আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার by সৌরভ সিকদার
বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ধর্ম এবং বহু ভাষার দেশ। এ দেশে প্রধান ভাষা বাংলা হলেও শতকরা দুই ভাগেরও অধিক ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাস করে। এদের মধ্যে উর্দুভাষী বিহারি, তেলেগুসহ ৩০ লাখ বা তারও বেশি আদিবাসী বা নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী বাস করে। যদিও সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা এর অর্ধেক। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে পৃথিবীর চারটি প্রধান ভাষা-পরিবারের প্রায় ৩০টি ভাষা তারা ব্যবহার করে। এর মধ্যে কিছু ভাষা পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হলেও অনেক ভাষাই পরস্পর এতটা ঘনিষ্ঠ যে এগুলোকে উপভাষাই বলা যায়। যেমন তনচঙ্গা মূলত চাকমা ভাষার উপভাষা। অনুরূপভাবে রাখাইন মারমা ভাষার, লালং বা পাত্র গারো ভাষার এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ও হাজং বাংলার উপভাষা। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষার সংখ্যা ২৬-৩০টি। যদিও একটি ওয়েবসাইটে (Ethnologue, Languages of Bangladesh) বাংলাদেশে বাংলাসহ মোট ৩৭টি ভাষার উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে ওই ওয়েবসাইটে আসামিজ, বার্মিজ, চিটাগোনিয়ান, হাকা-চীন, রিয়াং, সিলেটি প্রভৃতিকে পৃথক ভাষা হিসেবে দেখানো হয়েছে।
জর্জ গ্রিয়ারসনের ‘ভারতীয় ভাষাসমূহের জরিপ’ প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ অঞ্চলের আদিবাসী ভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। ফলে ভাষাগুলোর শ্রেণীকরণসহ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় এবং তুলনামূলক কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ গত প্রায় এক শ বছরে ভাষাগুলোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলাসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ, সিলেট বিভাগের চা-বাগানসহ নানা উপজেলা, ময়মনসিংহের শেরপুর, মধুপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনাসহ গারো পাহাড়সংলগ্ন এলাকা এবং কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলায় বসবাস করে এরা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তুলনায় এরা রয়েছে নানা দিক থেকে পিছিয়ে। বিশেষ করে মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অথচ যেকোনো শিশুরই মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্কুলে যেতে পারে কিংবা স্কুলে যাচ্ছে এরূপ চার থেকে দশ বছর বয়সের আদিবাসী শিশুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। ইউনেসকো ২০০৩-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের মাতৃভাষা জাতীয় বা স্থানীয় ভাষা থেকে ভিন্ন তারা শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকটা সুবিধাবঞ্চিত থাকে। বাংলাদেশের আদিবাসী শিশুর ক্ষেত্রে এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
এ বিষয়ে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, ‘আমরা মনে করি বাংলাদেশে আদিবাসী ও তাদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে জাতীয় পর্যায়েই এমন সব কৌশল, পরিকল্পনা, কাঠামো ও চুক্তি বিদ্যমান যা দেশের আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি দীর্ঘস্থায়ী মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য অনুকূল’ (প্রথমে মাতৃভাষা, ২০০৭; সেভ দ্য চিলড্রেন)। তবে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত এসব কৌশল, পরিকল্পনা এবং চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি। বাংলাদেশের সব শিশুর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে এসবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থানভেদে কোনো ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৫ ও ১৭ ধারায় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, গণভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এদিক দিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগ পাওয়ার দাবিদার। ১৯৯৭ সালের পাবর্ত্য শান্তি চুক্তির ৩৩/খ-২ ধারায়ও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুকে এই শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় বিগত দুই দশকে শিক্ষার হার বাড়তে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে শিক্ষার হারও বেড়েছে। কিন্তু আদিবাসী শিশুর শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে তেমন কোনো পরিকল্পনা অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নেওয়া হয়নি, যা হয়েছে তা বেসরকারি উদ্যোগে। সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসীদের শিক্ষার্থীর জন্য কোনো পৃথক ব্যবস্থা বা অর্থ বরাদ্দ নেই। কাজেই আদিবাসী শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছে মূলত উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহ। দেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (সরকারি) আমাদের প্রচলিত জাতীয় শিক্ষাক্রমের একই পাঠ্যবই অনুসরণ করা হয় এবং এগুলোর ভাষা সংগত কারণেই বাংলা। এসব পাঠ্যপুস্তক মূলত বাংলাভাষী বাঙালি শিশুর পাঠ, বোধগম্যতা এবং মানস-বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে। এগুলো মোটেও আদিবাসী শিশুর শিক্ষাগ্রহণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত নয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক এবং পাঠ্যপুস্তকজনিত সমস্যার কারণে অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর এই ভাষা যদি শিশুর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটে না। যেহেতু আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা নয় এবং বিদ্যালয়ে যে বই পড়তে হয় তার ভাষা এবং বিষয় তার পরিচিত পরিমণ্ডলের নয়, এমনকি যে শিক্ষক পড়ান তাঁর সঙ্গেও তার রয়েছে ভাষিক দূরত্ব (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কাজেই এতগুলো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আদিবাসী শিশুর শিক্ষার বিস্তার ঘটবে তা প্রত্যাশা করা যায় না। আর সম্ভবত এখানেই প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসী শিশুর ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক। কাজেই অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষক বা অন্যান্য সহপাঠীর সঙ্গে যথার্থ ভাষিক যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়, যা তাদের মনোবল ও উত্সাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পৃথিবীর যেকোনো জাতির রয়েছে মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার। কেননা শিশুর দৈহিক, মানসিক ও মানবিক বিকাশের স্বার্থে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জাতিসংঘ সনদে প্রতিটি শিশুর মাতৃভাষায় প্রথমিক শিক্ষার সুযোগ দানের কথা বলা হয়েছে (১২০.১৯৫৭, ১০৭/৩১-১)
শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানীদের ধারণা, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ না থাকায় আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটছে না। তা ছাডা বাংলাদেশের আদিবাসী এলাকায় অবস্থিত বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা যা পড়ছে তা কোনোক্রমেই তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে শিশুরা পাঠের উত্সাহ হারিয়ে ফেলে। কাজেই তাদের জন্য পৃথক পাঠক্রম তৈরি করা জরুরি।
আদিবাসী গবেষক মিথু শিলাক মুরমু লিখেছেন,
‘রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা যেন আদিবাসীদের ভাষা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা না হয়ে ভাষার নির্দেশিকা দুটোর প্রতিটি বর্ণ যেন একটি উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলতে পারে। সরকারকে ভাষা রক্ষার জন্য রেডিও-টেলিভিশনে সংশ্লিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর জন্য অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানে উত্সাহী করে। আদিবাসী একাডেমিগুলো থেকে যেন মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশনা, পাশাপাশি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যসূচি হিসেবে মাতৃভাষা অন্তর্ভুক্তিকরণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ভাষাগুলোকে উন্নয়ন প্রচলন ও সংরক্ষণের জন্য গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে’।
এ দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব। কিন্তু এ দেশেরই সংখ্যালঘু মানুষ তথা আদিবাসীদের ভাষা বিষয়ে আমরা উদাসীন। আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের ভাষাগুলো বিপন্নপ্রায়। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ভাষার অধিকার ও উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভাষা-পরিকল্পনা এবং ভাষিক সমমর্মিতা। বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা। পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশ নামক দেশে যতগুলো ভাষা রয়েছে তাদের মর্যাদা ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জর্জ গ্রিয়ারসনের ‘ভারতীয় ভাষাসমূহের জরিপ’ প্রকাশিত হওয়ার পর দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ অঞ্চলের আদিবাসী ভাষা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। ফলে ভাষাগুলোর শ্রেণীকরণসহ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় এবং তুলনামূলক কোনো আলোচনা হয়নি। অথচ গত প্রায় এক শ বছরে ভাষাগুলোতে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলাসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ, সিলেট বিভাগের চা-বাগানসহ নানা উপজেলা, ময়মনসিংহের শেরপুর, মধুপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনাসহ গারো পাহাড়সংলগ্ন এলাকা এবং কক্সবাজার, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলায় বসবাস করে এরা। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর তুলনায় এরা রয়েছে নানা দিক থেকে পিছিয়ে। বিশেষ করে মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অথচ যেকোনো শিশুরই মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের মৌলিক অধিকার রয়েছে। স্কুলে যেতে পারে কিংবা স্কুলে যাচ্ছে এরূপ চার থেকে দশ বছর বয়সের আদিবাসী শিশুর সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। ইউনেসকো ২০০৩-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যাদের মাতৃভাষা জাতীয় বা স্থানীয় ভাষা থেকে ভিন্ন তারা শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকটা সুবিধাবঞ্চিত থাকে। বাংলাদেশের আদিবাসী শিশুর ক্ষেত্রে এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
এ বিষয়ে মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা জানান, ‘আমরা মনে করি বাংলাদেশে আদিবাসী ও তাদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে জাতীয় পর্যায়েই এমন সব কৌশল, পরিকল্পনা, কাঠামো ও চুক্তি বিদ্যমান যা দেশের আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি দীর্ঘস্থায়ী মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য অনুকূল’ (প্রথমে মাতৃভাষা, ২০০৭; সেভ দ্য চিলড্রেন)। তবে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত এসব কৌশল, পরিকল্পনা এবং চুক্তির বাস্তবায়ন করেনি। বাংলাদেশের সব শিশুর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে হলে এসবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থানভেদে কোনো ধরনের বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৫ ও ১৭ ধারায় অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, গণভিত্তিক সার্বজনীন শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এদিক দিয়ে আদিবাসী শিক্ষার্থীরাও সমান সুযোগ পাওয়ার দাবিদার। ১৯৯৭ সালের পাবর্ত্য শান্তি চুক্তির ৩৩/খ-২ ধারায়ও মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে শিশুকে এই শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় বিগত দুই দশকে শিক্ষার হার বাড়তে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে শিক্ষার হারও বেড়েছে। কিন্তু আদিবাসী শিশুর শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে তেমন কোনো পরিকল্পনা অদ্যাবধি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে নেওয়া হয়নি, যা হয়েছে তা বেসরকারি উদ্যোগে। সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসীদের শিক্ষার্থীর জন্য কোনো পৃথক ব্যবস্থা বা অর্থ বরাদ্দ নেই। কাজেই আদিবাসী শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছে মূলত উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়সমূহ। দেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (সরকারি) আমাদের প্রচলিত জাতীয় শিক্ষাক্রমের একই পাঠ্যবই অনুসরণ করা হয় এবং এগুলোর ভাষা সংগত কারণেই বাংলা। এসব পাঠ্যপুস্তক মূলত বাংলাভাষী বাঙালি শিশুর পাঠ, বোধগম্যতা এবং মানস-বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে। এগুলো মোটেও আদিবাসী শিশুর শিক্ষাগ্রহণের জন্য বিজ্ঞানসম্মত নয়। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষক এবং পাঠ্যপুস্তকজনিত সমস্যার কারণে অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ভাষা। আর এই ভাষা যদি শিশুর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষার সম্প্রসারণ ঘটে না। যেহেতু আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা বাংলা নয় এবং বিদ্যালয়ে যে বই পড়তে হয় তার ভাষা এবং বিষয় তার পরিচিত পরিমণ্ডলের নয়, এমনকি যে শিক্ষক পড়ান তাঁর সঙ্গেও তার রয়েছে ভাষিক দূরত্ব (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) কাজেই এতগুলো প্রতিকূলতা পেরিয়ে আদিবাসী শিশুর শিক্ষার বিস্তার ঘটবে তা প্রত্যাশা করা যায় না। আর সম্ভবত এখানেই প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসী শিশুর ঝরে পড়ার হার আশঙ্কাজনক। কাজেই অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসী শিশুরা শিক্ষক বা অন্যান্য সহপাঠীর সঙ্গে যথার্থ ভাষিক যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়, যা তাদের মনোবল ও উত্সাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পৃথিবীর যেকোনো জাতির রয়েছে মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার। কেননা শিশুর দৈহিক, মানসিক ও মানবিক বিকাশের স্বার্থে মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জাতিসংঘ সনদে প্রতিটি শিশুর মাতৃভাষায় প্রথমিক শিক্ষার সুযোগ দানের কথা বলা হয়েছে (১২০.১৯৫৭, ১০৭/৩১-১)
শিক্ষাবিদ ও ভাষাবিজ্ঞানীদের ধারণা, মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ না থাকায় আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটছে না। তা ছাডা বাংলাদেশের আদিবাসী এলাকায় অবস্থিত বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা যা পড়ছে তা কোনোক্রমেই তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ফলে শিশুরা পাঠের উত্সাহ হারিয়ে ফেলে। কাজেই তাদের জন্য পৃথক পাঠক্রম তৈরি করা জরুরি।
আদিবাসী গবেষক মিথু শিলাক মুরমু লিখেছেন,
‘রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা যেন আদিবাসীদের ভাষা উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা না হয়ে ভাষার নির্দেশিকা দুটোর প্রতিটি বর্ণ যেন একটি উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলতে পারে। সরকারকে ভাষা রক্ষার জন্য রেডিও-টেলিভিশনে সংশ্লিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর জন্য অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানে উত্সাহী করে। আদিবাসী একাডেমিগুলো থেকে যেন মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশনা, পাশাপাশি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত বিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যসূচি হিসেবে মাতৃভাষা অন্তর্ভুক্তিকরণ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃক ভাষাগুলোকে উন্নয়ন প্রচলন ও সংরক্ষণের জন্য গবেষণার উদ্যোগ নিতে হবে’।
এ দেশের মানুষ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরব। কিন্তু এ দেশেরই সংখ্যালঘু মানুষ তথা আদিবাসীদের ভাষা বিষয়ে আমরা উদাসীন। আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের ভাষাগুলো বিপন্নপ্রায়। বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের এখন নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ভাষার অধিকার ও উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভাষা-পরিকল্পনা এবং ভাষিক সমমর্মিতা। বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা। পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশ নামক দেশে যতগুলো ভাষা রয়েছে তাদের মর্যাদা ও ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments