তিনি কি ব্যর্থ মানুষ -শ্রদ্ধাঞ্জলি by জাহীদ রেজা নূর
কেমন ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান? এত দিন পর কেনই বা তাঁকে নিয়ে বলতে হবে কথা?
১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ দেখেছিলাম তাঁকে। পাজামা-পাঞ্জাবি আর চাদর গায়ে এসেছিলেন তিনি। আব্বার সঙ্গে (শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন) তাঁর সখ্যের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। সে দৃশ্য গাঢ় হয়ে আছে মনে। আমার মেজো ভাইয়ের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন একটি কলমের সেট। তারই একটি বহুদিন ব্যবহার করেছিলাম আমি।
ভাষা আন্দোলনের কথা পরে বলি। আগে বলি, জীবনে তাঁর কী অর্জন ছিল, তা নিয়ে। নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি, পুস্তক ব্যবসা করতে গিয়ে যখন একদিন দেখলেন, শেষ হয়ে আসছে আয়ু, তখন বুঝতে পারলেন, জীবনের সবচেয়ে বেশি যেটা অর্জন হয়েছে, তার নাম নিরাপত্তাহীনতা। নিশ্চয় তিনি ভেবেছিলেন, এই যে চারটি সন্তান রেখে এ জগেক বিদায় জানাচ্ছেন, ওরা বাঁচবে কী করে? কে দেখাবে পথ? কে নেবে ওদের দায়িত্ব? ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর চলে যাওয়ার আগে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তিনি কি নিজেকে ভেবেছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ?
সারা জীবনের যোগফল শূন্য হতে দেখলে কার ভালো লাগে? আসলেই কি শূন্য হয়ে গেল সব?
জাগতিক খ্যাতি আর বৈষয়িক দৃষ্টিতে তিনি তো সত্যিই একজন ব্যর্থ মানুষ। ভাষা আন্দোলনে সামনের সারির সুযোগ্য নেতা ছিলেন বটে; কিন্তু কত মানুষ একুশে পদক পেয়ে গেলেন, তাঁর ভাগ্যে সেটা জুটল না। এ নিয়ে আক্ষেপও অবশ্য ছিল না তাঁর। আসলে জাগতিক উন্নতির সোপান তাঁর সামনে কখনোই উন্মুক্ত হয়নি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, তিনি জানতেনই না, সমাজে টিকে থাকতে হলে বিষয়-বুদ্ধির রয়েছে অমোঘ তাত্পর্য। আর তাই, সমাজের একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনের মাপে তাঁর উচ্চতা নির্ণয় করতে হলে ভুগতে হবে। এই পথে মিলবে না তাঁর হদিস।
সেই যে বামপন্থী রাজনীতি করতে গিয়ে জীবনের সবটুকু ঢেলে কর্ষণ করলেন রাজনীতির জমি, তাতে কোন ফসল উঠল তাহলে? সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নটা কি তাহলে শুধুই মরীচিকা? পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের প্রবল হাওয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেসে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। সে নব্বইয়ের দশকের শুরুর কথা। তাহলে কি সাম্য, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির আর কোনোই মূল্য থাকল না? এই যে মোহাম্মদ সুলতানের মতো মানুষেরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটি করে গেলেন সারা জীবন, তাহলে কি তা ছিল আদতেই পণ্ডশ্রম?
শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতায় আছে, ‘সুখের সংজ্ঞা তো আঙুলে গোনা যায়, বসতি নির্মাণ, বংশরক্ষা’। এই দুটি কিংবা মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো হয়ে গেলেই জীবনে সুখ এসে গেছে বলে যাঁরা ভাবেন, মোহাম্মদ সুলতান সেই দলে ছিলেন না। তাঁর কাছে, অন্য অনেক বামপন্থী রাজনীতিবিদের মতোই, জীবনের ভূমি কর্ষণ করে সোনা ফলানোটাই ছিল জীবনের উদ্দেশ্য। আজ যখন লাতিন আমেরিকার কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশের মানুষ সাহস করে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হয়, স্বপ্নেরা মরে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ওয়ার্ডের বাইরে অপ্রশস্ত করিডরে যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন মোহাম্মদ সুলতান, তখন কি তিনি জানতেন, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন, যে অথই জলে ভাসিয়েছেন মানবিক জীবনের নৌকা, তাঁরই হাল ধরবেন উগো শাভেজ, লুলা, কাস্ত্রোরা? আবার বলতে হয়, স্বপ্নেরা মরে না।
তাঁর কথা বলি। যে বছর ভাষা আন্দোলন হলো, সেই ১৯৫২ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করলেন। ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। তাঁর স্কুলের ছাত্ররাও যোগ দিয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনেও রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। ছিলেন বামপন্থী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেও সংগঠিত করে তুলতে রেখেছেন অবদান। ১৯৭০ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে প্রকাশনার কাজে যুক্ত হন।
মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটির কথা মনে পড়ে সবার আগে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত এই সংকলনটি ভাষা আন্দোলনের অনবদ্য সাহিত্য-দলিল। বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে জোগাড় হয়েছিল লেখাগুলো। বইটির প্রকাশক হয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তাঁরই পুঁথিপত্র প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল বইটি। সেদিন বইটি প্রকাশ করতে সাহসী হয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। এ কথা এখন সবাই জানে, সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে এবং মোহাম্মদ সুলতানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আত্মগোপনে চলে যান এই ভাষাসৈনিক। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী দশকটিতে বারবার আত্মগোপন করে থাকতে হয় তাঁকে। এ সময় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ আবু তালেব ও রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের যে বাড়িটিতে থাকতেন, তা ছিল মোহাম্মদ সুলতানের জন্য বড় আশ্রয়। যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁদের কেউই বামপন্থী ছিলেন না, কিন্তু তখন বন্ধুত্বকে রাজনীতির ওপরেই দেখা হতো, তাই আদর্শের বিভাজন মনকে বিভাজিত করেনি।
সব মানুষের প্রাপ্তির তৃষ্ণা থাকে না। মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন সে রকমই একজন মানুষ। চলতে চলতে সংগ্রাম করেছেন, বলিষ্ঠ ভাষায় অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন, আশপাশের সবার জীবন রাঙিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তাতে তাঁর সংসারজীবন সুখের হয়নি। যে সামাজিক সুখের প্রত্যাশায় অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটে, সেই সুখ তিনি দিতে পারেননি পরিবারের মানুষদের। যাওয়ার বেলায় গেছেন শূন্য হাতেই। জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবরের জায়গাটি কেনার মতো অর্থও ছিল না বাড়িতে। তাঁরই এক ছাত্র সে অর্থ জোগাড় করে দিয়েছিল।
খুব কম মানুষই মনে রেখেছে তাঁকে। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, ভাষা আন্দোলনের কথা উঠলেই মোহাম্মদ সুলতানের নামটিকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সেই একুশের সংকলনটির কথা এলেই উঠে আসবে তাঁর মুখ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। প্রগতিশীল স্বপ্ন দেখতে দেখতে তাঁরা কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা জীবন; ঘরের হাঁড়ির খবর রাখেননি। এ ধরনের মানুষকে যে অভিধায়ই অভিষিক্ত করা হোক না কেন, আমরা তাঁদের ব্যর্থ মানুষ বলে মনে করি না। নিজেকে নিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেন যাঁরা, তারা কি ব্যর্থ হতে পারেন?
মোহাম্মদ সুলতান তাই ব্যর্থ মানুষ নন।
১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ দেখেছিলাম তাঁকে। পাজামা-পাঞ্জাবি আর চাদর গায়ে এসেছিলেন তিনি। আব্বার সঙ্গে (শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন) তাঁর সখ্যের স্মৃতিচারণা করেছিলেন। সে দৃশ্য গাঢ় হয়ে আছে মনে। আমার মেজো ভাইয়ের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন একটি কলমের সেট। তারই একটি বহুদিন ব্যবহার করেছিলাম আমি।
ভাষা আন্দোলনের কথা পরে বলি। আগে বলি, জীবনে তাঁর কী অর্জন ছিল, তা নিয়ে। নিঃস্বার্থভাবে রাজনীতি, পুস্তক ব্যবসা করতে গিয়ে যখন একদিন দেখলেন, শেষ হয়ে আসছে আয়ু, তখন বুঝতে পারলেন, জীবনের সবচেয়ে বেশি যেটা অর্জন হয়েছে, তার নাম নিরাপত্তাহীনতা। নিশ্চয় তিনি ভেবেছিলেন, এই যে চারটি সন্তান রেখে এ জগেক বিদায় জানাচ্ছেন, ওরা বাঁচবে কী করে? কে দেখাবে পথ? কে নেবে ওদের দায়িত্ব? ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর চলে যাওয়ার আগে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তিনি কি নিজেকে ভেবেছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ?
সারা জীবনের যোগফল শূন্য হতে দেখলে কার ভালো লাগে? আসলেই কি শূন্য হয়ে গেল সব?
জাগতিক খ্যাতি আর বৈষয়িক দৃষ্টিতে তিনি তো সত্যিই একজন ব্যর্থ মানুষ। ভাষা আন্দোলনে সামনের সারির সুযোগ্য নেতা ছিলেন বটে; কিন্তু কত মানুষ একুশে পদক পেয়ে গেলেন, তাঁর ভাগ্যে সেটা জুটল না। এ নিয়ে আক্ষেপও অবশ্য ছিল না তাঁর। আসলে জাগতিক উন্নতির সোপান তাঁর সামনে কখনোই উন্মুক্ত হয়নি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, তিনি জানতেনই না, সমাজে টিকে থাকতে হলে বিষয়-বুদ্ধির রয়েছে অমোঘ তাত্পর্য। আর তাই, সমাজের একজন সাধারণ নাগরিকের জীবনের মাপে তাঁর উচ্চতা নির্ণয় করতে হলে ভুগতে হবে। এই পথে মিলবে না তাঁর হদিস।
সেই যে বামপন্থী রাজনীতি করতে গিয়ে জীবনের সবটুকু ঢেলে কর্ষণ করলেন রাজনীতির জমি, তাতে কোন ফসল উঠল তাহলে? সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নটা কি তাহলে শুধুই মরীচিকা? পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনস্তের প্রবল হাওয়ায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেসে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। সে নব্বইয়ের দশকের শুরুর কথা। তাহলে কি সাম্য, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা ইত্যাদির আর কোনোই মূল্য থাকল না? এই যে মোহাম্মদ সুলতানের মতো মানুষেরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজটি করে গেলেন সারা জীবন, তাহলে কি তা ছিল আদতেই পণ্ডশ্রম?
শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতায় আছে, ‘সুখের সংজ্ঞা তো আঙুলে গোনা যায়, বসতি নির্মাণ, বংশরক্ষা’। এই দুটি কিংবা মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো হয়ে গেলেই জীবনে সুখ এসে গেছে বলে যাঁরা ভাবেন, মোহাম্মদ সুলতান সেই দলে ছিলেন না। তাঁর কাছে, অন্য অনেক বামপন্থী রাজনীতিবিদের মতোই, জীবনের ভূমি কর্ষণ করে সোনা ফলানোটাই ছিল জীবনের উদ্দেশ্য। আজ যখন লাতিন আমেরিকার কিউবা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশের মানুষ সাহস করে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তখন মনে হয়, স্বপ্নেরা মরে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি ওয়ার্ডের বাইরে অপ্রশস্ত করিডরে যখন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছিলেন মোহাম্মদ সুলতান, তখন কি তিনি জানতেন, তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছেন, যে অথই জলে ভাসিয়েছেন মানবিক জীবনের নৌকা, তাঁরই হাল ধরবেন উগো শাভেজ, লুলা, কাস্ত্রোরা? আবার বলতে হয়, স্বপ্নেরা মরে না।
তাঁর কথা বলি। যে বছর ভাষা আন্দোলন হলো, সেই ১৯৫২ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করলেন। ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে শিক্ষকতাও করেছেন। তাঁর স্কুলের ছাত্ররাও যোগ দিয়েছিল ভাষা আন্দোলনে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনেও রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। ছিলেন বামপন্থী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকেও সংগঠিত করে তুলতে রেখেছেন অবদান। ১৯৭০ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে প্রকাশনার কাজে যুক্ত হন।
মোহাম্মদ সুলতানকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটির কথা মনে পড়ে সবার আগে। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত এই সংকলনটি ভাষা আন্দোলনের অনবদ্য সাহিত্য-দলিল। বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে জোগাড় হয়েছিল লেখাগুলো। বইটির প্রকাশক হয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। তাঁরই পুঁথিপত্র প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল বইটি। সেদিন বইটি প্রকাশ করতে সাহসী হয়েছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। এ কথা এখন সবাই জানে, সংকলনটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে এবং মোহাম্মদ সুলতানের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। আত্মগোপনে চলে যান এই ভাষাসৈনিক। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী দশকটিতে বারবার আত্মগোপন করে থাকতে হয় তাঁকে। এ সময় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ আবু তালেব ও রাজনীতিবিদ আবদুল মান্নান পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডের যে বাড়িটিতে থাকতেন, তা ছিল মোহাম্মদ সুলতানের জন্য বড় আশ্রয়। যাঁদের কথা বলা হলো, তাঁদের কেউই বামপন্থী ছিলেন না, কিন্তু তখন বন্ধুত্বকে রাজনীতির ওপরেই দেখা হতো, তাই আদর্শের বিভাজন মনকে বিভাজিত করেনি।
সব মানুষের প্রাপ্তির তৃষ্ণা থাকে না। মোহাম্মদ সুলতান ছিলেন সে রকমই একজন মানুষ। চলতে চলতে সংগ্রাম করেছেন, বলিষ্ঠ ভাষায় অধিকার আদায়ের কথা বলেছেন, আশপাশের সবার জীবন রাঙিয়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তাতে তাঁর সংসারজীবন সুখের হয়নি। যে সামাজিক সুখের প্রত্যাশায় অধিকাংশ মানুষের জীবন কাটে, সেই সুখ তিনি দিতে পারেননি পরিবারের মানুষদের। যাওয়ার বেলায় গেছেন শূন্য হাতেই। জুরাইন কবরস্থানে তাঁর কবরের জায়গাটি কেনার মতো অর্থও ছিল না বাড়িতে। তাঁরই এক ছাত্র সে অর্থ জোগাড় করে দিয়েছিল।
খুব কম মানুষই মনে রেখেছে তাঁকে। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, ভাষা আন্দোলনের কথা উঠলেই মোহাম্মদ সুলতানের নামটিকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সেই একুশের সংকলনটির কথা এলেই উঠে আসবে তাঁর মুখ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর এ ধরনের মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। প্রগতিশীল স্বপ্ন দেখতে দেখতে তাঁরা কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা জীবন; ঘরের হাঁড়ির খবর রাখেননি। এ ধরনের মানুষকে যে অভিধায়ই অভিষিক্ত করা হোক না কেন, আমরা তাঁদের ব্যর্থ মানুষ বলে মনে করি না। নিজেকে নিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেন যাঁরা, তারা কি ব্যর্থ হতে পারেন?
মোহাম্মদ সুলতান তাই ব্যর্থ মানুষ নন।
No comments