গুলিতে বাবার মৃত্যু,৭ মাসের শিশুটি অসহায় by ফাহিমা আক্তার সুমি
ওয়াসিম শেখের স্ত্রী রেহানা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বামী ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমাদের ৭ মাসের একমাত্র সন্তান রয়েছে। সে জন্মের পর থেকে তাকে কেনা দুধ খাওয়াতে হয়। বাবা ছাড়া সংসার পরিচালনা করা একজন মায়ের জন্য অনেক কষ্টের। ঘটনার দিন বিকাল ৪টায় বাসা থেকে বের হয়। ওইদিন আমি ও আমার শাশুড়ি খাবার খাচ্ছিলাম সেসময় সে মেয়েকে ঘুমিয়ে রেখে বাইরে চলে যায়। আমাদের বিয়ের ৮ বছর পর মেয়েটি হয়। তার সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তাকে কোথায় ঘুরতে নিবে, কোথায় পড়াবে সেসব চিন্তা করতো সবসময়। মেয়ের ২ মাস ১২ দিন বয়সে ওর বাবা মারা যায়।
তিনি বলেন, আমার চিন্তা এখন মেয়েকে নিয়ে। আমি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর পড়তে পারিনি। এখন মেয়ের কথা চিন্তা করে আমাকে চাকরি করতে হবে, না হলে মেয়েকে নিয়ে কোথায় কার কাছে যাবো। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়েকে মাদ্রাসায় পড়াশোনা করাবে কিন্তু সেই ইচ্ছা তো আর পূরণ করতে পারেনি। সে তো একদিকে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, আরেক দিকে আমার সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে। ওর বাবার একমাত্র সন্তান ছিল। এর প্রতি অনেক টান ছিল, মেয়েও তার বাবাকে পেলে আর কাউকে চিনতো না। সারাদিন বাইরে থেকে যখন কাজ শেষে বাসায় আসতো তখন ওর বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না, অনেক রাত পর্যন্ত বাবার সঙ্গে খেলতো। এখন বাবাকে দেখতে না পেয়ে চারিদিকে খুঁজতে থাকে। আমি তো মা আমি বুঝি আমার সন্তান কি চায়। হয়তো সে বলতে পারে না কিন্তু বাবা না থাকার শূন্যতা ঠিকই বুঝতে পারে।
নিহতের মা জোসনা বেগম বলেন, আমি আমার সন্তানরে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিলাম। ও বের হওয়ার সময় বলেছিল মা আমি একটু দোকান দেখে আসি যদি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় দোকানটা। এ কথা শুনে আমি তাকে বাধা দেইনি আমি খাবার খাইয়ে দিলাম কিন্তু আমার সন্তান তো আর ফিরে এলো না। এখন আমার ছোট ছেলেটি ব্যবসা চালায়। আমার সন্তান যেভাবে বেচাকেনা করতো এখন সেটি আর হয় না। এখন সবসময় মনে হয় আমার সন্তান যেন কোথায় গিয়েছে। আমাদের গ্রামে কোনো বাড়িঘর নেই, নদীতে ভেঙে গেছে। অনেক আগে আমরা ঢাকায় এসেছি। ওর বাবাও গুলিস্তানে ব্যবসা করতো। সরকার থেকে এখানো কিছু পাইনি, আমার আত্মীয়স্বজনরা কিছু সহযোগিতা করেছে। ছেলে থাকতে আগে তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতাম এখন একটি টিনশেডের বাসায় উঠেছি। তখন ১০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতাম এখন ৫ হাজার টাকা দেই। এত টাকা কীভাবে জোগাড় করবো আমরা।
ওয়াসিমের বোন তামান্না ওইদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ১৮ই জুলাই দুপুরে খাবার খেয়ে দোকান দেখার কথা বলে বাইরে যায়। শনির আখড়ায় ভাইয়ের দোকানটি ছিল। এভাবে প্রায়ই সে আন্দোলনে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পানি খাওয়াতো। আমার ভাই মারা যাওয়ার ৪ মাস আগে আমার বাবা ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যায়। বাবা গুলিস্থানে ব্যবসা করতো। ওইদিন বিকাল ৫টায় আমার মোবাইলে কল আসে। তখন তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি জানতে পারি। তাকে উদ্ধার করে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। এটি শোনার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভাইকে খুঁজতে থাকি। এক ঘণ্টা পরে মর্গে গিয়ে ভাইকে পাই। সেখানে অসংখ্য লাশ ছিল। আমার ভাইয়ের মাথার একপাশের খুলি উড়ে যায় গুলিতে। পরদিন অনেক ঝামেলার মধ্যে গিয়ে আমরা মরদেহ হাতে পাই। কাজলা ব্রিজের সামনে মারা যায়। তিনি বলেন, ফুটপাথে প্যান্টের দোকান ছিল। এই দোকানের আয় দিয়ে পরিবার চলতো। তার পরিবারে মা, তার স্ত্রী ও সন্তান রয়েছে। আমরা তিন ভাই দুই বোন। এই ভাই মেজো ছিল। একামাত্র সন্তান রেখে ভাই মারা যায়। বাবার মৃত্যুর ৪ মাসের মাথায় ভাই মারা গেল। পরিবারে একজনের শোক কাটাতে না কাটাতে আরেক জনের মৃত্যু হলো। এখন সবচেয়ে ভাইয়ের সন্তানটিকে দেখলে কষ্ট হয় কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই বাবাকে হারালো। ও বাবার অনেক আদরের ছিল। এখন মা, ভাবী ও তার সন্তানের চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। মা অসুস্থ, ভাবী তার ছোট সন্তানকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি।
No comments