শীত ও গ্রীষ্মের জন্য পৃথক সময়সূচি প্রয়োজন -জরুরি ভাবনা by ফিরোজ জামান চৌধুরী
শীত কড়া নাড়ছে দরজায়। দিনের আলো ইতিমধ্যে ঘণ্টা দুয়েক কমে গেছে। গ্রীষ্মকালে ঘড়ির কাঁটার যে পরিবর্তন সুখকর ছিল, তাই এখন গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। শীতকালে এ সময়সূচি নিয়ে মানুষজন যারপরনাই চিন্তিত। অনেকে বিরক্তও বটে। ১৯ ও ২০ অক্টোবর প্রথম আলোর টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্যে বেশির ভাগ পাঠকই শীতকালে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের কিছু কর্তাব্যক্তি বিদ্যমান সময়সূচি বদল করতে চাইছেন না। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তো সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘ঘড়ির কাঁটা এখন যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে, পেছানো হবে না।’ (প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর ০৯)।
শীতকালে বিদ্যমান ঘড়ির কাঁটার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে যাচ্ছে স্কুলগামী শিশুরা এবং তাদের অভিভাবকেরা। সরকারের নতুন ঘোষিত (১ নভেম্বর থেকে কার্যকর) স্কুলসূচি অনুযায়ী স্কুল শুরু করতে হবে সকাল সাতটা ৩০ মিনিট থেকে আটটা ৩০ মিনিটের মধ্যে। যদি সাতটা ৩০ মিনিটে স্কুলে উপস্থিত হতে হয়, তাহলে ওই শিশুকে অবশ্যই ছয়টা ৩০ মিনিটে রওনা দিতে হবে। তাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে আরও এক ঘণ্টা আগে অর্থাত্ পাঁচটা ৩০ মিনিটে। তখন তো ভোর। সূর্যিমামার দেখা নেই। শিশুটি ঘুমঘুম চোখে কখন তৈরি হবে, কখন স্কুলে যাবে? এক মাস পর এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিশুদের এ হেনস্তার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের কি কিছুই করার নেই?
সরকার ১৯ জুন বিদ্যুত্-সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে দেয় এবং কমপক্ষে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্-সাশ্রয় হবে বলে ঘোষণা দেয়। বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী প্রথম প্রথম জোর গলায় বিদ্যুত্-সাশ্রয়ের ঘোষণা দিলেও পরে আর তাঁর কণ্ঠ শোনা যায়নি। লোডশেডিং থেকে জনগণের মুক্তি না মেলায় বিদ্যুত্সাশ্রয় নিয়ে জনগণের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তার পরও এ পরিবর্তনকে জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল। পরিবর্তিত সময়ে সন্ধ্যাতেও বিকেলের ঝকঝকে আলোয় চলাফেরা করতে সবাই সচ্ছন্দ বোধ করত। বিশেষ করে, কর্মজীবী নারীদের জন্য এ সময়সূচি অনেক সহায়ক হয়েছিল। সরকার তখন বলেছিল, শীতকালে নতুন সময়সূচি ঘোষিত হবে অর্থাত্ শীতের শুরু থেকে আবার ঘড়ির কাঁটা আগের সময়ে ফিরে যাবে। তবে কবে থেকে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে, তা তখন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, সময় আর আগের জায়গায় ফেরত যাবে না।
২.
একটি দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ বা মান সময় নির্ধারিত হয় সে দেশের দ্রাঘিমাংশের তারতম্যের ভিত্তিতে এবং গ্রিনিচ মান সময়ের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকে সুনির্দিষ্ট। সে হিসাবে আমাদের দেশে এতকাল গ্রিনিচ মান সময়ের সঙ্গে ছয় ঘণ্টা যোগ করে সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সরকার ১৯ জুন থেকে যেভাবে সময়সূচি পরিবর্তন করেছে, তার সঙ্গে ভূগোলের কোনো সম্পর্ক নেই। এ পরিবর্তনের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। এর ফলে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্রাঘিমাংশের হিসাবে সময়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার ঘটনা ঘটছে। কারণ সীমান্তবর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান এখন দেড় ঘণ্টা। দুই দেশের স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় দেড় ঘণ্টা আগে-পরে।
বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত এবং মধ্যম সারির শিক্ষিত দেশে ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ খোদ আমেরিকাতেই এই নিয়ে বিতর্ক চলেছে প্রায় চার দশক ধরে। ১৯৬৬ সালে আইন করে সময় পরিবর্তন করার পর নানা সংযোজন-বিয়োজন শেষে সময়সূচির স্থায়ী রূপ পায় ২০০৭ সালে এসে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই গ্রীষ্ম ও শীতকালীন সময়সূচি বিদ্যমান। প্রায় দেশেই ১ এপ্রিল গ্রীষ্মকালীন ও ১ অক্টোবরকেই শীতকালীন সময়সূচি হিসেবে মানা হয়। আমাদেরও উচিত এই সময়সূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, তা না হলে দলছুট হওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ‘১৯৪৩ সালের স্ট্যান্ডার্ড টাইম-সংক্রান্ত একটি আইন আছে, যা এখনো বিদ্যমান। সরকার যেভাবে স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা মান সময় পরিবর্তন করেছে, তা ওই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই মান সময়সংক্রান্ত আইন রয়েছে। আমাদের দেশেও তা থাকতে পারে।’
আমরা মনে করি, বিদ্যুত্—সাশ্রয় এবং দিনের আলোর ব্যবহার বাড়াতে গ্রীষ্মকালে সময়সূচি পরিবর্তন করা যেতেই পারে। তবে সে জন্য সরকারকে অবশ্যই ওই আইন সংশোধন করতে হবে, নতুবা এ-সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের উচিত হবে, সংসদে মান সময়সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করা এবং স্থায়ীভাবে একটি আইন পাস করা। প্রতিবছর এ নিয়ে অযথা বিতর্ক কাম্য নয়।
৩.
ডে লাইট সেভিং টাইম বা ডিএসটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পন্থা। যেসব দেশে বিদ্যুতের অভাব নেই, সেসব দেশেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। শ খানেক দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে শীতের শুরুর (১ অক্টোবর) হিসাবটা বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, ইতিমধ্যে দিনের আলো ঘণ্টা দুয়েক কমে গেছে। এখন কোনোভাবেই ডিএসটি বা ডে লাইট সেভিংস টাইম প্রযোজ্য হতে পারে না। তা ছাড়া শীতকালে সকালে এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠলে বরং এক ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে।
জ্বালানি উপদেষ্টার মতে, গ্রীষ্মকালের যে সময়সূচি তাতে বিদ্যুত্-সাশ্রয় হচ্ছে। তাঁর মতে, শীতকালেও এর সুফল পাওয়া যাবে। শীতকালে দিনের আলো এমনিতেই দুই থেকে তিন ঘণ্টা কমে আসে, তাহলে তিনি কীভাবে দিনের আলো সাশ্রয় করবেন? বিষয়টি শীতকালের কম্বল গরমকালেও গায়ে দেওয়ার মতো হয়ে গেল না! গরমে যেমন কম্বল গায়ে দেওয়া যায় না, গ্রীষ্মকালের দিনের আলো সাশ্রয়ের হিসাবও শীতকালে তাই অবান্তর।
সরকারের যাঁরা বিদ্যমান সময় পরিবর্তনের বিপক্ষে, তাঁদের যুক্তি এ ক্ষেত্রে গ্রীষ্ম ও শীতকালে দুবার ঘড়ি পাল্টাতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, তাতে সমস্যা কোথায়? অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেমন: পাকিস্তান ও ইরান প্রতিবছর গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন এই সময়সূচির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা মান সময় নিয়ে সরকারের লেজেগোবরে অবস্থা তৈরির কোনো মানে হয় না। অক্টোবর শেষ হয়ে এল। নভেম্বর থেকেই ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন (১ এপ্রিল—৩০ সেপ্টেম্বর) এবং শীতকালীন (১ অক্টোবর—৩১ মার্চ) স্থায়ী সময়সূচির ঘোষণা দেওয়াও জরুরি। বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সময়সূচি প্রচলিত। ঘড়ির কাঁটা তথা সময়সূচির সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন কাজকর্মের পাশাপাশি বিমানের আন্তর্জাতিক সময়সূচিও জড়িত। তাই বাংলাদেশে ঘড়ির সময়সূচির বার্ষিক সময়সূচি প্রবর্তন করা জরুরি। প্রতিবছর যেন এ বিষয়ে নতুন করে ঘোষণা বা হইচইয়ের প্রয়োজন না পড়ে।
সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল—সেপ্টেম্বর) সময়সূচি হওয়া উচিত ‘গ্রিনিচ সময়+সাত ঘণ্টা’, আর শীতকালীন (অক্টোবর—মার্চ) সময়সূচি হওয়া উচিত ‘গ্রিনিচ সময়+ছয় ঘণ্টা’। স্থায়ীভাবে এ সময়সূচি ঘোষিত হলে মানুষ আগে থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকবে এবং সে অনুযায়ী আপনা-আপনিই ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করে নেবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
শীতকালে বিদ্যমান ঘড়ির কাঁটার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে যাচ্ছে স্কুলগামী শিশুরা এবং তাদের অভিভাবকেরা। সরকারের নতুন ঘোষিত (১ নভেম্বর থেকে কার্যকর) স্কুলসূচি অনুযায়ী স্কুল শুরু করতে হবে সকাল সাতটা ৩০ মিনিট থেকে আটটা ৩০ মিনিটের মধ্যে। যদি সাতটা ৩০ মিনিটে স্কুলে উপস্থিত হতে হয়, তাহলে ওই শিশুকে অবশ্যই ছয়টা ৩০ মিনিটে রওনা দিতে হবে। তাকে ঘুম থেকে উঠতে হবে আরও এক ঘণ্টা আগে অর্থাত্ পাঁচটা ৩০ মিনিটে। তখন তো ভোর। সূর্যিমামার দেখা নেই। শিশুটি ঘুমঘুম চোখে কখন তৈরি হবে, কখন স্কুলে যাবে? এক মাস পর এ অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিশুদের এ হেনস্তার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের কি কিছুই করার নেই?
সরকার ১৯ জুন বিদ্যুত্-সাশ্রয়ের লক্ষ্যে এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে দেয় এবং কমপক্ষে ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত্-সাশ্রয় হবে বলে ঘোষণা দেয়। বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী প্রথম প্রথম জোর গলায় বিদ্যুত্-সাশ্রয়ের ঘোষণা দিলেও পরে আর তাঁর কণ্ঠ শোনা যায়নি। লোডশেডিং থেকে জনগণের মুক্তি না মেলায় বিদ্যুত্সাশ্রয় নিয়ে জনগণের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু তার পরও এ পরিবর্তনকে জনগণ স্বাগত জানিয়েছিল। পরিবর্তিত সময়ে সন্ধ্যাতেও বিকেলের ঝকঝকে আলোয় চলাফেরা করতে সবাই সচ্ছন্দ বোধ করত। বিশেষ করে, কর্মজীবী নারীদের জন্য এ সময়সূচি অনেক সহায়ক হয়েছিল। সরকার তখন বলেছিল, শীতকালে নতুন সময়সূচি ঘোষিত হবে অর্থাত্ শীতের শুরু থেকে আবার ঘড়ির কাঁটা আগের সময়ে ফিরে যাবে। তবে কবে থেকে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া হবে, তা তখন নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, সময় আর আগের জায়গায় ফেরত যাবে না।
২.
একটি দেশের ‘স্ট্যান্ডার্ড টাইম’ বা মান সময় নির্ধারিত হয় সে দেশের দ্রাঘিমাংশের তারতম্যের ভিত্তিতে এবং গ্রিনিচ মান সময়ের সঙ্গে তার পার্থক্য থাকে সুনির্দিষ্ট। সে হিসাবে আমাদের দেশে এতকাল গ্রিনিচ মান সময়ের সঙ্গে ছয় ঘণ্টা যোগ করে সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু সরকার ১৯ জুন থেকে যেভাবে সময়সূচি পরিবর্তন করেছে, তার সঙ্গে ভূগোলের কোনো সম্পর্ক নেই। এ পরিবর্তনের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। এর ফলে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্রাঘিমাংশের হিসাবে সময়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে স্থলপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার ঘটনা ঘটছে। কারণ সীমান্তবর্তী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে আমাদের সময়ের ব্যবধান এখন দেড় ঘণ্টা। দুই দেশের স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয় দেড় ঘণ্টা আগে-পরে।
বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত এবং মধ্যম সারির শিক্ষিত দেশে ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ খোদ আমেরিকাতেই এই নিয়ে বিতর্ক চলেছে প্রায় চার দশক ধরে। ১৯৬৬ সালে আইন করে সময় পরিবর্তন করার পর নানা সংযোজন-বিয়োজন শেষে সময়সূচির স্থায়ী রূপ পায় ২০০৭ সালে এসে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই গ্রীষ্ম ও শীতকালীন সময়সূচি বিদ্যমান। প্রায় দেশেই ১ এপ্রিল গ্রীষ্মকালীন ও ১ অক্টোবরকেই শীতকালীন সময়সূচি হিসেবে মানা হয়। আমাদেরও উচিত এই সময়সূচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, তা না হলে দলছুট হওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা থাকবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ‘১৯৪৩ সালের স্ট্যান্ডার্ড টাইম-সংক্রান্ত একটি আইন আছে, যা এখনো বিদ্যমান। সরকার যেভাবে স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা মান সময় পরিবর্তন করেছে, তা ওই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই মান সময়সংক্রান্ত আইন রয়েছে। আমাদের দেশেও তা থাকতে পারে।’
আমরা মনে করি, বিদ্যুত্—সাশ্রয় এবং দিনের আলোর ব্যবহার বাড়াতে গ্রীষ্মকালে সময়সূচি পরিবর্তন করা যেতেই পারে। তবে সে জন্য সরকারকে অবশ্যই ওই আইন সংশোধন করতে হবে, নতুবা এ-সংক্রান্ত নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সরকারের উচিত হবে, সংসদে মান সময়সংক্রান্ত বিল উত্থাপন করা এবং স্থায়ীভাবে একটি আইন পাস করা। প্রতিবছর এ নিয়ে অযথা বিতর্ক কাম্য নয়।
৩.
ডে লাইট সেভিং টাইম বা ডিএসটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পন্থা। যেসব দেশে বিদ্যুতের অভাব নেই, সেসব দেশেও এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। শ খানেক দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। আমাদের দেশে শীতের শুরুর (১ অক্টোবর) হিসাবটা বিবেচনায় নিলে বলতে হয়, ইতিমধ্যে দিনের আলো ঘণ্টা দুয়েক কমে গেছে। এখন কোনোভাবেই ডিএসটি বা ডে লাইট সেভিংস টাইম প্রযোজ্য হতে পারে না। তা ছাড়া শীতকালে সকালে এক ঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠলে বরং এক ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে।
জ্বালানি উপদেষ্টার মতে, গ্রীষ্মকালের যে সময়সূচি তাতে বিদ্যুত্-সাশ্রয় হচ্ছে। তাঁর মতে, শীতকালেও এর সুফল পাওয়া যাবে। শীতকালে দিনের আলো এমনিতেই দুই থেকে তিন ঘণ্টা কমে আসে, তাহলে তিনি কীভাবে দিনের আলো সাশ্রয় করবেন? বিষয়টি শীতকালের কম্বল গরমকালেও গায়ে দেওয়ার মতো হয়ে গেল না! গরমে যেমন কম্বল গায়ে দেওয়া যায় না, গ্রীষ্মকালের দিনের আলো সাশ্রয়ের হিসাবও শীতকালে তাই অবান্তর।
সরকারের যাঁরা বিদ্যমান সময় পরিবর্তনের বিপক্ষে, তাঁদের যুক্তি এ ক্ষেত্রে গ্রীষ্ম ও শীতকালে দুবার ঘড়ি পাল্টাতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, তাতে সমস্যা কোথায়? অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেমন: পাকিস্তান ও ইরান প্রতিবছর গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন এই সময়সূচির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
স্ট্যান্ডার্ড টাইম বা মান সময় নিয়ে সরকারের লেজেগোবরে অবস্থা তৈরির কোনো মানে হয় না। অক্টোবর শেষ হয়ে এল। নভেম্বর থেকেই ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন (১ এপ্রিল—৩০ সেপ্টেম্বর) এবং শীতকালীন (১ অক্টোবর—৩১ মার্চ) স্থায়ী সময়সূচির ঘোষণা দেওয়াও জরুরি। বিশ্বের প্রায় ১০০ দেশে গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সময়সূচি প্রচলিত। ঘড়ির কাঁটা তথা সময়সূচির সঙ্গে দেশীয় বিভিন্ন কাজকর্মের পাশাপাশি বিমানের আন্তর্জাতিক সময়সূচিও জড়িত। তাই বাংলাদেশে ঘড়ির সময়সূচির বার্ষিক সময়সূচি প্রবর্তন করা জরুরি। প্রতিবছর যেন এ বিষয়ে নতুন করে ঘোষণা বা হইচইয়ের প্রয়োজন না পড়ে।
সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল—সেপ্টেম্বর) সময়সূচি হওয়া উচিত ‘গ্রিনিচ সময়+সাত ঘণ্টা’, আর শীতকালীন (অক্টোবর—মার্চ) সময়সূচি হওয়া উচিত ‘গ্রিনিচ সময়+ছয় ঘণ্টা’। স্থায়ীভাবে এ সময়সূচি ঘোষিত হলে মানুষ আগে থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকবে এবং সে অনুযায়ী আপনা-আপনিই ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করে নেবে।
ফিরোজ জামান চৌধুরী: সাংবাদিক।
firoz.choudhury@yahoo.com
No comments