মানচিত্র পরিবর্তন, রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য এবং. -রাজনীতি ও সরকার by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
দেশের রাজনীতির মান খুব একটা উন্নত হচ্ছে বলে মনে হয় না। আমরা আশা করেছিলাম, দুই বছর জরুরি অবস্থায় থাকার পর এবং বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আমাদের রাজনীতিবিদেরা অন্তত এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে বাংলাদেশে নতুন ধারার ও নতুন আঙ্গিকে রাজনীতি করার একটা সুযোগ এসেছে। আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল উভয়ই অনেক কষ্ট ও অত্যাচার সহ্য করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। কিছুটা ন্যায়সংগত কারণে আবার অনেকটা বিনা কারণে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো এই যে জানুয়ারি ২০০৭ থেকে জানুয়ারি ২০০৯ পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা আমরা জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে সঞ্চয় করেছি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছিলাম যে আমাদের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে। কেউই চাইবেন না ফিরে যেতে ওই দিনগুলোতে, যখন দুঃশাসন ও দুর্নীতি দেশকে এক গভীর অন্ধকারে ফেলে দিয়েছিল। যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি শক্তিশালী করা হচ্ছিল, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে এ ধারাটি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব গণতন্ত্র ফিরে আসার পর ধরে রাখবে।
সে রকম আশা করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। একটু ভালো করে ভেবে দেখুন আর যদি তা-ই করেন, তখন আপনার মনের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাবে যে আমরা আগের সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি, যার অবসান অক্টোবর ২০০৬ সালে হয়েছে বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। এই গেল কিছুদিন আগে সাবেক প্রধনমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমাদের সবাইকে হতবাক করে বলে ফেললেন, বর্তমান সরকার দেশের মানচিত্র পরিবর্তন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এটি ঘোরতর অভিযোগ। তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে অনায়াসে বলে দিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে ধ্বংস করার কাজে নেমে পড়েছে। বেগম জিয়ার সৌভাগ্য এবং আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সমাজ হিসেবে এখনো এমন স্তরে পৌঁছাইনি যে এ ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে বা রোধ করতে বা যিনি মন্তব্য করেন তাঁকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেআদালতে যাব। কোনো উন্নত দেশে কোনো রাজনীতিবিদ এ ধরনের মন্তব্য করবেন অন্য রাজনীতিবিদদের সম্বন্ধে, এটা কল্পনা করা যায় না। আমরা আশা করেছিলাম, যেহেতু বেগম জিয়া দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু তিনি যেকোনো বিষয়ে ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। সেটা তিনি করেননি। ভবিষ্যতে যে তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে রাজনীতিসুলভ আচার-আচরণ পাব, তা বোধ করি একটু বেশি আশা করাই হয়ে যাবে।
এ তো গেল খালেদা জিয়ার কথা। এবার যদি আওয়ামী লীগের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, দেখবেন সেখানেও কেউ পিছিয়ে নেই। বেগম জিয়ার একটি দাবি ছিল নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে যখনই বিএনপি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে, তখনই দলটি একরকম অসহায় হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় না থাকলে দলটি বেশ বেকায়দা ও বেমানান অবস্থায় পড়ে যায়। এবং সম্ভবত এসব কারণেই বেগম জিয়া নতুন নির্বাচন যা তাঁর জন্য সুখকর হবে, সে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। তা বেশ ভালো কথা। দাবি আসতেই পারে। এতে বিচলিত হওয়ার তো কিছুই নেই। এই মুহূর্তে নির্বাচন চাওয়াটা কতটা যুক্তিসংগত হতে পারে, সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু লক্ষ করেছেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এই দাবির বিষয়ে কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, এখন নির্বাচনের দাবি সংবিধানবিরোধী, কেননা একমাত্র জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমেই একটি সরকারের পতন হতে পারে। সৈয়দ আশরাফের কথায় বেশ যুক্তি আছে। কিন্তু এর পরই যে কথা তিনি বললেন, তা আমাদের বিস্মিত করেছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাদের জানিয়ে দিলেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনের দাবি তোলা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের শামিল। কথাটি আমাদের অবাক করে দেয় বটে এবং সেটা এ কারণে যে সৈয়দ আশরাফ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মতো সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যদি কেউ অবস্থান নেয়, তাহলে সেই অবস্থান যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় পড়ে, সেটা কে বলল? অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে মন্তব্যটি করলেন, সে ধরনের মন্তব্য সব ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সব সময়ই করে এসেছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ধারাটির সূচনা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ করেছিলেন, যখন তিনি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিকে দেশের শত্রুর কাজ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, যে যুগে আমরা বাস করছি, সেই যুগে স্বাভাবিকভাবেই গঠনমূলক রাজনীতি আমরা পাব। কিন্তু সেটা আমরা এখনো পাইনি। সৈয়দ আশরাফ একজন ভদ্র মানুষ। তিনি কেমন করে এবং কী কারণে ঢালাওভাবে এ মন্তব্য করলেন, সেটাই এখন আমাদের চিন্তার উদ্রেক করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কোনো বিশেষ পরিবর্তন বিগত নির্বাচনের পর আসেনি, সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওই সব তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনার মধ্য দিয়ে। আজও মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে ওই সব বাহিনীর হাতে, যাদের দায়িত্ব মূলত ছিল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একদিকে একটি নির্বাচিত সরকার আর অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা—এ কেমন গণতন্ত্র? সেদিন কয়েকজন বিদেশি কূটনৈতিক ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তাঁর সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘোর বিরুদ্ধে। খুবই ভালো কথা, কিন্তু এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বাস্তবিক পদক্ষেপ কোথায়? আর যদি শেখ হাসিনার মন্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই, তাহলে তাঁরই মন্ত্রী শাজাহান খান যে কিছুদিন আগে এই ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন, সে বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখব? আমাদের দুশ্চিন্তা আরও অনেক ধাপ বেড়ে যায় যখন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের এই মর্মে আশ্বাস দিতে নারাজ যে র্যাব বাহিনীর যেসব ব্যক্তি দৈনিক নিউ এজ-এর সাংবাদিক এফ এম মাসুমের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিমানবাহিনী থেকে আগত যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ওই কাণ্ডটি করেছেন, তাঁকে র্যাব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটাই কি যথেষ্ট? এতে বিচার বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কোথায় রইল? সরকার যদি তার বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারে অথবা করতে না চায়, তাহলে সাধারণ নাগরিক কী করে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে?
বর্তমানে যে ধারায় রাজনীতি চলছে, তাতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এই কয়েক মাস আগেও দেশে জরুরি অবস্থা এবং অনির্বাচিত সরকার ছিল এবং সেটা এ কারণে যে আমাদের রাজনীতিবিদেরাই, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা কি কোনো রকম অনুশোচনা করেছেন? নিজেদের ভুল, নিজেদের দুর্নীতির ব্যাপারে তাঁরা কি আত্মসমালোচনা করেছেন? বেগম জিয়া ও তাঁর সহযোগীরা এখনো পর্যন্ত শুধু ষড়যন্ত্রই দেখে যাচ্ছেন। তাঁরা ব্যতীত দেশের মঙ্গল কামনা করেন, এমন কোনো মানুষ বা দল নেই। তাঁরা যেভাবে গোটা দেশকে একটি ভয়ানক ও নাজুক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তাঁরা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। তাঁরা জাতীয় সংসদে যাবেন না। সমস্যা হলো, যখনই তাঁরা ক্ষমতা হারান, তখনই জাতীয় সংসদের ব্যাপারে তাঁদের অনীহা জেগে ওঠে। সংসদের বাইরে তাঁরা অনেক কথাই তুলছেন, যে কথাগুলো আরও গুছিয়ে আরও জোরালোভাবে তাঁরা সংসদে তুলে ধরতে পারতেন।
কিন্তু কে কাকে বোঝাবে? কার কথা কে শোনে? কথা ছিল, দারিদ্র্য বিমোচনসংক্রান্ত একটি সমাবেশে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা একমঞ্চে উপস্থিত থাকবেন। শেষ মুহূর্তে বেগম জিয়া সরে দাঁড়ালেন। গোটা অনুষ্ঠান ম্লান হয়ে গেল। আর যদি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির উল্লেখ করি, তাহলে এ ধারণা ব্যক্ত করা ভুল হবে না যে তাঁর উচিত ছিল দারিদ্র্যকে কেন্দ্র করেই তাঁর বক্তব্য পেশ করা। তিনি ভালো করতেন যদি সাধারণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে তিনি নিজেকে রাখতেন। যদি বেগম জিয়ার অনুপস্থিতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করতেন। করলেন তিনি ঠিক উল্টোটা। তিনি তাঁর বক্তৃতার অনেকখানি অংশ ব্যয় করলেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমালোচনায়। সেটা করা কি এতই জরুরি ছিল?
আজ দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে এবং সেই কাজটি হচ্ছে সরকারি মহলে। অন্যদিকে বিরোধী দল অপেক্ষায় রয়েছে সরকারের পতন কবে হবে এবং সেই পুরোনো দিনগুলো কবে ফিরে আসবে।
স্থানীয় সরকার সম্প্রসারণের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। মানবাধিকার কমিশনের কথা কেবল শুনেই আসছি। যেসব ব্যক্তির কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি, তাঁদের বক্তব্য শুনে হতাশ হতে হয়।
আবার বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীকে সুন্দর করে মহাসড়ক ও কাঁচপুর সেতু পরিদর্শনে যেতে দেখা যায়। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন তত্পর হয়ে ওঠে নিশ্চিত করতে, সেই মুহূর্তে যেন বিভিন্ন যানবাহনে মানুষ ওঠা-নামা না করে, পথ যেন পরিষ্কার থাকে। ফলাফল? মন্ত্রী আমাদের অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, কই, যানজট কোথায়? ওই সব নাকি মিডিয়ার তৈরি গল্প। বেশ তো। একদিন মন্ত্রী তাঁর সরকারি গাড়ি, পতাকা এবং দামি পোশাক পরিহার করে আসুন না শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে একটি ট্যাক্সি বা বাসে চেপে? তখন না হয় তিনি যানজট দেখবেন।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম কোনো একদিন হঠাত্ করেই এ শহরের কোনো থানায় উপস্থিত হয়েছিলেন সেই থানার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে। থানার কর্মকর্তারা প্রথমে তাঁকে চিনতে পারেননি। ওই না চেনার ফলে মন্ত্রী সাধারণ মানুষের মতো হয়তো অনেক সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেদিন।
সেই রফিকুল ইসলামের মতো মন্ত্রী পাওয়া কি আজকাল খুবই দুর্লভ?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
সে রকম আশা করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। একটু ভালো করে ভেবে দেখুন আর যদি তা-ই করেন, তখন আপনার মনের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাবে যে আমরা আগের সেই অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি, যার অবসান অক্টোবর ২০০৬ সালে হয়েছে বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। এই গেল কিছুদিন আগে সাবেক প্রধনমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমাদের সবাইকে হতবাক করে বলে ফেললেন, বর্তমান সরকার দেশের মানচিত্র পরিবর্তন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। এটি ঘোরতর অভিযোগ। তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে অনায়াসে বলে দিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে ধ্বংস করার কাজে নেমে পড়েছে। বেগম জিয়ার সৌভাগ্য এবং আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সমাজ হিসেবে এখনো এমন স্তরে পৌঁছাইনি যে এ ধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে বা রোধ করতে বা যিনি মন্তব্য করেন তাঁকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেআদালতে যাব। কোনো উন্নত দেশে কোনো রাজনীতিবিদ এ ধরনের মন্তব্য করবেন অন্য রাজনীতিবিদদের সম্বন্ধে, এটা কল্পনা করা যায় না। আমরা আশা করেছিলাম, যেহেতু বেগম জিয়া দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু তিনি যেকোনো বিষয়ে ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। সেটা তিনি করেননি। ভবিষ্যতে যে তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে রাজনীতিসুলভ আচার-আচরণ পাব, তা বোধ করি একটু বেশি আশা করাই হয়ে যাবে।
এ তো গেল খালেদা জিয়ার কথা। এবার যদি আওয়ামী লীগের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, দেখবেন সেখানেও কেউ পিছিয়ে নেই। বেগম জিয়ার একটি দাবি ছিল নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে যে যখনই বিএনপি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে, তখনই দলটি একরকম অসহায় হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় না থাকলে দলটি বেশ বেকায়দা ও বেমানান অবস্থায় পড়ে যায়। এবং সম্ভবত এসব কারণেই বেগম জিয়া নতুন নির্বাচন যা তাঁর জন্য সুখকর হবে, সে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। তা বেশ ভালো কথা। দাবি আসতেই পারে। এতে বিচলিত হওয়ার তো কিছুই নেই। এই মুহূর্তে নির্বাচন চাওয়াটা কতটা যুক্তিসংগত হতে পারে, সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু লক্ষ করেছেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এই দাবির বিষয়ে কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, এখন নির্বাচনের দাবি সংবিধানবিরোধী, কেননা একমাত্র জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমেই একটি সরকারের পতন হতে পারে। সৈয়দ আশরাফের কথায় বেশ যুক্তি আছে। কিন্তু এর পরই যে কথা তিনি বললেন, তা আমাদের বিস্মিত করেছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আমাদের জানিয়ে দিলেন, এই মুহূর্তে নির্বাচনের দাবি তোলা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের শামিল। কথাটি আমাদের অবাক করে দেয় বটে এবং সেটা এ কারণে যে সৈয়দ আশরাফ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার মতো সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে ফেলেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যদি কেউ অবস্থান নেয়, তাহলে সেই অবস্থান যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আওতায় পড়ে, সেটা কে বলল? অবশ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে মন্তব্যটি করলেন, সে ধরনের মন্তব্য সব ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সব সময়ই করে এসেছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ধারাটির সূচনা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ করেছিলেন, যখন তিনি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিকে দেশের শত্রুর কাজ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম, যে যুগে আমরা বাস করছি, সেই যুগে স্বাভাবিকভাবেই গঠনমূলক রাজনীতি আমরা পাব। কিন্তু সেটা আমরা এখনো পাইনি। সৈয়দ আশরাফ একজন ভদ্র মানুষ। তিনি কেমন করে এবং কী কারণে ঢালাওভাবে এ মন্তব্য করলেন, সেটাই এখন আমাদের চিন্তার উদ্রেক করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কোনো বিশেষ পরিবর্তন বিগত নির্বাচনের পর আসেনি, সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওই সব তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’র ঘটনার মধ্য দিয়ে। আজও মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে ওই সব বাহিনীর হাতে, যাদের দায়িত্ব মূলত ছিল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একদিকে একটি নির্বাচিত সরকার আর অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যা—এ কেমন গণতন্ত্র? সেদিন কয়েকজন বিদেশি কূটনৈতিক ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তাঁর সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘোর বিরুদ্ধে। খুবই ভালো কথা, কিন্তু এসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বাস্তবিক পদক্ষেপ কোথায়? আর যদি শেখ হাসিনার মন্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই, তাহলে তাঁরই মন্ত্রী শাজাহান খান যে কিছুদিন আগে এই ক্রসফায়ারের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন, সে বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখব? আমাদের দুশ্চিন্তা আরও অনেক ধাপ বেড়ে যায় যখন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের এই মর্মে আশ্বাস দিতে নারাজ যে র্যাব বাহিনীর যেসব ব্যক্তি দৈনিক নিউ এজ-এর সাংবাদিক এফ এম মাসুমের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বিমানবাহিনী থেকে আগত যে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ওই কাণ্ডটি করেছেন, তাঁকে র্যাব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এটাই কি যথেষ্ট? এতে বিচার বা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ কোথায় রইল? সরকার যদি তার বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে না পারে অথবা করতে না চায়, তাহলে সাধারণ নাগরিক কী করে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে?
বর্তমানে যে ধারায় রাজনীতি চলছে, তাতে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এই কয়েক মাস আগেও দেশে জরুরি অবস্থা এবং অনির্বাচিত সরকার ছিল এবং সেটা এ কারণে যে আমাদের রাজনীতিবিদেরাই, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা কি কোনো রকম অনুশোচনা করেছেন? নিজেদের ভুল, নিজেদের দুর্নীতির ব্যাপারে তাঁরা কি আত্মসমালোচনা করেছেন? বেগম জিয়া ও তাঁর সহযোগীরা এখনো পর্যন্ত শুধু ষড়যন্ত্রই দেখে যাচ্ছেন। তাঁরা ব্যতীত দেশের মঙ্গল কামনা করেন, এমন কোনো মানুষ বা দল নেই। তাঁরা যেভাবে গোটা দেশকে একটি ভয়ানক ও নাজুক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে তাঁরা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। তাঁরা জাতীয় সংসদে যাবেন না। সমস্যা হলো, যখনই তাঁরা ক্ষমতা হারান, তখনই জাতীয় সংসদের ব্যাপারে তাঁদের অনীহা জেগে ওঠে। সংসদের বাইরে তাঁরা অনেক কথাই তুলছেন, যে কথাগুলো আরও গুছিয়ে আরও জোরালোভাবে তাঁরা সংসদে তুলে ধরতে পারতেন।
কিন্তু কে কাকে বোঝাবে? কার কথা কে শোনে? কথা ছিল, দারিদ্র্য বিমোচনসংক্রান্ত একটি সমাবেশে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা একমঞ্চে উপস্থিত থাকবেন। শেষ মুহূর্তে বেগম জিয়া সরে দাঁড়ালেন। গোটা অনুষ্ঠান ম্লান হয়ে গেল। আর যদি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির উল্লেখ করি, তাহলে এ ধারণা ব্যক্ত করা ভুল হবে না যে তাঁর উচিত ছিল দারিদ্র্যকে কেন্দ্র করেই তাঁর বক্তব্য পেশ করা। তিনি ভালো করতেন যদি সাধারণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে তিনি নিজেকে রাখতেন। যদি বেগম জিয়ার অনুপস্থিতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করতেন। করলেন তিনি ঠিক উল্টোটা। তিনি তাঁর বক্তৃতার অনেকখানি অংশ ব্যয় করলেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর সমালোচনায়। সেটা করা কি এতই জরুরি ছিল?
আজ দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে এবং সেই কাজটি হচ্ছে সরকারি মহলে। অন্যদিকে বিরোধী দল অপেক্ষায় রয়েছে সরকারের পতন কবে হবে এবং সেই পুরোনো দিনগুলো কবে ফিরে আসবে।
স্থানীয় সরকার সম্প্রসারণের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। মানবাধিকার কমিশনের কথা কেবল শুনেই আসছি। যেসব ব্যক্তির কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি, তাঁদের বক্তব্য শুনে হতাশ হতে হয়।
আবার বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীকে সুন্দর করে মহাসড়ক ও কাঁচপুর সেতু পরিদর্শনে যেতে দেখা যায়। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন তত্পর হয়ে ওঠে নিশ্চিত করতে, সেই মুহূর্তে যেন বিভিন্ন যানবাহনে মানুষ ওঠা-নামা না করে, পথ যেন পরিষ্কার থাকে। ফলাফল? মন্ত্রী আমাদের অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, কই, যানজট কোথায়? ওই সব নাকি মিডিয়ার তৈরি গল্প। বেশ তো। একদিন মন্ত্রী তাঁর সরকারি গাড়ি, পতাকা এবং দামি পোশাক পরিহার করে আসুন না শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে একটি ট্যাক্সি বা বাসে চেপে? তখন না হয় তিনি যানজট দেখবেন।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম কোনো একদিন হঠাত্ করেই এ শহরের কোনো থানায় উপস্থিত হয়েছিলেন সেই থানার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতে। থানার কর্মকর্তারা প্রথমে তাঁকে চিনতে পারেননি। ওই না চেনার ফলে মন্ত্রী সাধারণ মানুষের মতো হয়তো অনেক সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেদিন।
সেই রফিকুল ইসলামের মতো মন্ত্রী পাওয়া কি আজকাল খুবই দুর্লভ?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments