে মাতামাতি করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও আমরা প্রায়ই খেলো করে ফেলি। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা নিয়ে ভাবাবেগপূর্ণ অনেক কথা বললেও নানাভাবে এসবকে খেলোও করেছি আমরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কীভাবে খেলো করা হলো, রাষ্ট্রপতির প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপি কীভাবে খেলো করল, সেসব একবার ভাবুন!
বহু বছর পর এবার বাংলা একাডেমীর বইমেলায় গিয়ে মনে হলো, বই লেখা, বই প্রকাশ করা—এ সবই নেহাত ছেলেখেলার বিষয় হয়ে যাচ্ছে। কেউ পাঁচটা, কেউ ছয়টা, কেউ এরও বেশি বই লিখে প্রকাশ করছেন এক বছরে! বঙ্গবন্ধুর নামকে যথেচ্ছ খেলো করার কাজে নেমেছে এক দল। তদ্রূপ জিয়া ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে চলছে ছেলেখেলা। অনেক কাল আগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশ বহু মানুষের স্বপ্নের দেশ। কথাটা অসত্য নয়। তবে আজ মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ বহু মানুষের শখের দেশ—অর্থাত্ শখ পূরণের দেশ। এই শখের মধ্যে একটি সহজ খেলো শখ হচ্ছে বই লেখা ও লেখক হওয়া। অনেকের শখ মন্ত্রী হওয়া, ইদানীং অনেকে ভাবেন মন্ত্রীর চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার শখ পূরণ হলে মর্যাদা বেশি হবে। খালেদা জিয়া শখ করে ইয়াজউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি বানালেন, ইয়াজউদ্দিন শখ করে মফিজকে বানালেন প্রেস-সচিব।
একুশের প্রধান উত্সব বাংলা একাডেমীর বইমেলা। এটাই এখন শখ পূরণের প্রধান অঙ্গন। এ পর্যন্ত (১৬ ফেব্রুয়ারি) প্রায় ১৮০০ নতুন বই এসেছে মেলায় আর দুই শতাধিক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান হয়েছে। তাতে বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী, মন্ত্রী, সাংসদ, লেখক, সাহিত্যিকেরা অংশ নিয়েছেন। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারে বাংলাদেশের সারস্বত সাধনা ও মনন-মনীষার চর্চা এবং সৃজন-সাহিত্যের বসন্তকাল যে চলছে, তা মানতেই হবে। দর্শনে একটা তত্ত্বে বলে appearance and reality, অর্থাত্ দৃশ্যত যে রকম কার্যত ব্যাপারটা তা নয় সব সময়। এই পৃথিবীটা দেখতে লাগে সমতল, কিন্তু কার্যত এটি গোল, আকাশটা দেখায় নীল কিন্তু বাস্তবে তার কোনো রং নেই। তো এই বিশাল মেলা, বিপুল প্রকাশনা, অসংখ্য নতুন বই, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এত আবেগ-ভালোবাসার কতটা বাস্তবে সত্য, এ প্রশ্ন কি তোলা যায় না?
কারণ বাংলা ভাষা চর্চার অবস্থাটা ভালো নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের আধিপত্য ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাপিয়ে মফস্বলে পৌঁছেছে। এখন ক্রমে এর একটা করাপ্ট রূপ চালু হতে শুরু করেছে। এরও চেয়ে মারাত্মক হলো শিক্ষাভিমানী বাঙালির মনের অবস্থা। এখন ইংরেজিই তার সুয়োরানি, বাংলা দুয়ো। এত সাধের শখের মাতৃভাষা বাংলার বিনিময়ে হলেও সে সন্তানের ইংরেজি শেখার বিষয়ে তত্পর। ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু বর্তমান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অধিকাংশ সফল খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গের সন্তান-সন্ততি যাচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, বেরোচ্ছে বাংলায় ভয়ংকর দুর্বলতা নিয়ে। তাতে ক্রিয়াত্মক শিল্প চলতে পারে, কিন্তু সাহিত্য ও মননসাধনার মতো ভাষানির্ভর কাজের কী হবে। এভাবে কি জাতি এগোবে?
এভাবে বাংলা ভাষা নিয়ে মৌলিক গবেষণা, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা (এ নিয়ে বাংলা একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক অবশ্য একটা উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছেন), সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার সংকট ও সংস্কৃত জানা শিক্ষকের অভাব, স্কুল পর্যায়ে বাংলা শিক্ষকের মানের ক্রমাবনতি ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ তোলা যায়। এসব ক্ষেত্রে যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে, এর সঙ্গে মেলানো যাবে না বাগাড়ম্বর ও ভাবাবেগপূর্ণ সেমিনার, প্রকাশনা ও মেলার কার্যক্রমের চিত্রকে।
এরই সূত্র ধরে একটা কথা একটু ভাবার জন্য বলব। একুশে যদি আমার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির চেতনা এবং এগুলোকে অবলম্বন করে আত্মবিকাশের প্রেরণা হয়ে থাকে, তবে একুশের সূত্রে কেবল কি ভাষাশহীদেরাই আমাদের নায়ক থাকবেন? এঁরা বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রের পুলিশি হামলার শিকার হয়েছেন। তাঁরা শহীদ, সে কারণে তাঁরা স্মরণীয় ও বরণীয়। তাঁদের কথা আমাদের ইতিহাসে অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এবং তাঁদের প্রসঙ্গে আমরা ইতিহাসে পাঠ করব।
একটু সংকোচের সঙ্গে বলি, তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, শহীদ মাত্রেরই জীবন ছাত্র-শিশুদের জন্য কিছু স্মরণীয়-শিক্ষণীয় পাঠে সমৃদ্ধ নাও হতে পারে। আবারও বলছি, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো ও স্মরণ করা জাতির কর্তব্য। এ জন্য তাঁদের নামে স্কুল, কলেজ, পাঠাগারও হতে পারে। কিন্তু জীবনী পাঠের জন্য স্কুলছাত্রদের ওপর জবরদস্তি খাটানো উচিত কি না, ভেবে দেখা দরকার।
এ কথাটা আরও বিশেষভাবে বলছি, যদি একুশের চেতনা হয়ে থাকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ইত্যাদি, তাহলে এই চেতনা আমাদের কেন অনুপ্রাণিত করে না আধুনিক বাংলা গদ্যের নির্মাতা হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করতে, তিনি কেবল ভাষার ক্ষেত্রে নয়—সমাজ সংস্কার বাদ দিলাম—শিক্ষাবিস্তারে যে কাজ করেছেন, সে কারণে তাঁর নামে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, নিদেনপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নাম, কোনো মিলনায়তনের নাম হতে পারত না? এ গদ্যের ওপর যাঁরা সাহিত্যের সৌধ নির্মাণ করে যুগপত্ বাংলা ভাষা ও বাঙালি-মনীষার উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, সেই বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথের নামেও কি আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েছি? এভাবে বলা যাবে মাইকেল, লালন, নজরুল, জসীম, জয়নুল, আব্বাসউদ্দীনদের নামেই বা আমরা যথাযোগ্য কী করেছি?
একটা জাতি সালাম-জব্বার-রফিক-বরকতকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়, তাঁদের শ্রদ্ধা জানায় কিন্তু বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ হয়ে নজরুল-জসীম-জয়নুল-আব্বাসউদ্দীনদের বিস্মৃত হতে থাকলে তার সম্পর্কে কী ভাবব?
একই রকমের খটকা লাগে বীরশ্রেষ্ঠদের ব্যাপারেও। তাঁরা অবশ্যই আমাদের শ্রেষ্ঠবীর। তাঁরা অমর, তাঁদের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁদের নামে নানা প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠবে নিশ্চয়। তাঁদের ত্যাগোদ্দীপ্ত বীরত্বব্যঞ্জক যুদ্ধগুলো নিয়ে সাহিত্যও রচিত হতে পারে, কিন্তু ঠিক স্বতন্ত্রভাবে জীবনীপাঠ্য করার কথা বললে মনে প্রশ্ন জাগে, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের মূল রূপকার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্ত ও বিতর্কে লিপ্ত থাকে, মূল স্থপতি তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে উদাসীন ও নির্লিপ্ত, তার জন্য এ কাজ কতটা যথার্থ হচ্ছে? এমনকি সে কেন মাস্টারদা সূর্য সেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা এবং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকবে?
তখন সংশয় হয়, আমরা ভাবনা-চিন্তা, বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া হুজুগে মেতে উঠিনি তো?
বাংলাদেশ স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই পথ হারাতে শুরু করেছিল। ১৯৭৫-এর পর থেকে সম্পূর্ণ বিপথগামী হয়ে গেল দেশ। আমরা মনে করছি বহুদিন বিপথে-বিপদে ঘুরপাক খেয়ে ভ্রান্তি-ব্যর্থতার গোলকধাঁধা পেরিয়ে এবার বোধহয় জাতি ঠিক পথে আসতে চাইছে। সে রকম কিছু লক্ষণ তত্ত্বাবধায়ক আমল থেকে দেখা যাচ্ছিল, এবং বিগত নির্বাচনে নতুন প্রজন্মসহ অধিকাংশ দেশবাসী সে রকম মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এই প্রত্যাশার দায় চেপেছে বর্তমান সরকারের ওপর, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের ওপর। একটু বলে নিতে চাই, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র অবশ্যই ছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা সফল হতে দিতে চায়নি, এসব কথা সত্য বটে, তবে সেই সঙ্গে এও সত্য যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে সেদিন সঠিক পথে চালাতে পারেনি।
এবার কিন্তু ব্যর্থ হলে চলবে না। নানা মানুষের শখ পূরণের কাজে যেন সরকার বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবহূত না হয়। উচ্চাভিলাষী, শৌখিন, বিলাসী মানুষের শখ পূরণের কাজে আমাদের কোনো উপলক্ষ, অনুষ্ঠান যেন ছিনতাই হয়ে না যায়। লাখো মানুষের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণই বড় কথা।
ভাবাবেগ ও বাগাড়ম্বরে যেন আমরা গা না ভাসাই। এভাবে ভাঙা যায়, গড়া যায় না। গড়ে তোলা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। অত্যন্ত সূক্ষ্ম বিচারবোধ কাজ না করলে দেবতা গড়তে বাঁদর গড়া হয়ে যেতে পারে। আমার ভয়, আমাদের মজ্জাগত গা-ভাসানো স্বভাব, শখ মেটানোর দুর্বলতার ফলে আতিশয্য ও অতিশয়োক্তির চোরাবালিতে না আবার ডুবে মরি।
দ্রুত, দ্রুত আমাদের শক্ত জমিনের ওপর দাঁড়াতে হবে। যেটি যেমন হওয়া উচিত, যাকে যেভাবে স্বীকৃতি দিতে ও জানতে হবে, মোট কথা যে কাজ যেভাবে করণীয় তা সেভাবেই করতে হবে। যুক্তিহীন ভাবের ঘোরে পড়লে দশায় পাবে। ব্যক্তির এমন অবস্থা হলে ক্ষতি সামান্য—সেই ক্ষতি ব্যক্তি ও তার পরিবারের, কিন্তু জাতি ঘোরে কাটালে, দশায় পড়লে সমূহ বিপদ।
একুশ আমাদের অমূল্য সম্পদ, এর যেন ভাবের ঘোরে দশাপ্রাপ্তি না ঘটে, সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments