সাংগু কি ব্যর্থ গ্যাসক্ষেত্র: বিদেশি কোম্পানি কী বলে -জ্বালানি নিরাপত্তা by বদরূল ইমাম

যেকোনো দেশের সাগরবক্ষ তার প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে তেল ও গ্যাসভান্ডারের মোক্ষম স্থান হতে পারে। বিশ্বে অনেক দেশই তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার চাপ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে সাগরবক্ষের তেল ও গ্যাসভান্ডার উন্মোচনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময় সাগরবক্ষে বিদেশি কোম্পানিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত করলেও, ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ তেল কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির সাংগু গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার এবং ১৯৯৮ সালে গ্যাসক্ষেত্রটির উৎপাদন চালুর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেশের মাটিতে সাগরের গ্যাস পৌঁছায়। এ দেশের মানুষের মনে আশা জাগে যে বাংলাদেশের সাগরও বুঝি ঘরে লক্ষ্মী বয়ে এনেছে সমৃদ্ধি ঘটাবে বলে।
সাংগু গ্যাসক্ষেত্র প্রথম দিকে আশানুরূপ গ্যাস উৎপাদন করে এলেও হঠাৎ করেই একসময় অনেকটা অপরিপক্ব অবস্থায় তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একসময় যেখানে দৈনিক ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো তা হঠাৎ করে কমে যায় এবং কমতে কমতে বর্তমানে দৈনিক মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করার ক্ষমতা নিয়ে চালু রয়েছে। মাত্র প্রায় ১২ বছরে গ্যাসক্ষেত্রটি এ রকম নিম্নমুখী যাত্রা অদূর ভবিষতে তার অকাল মৃত্যুর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন। সাংগু গ্যাসক্ষেত্রের এহেন উৎপাদন পতন যে সবাইকে আশাহত করেছে, কেবল তাই নয়, বরং সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহকে ইতিপূর্বে সাংগুর ওপর নির্ভরশীল করে দেওয়ার ফলে বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চল চরম গ্যাসসংকটে পড়েছে।
সাংগু গ্যাসক্ষেত্রটিতে এ রকম অবস্থা ঘটার কারণ কী? পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বিদেশি কোম্পানি গ্যাসক্ষেত্রটি থেকে অতিরিক্ত হারে গ্যাস উৎপাদন করার ফলে গ্যাসস্তরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা পরে উৎপাদন পতনের কারণ ঘটায়। এ ছাড়া বিদেশি কোম্পানি আগে সাংগুক্ষেত্রে যে গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছিল, পরে মজুদ তার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কম বলে জানায়। সাংগু গ্যাসক্ষেত্র বর্তমানে যৌথভাবে পরিচালনা করছে ব্রিটিশ কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জি ও অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোস অয়েল। সাংগু গ্যাসক্ষেত্রটির কর্মকাণ্ড ইতিমধ্যেই পর্যবেক্ষক মহলে সমালোচিত হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে বিদেশি কোম্পানি কী মত পোষণ করে?
সাংগু গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনায় নিয়োজিত যৌথ কোম্পানির একজন উচ্চতর প্রতিনিধিকে অতিরিক্ত হারে উৎপাদন করার ফলে গ্যাসস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও পরিণতিতে উৎপাদন পতনসংক্রান্ত পেট্রোবাংলার অভিমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এ সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ‘এটি একটি ভুল ধারণা। অতিরিক্ত উৎপাদন হার নয়, বরং ক্ষেত্রটির ভূগর্ভস্থ গ্যাসস্তরবিন্যাসের জটিলতা উৎপাদন হার পতনের কারণ। সাংগুর গ্যাসস্তরের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তা প্রায়ই “চ্যানেল কাট” দ্বারা ক্ষয়ের প্রভাবে প্রভাবিত, যা কি না গ্যাসস্তরের সরল বিস্তৃতি ভঙ্গ করে। আর ৩-ডি সাইসমিক জরিপ ছাড়া এ রকম জটিল স্তরে উৎপাদন করে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ৩-ডি সাইসমিক জরিপ অধিকতর ব্যয়সাধ্য এবং তা কোম্পানির কস্ট রিকভারি বা বিনিয়োগ উশুলের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেবে বলে পেট্রোবাংলা আগে তার অনুমোদন দিতে রাজি ছিল না, যদিও বর্তমানে এ অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে।’
উৎপাদন পতন ছাড়া অপর একটি ক্ষেত্রেও সাংগু বিতর্কিত হয়েছে। তা হলো এর মজুদ নির্ধারণে কোম্পানির অসংগতি। অনেকে মনে করেন, প্রাথমিক মজুদ ঘোষণায় কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাসক্ষেত্রকে বড় দেখিয়েছে, যাতে অধিকতর উৎপাদনের অনুমোদন পাওয়া যায়। অধিকতর উৎপাদনের লক্ষ্য কম সময়ে অধিকতর মুনাফা অর্জন, আর কোম্পানি এ কাজটি করে গ্যাসক্ষেত্রটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ বিষয়টি নিয়েও কোম্পানির প্রতিনিধি ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, ‘গ্যাসক্ষেত্রের মজুদ নির্ণয় একটি চলমান প্রক্রিয়া। গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের সঙ্গে নতুন প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কখনো আগের মজুদ বৃদ্ধি পায়, আবার কখনো বা মজুদ হ্রাস পেতে দেখা যায়। এটি তেল-গ্যাস ব্যবসায় সর্বত্রই ঘটে থাকে। সাংগুতে প্রাথমিক জরিপে এক টিসিএস গ্যাস আছে বলে হিসাব করা হয়েছিল, কিন্তু পরে তার পরিমাণ প্রায় অর্ধেক বলে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে সাংগুর মতো জটিল স্তরবিন্যাসসম্পন্ন গ্যাসক্ষেত্রের বেলায় তা অস্বাভাবিক নয়। অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, একসঙ্গে বহুসংখ্যক গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটায় মজুদ বৃদ্ধি পেল, আবার অনেকটায় মজুদ হ্রাস। তবে সার্বিকভাবে তা লাভজনক হয় বটে। সাংগুর সমস্যা হলো, এখানে সমুদ্রবক্ষে এটিই একমাত্র উৎপাদক গ্যাসক্ষেত্র এবং এই একটিতে মজুদ হ্রাস হওয়া মানে সার্বিকভাবে নেতিবাচক চিত্র প্রতীয়মান হওয়া।’
সাংগু বড় গ্যাসক্ষেত্র না হলেও এটির গ্যাস প্রসেসিং করার জন্য সাগরের সন্নিকটে চট্টগ্রামের সিলিমপুরে যে গ্যাস প্রসেসিং প্লান্টটি নির্মাণ করা হয়েছে তার আয়তন ও ক্ষমতা অসামঞ্জস্যভাবে বৃহৎ। যেখানে সাংগুর সর্বোচ্চ উৎপাদন মাত্রা দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত হতে পারে বলে মনে করা হতো (বর্তমানে উৎপাদন কমে দৈনিক মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে) সেখানে বিশাল খরচ সাপেক্ষে দৈনিক ৫২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রসেস করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্লান্ট তৈরি করা নেহাতই অপচয় এবং বর্তমানে এটি যেন একটি সাদা হাতি। আর এ নির্মাণব্যয়ের পুরোটাই পিএসসির ধারামতে বাংলাদেশের প্রাপ্য গ্যাস-অংশ থেকে কস্ট রিকভারি বা বিনিয়োগ উশুল হিসেবে কোম্পানি তুলে নিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সাংগুর যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত তা হলো কস্ট রিকভারি বা কোম্পানির বিনিয়োগের খরচ উশুল করার উচ্চমাত্রা। বাংলাদেশ বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে গ্যাস উত্তোলন করে এই কারণে যে উৎপাদিত গ্যাস কোম্পানি ও বাংলাদেশের মধ্যে ভাগাভাগি হবে এবং বাংলাদেশ তার প্রাপ্য ভাগ ব্যবহার করে লাভবান হবে। কিন্তু সাংগুর বেলায় কোম্পানির বিনিয়োগের খরচ উশুলের সূত্রে বাংলাদেশের প্রাপ্য গ্যাসের বিরাট অংশই চলে যায়। তাহলে এ গ্যাস উত্তোলন করে বাংলাদেশের লাভ কোথায়? বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করে কোম্পানির প্রতিনিধি তাঁর মত প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, ‘সাংগু বাংলাদেশের জন্য যেমন ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, কোম্পানির ক্ষেত্রেও সে রকম অলাভজনক পরিস্থতি বহন করে এনেছে। সাংগুতে কোম্পানির বিনিয়োগ প্রায় এক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, কিন্তু গ্যাসক্ষেত্রটির অভ্যন্তরীণ ভূতাত্ত্বিক জটিলতার কারণে ঈপ্সিত গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়নি; এমনকি এখানে ভূগর্ভে অতিগভীরে উচ্চচাপ অঞ্চলে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল ড্রিলিং করেও গ্যাস না পাওয়াটা কোম্পানির জন্য হতাশাব্যঞ্জক বটে। কোম্পানি এখানে তার বিনিয়োগের ক্ষতি পোষানোর জন্য ইতিপূর্বে অধিক হারে উৎপাদন করার পন্থা নেয়।’
তাহলে সাংগুর ভবিষ্যৎ কী? সাংগু পরিচালনায় নিয়োজিত কোম্পানি গ্যাসক্ষেত্রটিকে জীবিত রাখার লক্ষ্যে নতুন করে ৩-ডি সাইসমিক জরিপ পরিচালনা করছে। এর ওপর ভিত্তি করে নতুন কূপ খনন করার বিষয়টি নির্ভর করবে কোম্পানি তার বিনিয়োগের অঙ্ক কীভাবে কষবে তার ওপর। কোম্পানি চায় গ্যাস তুলে লাভজনক ব্যবসা করতে। কোম্পানির মতে, গ্যাসের নিম্ন মূল্যের কারণে এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভজনক ব্যবসা করা কঠিন। আর সে জন্য কোম্পানি চায় গ্যাসের মল্য বৃদ্ধি। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা তার অর্থনীতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সহজ কাজ নয়। তাই বাংলাদেশ ও বিদেশি কোম্পানিকে এমন একটি ফর্মুলা বের করতে হবে, যা দুই পক্ষকেই গ্যাস ব্যবসায় লাভ এনে দিতে পারে।
সাংগু বাংলাদেশের সাগরবক্ষে প্রথম উৎপাদক গ্যাসক্ষেত্র। এটি অদূর ভকিষ্যতে নিঃশেষিত হবে সে আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু সাংগু সাগরবক্ষের শেষ কথা নয়। বাংলাদেশের সাগরবক্ষের গ্যাস-সম্ভাবনা এখনো প্রকৃতভাবে উন্মোচিত হয়নি। এ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলে সাগরের সরবরাহকৃত গ্যাস বাংলাদেশকে গ্যাসসংকট থেকে মুক্ত করতে পারবে। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানে বর্তমানে বাংলাদেশের নিজস্ব কারিগরি ক্ষমতা না থাকায় বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়। বিদেশি কোম্পানি সাংগু ছাড়াও সাগরবক্ষে ম্যাগনামা, হাতিয়া, টেকনাফ সমুদ্র ইত্যাদি অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তিবদ্ধ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, অনুসন্ধানে বিনিয়োগ করতে তাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিদেশি কেম্পানি গ্যাস ব্যবসায়ে তাদের স্বার্থ যথেষ্টভাবে বোঝে। বাংলাদেশকেও নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও ক্ষমতা নিতে অগ্রসর হতে হবে। সাংগুর কার্যক্রম তদারক ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অনভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশকে সাংগু থেকে শিক্ষা নিতে হবে। নিজ স্বার্থ রক্ষা করে পারস্পরিক সহযোগিতা অনুসন্ধান কার্যক্রমকে গতিশীল করতে পারে। আর সেটাই হবে উত্তম পন্থা।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.