আমাদের কৃষিপণ্য ও কৃষকের পরিণতি কী হবে by রানা ভিক্ষু
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিনই কৃষকের জন্য নতুন নতুন দুঃসংবাদ উপস্থিত হচ্ছে। আমাদের কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে বিগত আড়াই শ বছরে কিষান-কিষানির প্রতি শোষণ ও বঞ্চনার দিকটাই প্রকটভাবে চোখে পড়ে। এ দেশের কৃষকের ঘাম ও শ্রমের মুনাফা ঘরে তুলতে শুরু করে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। শুরুর দিকে উত্পাদিত ফসল পাচারসহ সার, কীটনাশক ও আধুনিকায়নের নামে পরিবেশবিধ্বংসী প্রযুক্তিই ছিল কৃষি ও কৃষককে মারার হাতিয়ার। দিনে দিনে বীজের বাজার দখল করে নিয়ে কৃষককে তারা নিধিরাম সর্দার বানিয়ে ছেড়েছে।
কৃষকের নাভিশ্বাস দিনে দিনে আরও দীর্ঘ হতে থাকে, যখন কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কোম্পানি কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে, তখন থেকেই। এসব কোম্পানি ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সময়মতো কৃষকের হাতে বীজ, সার ও কীটনাশক পৌঁছাতে দেয় না। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলো, এখনো সরকারি বীজ (বিএডিসির বীজ) কৃষকদের কিনতে হয় বেসরকারি ব্যক্তির কাছ থেকে! যার মূল্যের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। লালমনিরহাটের মোগলহাট বাজারে বিএডিসির ১০ কেজি ধানের বীজের প্যাকেট ২২০ টাকার স্থলে বিক্রি হয় ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। দিনাজপুরের শতগ্রামে ওই একই বীজ বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। ফলে বিজ্ঞাপনের ধাঁধায় পড়ে অনেক কৃষক অধিক ফলনের আশায় হাইব্রিডসহ বেসরকারি বীজ কোম্পানির বীজ কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। প্যাকেটের বীজে ভেজাল থাকায় উত্পাদনে মার খাচ্ছেন অনেক কৃষক, সেটা জেনেও নিরুপায় কৃষক ভাগ্যকে সঁপে দিচ্ছেন অনিশ্চয়তার ফাঁদে। সরকারি বীজ কেন এবং কীভাবে খোলা বাজারে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি হচ্ছে, তার সদুত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠে কী করছে তা বোঝা যায়, যখন মোগলহাটের একজন কৃষক অভিযোগ করেন, ১৩০ প্রকারের কীটনাশক ব্যবহার করেও তাঁর সবজি খেতকে পোকার কবল থেকে বাঁচাতে পারেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তারা মাঠপর্যায়ে জনবলসংকটের অজুহাত দিলেও কৃষকেরা জানান অন্য কথা। তাঁরা বলেন, গরিব কৃষকের খেত তো দূরের কথা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কেবল গ্রামের দু-একজন ধনী কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত আসেন, ধনী কৃষকের খেত পর্যন্ত যান না।
উত্তরবঙ্গ তথা বৃহত্তর রংপুরের কৃষকদের আছে আরও এক হাস্যকর অভিজ্ঞতা। দেশ-বিদেশের কৃষিবিদ, গবেষকেরা কৃষিশ্রমিকদের মৌসুমি বেকারত্ব এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের আগাম ফসল বিক্রিকে উত্তরবঙ্গের মৌসুমি দারিদ্র্যের (মঙ্গা) ধ্রুব কারণ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। একের পর এক তাঁরা নানা নামের আগাম ফলনশীল ফসল উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেসব ফসল নিয়ে ব্যাপক আশার কথাও শোনানো হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে এসব ফসল চাষের সম্প্রসারণ থমকে থাকছে গবেষণা প্লট পর্যন্ত। উদ্ভাবন-উত্তর এসব ফসলের সম্প্রসারণ এতই কম যে উদ্ভাবক, গবেষক ও পদস্থ কর্তারাই তা রোপণ ও কর্তন করেন। কৃষক ও চাষিদের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দর্শক হিসেবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে সরকার অনেক কাজেই তার প্রমাণ রেখেছে। যেমন ই-মেইলের মাধ্যমে দরপত্র পেশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও কৃষকের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ফসলের বীজের মজুদ ও মূল্য তালিকার হালনাগাদ সাপ্তাহিক প্রতিবেদন যেটি রাখা ছিল, সেটি ২০০৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদ। আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, এ দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাত্ মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিনির্ভর।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, কৃষক তাঁর জমিতে কী চাষ করবেন, সেটা এখন আর কৃষকের বিষয় নয়। এটা নির্ভর করে বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ওপর। অন্যদিকে বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মর্জিনির্ভর কৃষক যে ফসল উত্পাদন করেন, তার বড় মুনাফাটা ঘরে তুলে নেয় বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অন্য গ্রুপ। এরা কেউ কেউ চাল, ডাল, মাছ, মাংস তো বটেই, মসলা থেকে দাঁতের খিলাল প্যাকেটজাত করে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশে। কৃষিপণ্যের লাভ যাতে শহর বা গ্রামের স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঘরে কোনোভাবে না ঢোকে, সে জন্য রাজধানী, জেলা শহর, উপজেলা শহর এমনকি বড় হাটবাজারগুলোয় সুন্দর সুন্দর নাম দিয়ে রংবেরঙের সাজসজ্জিত দোকান খুলে বসেছে তাদেরই অন্য গ্রুপ। কৃষকের ভূমিকা ও মর্যাদাকে খাটো করার জন্য এরা লাখো কোটি টাকা ব্যয় করে। চটকা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে জানিয়ে দেয়, কৃষক যে ফসল উত্পাদন করেন, সেটা স্বাস্থ্যহানিকর, ব্যবহারের উপযোগী নয়। সেটাকে পরিশোধন করে মানবজাতির সুস্থতার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এই অকৃষক ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে কৃষিপণ্যের বিজ্ঞাপনি সংস্থার সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, অদূর ভবিষ্যতে যা কৃষির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কৃষিকে করপোরেট বাণিজ্যে পরিণত করতে ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী সরকারের উদাসীনতা। কৃষিকেন্দ্রিক মুনাফালোভী কোম্পানিগুলোর প্রতারণার কবল থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য কৃষি আদালত গঠন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই উপলব্ধি জাগ্রত হওয়া দরকার যে শুধু ঐতিহ্য, ইতিহাস ও কৃষকের জন্য নয়, দেশ ও দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থেই কৃষিকে রক্ষা করা দরকার।
রানা ভিক্ষু: লেখক ও উন্নয়নকর্মী, পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
কৃষকের নাভিশ্বাস দিনে দিনে আরও দীর্ঘ হতে থাকে, যখন কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন কোম্পানি কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করে, তখন থেকেই। এসব কোম্পানি ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে সময়মতো কৃষকের হাতে বীজ, সার ও কীটনাশক পৌঁছাতে দেয় না। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা হলো, এখনো সরকারি বীজ (বিএডিসির বীজ) কৃষকদের কিনতে হয় বেসরকারি ব্যক্তির কাছ থেকে! যার মূল্যের কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। লালমনিরহাটের মোগলহাট বাজারে বিএডিসির ১০ কেজি ধানের বীজের প্যাকেট ২২০ টাকার স্থলে বিক্রি হয় ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। দিনাজপুরের শতগ্রামে ওই একই বীজ বিক্রি হয় ৬০০ টাকায়। ফলে বিজ্ঞাপনের ধাঁধায় পড়ে অনেক কৃষক অধিক ফলনের আশায় হাইব্রিডসহ বেসরকারি বীজ কোম্পানির বীজ কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। প্যাকেটের বীজে ভেজাল থাকায় উত্পাদনে মার খাচ্ছেন অনেক কৃষক, সেটা জেনেও নিরুপায় কৃষক ভাগ্যকে সঁপে দিচ্ছেন অনিশ্চয়তার ফাঁদে। সরকারি বীজ কেন এবং কীভাবে খোলা বাজারে ইচ্ছামতো দামে বিক্রি হচ্ছে, তার সদুত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
আমাদের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মাঠে কী করছে তা বোঝা যায়, যখন মোগলহাটের একজন কৃষক অভিযোগ করেন, ১৩০ প্রকারের কীটনাশক ব্যবহার করেও তাঁর সবজি খেতকে পোকার কবল থেকে বাঁচাতে পারেননি। ঊর্ধ্বতন কর্তারা মাঠপর্যায়ে জনবলসংকটের অজুহাত দিলেও কৃষকেরা জানান অন্য কথা। তাঁরা বলেন, গরিব কৃষকের খেত তো দূরের কথা, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কেবল গ্রামের দু-একজন ধনী কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত আসেন, ধনী কৃষকের খেত পর্যন্ত যান না।
উত্তরবঙ্গ তথা বৃহত্তর রংপুরের কৃষকদের আছে আরও এক হাস্যকর অভিজ্ঞতা। দেশ-বিদেশের কৃষিবিদ, গবেষকেরা কৃষিশ্রমিকদের মৌসুমি বেকারত্ব এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের আগাম ফসল বিক্রিকে উত্তরবঙ্গের মৌসুমি দারিদ্র্যের (মঙ্গা) ধ্রুব কারণ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। একের পর এক তাঁরা নানা নামের আগাম ফলনশীল ফসল উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেসব ফসল নিয়ে ব্যাপক আশার কথাও শোনানো হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য কারণে এসব ফসল চাষের সম্প্রসারণ থমকে থাকছে গবেষণা প্লট পর্যন্ত। উদ্ভাবন-উত্তর এসব ফসলের সম্প্রসারণ এতই কম যে উদ্ভাবক, গবেষক ও পদস্থ কর্তারাই তা রোপণ ও কর্তন করেন। কৃষক ও চাষিদের খেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দর্শক হিসেবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে সরকার অনেক কাজেই তার প্রমাণ রেখেছে। যেমন ই-মেইলের মাধ্যমে দরপত্র পেশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও কৃষকের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ফসলের বীজের মজুদ ও মূল্য তালিকার হালনাগাদ সাপ্তাহিক প্রতিবেদন যেটি রাখা ছিল, সেটি ২০০৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হালনাগাদ। আমাদের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, এ দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাত্ মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ কৃষিনির্ভর।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, কৃষক তাঁর জমিতে কী চাষ করবেন, সেটা এখন আর কৃষকের বিষয় নয়। এটা নির্ভর করে বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের ওপর। অন্যদিকে বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মর্জিনির্ভর কৃষক যে ফসল উত্পাদন করেন, তার বড় মুনাফাটা ঘরে তুলে নেয় বীজ, সার ও কীটনাশক উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অন্য গ্রুপ। এরা কেউ কেউ চাল, ডাল, মাছ, মাংস তো বটেই, মসলা থেকে দাঁতের খিলাল প্যাকেটজাত করে ছড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশে। কৃষিপণ্যের লাভ যাতে শহর বা গ্রামের স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঘরে কোনোভাবে না ঢোকে, সে জন্য রাজধানী, জেলা শহর, উপজেলা শহর এমনকি বড় হাটবাজারগুলোয় সুন্দর সুন্দর নাম দিয়ে রংবেরঙের সাজসজ্জিত দোকান খুলে বসেছে তাদেরই অন্য গ্রুপ। কৃষকের ভূমিকা ও মর্যাদাকে খাটো করার জন্য এরা লাখো কোটি টাকা ব্যয় করে। চটকা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে জানিয়ে দেয়, কৃষক যে ফসল উত্পাদন করেন, সেটা স্বাস্থ্যহানিকর, ব্যবহারের উপযোগী নয়। সেটাকে পরিশোধন করে মানবজাতির সুস্থতার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এই অকৃষক ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে কৃষিপণ্যের বিজ্ঞাপনি সংস্থার সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে, অদূর ভবিষ্যতে যা কৃষির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কৃষিকে করপোরেট বাণিজ্যে পরিণত করতে ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানত দায়ী সরকারের উদাসীনতা। কৃষিকেন্দ্রিক মুনাফালোভী কোম্পানিগুলোর প্রতারণার কবল থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য কৃষি আদালত গঠন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই উপলব্ধি জাগ্রত হওয়া দরকার যে শুধু ঐতিহ্য, ইতিহাস ও কৃষকের জন্য নয়, দেশ ও দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর স্বার্থেই কৃষিকে রক্ষা করা দরকার।
রানা ভিক্ষু: লেখক ও উন্নয়নকর্মী, পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments