যুদ্ধ ও জীবনের রং -গণমাধ্যমে যুদ্ধচিত্র by রবার্ট ফিস্ক
আমার
বয়স যখন তিন, তখন আমার গর্বিত মা-বাবা তাঁদের প্রিয় সন্তানের ছবি তুলতে
এক প্রতিকৃতি-আলোকচিত্রীর শরণাপন্ন হন। আমাদের এলাকায় তিনিই ছিলেন প্রথম
ছবি তুলিয়ে। ছবি তোলার সময় তাঁর কাজের জায়গায় সেট হিসেবে বসানো ট্রেন নিয়ে
আমাকে খেলতে বলা হয়েছিল।
সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী আলোকচিত্রী সাদা-কালোয় তোলা ছবিতে রং চড়িয়ে যথাসময়ে আমার মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। ছবি দেখে তাঁরা খুব খুশি হন। আমার উজ্জ্বল চুল, গোলাপি মুখাবয়ব ও নীল চোখ নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠায় তাঁরা ছিলেন মুগ্ধ। কিন্তু আমি মর্মাহত হই। আমার রাগের কারণ আলোকচিত্রী খেলনা ট্রেনটিকে নীল রং করেছিলেন। লন্ডন মিডল্যান্ড ও স্কটিশ রেলওয়ে কোম্পানির রং ছিল টকটকে লাল, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। ট্রেনের জন্য নিখুঁত রং করার কথা কি আলোকচিত্রী ভেবেছিলেন?
কথাগুলো মনে পড়ল সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে অ্যাপোকেলিপস: দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার দেখার সময়। এটি আর্কাইভ ফিল্মের সর্বশেষ রঙিন রূপ, যাতে সমসাময়িক দর্শকদের সুবিধার্থে সাদা-কালো ফুটেজের ওপর জীবন্ত রং আরোপ করা হয়েছে। বেশ আগে ফ্রান্স টু চ্যানেলের জন্য জঁ-ফ্রাসোয়াঁ দেলাসাসের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবির এক অসাধারণ রঙিন রূপ দেখে প্রশংসা করেছিলাম। ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলগুলো তখন থেকে একের পর এক সাদা-কালো ছবির রঙিন রূপ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে রূপ দেখলাম, তা আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে।
ধারাবাহিকটির একটি পর্বে যুদ্ধজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণের রং মনে হয় টকটকে লাল। আর পরের পর্বের বিষয় ছিল ফ্রান্সের পতন। এ পর্বের চিত্রমালার রঙিন রূপ বেশ নিম্নমানের লেগেছে। অদেখা কিছু আর্কাইভ ফিল্ম দেখলাম এতে, বিশেষত মনোবল ভেঙে পড়া ফ্রান্সের সেনাসদস্যদের জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণের দৃশ্যাবলি। কিন্তু রঙিন ছবিতে গাছের পাতা যতটা সবুজ, সে তুলনায় জার্মান ও তাদের যুদ্ধবন্দীদের অনেক সাদা-কালো মনে হয়েছে। আর হিটলারের দয়িতা ইভা ব্রুনের তোলা বাড়ির ভেতর হিটলারের একটা ক্লিপ খুব বেমানান ঠেকেছে। যদ্দূর মনে পড়ে, ব্রুন রঙিন স্টক ব্যবহার করে হিটলারের ছবি তুলেছিলেন। রঙিন বানানোর সময় মূল ছবির রং অনুজ্জ্বল করে বাদবাকি ফুটেজের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
শেষমেশ বাস্তবতার প্রশ্নই মুখ্য—সম্প্রতি টরন্টোতে ইউসুফ কার্শের আলোকচিত্রের প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। কার্শের তোলা চার্চিলের সাদা-কালো প্রতিকৃতিগুলোর রঙিন রূপ ভাবা যায় না। তাহলে কি আমরা সেনাদের খাকি পোশাকে আর ধূসর পরিখাকে বাদামি মাটিতে রূপান্তরিত করে আর্কাইভ ফিল্মের বিকৃতি ঘটাচ্ছি?
আমার তা মনে হয় না। কেউ হয়তো বলতে পারে, আর্কাইভের সাদা-কালো ফুটেজ নিজেই বিকৃত, সত্যিকারের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল রঙিন; রক্তের রং ছিল উজ্জ্বল লাল, গাছের পাতার রং ছিল সবুজ। এখন রং ও গভীরতা যুক্ত করার মাধ্যমে আমরা শুধু ১৯১৪-১৯১৮ সালের ফিল্ম স্টকের ঘাটতি পূরণ করছি। আজকের দিনের প্রযুক্তি তখনকার ক্যামেরাম্যানরা ব্যবহার করলে এ রকম ছবিই তাঁরা পেতেন।
মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন রোম নিয়ে কোনো রঙিন ছবি দেখতে আমাদের খারাপ লাগে না। এর কারণ হয়তো নিরো বাঁশি বাজাচ্ছেন বা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে—এমন দৃশ্যের কোনো সাদা-কালো আর্কাইভ ফিল্ম আমাদের নেই। সিসিল বি ডিমাইল যখন বারবার তাঁর তরবারি-চটির রঙিন মহাকাব্য বানাচ্ছিলেন, তাতে আপত্তিজনক কিছু দেখেনি কেউ, যদিও প্রথম প্রথম হলিউড ছবি রঙিন করতে গেলে অনেকের মনঃকষ্ট হয়েছিল। আমার কাছে রিকস বার আজীবন একরঙা ছবি হয়েই থাকবে; বোগার্টের স্যুট যেমন নতুনের মতো উজ্জ্বল সাদা, তেমনি লুইয়ের ভিচি জন্ডামারি পোশাক কালোই থাকবে, নীল হবে না কখনো।
কিন্তু ছবি তুলি আমরা নানা কায়দা করে। সানডে এক্সপ্রেস-এ দিনপঞ্জি কলাম লেখার সময় আমি শিখি পত্রিকাটির আলোকচিত্রীরা কেমন করে নারীদের ছবি তোলেন। অপূর্ব সুন্দরী নারীরা ইচ্ছামতো ভঙ্গিতে ছবি তুলতেন। কিন্তু যেসব নারী আলোকচিত্রীর প্রত্যাশামতো সুদর্শনা হতেন না, তাঁদের বলা হতো মাথা কাত করতে। তখন সব আলোকচিত্রী ছিলেন নারীবিদ্বেষী। পুরুষদের ক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যে এমন করা হতো। কাত করা মাথার মাজেজা হলো- দর্শক ছবিতে তাকানোর সময় চোখ যায় ছবির মানুষটার চোখে, মুখাবয়বে নয়। পত্রিকার বিনোদনের পাতায় নারীদের ছবিতে চোখ রাখলে এটাই দেখতে পাওয়া যায়। এরপর পত্রিকায় আমার যে ছবি ছাপা হয়, সেটি দেখুন। দেখতে পাবেন, আমার কুিসত মুখ ডানদিকে কাত করা।
বসনিয়ার যুদ্ধের প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমাদের লেখার সঙ্গে ব্যবহারের অনেক ছবি আমি নিজেই তুলেছি। সাদা-কালোয়, অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই। এই ভয়াবহ সংঘর্ষের মধ্যে আমি চেয়েছিলাম, সেই দুনিয়ার সব রং নিভিয়ে দিতে। বরফ বসনিয়ার শীতকালের একরঙা বিভীষিকার ছবি নিয়ে এসেছিল। যোদ্ধা ও তাঁদের হাতে বন্দী বেসামরিক মানুষ—সবাই মিলে কত যে মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল! কত মানুষ যে খাবারের ব্যাকুলতা দূর করতে সিগারেট খেয়ে খেয়ে কাটিয়েছে, তাদের মুখাবয়বের রং গোলাপি থাকেনি, ধূসর হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এ তো শুধু রঙের প্রশ্ন নয়। নির্বাক আর্কাইভ ফুটেজের সঙ্গে শব্দ যোগ করা হয়েছে ঘটনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ক্যামেরাম্যান নিশ্চয় শুনেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে ভেসে আসা হ্রেষাধ্বনি; জেনারেলের নির্দেশ দেওয়া আর গুলির শব্দ। কিন্তু শব্দগুলো তাঁরা পুনরুত্পাদন করতে পারেননি। অসত্য বয়ান তৈরির কাজ চলছে এখন, তবে তা শব্দ জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নয়, শব্দ ও ছবির সমন্বয়ের মাধ্যমে।
যুদ্ধের প্রতিবেদন তৈরি করার সময় আমার দৃষ্টি ও শব্দের সমন্বয় ঘটে না। ইসরায়েলি বিমান সব সময় পুরোপুরি নৈঃশব্দের মধ্যে ঠিক করে তার বোমার লক্ষ্যবস্তু। বোমার বিস্ফোরণ কোনো শব্দ বয়ে আনে না। কিছুক্ষণ পরই কেবল শব্দের বিস্ফোরণ আমার কাছে পৌঁছে ঘটনাস্থলের কত কাছে আসি তার ওপর নির্ভর করে।
বিবিসি থেকে সিএনএন পর্যন্ত প্রতিটি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক তাই যুদ্ধের শব্দকে পরিপাটি করে পরিবেশন করে। তাদের প্রতিবেদনে ব্যারেলের ভেতর থেকে আলোর ঝলকানি দেখার সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় দূরের গুলির শব্দ। ক্যামেরাম্যানের কাছে সত্যিকার শব্দ পৌঁছার বহু আগেই অনেক দূরের ট্যাংকের গর্জন শোনা যায়। বিবিসির এক প্রযোজক আমাকে বলেছিলেন, দর্শকের কাছে বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার হ্যাপার কোনো মানে হয় না। আলোর গতি শব্দের চেয়ে বেশি, শব্দের চেয়ে আলো আগে যায়। বিবিসিও তাই সরল করে এক সঙ্গে পরিবেশন করে।
তাঁর কথা একদম ঠিক। এখনকার যুদ্ধগুলো এমন নিশ্চিতভাবে সমলয়ের বানিয়ে তুলতে হবে, যেন তা ১৯৪২ সালের এল আলামাইনে রাতে কামানের গোলার শব্দ দৃশ্যের মতো সমলয়ের হয়। যে ছবি আমরা বানাব, তা দর্শকের চাহিদামতো হতে হবে। চাহিদার সঙ্গে মিলে যেতে হবে। যুদ্ধও বানিয়ে তুলতে হবে দর্শকের চাহিদামতো। শুধু যদি বাষ্পচালিত ট্রেনের রংটা ঠিক রাখা যেত।
দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
>>>রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী আলোকচিত্রী সাদা-কালোয় তোলা ছবিতে রং চড়িয়ে যথাসময়ে আমার মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন। ছবি দেখে তাঁরা খুব খুশি হন। আমার উজ্জ্বল চুল, গোলাপি মুখাবয়ব ও নীল চোখ নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠায় তাঁরা ছিলেন মুগ্ধ। কিন্তু আমি মর্মাহত হই। আমার রাগের কারণ আলোকচিত্রী খেলনা ট্রেনটিকে নীল রং করেছিলেন। লন্ডন মিডল্যান্ড ও স্কটিশ রেলওয়ে কোম্পানির রং ছিল টকটকে লাল, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। ট্রেনের জন্য নিখুঁত রং করার কথা কি আলোকচিত্রী ভেবেছিলেন?
কথাগুলো মনে পড়ল সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ধারাবাহিকভাবে অ্যাপোকেলিপস: দ্য সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার দেখার সময়। এটি আর্কাইভ ফিল্মের সর্বশেষ রঙিন রূপ, যাতে সমসাময়িক দর্শকদের সুবিধার্থে সাদা-কালো ফুটেজের ওপর জীবন্ত রং আরোপ করা হয়েছে। বেশ আগে ফ্রান্স টু চ্যানেলের জন্য জঁ-ফ্রাসোয়াঁ দেলাসাসের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত ছবির এক অসাধারণ রঙিন রূপ দেখে প্রশংসা করেছিলাম। ব্রিটিশ টিভি চ্যানেলগুলো তখন থেকে একের পর এক সাদা-কালো ছবির রঙিন রূপ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে রূপ দেখলাম, তা আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে।
ধারাবাহিকটির একটি পর্বে যুদ্ধজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণের রং মনে হয় টকটকে লাল। আর পরের পর্বের বিষয় ছিল ফ্রান্সের পতন। এ পর্বের চিত্রমালার রঙিন রূপ বেশ নিম্নমানের লেগেছে। অদেখা কিছু আর্কাইভ ফিল্ম দেখলাম এতে, বিশেষত মনোবল ভেঙে পড়া ফ্রান্সের সেনাসদস্যদের জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণের দৃশ্যাবলি। কিন্তু রঙিন ছবিতে গাছের পাতা যতটা সবুজ, সে তুলনায় জার্মান ও তাদের যুদ্ধবন্দীদের অনেক সাদা-কালো মনে হয়েছে। আর হিটলারের দয়িতা ইভা ব্রুনের তোলা বাড়ির ভেতর হিটলারের একটা ক্লিপ খুব বেমানান ঠেকেছে। যদ্দূর মনে পড়ে, ব্রুন রঙিন স্টক ব্যবহার করে হিটলারের ছবি তুলেছিলেন। রঙিন বানানোর সময় মূল ছবির রং অনুজ্জ্বল করে বাদবাকি ফুটেজের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
শেষমেশ বাস্তবতার প্রশ্নই মুখ্য—সম্প্রতি টরন্টোতে ইউসুফ কার্শের আলোকচিত্রের প্রদর্শনী দেখতে গিয়ে আমার এমনটাই মনে হয়েছে। কার্শের তোলা চার্চিলের সাদা-কালো প্রতিকৃতিগুলোর রঙিন রূপ ভাবা যায় না। তাহলে কি আমরা সেনাদের খাকি পোশাকে আর ধূসর পরিখাকে বাদামি মাটিতে রূপান্তরিত করে আর্কাইভ ফিল্মের বিকৃতি ঘটাচ্ছি?
আমার তা মনে হয় না। কেউ হয়তো বলতে পারে, আর্কাইভের সাদা-কালো ফুটেজ নিজেই বিকৃত, সত্যিকারের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল রঙিন; রক্তের রং ছিল উজ্জ্বল লাল, গাছের পাতার রং ছিল সবুজ। এখন রং ও গভীরতা যুক্ত করার মাধ্যমে আমরা শুধু ১৯১৪-১৯১৮ সালের ফিল্ম স্টকের ঘাটতি পূরণ করছি। আজকের দিনের প্রযুক্তি তখনকার ক্যামেরাম্যানরা ব্যবহার করলে এ রকম ছবিই তাঁরা পেতেন।
মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন রোম নিয়ে কোনো রঙিন ছবি দেখতে আমাদের খারাপ লাগে না। এর কারণ হয়তো নিরো বাঁশি বাজাচ্ছেন বা যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে—এমন দৃশ্যের কোনো সাদা-কালো আর্কাইভ ফিল্ম আমাদের নেই। সিসিল বি ডিমাইল যখন বারবার তাঁর তরবারি-চটির রঙিন মহাকাব্য বানাচ্ছিলেন, তাতে আপত্তিজনক কিছু দেখেনি কেউ, যদিও প্রথম প্রথম হলিউড ছবি রঙিন করতে গেলে অনেকের মনঃকষ্ট হয়েছিল। আমার কাছে রিকস বার আজীবন একরঙা ছবি হয়েই থাকবে; বোগার্টের স্যুট যেমন নতুনের মতো উজ্জ্বল সাদা, তেমনি লুইয়ের ভিচি জন্ডামারি পোশাক কালোই থাকবে, নীল হবে না কখনো।
কিন্তু ছবি তুলি আমরা নানা কায়দা করে। সানডে এক্সপ্রেস-এ দিনপঞ্জি কলাম লেখার সময় আমি শিখি পত্রিকাটির আলোকচিত্রীরা কেমন করে নারীদের ছবি তোলেন। অপূর্ব সুন্দরী নারীরা ইচ্ছামতো ভঙ্গিতে ছবি তুলতেন। কিন্তু যেসব নারী আলোকচিত্রীর প্রত্যাশামতো সুদর্শনা হতেন না, তাঁদের বলা হতো মাথা কাত করতে। তখন সব আলোকচিত্রী ছিলেন নারীবিদ্বেষী। পুরুষদের ক্ষেত্রেও মাঝেমধ্যে এমন করা হতো। কাত করা মাথার মাজেজা হলো- দর্শক ছবিতে তাকানোর সময় চোখ যায় ছবির মানুষটার চোখে, মুখাবয়বে নয়। পত্রিকার বিনোদনের পাতায় নারীদের ছবিতে চোখ রাখলে এটাই দেখতে পাওয়া যায়। এরপর পত্রিকায় আমার যে ছবি ছাপা হয়, সেটি দেখুন। দেখতে পাবেন, আমার কুিসত মুখ ডানদিকে কাত করা।
বসনিয়ার যুদ্ধের প্রতিবেদন করতে গিয়ে আমাদের লেখার সঙ্গে ব্যবহারের অনেক ছবি আমি নিজেই তুলেছি। সাদা-কালোয়, অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই। এই ভয়াবহ সংঘর্ষের মধ্যে আমি চেয়েছিলাম, সেই দুনিয়ার সব রং নিভিয়ে দিতে। বরফ বসনিয়ার শীতকালের একরঙা বিভীষিকার ছবি নিয়ে এসেছিল। যোদ্ধা ও তাঁদের হাতে বন্দী বেসামরিক মানুষ—সবাই মিলে কত যে মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল! কত মানুষ যে খাবারের ব্যাকুলতা দূর করতে সিগারেট খেয়ে খেয়ে কাটিয়েছে, তাদের মুখাবয়বের রং গোলাপি থাকেনি, ধূসর হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এ তো শুধু রঙের প্রশ্ন নয়। নির্বাক আর্কাইভ ফুটেজের সঙ্গে শব্দ যোগ করা হয়েছে ঘটনাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। ক্যামেরাম্যান নিশ্চয় শুনেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে ভেসে আসা হ্রেষাধ্বনি; জেনারেলের নির্দেশ দেওয়া আর গুলির শব্দ। কিন্তু শব্দগুলো তাঁরা পুনরুত্পাদন করতে পারেননি। অসত্য বয়ান তৈরির কাজ চলছে এখন, তবে তা শব্দ জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমে নয়, শব্দ ও ছবির সমন্বয়ের মাধ্যমে।
যুদ্ধের প্রতিবেদন তৈরি করার সময় আমার দৃষ্টি ও শব্দের সমন্বয় ঘটে না। ইসরায়েলি বিমান সব সময় পুরোপুরি নৈঃশব্দের মধ্যে ঠিক করে তার বোমার লক্ষ্যবস্তু। বোমার বিস্ফোরণ কোনো শব্দ বয়ে আনে না। কিছুক্ষণ পরই কেবল শব্দের বিস্ফোরণ আমার কাছে পৌঁছে ঘটনাস্থলের কত কাছে আসি তার ওপর নির্ভর করে।
বিবিসি থেকে সিএনএন পর্যন্ত প্রতিটি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক তাই যুদ্ধের শব্দকে পরিপাটি করে পরিবেশন করে। তাদের প্রতিবেদনে ব্যারেলের ভেতর থেকে আলোর ঝলকানি দেখার সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায় দূরের গুলির শব্দ। ক্যামেরাম্যানের কাছে সত্যিকার শব্দ পৌঁছার বহু আগেই অনেক দূরের ট্যাংকের গর্জন শোনা যায়। বিবিসির এক প্রযোজক আমাকে বলেছিলেন, দর্শকের কাছে বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার হ্যাপার কোনো মানে হয় না। আলোর গতি শব্দের চেয়ে বেশি, শব্দের চেয়ে আলো আগে যায়। বিবিসিও তাই সরল করে এক সঙ্গে পরিবেশন করে।
তাঁর কথা একদম ঠিক। এখনকার যুদ্ধগুলো এমন নিশ্চিতভাবে সমলয়ের বানিয়ে তুলতে হবে, যেন তা ১৯৪২ সালের এল আলামাইনে রাতে কামানের গোলার শব্দ দৃশ্যের মতো সমলয়ের হয়। যে ছবি আমরা বানাব, তা দর্শকের চাহিদামতো হতে হবে। চাহিদার সঙ্গে মিলে যেতে হবে। যুদ্ধও বানিয়ে তুলতে হবে দর্শকের চাহিদামতো। শুধু যদি বাষ্পচালিত ট্রেনের রংটা ঠিক রাখা যেত।
দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
>>>রবার্ট ফিস্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক।
No comments