স্বৈরাচারের কামড় এবং সোহেল তাজ by শামীমুল হক
দেশ এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একের পর এক দাবি আদায়ের নামে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। এমনটা কেন হচ্ছে? এ প্রশ্ন সর্বত্র। গত প্রায় ষোল বছরে পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের দোসররা কামড় দিয়ে বসেছে। এ অবস্থায়ই দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। আর স্বৈরাচার দেশ ছেড়ে পালায় তার দোসরদের রেখে। এখন ভিন দেশে বসে দোসরদের নির্দেশ দিচ্ছে দেশকে কীভাবে ব্যর্থ করা যায়। কীভাবে ধ্বংস করা যায়। বিভিন্ন সময় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ফাঁস হওয়া কথাবার্তায় তা স্পষ্ট। সর্বশেষ ইসকনকাণ্ডে তার বিবৃতিও এটাই প্রমাণ করে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী সোহেল তাজ তার ফেসবুক পেইজে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাতে সরাসরি তিনি স্বৈরাচারকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন-হত্যা, গুম, খুন, গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, গণতন্ত্র ধ্বংস করে, দুর্নীতি করে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, দেশটাকে শেষ করে ছাত্র-জনতার ঝাঁটাপেটা খেয়ে পালিয়ে গিয়ে এখন দেশ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। ও কতো বড় নির্লজ্জ বেহায়া দেশটাকে এক মুহূর্তের জন্য শান্তিতে থাকতে দিবে না। প্রথমে ডিজিটাল জুডিশিয়াল ক্যু-এর চেষ্টা, তারপর একের পর এক অপচেষ্টা- আনসার বাহিনী দিয়ে, ব্যাটারি রিকশা, নূর হোসেন দিবসে ট্রাম্পকার্ড, ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শাহবাগে মানুষের জমায়েত করার চেষ্টা, বিভিন্ন কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা আর এবার ধর্মীয় সমপ্রীতি নষ্ট করে লাশের উপর ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা। সোহেল তাজ লিখেন- দুইটা বই সবাইকে পড়তে অনুরোধ করবো: ১. আমার ফাঁসি চাই। ২. অন্তরালের হত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী। এই দুইটা বই মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান রেন্টুর লেখা। স্ট্যাটাসে সোহেল তাজ লিখেন-নীতি আদর্শ বিচ্যুত খারাপ মানুষের প্রশংসা আমার প্রয়োজন নাই- আমি আপাদেরকে চিনি।
বি.দ্র.: আওয়ামী লীগের ব্রেইন ওয়াশড নষ্ট পচা নীতি/আদর্শ বিচ্যুত লুটেরা খুনি হত্যা গুম নির্যাতনকারীদের সমর্থক সকলকে বলবো অনতিবিলম্বে আমার এই ফেসবুক পেইজটি আনফলো করতে- আর অনুরোধ থাকবে নিজের বিবেককে জাগিয়ে আত্মোপলব্ধি আত্মসমালোচনা করে অনুশোচনা করার। সোহেল তাজ এক সময় এই দলের এমপি ছিলেন। হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও। যদিও এই মন্ত্রিত্ব তার কাছে হয়ে উঠেছিল বিষাদময়। তার পিতা ছিলেন মুজিবনগর সরকার বা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল এই সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করেন। ১২ই জানুয়ারি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিসভা কার্যকর ছিল। শেখ হাসিনা যখন ভিন্ন দেশের আশ্রয়ে তখন সোহেল তাজের মা জোহরা তাজউদ্দীন ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী লীগের হাল ধরে তিনি দলকে এগিয়ে নিয়ে যান অনেকদূর। দুঃখের বিষয় হলো-এই তাজউদ্দীনকেই এক সময় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়। আর শেখ হাসিনার আমলে সোহেল তাজ বাধ্য হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আর কেন ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তার সঙ্গে শেখ হাসিনার আচরণ সবই তিনি মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছেন। দেশের প্রতি তার পরিবারের আত্মত্যাগ, তার পরিবারের অবদান শেখ হাসিনাই স্বীকার করেন না। তাইতো শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে হাজারো বার বলেছেন এই দেশটা আমার বাবা স্বাধীন করেছে। এমনভাবে বলতেন যেন তার পিতা একা দেশটা স্বাধীন করেছে। অন্য কারও কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ দেশটাকে স্বাধীন করতে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এ যুদ্ধে তার বাবাকে অস্ত্র ধরতে হয়নি। এ যুদ্ধ করতে গিয়ে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। সম্ভ্রম হারিয়েছেন দুই লাখ মা-বোন। আর তার পিতা ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে দেশ স্বাধীন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হয়। কিন্তু এ আত্মসমর্পণ নিয়েও কতো নাটক হয়েছে সবাই জানেন। দেশ স্বাধীনের এক বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন। কারাভোগের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে তিনি ৮ই জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন। পরে তিনি পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন। তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ের লেখা বইয়ে উল্লেখ রয়েছে দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে একই গাড়িতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন ফিরছিলেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তাজউদ্দীন আমার তো প্রধানমন্ত্রী হতে মন চাইছে। তাজউদ্দীন বললেন, হবেন। তাই হয়েছিলেন। দুইদিন যেতে না যেতেই ১২ই জানুয়ারি তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হলো সে উদ্দেশ্য থেকে বঙ্গবন্ধু সরকার বিচ্যুত হয়ে পড়েন। দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। নিজ দল আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে গঠন করেন বাকশাল নামে নতুন দল। এই বাকশালে দেশের সকল সরকারি- বেসরকারি মানুষকে সদস্য হতে বাধ্য করেন। দেশে চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব বন্ধ করে দেন। ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ে। যে চারটি পত্রিকা রাখা হয়েছিল সেগুলোও বঙ্গবন্ধুর চাটুকারীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এরপর ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট দেশের ইতিহাসে নির্মম হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় তারা বেঁচে যান।
আওয়ামী লীগ সবসময়ই ছিল স্বাধীন মত প্রকাশের বিরোধী। এটা প্রমাণিত সত্য। শেখ হাসিনার গত প্রায় ষোল বছরের শাসনামলে দেশবাসী তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিরোধী দলগুলো কোনো কথা বলবে তাতেও বাধা। একদলীয় শাসন থেকে নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসকে পরিণত হন হাসিনা। পরপর তিনটি নির্বাচন তার আমলে হয়েছে যা ছিল নির্বাচনের নামে তামাশা। নির্বাচনের পরদিন শেখ হাসিনা আবার নির্লজ্জের মতো আওয়ামী লীগকে পুনরায় ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেন। তা শুনে মানুষ হাসতেন। গুম, খুন, মামলা, হামলার সংস্কৃতি গড়ে তুলেন দেশে। ছাত্রলীগকে হামলার কারিগর হিসেবে লাইসেন্স দিয়ে দেন। তাই তো প্রকাশ্যে দিনে- দুপুরে ছাত্রলীগ বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করলেও তাদের কিছু হয় না। বিশ্বজিৎকে যখন কোপানো হচ্ছিল তখন ছাত্রলীগ বলছিল সে শিবিরের লোক। অথচ বিশ্বজিৎ চিৎকার করে বলছিলেন আমি শিবির নই। আমি হিন্দু। প্রয়োজনে আমার প্যান্ট খুলে দেখতে পারেন। কিন্তু ছাত্রলীগ কারও কথা শুনেনি। অন্যদিকে এ হত্যাকাণ্ডের পর কোনো হিন্দু নেতাকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিতেও দেখা যায়নি। কিন্তু এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা নিজের প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে হিন্দু নেতাদের কেউ কেউ জেগে উঠেছেন। তারা রাজপথে নেমে আসেন হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে বলে। কিন্তু দেশবাসী জানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কোনো হামলা হয়নি। বরং বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান সম্প্রদায়ের চেয়ে বেশি শান্তিতে রয়েছে। তবে দু’একটি হামলার ঘটনা যে ঘটেনি তা কিন্তু নয়। এ হামলা ছিল রাজনৈতিক। অবশ্যই ধর্মীয় নয়। দেশে এখনো স্বৈরাচারের দোসররা রয়েছে। কিন্তু তারা নীরবে নিভৃতে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর কীভাবে তা করছে বৃহস্পতিবার সোহেল তাজ তার ফেসবুক পেইজের স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, প্রথমে ডিজিটাল জুডিশিয়াল ক্যু-এর চেষ্টা করা হয়। তারপর একের পর এক অপচেষ্টা-আনসার বাহিনী দিয়ে, ব্যাটারি রিকশা, নূর হোসেন দিবসে ট্রাম্পকার্ড, ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে শাহবাগে মানুষের জমায়েত করার চেষ্টা, বিভিন্ন কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা আর এবার ধর্মীয় সমপ্রীতি নষ্ট করে লাশের উপর ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সবখানেই ব্যর্থ হয়েছেন হাসিনা। তিনি তারপরও বসে নেই। আবার কোন খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন শেখ হাসিনা একমাত্র তিনিই জানেন। হাসিনার একমাত্র ইচ্ছা দেশটাকে ধ্বংস করা। অন্যথায় তিনি তার নেতাকর্মীদের বলে দিতেন এখন তোমরা চুপ থাকো। সময়মতো মানুষের কাছে যাবে। তাদের হৃদয় জয় করবে। গত ষোল বছরের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে। যদিও এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনাসহ তার দলের কোনো নেতা ষোল বছরের আকামের জন্য অনশোচনা করেছেন কিংবা দুঃখ প্রকাশ করেছেন- এমন কথা শোনা যায়নি। যারা নিজেদের ভুল স্বীকার করতে এত কার্পণ্য করে তাদের দিয়ে আর কিছু হবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী দল। যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে তখনই দেশ স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছে। শেখ হাসিনা তো নিজে স্বৈরাচার হয়েছে আবার তার সঙ্গে টেনে নিয়েছে আরেক স্বৈরাচার এরশাদের দল জাতীয় পার্টিকে। দুই স্বৈরাচার মিলে দেশটাকে লুটেপুটে খেয়ে ফোকলা করে এখন দেশছাড়া হয়েছে। এ অবস্থায় দেশের সকল দলকে এক কাতারে এসে সরকারকে সহায়তা করতে হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে দলমত নির্বিশেষে সবাই এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। হাতে হাত রেখে দেশ রক্ষার শপথ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে ছাত্র- জনতার রক্তের বদলে পাওয়া নতুন বাংলাদেশকে হারতে দেয়া যাবে না।
No comments