নববর্ষ -আলোর দিকেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ by আনিসুল হক
বাংলাদেশের ৩৮ বছরের ইতিহাসে ২০১০ হতে পারে সবচেয়ে ভালো একটা বছর। এর চেয়েও ভালো বছর, ভালো দশক ভবিষ্যতে আরও আসতে থাকুক, আসবে নিশ্চয়ই, সুখী আলোকিত বাংলাদেশকে নিয়ে আসুক সেই দশকগুলো, কিন্তু সেই আলোর পথের যাত্রারম্ভটা ঘটা করে, স্পষ্ট করে শুরু হতে পারে ২০১০ সালেই।
২০০৯ সালও হতে পারত খুব একটা ভালো বছর। আমরা গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরে এসেছি গত বছরে। সারাটা বছর বিরোধী দল কোনো রকমের আন্দোলন করেনি, তারা দাবি করেছে, তারা এক দিনও হরতাল ডাকেনি, এটাই বা আমাদের জন্য কম কী! আর বিপুল দানবাকৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সরকারি দল যথেষ্ট সংযত ছিল, অন্তত আরও অসংযত হয়নি, বাড়াবাড়ি করেনি, সেটিকেও দেখতে হবে অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবেই। শুধু বছরের শুরুতে যদি বিডিআর বিদ্রোহটা না ঘটত আর বছরের শেষে বড়সড় লঞ্চ দুর্ঘটনাটা!
একটা নতুন সরকার নিজেকে ও দেশকে বদলে নেওয়ার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসতে না বসতেই এসেছে অপ্রত্যাশিত আঘাত। খুব বড়সড় আঘাত। এত বড় সশস্ত্র বিদ্রোহ, এত রক্তপাত। দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় যখন তার, তখন তাকে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে ওই ধাক্কাটা সামাল দিতে। গণতন্ত্রের প্রতি দেশের মানুষ ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে নিরঙ্কুশ অঙ্গীকার, সেটাই নতুনভাবে প্রমাণিত হয়েছে ওই সংকটে। প্রায় দুই বছরের অসচরাচর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন থেকে আমরা গণতন্ত্রে ফিরে এসেছি, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে, এবং সেই গণতন্ত্র আমরা চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেছি, ২০০৯ সালে সেইটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আর প্রচলিত আইনেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণাও আমাদের জাতীয় পথরেখাকে দিয়েছে কলঙ্কমুক্তির উজ্জ্বলতা।
একটা উড়োজাহাজ যখন উড়তে শুরু করে, তার আগে তাকে স্টার্ট নিতে হয়। স্টার্ট নিয়েই সে চলতে শুরু করে না। খানিকক্ষণ তাকে দাঁড়াতে হয়। ২০০৯ সাল ছিল আমাদের সেই স্টার্ট নেওয়ার আর দাঁড়ানোর সময়। ২০১০ হোক আমাদের অগ্রগতির পথে উড়াল দেওয়ার বছর।
এটা হওয়া খুব সম্ভব। এখনো পর্যন্ত সরকারি দলকে দেশের অগ্রগতি ও দেশের মানুষের ভাগ্য বদলের বিষয়ে অঙ্গীকৃত বলেই মনে হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সমীকরণ বাংলাদেশ ও সরকারের জন্য অনুকূল হিসেবে দেখা দিয়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে পরিবর্তনের আওয়াজ তোলা বারাক ওবামার সরকার। ভারতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মনমোহন সিংহের মতো সজ্জন ও বিদ্বজ্জন। এমনকি পাকিস্তানেও আছে একটা নির্বাচিত সরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে।
সব মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির উপযোগী। কেবল সরকারের উচিত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে উদার করা, তার বন্ধুর বৃত্তটা বড় করে ফেলা, তার স্বাভাবিক মিত্রদের কাজে লাগানো। আর দেশে ও দেশের বাইরে যেসব বাংলাদেশি যে কাজের যোগ্য, সেই কাজে তাদের সহযোগিতা আহ্বান করা। দেশের প্রয়োজনে সরকার সাহায্য চাইলে আমাদের কোনো নাগরিক—তিনি যত বড় বিশেষজ্ঞই হন না কেন—এগিয়ে আসবেন না, তা হয় না। বিরোধী দলকে সংসদে আনতে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। আমাদের গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতেই হবে। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয় না, কার্যকরও হয় না। ২০০৯ সাল সেদিক থেকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখায়নি, ২০১০ সালে সরকার আর বিরোধী দল মিলেমিশে দেশকে এগিয়ে নিতে নেমে পড়েছে, আমরা সেই অসম্ভব স্বপ্নটা নববর্ষের এই প্রভাতেই দেখতে চাই। আর বিরোধী দল নিশ্চয়ই বিরোধিতা করবে, সরকারের সমালোচনা করবে। কিন্তু সেটা কেবল নিজেদের রাজনৈতিক লাভক্ষতির কথা বিবেচনা করে যেন না হয়। এখন পর্যন্ত দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সরকার চাইছে বিরোধী দলকে যতটা পারা যায় নিষ্ক্রিয় রাখতে আর বিরোধী দল তাদের বহুব্যবহূত ভারতজুজুর ট্রাম্পকার্ডটা দিয়েই আরেক দফা বাজিমাত করার স্বপ্ন দেখছে। দেশের মানুষ যে বোকা নয়, চার-চারটা নির্বাচনের পরও কি রাজনৈতিক নেতাদের সে বিষয়ে সন্দেহ আছে?
আমাদের এক বন্ধু বড় ভাই অনেক দিন পর দেশে এলেন। তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত। বললেন, বেসরকারি খাতে অগ্রগতি তো বিস্ময়কর! পৃথিবীর যেকোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এখন তুলনীয়। শুধু যদি সরকার অবকাঠামোগত সমর্থনটা দিয়ে যেতে পারে! আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা ও বিদ্যুত্ খাতের উন্নতি ঘটানোর কাজটা করতে হবে সরকারকেই।
সত্যি, দেশ নানা দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ঢাকার দিগন্ত পাল্টে গেল। আগে ব্যাংকক-কুয়ালালামপুরে যে ধরনের ভবন আমরা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম, সে রকম ভবন এখন ঢের হয়েছে ঢাকায়। আমি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে গিয়ে দেখেছি, ওখানকার এমআইটি বা হার্ভার্ড-পড়ুয়া সব ছাত্রের কাছে মোবাইল ফোন নেই। আর আমাদের পানের দোকানির কাছেও দুটো মোবাইল ফোন। ভারত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তি হতে যাচ্ছে বলে এত যে রব, সেখানেও তো রাস্তার দুই ধারে দেখতে পেলাম চরম দারিদ্র্যের চিহ্ন, বৈষম্য সেখানে প্রবল। হোটেলের কর্মচারীরা মাত্র এক হাজার বা এক হাজার ২০০ রুপি বেতনে কাজ করেন, আমাদের টাকায় দেড়-দুই হাজার। আজকে আমাদের গ্রামের বাড়ির খেতমজুরও দিনশেষে সোয়া শ টাকা মজুরি ও এক বেলা খাবার পান। মানে, তাঁর মাসিক আয় তিন হাজারেরও বেশি।
দারিদ্র্য, জনসংখ্যাধিক্য আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে ঘটেই চলেছে, সেটাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছিল বাংলাদেশ প্যারাডক্স বলে। দিনার স্টান্ডার্ড নামের একটা পত্রিকায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর সেরা ব্যাংকগুলো, যেমন সিটি, গোল্ডম্যান স্যাকস, জেপিমর্গান, মেরিল লিঞ্চ বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে বিনিয়োগের এক চমত্কার সুযোগ হিসেবে।
বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ এখন কিনছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ খাতের দিকে নজর দেওয়া হলে ছয় বছরের মধ্যে এই খাত জাতীয় প্রবৃদ্ধি তিন ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারবে। বাংলাদেশ জাহাজভাঙা শিল্পের দেশ থেকে জাহাজ নির্মাণশিল্পের দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্বসভায় সুপরিচিত করতে পারে।
বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা আছে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে। আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১০ ভাগ কাজ আনার যোগ্যতা রাখে বলে বাইরের বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই মন্তব্য করেছেন। তা করা গেলে আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়ে যেতে পারে উল্লেখযোগ্যভাবে।
নতুন আশার সঞ্চার করেছে সৌরবিদু্যুতের ক্ষেত্র। রহিমআফরোজ ১০ লাখ বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার বাড়িতে তারা সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে বলতে হয়, জলবায়ুর বিপদ আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। যেকোনো বিপদকে সম্পদে পরিণত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে এই দেশের আর এই দেশের মানুষের। এবার আমরা একটা বড় বিপদের মধ্যে আছি, তার নাম জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ। পৃথিবীর উষ্ণতা এভাবে বেড়ে যেতে থাকলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে যাবে, সেই আশঙ্কার কথা পৃথিবীব্যাপী প্রচারিত। কিন্তু এটা হতে পারে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর এবং দেশটাকে গড়ে তোলার একটা বড় সুযোগ। দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছি আমরা, কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকেই আমরা হার স্বীকার করিনি। এই জলবায়ু-দুর্যোগেও করব না।
পৃথিবীব্যাপী এখন আওয়াজ উঠেছে সবুজ জ্বালানির, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের। আমরা সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদনের একটা বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করতে পারি। তাতে লাভ হবে দুটো। এক. আমাদের বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারব অনেকাংশে। দুই. সারা পৃথিবীকে আমরা দেখাতে পারব, আমরা কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার হিসেবে অসহায়ত্বের কথা বলছি না, আমরা নিজেরা সবুজ জ্বালানি ব্যবহার করছি, আমরা কম পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করছি, আমরা পৃথিবীতে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি।
আমরা কিন্তু কোপেনহেগেনে কেবল ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাইনি। বরং আমরা গিয়েছি সেই দেশ হিসেবে, যে দেশ পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে পারে, শিখিয়ে দিতে পারে, দেখো, দুর্বিপাকে কীভাবে বাঁচতে হয়, ঘুরে দাঁড়াতে হয়। অভিযোজনের কী উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই না স্থাপন করেছে আমাদের উপকূলের মানুষেরা!
কিন্তু আমাদের পাওনাও তো আমাদের চাইতে হবে। কোপেনহেগেন থেকে আমরা ঝুলি ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসব, এমন ভাবনা কোনো মূর্খই ভাবেনি। কিন্তু কোপেনহেগেনের কূটনৈতিক সভায় বাংলাদেশ সম্মানজনক আসনই অধিকার করে নিয়েছে। ক্লাব ২৬-এ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পাশে জায়গা হয়েছে বাংলাদেশের। কোপেনহেগেন সম্মেলনে একটা কোনোরকমের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে, আজ হোক, কাল হোক, জলবায়ু তহবিল গঠন করতেই হবে পৃথিবীর দেশগুলোকে। আর আমরা অভিযোজনের জন্য সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ চাইবই, এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা। পাশাপাশি মিটিগেশন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও আমাদের কাজ করতে হবে এবং তহবিল পেতে হবে। পৃথিবীর দূষণে আমাদের দায় নেই সত্য, তবে আমরা আরও সবুজ জ্বালানি-নীতি অবলম্বন করে একটা আদর্শ রাষ্ট্রের ভূমিকা নিতে পারি। এ বিষয়ে আমাদের নাগরিকদেরও সচেতনতার অভাব আছে। নইলে একটা দেশলাইয়ের কাঠির পয়সা বাঁচাতে আমরা গ্যাসের চুলা অবিরাম জ্বালিয়ে রাখি। আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে নীতিমালাও প্রণয়ন করতে হবে।
জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, তিনি তাঁর নিজ গ্রামে কাজ করছেন এমন ধান উদ্ভাবন করতে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস কম নিঃসরণ করবে। এমন ধানও উদ্ভাবিত হচ্ছে, যা লোনাপানিতে বাঁচবে। এসব জলবায়ুর পরিবর্তনরোধী প্রজাতির শস্য আমরা যেমন নিজেরা আবাদ করতে পারি, তেমনি এসব আমরা বিদেশেও রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারি। আর জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক তহবিল গঠিত হলে অবশ্যই আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা লাভ করব।
সব মিলিয়ে আমরা সত্যি আশাবাদী হতে পারি নতুন সহস্রাব্দের নতুন দশকটা নিয়ে। এই ১০ বছরে আমরা উড়ব উন্নতির বন্দরটার দিকে। আমাদের আছে বিপুল জনশক্তি, যার বেশির ভাগই তরুণ, যারা শিক্ষালয়ে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে পৃথিবীর উন্নতিতে নিজেদের নিয়োজিত করবে বলে, আমাদের আছে গণতন্ত্র, আছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা। আর কোন দেশ আছে আমাদের আশপাশে, যেখানে এত শান্তি বিরাজমান? আমাদের আছে ধারাবাহিক গণতন্ত্র। আমাদের আছে প্রবাসী জনশক্তি, যারা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন বিশ্বমন্দার মধ্যেও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ।
এখন এ সুযোগ কাজে লাগানোর যোগ্যতা, দক্ষতা, সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে সরকারকে। আমাদের বেসরকারি খাত, আমাদের কৃষক, আমাদের মানুষ নিজের উদ্যোগে নিজেদের সৃজনপ্রতিভা দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। এবার আমরা সরকার ও বিরোধী দল মিলে জাতীয় জাগরণ ও অগ্রসরের জন্য প্রস্তুত হতে চাই। ২০১০-এর নতুন সূর্য নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে আলোকিত করে তুলুক এক অগ্রসর বাংলাদেশকে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
২০০৯ সালও হতে পারত খুব একটা ভালো বছর। আমরা গণতান্ত্রিক শাসনে ফিরে এসেছি গত বছরে। সারাটা বছর বিরোধী দল কোনো রকমের আন্দোলন করেনি, তারা দাবি করেছে, তারা এক দিনও হরতাল ডাকেনি, এটাই বা আমাদের জন্য কম কী! আর বিপুল দানবাকৃতি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সরকারি দল যথেষ্ট সংযত ছিল, অন্তত আরও অসংযত হয়নি, বাড়াবাড়ি করেনি, সেটিকেও দেখতে হবে অনেক বড় প্রাপ্তি হিসেবেই। শুধু বছরের শুরুতে যদি বিডিআর বিদ্রোহটা না ঘটত আর বছরের শেষে বড়সড় লঞ্চ দুর্ঘটনাটা!
একটা নতুন সরকার নিজেকে ও দেশকে বদলে নেওয়ার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় বসতে না বসতেই এসেছে অপ্রত্যাশিত আঘাত। খুব বড়সড় আঘাত। এত বড় সশস্ত্র বিদ্রোহ, এত রক্তপাত। দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার সময় যখন তার, তখন তাকে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে ওই ধাক্কাটা সামাল দিতে। গণতন্ত্রের প্রতি দেশের মানুষ ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে নিরঙ্কুশ অঙ্গীকার, সেটাই নতুনভাবে প্রমাণিত হয়েছে ওই সংকটে। প্রায় দুই বছরের অসচরাচর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন থেকে আমরা গণতন্ত্রে ফিরে এসেছি, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে, এবং সেই গণতন্ত্র আমরা চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেছি, ২০০৯ সালে সেইটা প্রমাণিত হয়ে গেছে। আর প্রচলিত আইনেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণাও আমাদের জাতীয় পথরেখাকে দিয়েছে কলঙ্কমুক্তির উজ্জ্বলতা।
একটা উড়োজাহাজ যখন উড়তে শুরু করে, তার আগে তাকে স্টার্ট নিতে হয়। স্টার্ট নিয়েই সে চলতে শুরু করে না। খানিকক্ষণ তাকে দাঁড়াতে হয়। ২০০৯ সাল ছিল আমাদের সেই স্টার্ট নেওয়ার আর দাঁড়ানোর সময়। ২০১০ হোক আমাদের অগ্রগতির পথে উড়াল দেওয়ার বছর।
এটা হওয়া খুব সম্ভব। এখনো পর্যন্ত সরকারি দলকে দেশের অগ্রগতি ও দেশের মানুষের ভাগ্য বদলের বিষয়ে অঙ্গীকৃত বলেই মনে হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সমীকরণ বাংলাদেশ ও সরকারের জন্য অনুকূল হিসেবে দেখা দিয়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে পরিবর্তনের আওয়াজ তোলা বারাক ওবামার সরকার। ভারতের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মনমোহন সিংহের মতো সজ্জন ও বিদ্বজ্জন। এমনকি পাকিস্তানেও আছে একটা নির্বাচিত সরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে।
সব মিলিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির উপযোগী। কেবল সরকারের উচিত নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে উদার করা, তার বন্ধুর বৃত্তটা বড় করে ফেলা, তার স্বাভাবিক মিত্রদের কাজে লাগানো। আর দেশে ও দেশের বাইরে যেসব বাংলাদেশি যে কাজের যোগ্য, সেই কাজে তাদের সহযোগিতা আহ্বান করা। দেশের প্রয়োজনে সরকার সাহায্য চাইলে আমাদের কোনো নাগরিক—তিনি যত বড় বিশেষজ্ঞই হন না কেন—এগিয়ে আসবেন না, তা হয় না। বিরোধী দলকে সংসদে আনতে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত। আমাদের গণতন্ত্রকে অর্থবহ করতেই হবে। শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হয় না, কার্যকরও হয় না। ২০০৯ সাল সেদিক থেকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখায়নি, ২০১০ সালে সরকার আর বিরোধী দল মিলেমিশে দেশকে এগিয়ে নিতে নেমে পড়েছে, আমরা সেই অসম্ভব স্বপ্নটা নববর্ষের এই প্রভাতেই দেখতে চাই। আর বিরোধী দল নিশ্চয়ই বিরোধিতা করবে, সরকারের সমালোচনা করবে। কিন্তু সেটা কেবল নিজেদের রাজনৈতিক লাভক্ষতির কথা বিবেচনা করে যেন না হয়। এখন পর্যন্ত দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সরকার চাইছে বিরোধী দলকে যতটা পারা যায় নিষ্ক্রিয় রাখতে আর বিরোধী দল তাদের বহুব্যবহূত ভারতজুজুর ট্রাম্পকার্ডটা দিয়েই আরেক দফা বাজিমাত করার স্বপ্ন দেখছে। দেশের মানুষ যে বোকা নয়, চার-চারটা নির্বাচনের পরও কি রাজনৈতিক নেতাদের সে বিষয়ে সন্দেহ আছে?
আমাদের এক বন্ধু বড় ভাই অনেক দিন পর দেশে এলেন। তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত। বললেন, বেসরকারি খাতে অগ্রগতি তো বিস্ময়কর! পৃথিবীর যেকোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এখন তুলনীয়। শুধু যদি সরকার অবকাঠামোগত সমর্থনটা দিয়ে যেতে পারে! আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা ও বিদ্যুত্ খাতের উন্নতি ঘটানোর কাজটা করতে হবে সরকারকেই।
সত্যি, দেশ নানা দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে ঢাকার দিগন্ত পাল্টে গেল। আগে ব্যাংকক-কুয়ালালামপুরে যে ধরনের ভবন আমরা দেখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম, সে রকম ভবন এখন ঢের হয়েছে ঢাকায়। আমি যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে গিয়ে দেখেছি, ওখানকার এমআইটি বা হার্ভার্ড-পড়ুয়া সব ছাত্রের কাছে মোবাইল ফোন নেই। আর আমাদের পানের দোকানির কাছেও দুটো মোবাইল ফোন। ভারত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক শক্তি হতে যাচ্ছে বলে এত যে রব, সেখানেও তো রাস্তার দুই ধারে দেখতে পেলাম চরম দারিদ্র্যের চিহ্ন, বৈষম্য সেখানে প্রবল। হোটেলের কর্মচারীরা মাত্র এক হাজার বা এক হাজার ২০০ রুপি বেতনে কাজ করেন, আমাদের টাকায় দেড়-দুই হাজার। আজকে আমাদের গ্রামের বাড়ির খেতমজুরও দিনশেষে সোয়া শ টাকা মজুরি ও এক বেলা খাবার পান। মানে, তাঁর মাসিক আয় তিন হাজারেরও বেশি।
দারিদ্র্য, জনসংখ্যাধিক্য আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে ঘটেই চলেছে, সেটাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছিল বাংলাদেশ প্যারাডক্স বলে। দিনার স্টান্ডার্ড নামের একটা পত্রিকায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর সেরা ব্যাংকগুলো, যেমন সিটি, গোল্ডম্যান স্যাকস, জেপিমর্গান, মেরিল লিঞ্চ বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছে বিনিয়োগের এক চমত্কার সুযোগ হিসেবে।
বাংলাদেশের তৈরি জাহাজ এখন কিনছে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ খাতের দিকে নজর দেওয়া হলে ছয় বছরের মধ্যে এই খাত জাতীয় প্রবৃদ্ধি তিন ভাগ বাড়িয়ে দিতে পারবে। বাংলাদেশ জাহাজভাঙা শিল্পের দেশ থেকে জাহাজ নির্মাণশিল্পের দেশ হিসেবে নিজেকে বিশ্বসভায় সুপরিচিত করতে পারে।
বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা আছে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে। আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর ১০ ভাগ কাজ আনার যোগ্যতা রাখে বলে বাইরের বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই মন্তব্য করেছেন। তা করা গেলে আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধি বেড়ে যেতে পারে উল্লেখযোগ্যভাবে।
নতুন আশার সঞ্চার করেছে সৌরবিদু্যুতের ক্ষেত্র। রহিমআফরোজ ১০ লাখ বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার বাড়িতে তারা সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে বলতে হয়, জলবায়ুর বিপদ আমাদের জন্য সৃষ্টি করেছে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র। যেকোনো বিপদকে সম্পদে পরিণত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে এই দেশের আর এই দেশের মানুষের। এবার আমরা একটা বড় বিপদের মধ্যে আছি, তার নাম জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ। পৃথিবীর উষ্ণতা এভাবে বেড়ে যেতে থাকলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে যাবে, সেই আশঙ্কার কথা পৃথিবীব্যাপী প্রচারিত। কিন্তু এটা হতে পারে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর এবং দেশটাকে গড়ে তোলার একটা বড় সুযোগ। দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছি আমরা, কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকেই আমরা হার স্বীকার করিনি। এই জলবায়ু-দুর্যোগেও করব না।
পৃথিবীব্যাপী এখন আওয়াজ উঠেছে সবুজ জ্বালানির, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারের। আমরা সৌরবিদ্যুত্ উত্পাদনের একটা বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করতে পারি। তাতে লাভ হবে দুটো। এক. আমাদের বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারব অনেকাংশে। দুই. সারা পৃথিবীকে আমরা দেখাতে পারব, আমরা কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার হিসেবে অসহায়ত্বের কথা বলছি না, আমরা নিজেরা সবুজ জ্বালানি ব্যবহার করছি, আমরা কম পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করছি, আমরা পৃথিবীতে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছি।
আমরা কিন্তু কোপেনহেগেনে কেবল ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে যাইনি। বরং আমরা গিয়েছি সেই দেশ হিসেবে, যে দেশ পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে পারে, শিখিয়ে দিতে পারে, দেখো, দুর্বিপাকে কীভাবে বাঁচতে হয়, ঘুরে দাঁড়াতে হয়। অভিযোজনের কী উজ্জ্বল দৃষ্টান্তই না স্থাপন করেছে আমাদের উপকূলের মানুষেরা!
কিন্তু আমাদের পাওনাও তো আমাদের চাইতে হবে। কোপেনহেগেন থেকে আমরা ঝুলি ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসব, এমন ভাবনা কোনো মূর্খই ভাবেনি। কিন্তু কোপেনহেগেনের কূটনৈতিক সভায় বাংলাদেশ সম্মানজনক আসনই অধিকার করে নিয়েছে। ক্লাব ২৬-এ আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পাশে জায়গা হয়েছে বাংলাদেশের। কোপেনহেগেন সম্মেলনে একটা কোনোরকমের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে, আজ হোক, কাল হোক, জলবায়ু তহবিল গঠন করতেই হবে পৃথিবীর দেশগুলোকে। আর আমরা অভিযোজনের জন্য সে ক্ষেত্রে বরাদ্দ চাইবই, এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা। পাশাপাশি মিটিগেশন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়েও আমাদের কাজ করতে হবে এবং তহবিল পেতে হবে। পৃথিবীর দূষণে আমাদের দায় নেই সত্য, তবে আমরা আরও সবুজ জ্বালানি-নীতি অবলম্বন করে একটা আদর্শ রাষ্ট্রের ভূমিকা নিতে পারি। এ বিষয়ে আমাদের নাগরিকদেরও সচেতনতার অভাব আছে। নইলে একটা দেশলাইয়ের কাঠির পয়সা বাঁচাতে আমরা গ্যাসের চুলা অবিরাম জ্বালিয়ে রাখি। আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যম ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকে নীতিমালাও প্রণয়ন করতে হবে।
জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, তিনি তাঁর নিজ গ্রামে কাজ করছেন এমন ধান উদ্ভাবন করতে, যা গ্রিনহাউস গ্যাস কম নিঃসরণ করবে। এমন ধানও উদ্ভাবিত হচ্ছে, যা লোনাপানিতে বাঁচবে। এসব জলবায়ুর পরিবর্তনরোধী প্রজাতির শস্য আমরা যেমন নিজেরা আবাদ করতে পারি, তেমনি এসব আমরা বিদেশেও রপ্তানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারি। আর জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তর্জাতিক তহবিল গঠিত হলে অবশ্যই আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা লাভ করব।
সব মিলিয়ে আমরা সত্যি আশাবাদী হতে পারি নতুন সহস্রাব্দের নতুন দশকটা নিয়ে। এই ১০ বছরে আমরা উড়ব উন্নতির বন্দরটার দিকে। আমাদের আছে বিপুল জনশক্তি, যার বেশির ভাগই তরুণ, যারা শিক্ষালয়ে যাচ্ছে, গড়ে উঠছে পৃথিবীর উন্নতিতে নিজেদের নিয়োজিত করবে বলে, আমাদের আছে গণতন্ত্র, আছে শান্তি ও স্থিতিশীলতা। আর কোন দেশ আছে আমাদের আশপাশে, যেখানে এত শান্তি বিরাজমান? আমাদের আছে ধারাবাহিক গণতন্ত্র। আমাদের আছে প্রবাসী জনশক্তি, যারা আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন বিশ্বমন্দার মধ্যেও। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ।
এখন এ সুযোগ কাজে লাগানোর যোগ্যতা, দক্ষতা, সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হবে সরকারকে। আমাদের বেসরকারি খাত, আমাদের কৃষক, আমাদের মানুষ নিজের উদ্যোগে নিজেদের সৃজনপ্রতিভা দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। এবার আমরা সরকার ও বিরোধী দল মিলে জাতীয় জাগরণ ও অগ্রসরের জন্য প্রস্তুত হতে চাই। ২০১০-এর নতুন সূর্য নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করে আলোকিত করে তুলুক এক অগ্রসর বাংলাদেশকে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments