প্রতিকূলতার মধ্যেও ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা উচ্চ by মনজুর আহমেদ
২০০৯ সালে দেশের বেসরকারি ও রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সবাই উচ্চ পরিচালন মুনাফা করেছে। ৩০টি বেসরকারি ব্যাংকের গত দুই বছরের পরিচালনগত মুনাফার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সব ব্যাংকই আগের বছরের চেয়ে অধিক মুনাফা করেছে। রাষ্ট্র খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকেরও দুই বছরের তুলনায় উচ্চ পরিচালন মুনাফার হিসাব মিলেছে।
দুই বছর দেশে জরুরি অবস্থার পর নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আলোচ্য বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধিসহ শিল্প-বাণিজ্য পণ্যের দর সংযত করতে সুদের হার কমানোর অব্যাহত চাপ তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শিল্প-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা তৈরি হয়, তার জের ছিল এক বছর ধরেই।
অন্যদিকে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি থেকে উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের মূল্যপতন হয়েছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সার্বিক পণ্যমূল্য কমে আসায় আমদানি খাতের ব্যয় কমেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি উভয় খাতেই ব্যাংকগুলোর ব্যবসা তেমন ভালো যায়নি।
তবে এ সময় শেয়ারবাজার বেশ তেজি ছিল। আর অনেকগুলো ব্যাংকের ব্রোকারেজ ব্যবসা ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও তাদের নিজস্ব তহবিল শেয়ারবাজারে খাটিয়েছে। ফলে এ খাতে বড় আয় হয়েছে ব্যাংকগুলোর। দু-একটি ব্যাংকের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। তবে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে গত বছরের আয়ে যোগ হয়নি। আগামী বছরগুলো এই আয় আসবে।
বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণে প্রভাবিত করা হয়েছে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ বিতরণে সুদের হারও নির্ধারণ করা রয়েছে। যার সবই উচ্চ মুনাফার ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল।
এত সব সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) দেশে আসায় ব্যাংকের পরিচালনগত মুনাফা বাড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। অন্যদিকে বিশ্বমন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতের ঋণ এককালীন (ডাউন পেমেন্টে) জমা ছাড়াই পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। ফলে এসব ঋণ থেকে আয় তো আসেইনি, উপরন্তু এককালীন জমার মাধ্যমে কিছু টাকা ব্যাংকের খাতায় যুক্ত হতে পারত, তাও হয়নি।
তবে সুবিধার দিক হলো, ব্যাংকগুলো এসব ঋণ পুনঃ তফসিল করায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়নি। ফলে এর বিপরীতে উচ্চ হারে প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হবে না।
ধারণা করা হয়, আলোচ্য বছরে ঋণ খাতে ব্যাংকের ততটা আয় বৃদ্ধি পায়নি। কেননা, গত বছরের হিসাবে শ্রেণীকৃত বা খেলাপি ঋণ বাড়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি একটা মন্দা বিনিয়োগ পরিস্থিতিও দেশে ছিল।
খেলাপি ঋণ ঠেকাতে এককালীন জমার ছাড় ব্যাংকের জন্য সুবিধা হলেও আয় আসবে না। অন্যদিকে প্রায় বছরজুড়ে মুদ্রাবাজারে কলমানির সুদের হার কম ছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নগদ টাকার পাহাড় জমে ছিল ব্যাংকগুলোতে। টাকা ঋণে খাটানো যাবে না ভেবে ব্যাংকগুলো সরকারি নিরাপদ বিনিয়োগ ট্রেজারি বিলে অর্থ খাটিয়েছে।
তবে এ বছরের জুন পর্যন্ত অর্ধবার্ষিক হিসাবে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো উচ্চ মুনাফা করেছে। আর বছর শেষে তথ্য নিতে গিয়ে জানা যায় সব ব্যাংকই ভালো মুনাফা করেছে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে বিপর্যয় উত্তরণে উন্নত দেশগুলো যখন বিভিন্ন পুনরুদ্ধার প্যাকেজ নিয়ে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ মুনাফা করার খবর সুখবরও বটে। তবে সংশ্লিষ্ট কারও কারও মতে, এই পরিচালন মুনাফার মধ্যে বড় ধরনের হিসাবের ফাঁক বা ‘উইন্ডো ড্রেসিং’ থাকতে পারে।
উপরন্তু, এই পরিচালনগত মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। পরিচালনগত মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) এবং কর (৪২ দশমিক ৫ শতাংশ) বাদ দিয়ে নিট মুনাফার পরিমাণ হিসাব করা হয়। ফলে নিট মুনাফা অনেকটা কমে আসবে।
এর ওপর ব্যাংক বিশেষে সাধারণ রিজার্ভ খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষা করতে হবে নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাব পাওয়া পর্যন্ত।
আবার অনেক ক্ষেত্রেই নিট মুনাফা হলেও তার সম্পূর্ণ অর্থ লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা হবে না। যার কারণে শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাওয়ার হিসাব কষতে অপেক্ষা করতে হবে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) আগের পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত।
সর্বোপরি ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বা ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের ১০ শতাংশ—এ দুয়ের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে। যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ২০০ কোটি টাকা। ফলে অনেক ব্যাংকের মুনাফা বিতরণ কমে আসতে পারে। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী পরিচালন মুনাফা প্রকাশ একটি স্বীকৃত বিষয়।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে এই পরিচালন মুনাফা প্রকাশে ব্যাংকগুলোর ওপর নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এই বিধিনিষেধ এসেছে স্থূল কারণে এবং তা এসেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ঘুরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
তবে শেয়ারবাজারে যারা প্রতিনিয়ত কেনাবেচা করেন এবং যাদের কোনো ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে, তাঁরা ব্যক্তি যোগাযোগের মাধ্যমেই এ তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে আগেভাগেই পেয়ে থাকেন।
পাশাপাশি দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেই পরিচালন মুনাফা প্রকাশে বিশেষ অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। এর পেছনে আবার ভিন্ন ধরনের স্বার্থও আছে।
প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর ভালো পরিচালন মুনাফার তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ তৈরি হয় যে ব্যাংক সেবার নামে অতি মুনাফা করছে। বিশেষত ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদের হার, বিভিন্ন ধরনের কমিশন ও মাশুল কমানোর তত্পরতা চালান। যে কারণে ব্যাংকে উদ্যোক্তা ও শীর্ষ নির্বাহীদের পক্ষ থেকে এসইসির মতো স্থূল যুক্তিতে নিজ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ ধরনের কড়াকড়ি রয়েছে।
বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো ২০০৯ সালেও পরিচালন মুনাফার পরিমাণের দিক থেকে সর্বাধিক আয় করেছে ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। আগের বছর ব্যাংকটি ৫৩২ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছিল।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ (ঋণ) পদ্ধতি ভিন্ন। ফলে তাদের হিসাবও ভিন্ন। উপরন্তু ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ বেসরকারি অন্য একক কোনো ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। সেই হিসাবে ইসলামী ব্যাংককে বাদ দিলে গত বছর সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে প্রাইম ব্যাংক। এর পর রয়েছে এবি ব্যাংক।
রাষ্ট্র মালিকাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এবার ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে। জনতা ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি বরাবরই অন্য তিন ব্যাংকের চেয়ে ভালো ছিল। মুনাফাতেও এর প্রতিফলন রয়েছে। রূপালী ব্যাংক ২০০ কোটি টাকারও বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে। অগ্রণী ব্যাংক গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত হিসাব শেষ করতে পারেনি। তবে তাদের বার্ষিক পরিচালন মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ৭০০ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা হবে। সোনালী ব্যাংক হিসাব চূড়ান্ত করতে না পারলেও ৮০০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিষয়ে আশাবাদী।
ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা (কোটি টাকায়)
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ২০০৯ ২০০৮
সোনালী ব্যাংক ৮০০ ৬৩৬
জনতা ব্যাংক ৮০০ ৭০০
অগ্রণী ব্যাংক — ৬৩২
রূপালী ব্যাংক ২০০ ১০১
বেসরকারি ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংক ৮৫০ ৮৩২
এবি ব্যাংক ৫০০ ৪৬৫
প্রাইম ব্যাংক ৫৮০ ৪৩০
পূবালী ব্যাংক ৪২৭ ৩৬৫
ন্যাশনাল ব্যাংক ৩৫০ ৩৫০
সাউথইস্ট ব্যাংক ৪৬৫ ৩০০
ব্র্যাক ব্যাংক ৪০০ ৩০০
সিটি ব্যাংক ২৩০ ১৭০
এক্সিম ব্যাংক ৩২০ ২৬৭
ইউসিবিএল ৩৪০ ২৬০
ঢাকা ব্যাংক ২৭০ ২৫৪
এনসিসিবিএল ৩১৪ ২৩৬
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২৬০ ২১৮
উত্তরা ব্যাংক ২৫০ ২১৫
শাহ্জালাল ব্যাংক ২১০ ২০৭
ইস্টার্ন ব্যাংক ৩১৫ ২০০
ব্যাংক এশিয়া ৩০০ ১৯৫
মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২২৪ ১৯৩
আইএফআইসি ব্যাংক ২০০ ১৭৮
বেসিক ব্যাংক ১৬২ ১৭৫
আল-আরাফাহ ব্যাংক ১৮১ ১৫৮
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১৮১ ১৫৫
প্রিমিয়ার ব্যাংক ১৬০ ১৪৫
ট্রাস্ট ব্যাংক ১৬০ ১৩৫
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১৬০ ১২২
ওয়ান ব্যাংক ১৭০ ১১০
যমুনা ব্যাংক ১৯৮ ১০৯
এসআইবিএল ১৩০ ১০০
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ৭৬ ২৫
কমার্স ব্যাংক — ১৮
দুই বছর দেশে জরুরি অবস্থার পর নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আলোচ্য বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধিসহ শিল্প-বাণিজ্য পণ্যের দর সংযত করতে সুদের হার কমানোর অব্যাহত চাপ তৈরি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে শিল্প-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা তৈরি হয়, তার জের ছিল এক বছর ধরেই।
অন্যদিকে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি থেকে উন্নত দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানি পণ্যের মূল্যপতন হয়েছে। একইভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে সার্বিক পণ্যমূল্য কমে আসায় আমদানি খাতের ব্যয় কমেছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি উভয় খাতেই ব্যাংকগুলোর ব্যবসা তেমন ভালো যায়নি।
তবে এ সময় শেয়ারবাজার বেশ তেজি ছিল। আর অনেকগুলো ব্যাংকের ব্রোকারেজ ব্যবসা ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং রয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও তাদের নিজস্ব তহবিল শেয়ারবাজারে খাটিয়েছে। ফলে এ খাতে বড় আয় হয়েছে ব্যাংকগুলোর। দু-একটি ব্যাংকের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। তবে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে গত বছরের আয়ে যোগ হয়নি। আগামী বছরগুলো এই আয় আসবে।
বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে দুই বছর ধরে দেশের ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণে প্রভাবিত করা হয়েছে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে ঋণ বিতরণে সুদের হারও নির্ধারণ করা রয়েছে। যার সবই উচ্চ মুনাফার ক্ষেত্রে অন্তরায় ছিল।
এত সব সত্ত্বেও বেশি পরিমাণ প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) দেশে আসায় ব্যাংকের পরিচালনগত মুনাফা বাড়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়। অন্যদিকে বিশ্বমন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানি খাতের ঋণ এককালীন (ডাউন পেমেন্টে) জমা ছাড়াই পুনঃ তফসিল করা হয়েছে। ফলে এসব ঋণ থেকে আয় তো আসেইনি, উপরন্তু এককালীন জমার মাধ্যমে কিছু টাকা ব্যাংকের খাতায় যুক্ত হতে পারত, তাও হয়নি।
তবে সুবিধার দিক হলো, ব্যাংকগুলো এসব ঋণ পুনঃ তফসিল করায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়নি। ফলে এর বিপরীতে উচ্চ হারে প্রভিশনিং (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রাখতে হবে না।
ধারণা করা হয়, আলোচ্য বছরে ঋণ খাতে ব্যাংকের ততটা আয় বৃদ্ধি পায়নি। কেননা, গত বছরের হিসাবে শ্রেণীকৃত বা খেলাপি ঋণ বাড়ার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি একটা মন্দা বিনিয়োগ পরিস্থিতিও দেশে ছিল।
খেলাপি ঋণ ঠেকাতে এককালীন জমার ছাড় ব্যাংকের জন্য সুবিধা হলেও আয় আসবে না। অন্যদিকে প্রায় বছরজুড়ে মুদ্রাবাজারে কলমানির সুদের হার কম ছিল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নগদ টাকার পাহাড় জমে ছিল ব্যাংকগুলোতে। টাকা ঋণে খাটানো যাবে না ভেবে ব্যাংকগুলো সরকারি নিরাপদ বিনিয়োগ ট্রেজারি বিলে অর্থ খাটিয়েছে।
তবে এ বছরের জুন পর্যন্ত অর্ধবার্ষিক হিসাবে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো উচ্চ মুনাফা করেছে। আর বছর শেষে তথ্য নিতে গিয়ে জানা যায় সব ব্যাংকই ভালো মুনাফা করেছে।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে বিপর্যয় উত্তরণে উন্নত দেশগুলো যখন বিভিন্ন পুনরুদ্ধার প্যাকেজ নিয়ে ব্যস্ত, তখন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ মুনাফা করার খবর সুখবরও বটে। তবে সংশ্লিষ্ট কারও কারও মতে, এই পরিচালন মুনাফার মধ্যে বড় ধরনের হিসাবের ফাঁক বা ‘উইন্ডো ড্রেসিং’ থাকতে পারে।
উপরন্তু, এই পরিচালনগত মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। নিট মুনাফাই ব্যাংকের প্রকৃত আয়। পরিচালনগত মুনাফা থেকে ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি (প্রভিশন) এবং কর (৪২ দশমিক ৫ শতাংশ) বাদ দিয়ে নিট মুনাফার পরিমাণ হিসাব করা হয়। ফলে নিট মুনাফা অনেকটা কমে আসবে।
এর ওপর ব্যাংক বিশেষে সাধারণ রিজার্ভ খাতে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। ফলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষা করতে হবে নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাব পাওয়া পর্যন্ত।
আবার অনেক ক্ষেত্রেই নিট মুনাফা হলেও তার সম্পূর্ণ অর্থ লভ্যাংশ আকারে বিতরণ করা হবে না। যার কারণে শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ পাওয়ার হিসাব কষতে অপেক্ষা করতে হবে ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) আগের পরিচালনা পর্ষদের সভার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত।
সর্বোপরি ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে মূলধন ৪০০ কোটি টাকা বা ঝুঁকিনির্ভর সম্পদের ১০ শতাংশ—এ দুয়ের মধ্যে যা বেশি সেই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণ করতে হবে। যার মধ্যে পরিশোধিত মূলধন হতে হবে ২০০ কোটি টাকা। ফলে অনেক ব্যাংকের মুনাফা বিতরণ কমে আসতে পারে। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী পরিচালন মুনাফা প্রকাশ একটি স্বীকৃত বিষয়।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে এই পরিচালন মুনাফা প্রকাশে ব্যাংকগুলোর ওপর নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এই বিধিনিষেধ এসেছে স্থূল কারণে এবং তা এসেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ঘুরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে।
তবে শেয়ারবাজারে যারা প্রতিনিয়ত কেনাবেচা করেন এবং যাদের কোনো ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ রয়েছে, তাঁরা ব্যক্তি যোগাযোগের মাধ্যমেই এ তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে আগেভাগেই পেয়ে থাকেন।
পাশাপাশি দুই বছর ধরে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকেই পরিচালন মুনাফা প্রকাশে বিশেষ অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। এর পেছনে আবার ভিন্ন ধরনের স্বার্থও আছে।
প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর ভালো পরিচালন মুনাফার তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ তৈরি হয় যে ব্যাংক সেবার নামে অতি মুনাফা করছে। বিশেষত ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদের হার, বিভিন্ন ধরনের কমিশন ও মাশুল কমানোর তত্পরতা চালান। যে কারণে ব্যাংকে উদ্যোক্তা ও শীর্ষ নির্বাহীদের পক্ষ থেকে এসইসির মতো স্থূল যুক্তিতে নিজ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য দেওয়ার বিষয়ে বিশেষ ধরনের কড়াকড়ি রয়েছে।
বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বরাবরের মতো ২০০৯ সালেও পরিচালন মুনাফার পরিমাণের দিক থেকে সর্বাধিক আয় করেছে ইসলামী ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৮৫০ কোটি টাকা। আগের বছর ব্যাংকটি ৫৩২ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছিল।
ইসলামী ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ (ঋণ) পদ্ধতি ভিন্ন। ফলে তাদের হিসাবও ভিন্ন। উপরন্তু ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ বেসরকারি অন্য একক কোনো ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি। সেই হিসাবে ইসলামী ব্যাংককে বাদ দিলে গত বছর সবচেয়ে বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে প্রাইম ব্যাংক। এর পর রয়েছে এবি ব্যাংক।
রাষ্ট্র মালিকাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এবার ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে। জনতা ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি বরাবরই অন্য তিন ব্যাংকের চেয়ে ভালো ছিল। মুনাফাতেও এর প্রতিফলন রয়েছে। রূপালী ব্যাংক ২০০ কোটি টাকারও বেশি পরিচালন মুনাফা করেছে। অগ্রণী ব্যাংক গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত হিসাব শেষ করতে পারেনি। তবে তাদের বার্ষিক পরিচালন মুনাফার লক্ষ্যমাত্রা ৭০০ কোটি টাকা। ধারণা করা হচ্ছে, সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার বেশি পরিচালন মুনাফা হবে। সোনালী ব্যাংক হিসাব চূড়ান্ত করতে না পারলেও ৮০০ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফার বিষয়ে আশাবাদী।
ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা (কোটি টাকায়)
রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংক ২০০৯ ২০০৮
সোনালী ব্যাংক ৮০০ ৬৩৬
জনতা ব্যাংক ৮০০ ৭০০
অগ্রণী ব্যাংক — ৬৩২
রূপালী ব্যাংক ২০০ ১০১
বেসরকারি ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংক ৮৫০ ৮৩২
এবি ব্যাংক ৫০০ ৪৬৫
প্রাইম ব্যাংক ৫৮০ ৪৩০
পূবালী ব্যাংক ৪২৭ ৩৬৫
ন্যাশনাল ব্যাংক ৩৫০ ৩৫০
সাউথইস্ট ব্যাংক ৪৬৫ ৩০০
ব্র্যাক ব্যাংক ৪০০ ৩০০
সিটি ব্যাংক ২৩০ ১৭০
এক্সিম ব্যাংক ৩২০ ২৬৭
ইউসিবিএল ৩৪০ ২৬০
ঢাকা ব্যাংক ২৭০ ২৫৪
এনসিসিবিএল ৩১৪ ২৩৬
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২৬০ ২১৮
উত্তরা ব্যাংক ২৫০ ২১৫
শাহ্জালাল ব্যাংক ২১০ ২০৭
ইস্টার্ন ব্যাংক ৩১৫ ২০০
ব্যাংক এশিয়া ৩০০ ১৯৫
মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২২৪ ১৯৩
আইএফআইসি ব্যাংক ২০০ ১৭৮
বেসিক ব্যাংক ১৬২ ১৭৫
আল-আরাফাহ ব্যাংক ১৮১ ১৫৮
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ১৮১ ১৫৫
প্রিমিয়ার ব্যাংক ১৬০ ১৪৫
ট্রাস্ট ব্যাংক ১৬০ ১৩৫
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১৬০ ১২২
ওয়ান ব্যাংক ১৭০ ১১০
যমুনা ব্যাংক ১৯৮ ১০৯
এসআইবিএল ১৩০ ১০০
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ৭৬ ২৫
কমার্স ব্যাংক — ১৮
No comments