মহান আমেরিকান রস পেরট সিনিয়রের কীর্তিগাঁথা by ইকরাম সেহগাল
রস পেরট সিনিয়র ও ইকরাম সেহগাল (বাঁয়ে) |
ক্যান্সারের
বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই মহান বৃদ্ধলোকটি যখন হেরে যান, তখন তার বয়স হয়েছিল
৮৯ বছর। ডালাসে রস পেরট সিনিয়রের মৃত্যুর খবরটি এসেছিল কষ্টের খবর হিসেবে।
এটা ছিল ব্যক্তিগত দুঃখের খবর। কারণ তার ছেলে রস পেরট জুনিয়র আমার অন্যতম
সেরা বন্ধু।
টেক্সাসে ১৯৩০ সালে মহামন্দার সময় সাধারণ অবস্থায় জন্মগ্রহণকারী পেরট নিজের চেষ্টায় বিলিয়নিয়ার হয়েছিলেন। একবার এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি বাস করেন এক ‘আমেরিকান স্বপ্নের মধ্যে,’ যে স্বপ্ন দেখে অনেকে তাদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে ভাগ্য বদলাতে আমেরিকায় পাড়ি দেয়।
তিনি সাত বছর বয়সে সংবাদপত্র বিতরণের কাজ করেন। প্রতি দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে তিনি পত্রিকা বিলি করতেন। ১৯৫৩ সালে মার্কিন নেভাল একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েট করে তিনি চার বছর নৌবাহিনীতে কাজ করেন। এখানেই তিনি প্রথম কম্পিউটার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। এতে তিনি যে আগ্রহ লাভ করেন তাই তাকে দুটি ডাটা প্রসেসিং কোম্পানির মাধ্যমে ভাগ্য গড়তে সহায়তা করে। তিনি বড় ধরনের মুনাফা নিয়ে ১৯৯০-এর দশকে কোম্পানি দুটি বিক্রি করে দেন।
রস পেরট সিনিয়র ১৯৫৭ সালে নৌবাহিনী ত্যাগ করে আইবিএম সেলসম্যান হন। আইমিএমের সিইও যখন দেখলেন যে এই লোক কমিশনের মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করছেন, তখন তিনি তার আয় হ্রাস করার জন্য কমিশনে সীমা নির্ধারণ করে দেন। পেরট সিনিয়র প্রথম মাসেই ওই সীমায় পৌঁছে যান।
সেলসম্যান হিসেবে তিনি খুবই ভালোভাবে সার্ভিসিংয়ের অভাবের বিষয়টি অবগত ছিলেন। এর ফলে আইবিএম তাদের পূর্ণ ধারণ ক্ষমতায় কম্পিউটার বিক্রি করতে পারছিল না। তিনি বিষয়টি আইবিএমের ব্যবস্থাপকদের অবহিত করলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। হতাশ হয়ে রস সিনিয়র ১৯৬২ সালে আইবিএম ত্যাগ করেন।
তিনি মাত্র ১০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে ইলেকট্রনিক ডাটা সিস্টেমস (ইডিএস) গঠন করে বিক্রয়োত্তর সেবার দিকে মনোযোগ দেন। ড. ইহসান ও আমি যখন ইডিএস পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, তখন তিনি তার স্ত্রীর কাছ থেকে উদ্যোগের প্রথম বিনিয়োগ হিসেবে পাওয়া ঐতিহাসিক ১০০০ ডলারের চেকটি গর্বভরে আমাদের দেখিয়েছিলেন।
আজকের কঠোর বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়ে আইবিএমের সবচেয়ে লাভজনক অংশ হলো আইমিএম গ্লোবাল সার্ভিসেস। রস সিনিয়র শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে ২.৪ বিলিয়ন ডলারে ইডিএস বিক্রি করেন জেনারেল মটর্সকে। তিনি ১৯৮৮ সালে পেরট সিস্টেমস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি ডেল সিস্টেমস কিনে নেয় ৩.৯ বিলিয়ন ডলারে।
দুর্দান্ত ভিশনের অধিকারী উদ্যোক্তা রস সিনিয়র স্টিভ জবসের উদ্যোগে ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। তবে এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি প্রতিষ্ঠানটি ত্যাগ করেন। এরপর তার সাফল্য কাহিনী ছিল ‘নেক্সট’।
পেরট সিনিয়র তার দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন, এই দেশের কল্যাণে যত্নবান ছিলেন। তার এত টাকা তাকে উদ্ধত করেনি, তার দেশের জনগণের ভাগ্য সম্পর্কে উদাসীন হননি।
ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের সাথে কঠোর আচরণের খবর পেয়ে তিনি ১৯৬৯ সালে সংগঠিত চেষ্টায় বিমান থেকে খাবার ও চিকিৎসা সামগ্রী ফেলার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টাটি সফল হয়নি। তিনি এই কাজে কেবল হ্যানয় বা মস্কোর কাছ থেকেই বাধার মুখে পড়েননি, সেইসাথে ওয়াশিংটনেও বৈরী অবস্থায় পড়েন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ সমাপ্তির অনেক পরও তিনি এই যুদ্ধবন্দীদের প্রতি আবিষ্ঠ ছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধবন্দীর নিরাপদে ফেরা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার জন্য তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন।
তার কোম্পানিতে কর্মরত দুই কর্মী ১৯৭৮ সালে শাহের পতন্মুখ সরকারের সাথে চুক্তিগত বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতির অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কোম্পানিকে বলা হয়, তাদের মুক্তির জন্য ১২ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে। কার্টার প্রশাসনের উদাসিনতা লক্ষ্য করে এবং তার কর্মীদের ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার কর্নেল আর্থার সাইমন্সের নেতৃত্বে একটি উদ্ধার মিশন গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে শাহের নির্বাসনবিষয়ক বিশৃঙ্খলার মধ্যে তারা প্রথমে কিছুই করতে পারেননি। তবে বিপ্লবী জনতা তেহরানের কাসর কারাগারে হামলা চালিয়ে এক হাজার বন্দীকে মুক্ত করলে তাদের সুযোগ আসে। পেরট ও সাইমন্স অবশেষে তাদের সহকর্মীদের পেয়ে তাদেরকে ভ্যানে চড়িয়ে নিয়ে আসেন। তাদের এই উদ্ধার অভিযানটি ছিল রোমহর্ষক।
এই ঘটনাতে উদ্দীপ্ত হয়ে কেন ফোলেট ‘অন উইয়িং অব ইগলস’ ও টেলিভিশন মিনি সিরিজ নির্মাণ করেন। কর্মীদের উদ্ধারে তার এই উদ্যোগের ফলে তার জাতীয় স্বীকৃতি মেলে।
তিনি কখনো সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ না করেই ১৯৯২ সালে এক টকশোতে ঘোষণা করেন যে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। প্রচারণাকালে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট, চাকরির জন্য বিদেশে আউটসোর্সিংয়ের কথা তুলে ধরেন।
তিনি নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রে এগ্রিমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন, এমনটা হলে প্রধানত এশিয়ানদের কাছে আমেরিকানরা চাকরি হারাবে।
তিনি আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করতেন। এ দিক থেকে তিনি ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বসূরী। পেরটের ছোট সরকার ও বিশ্বায়নবিরোধী দাবির কারণেই ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৯ ভাগ জনমত পেয়ে এগিয়ে থাকা অবস্থাতেই অজ্ঞাত কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যান।
তবে অনুসারীদের অনুরোধে আবার নির্বাচনে এসেছিলেন ১ এপ্রিল। কিন্তু তখন আগের ধারাটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে তিনি হয়েছিলেন তৃতীয়। বিল ক্লিনটন পেয়েছিলেন ৪৫ ভাগ, জর্জ বুশ ২৭.৫ ভাগ আর তিনি ১৯ ভাগ। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর এটিই সেরা সাফল্য।
রাজনৈতিক পরিকল্পনা ত্যাগ করে ১৯৯৬ সালে তিনি তার ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পেরট সিস্টেমস করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০০ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কোম্পানিটির প্রধান। ৭০ বছর বয়সে তিনি তার ছেলে রস পেরট জুনিয়রের কাছে দায়িত্বভারটি অর্পণ করেন।
তবে দেশ নিয়ে তার উদ্বেগ কখনো কমেনি। আমেরিকার জাতীয় ঋণ নিয়ে তিনি চিন্তায় ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি তার দেশবাসীকে সচেতন করতে থাকেন।
আমি ১৯৯৪ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ছেলে জারারের গ্রাজুয়েশনের সময় আমি প্রথম রস পেরট সিনিয়রকে দেখি। তিনি ছিলেন ওই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো বক্তা। পরে তার ছেলে রস পেরট জুনিয়রের সুবাদে আমি পেরট পরিবারের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পেরট সিনিয়রের সাথে সাক্ষাত করার। ২০১৩ সালে প্রথম সাক্ষাতের সময় তার বয়স ছিল ৮৩ বছর।
রস জুনিয়রও অন্যদের মতো ধনী নন। তিনি তার পিতার মতোই দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষ। তিনিও নানা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন।
ডাভোসে পাকিস্তান ব্রেকফাস্টে আমার একটি বড় সাফল্য ছিল রস জুনিয়রের উপস্থিতি। তিনি টানা কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ব্রেকফাস্টে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ইমরান খান (তখন তিনি ছিলেন স্রেফ একজন পরিচিত রাজনীতিবিদ) উপস্থিত ছিলেন, তখন তিনিও ছিলেন। তিনি তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই লোক নিকট ভবিষ্যতে তোমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার কথা সত্যে পরিণত হয়েছে।
জর্ডানের আম্মানে কয়েক বছর আগে গত ইস্ট ওয়েস্ট ইনস্টিটিউট (ইডব্লিউআই) ডিরেক্টর্স বোর্ড মিটিংয়ে রস জুনিয়র ও আমার উভয় পরিবার দারুণভাবে একত্রিত হয়েছিলাম।
রস পেরট সিনিয়রের মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে পেরট পরিবার যথার্থভাবেই বলেছে যে ব্যবসা ও জীবনে রস ছিলেন সৎ ও কাজের লোক। একজন দেশপ্রেমিক আমেরিকান, বিরল ভিশনের অধিকারী, নীতিবান ও গভীর সহানাভূতিসম্পন্ন লোক হিসেবে তিনি সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধফেরত সৈনিকদের প্রতি অটল সমর্থন ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছেন।
টেক্সাসের পেরটরা সত্যিই মহান আমেরিকান পরিবারগুলোর অন্যতম।
>>>লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
টেক্সাসে ১৯৩০ সালে মহামন্দার সময় সাধারণ অবস্থায় জন্মগ্রহণকারী পেরট নিজের চেষ্টায় বিলিয়নিয়ার হয়েছিলেন। একবার এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন যে তিনি বাস করেন এক ‘আমেরিকান স্বপ্নের মধ্যে,’ যে স্বপ্ন দেখে অনেকে তাদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে ভাগ্য বদলাতে আমেরিকায় পাড়ি দেয়।
তিনি সাত বছর বয়সে সংবাদপত্র বিতরণের কাজ করেন। প্রতি দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে তিনি পত্রিকা বিলি করতেন। ১৯৫৩ সালে মার্কিন নেভাল একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েট করে তিনি চার বছর নৌবাহিনীতে কাজ করেন। এখানেই তিনি প্রথম কম্পিউটার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। এতে তিনি যে আগ্রহ লাভ করেন তাই তাকে দুটি ডাটা প্রসেসিং কোম্পানির মাধ্যমে ভাগ্য গড়তে সহায়তা করে। তিনি বড় ধরনের মুনাফা নিয়ে ১৯৯০-এর দশকে কোম্পানি দুটি বিক্রি করে দেন।
রস পেরট সিনিয়র ১৯৫৭ সালে নৌবাহিনী ত্যাগ করে আইবিএম সেলসম্যান হন। আইমিএমের সিইও যখন দেখলেন যে এই লোক কমিশনের মাধ্যমে তার চেয়ে বেশি উপার্জন করছেন, তখন তিনি তার আয় হ্রাস করার জন্য কমিশনে সীমা নির্ধারণ করে দেন। পেরট সিনিয়র প্রথম মাসেই ওই সীমায় পৌঁছে যান।
সেলসম্যান হিসেবে তিনি খুবই ভালোভাবে সার্ভিসিংয়ের অভাবের বিষয়টি অবগত ছিলেন। এর ফলে আইবিএম তাদের পূর্ণ ধারণ ক্ষমতায় কম্পিউটার বিক্রি করতে পারছিল না। তিনি বিষয়টি আইবিএমের ব্যবস্থাপকদের অবহিত করলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। হতাশ হয়ে রস সিনিয়র ১৯৬২ সালে আইবিএম ত্যাগ করেন।
তিনি মাত্র ১০০০ ডলার পুঁজি নিয়ে ইলেকট্রনিক ডাটা সিস্টেমস (ইডিএস) গঠন করে বিক্রয়োত্তর সেবার দিকে মনোযোগ দেন। ড. ইহসান ও আমি যখন ইডিএস পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, তখন তিনি তার স্ত্রীর কাছ থেকে উদ্যোগের প্রথম বিনিয়োগ হিসেবে পাওয়া ঐতিহাসিক ১০০০ ডলারের চেকটি গর্বভরে আমাদের দেখিয়েছিলেন।
আজকের কঠোর বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়ে আইবিএমের সবচেয়ে লাভজনক অংশ হলো আইমিএম গ্লোবাল সার্ভিসেস। রস সিনিয়র শেষ পর্যন্ত ১৯৮৪ সালে ২.৪ বিলিয়ন ডলারে ইডিএস বিক্রি করেন জেনারেল মটর্সকে। তিনি ১৯৮৮ সালে পেরট সিস্টেমস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি ডেল সিস্টেমস কিনে নেয় ৩.৯ বিলিয়ন ডলারে।
দুর্দান্ত ভিশনের অধিকারী উদ্যোক্তা রস সিনিয়র স্টিভ জবসের উদ্যোগে ২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেন। তবে এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি প্রতিষ্ঠানটি ত্যাগ করেন। এরপর তার সাফল্য কাহিনী ছিল ‘নেক্সট’।
পেরট সিনিয়র তার দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন, এই দেশের কল্যাণে যত্নবান ছিলেন। তার এত টাকা তাকে উদ্ধত করেনি, তার দেশের জনগণের ভাগ্য সম্পর্কে উদাসীন হননি।
ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধবন্দীদের সাথে কঠোর আচরণের খবর পেয়ে তিনি ১৯৬৯ সালে সংগঠিত চেষ্টায় বিমান থেকে খাবার ও চিকিৎসা সামগ্রী ফেলার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টাটি সফল হয়নি। তিনি এই কাজে কেবল হ্যানয় বা মস্কোর কাছ থেকেই বাধার মুখে পড়েননি, সেইসাথে ওয়াশিংটনেও বৈরী অবস্থায় পড়েন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ সমাপ্তির অনেক পরও তিনি এই যুদ্ধবন্দীদের প্রতি আবিষ্ঠ ছিলেন। প্রতিটি যুদ্ধবন্দীর নিরাপদে ফেরা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার জন্য তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করেছেন।
তার কোম্পানিতে কর্মরত দুই কর্মী ১৯৭৮ সালে শাহের পতন্মুখ সরকারের সাথে চুক্তিগত বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতির অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কোম্পানিকে বলা হয়, তাদের মুক্তির জন্য ১২ মিলিয়ন ডলার দিতে হবে। কার্টার প্রশাসনের উদাসিনতা লক্ষ্য করে এবং তার কর্মীদের ভাগ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় তিনি অবসরপ্রাপ্ত স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার কর্নেল আর্থার সাইমন্সের নেতৃত্বে একটি উদ্ধার মিশন গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে শাহের নির্বাসনবিষয়ক বিশৃঙ্খলার মধ্যে তারা প্রথমে কিছুই করতে পারেননি। তবে বিপ্লবী জনতা তেহরানের কাসর কারাগারে হামলা চালিয়ে এক হাজার বন্দীকে মুক্ত করলে তাদের সুযোগ আসে। পেরট ও সাইমন্স অবশেষে তাদের সহকর্মীদের পেয়ে তাদেরকে ভ্যানে চড়িয়ে নিয়ে আসেন। তাদের এই উদ্ধার অভিযানটি ছিল রোমহর্ষক।
এই ঘটনাতে উদ্দীপ্ত হয়ে কেন ফোলেট ‘অন উইয়িং অব ইগলস’ ও টেলিভিশন মিনি সিরিজ নির্মাণ করেন। কর্মীদের উদ্ধারে তার এই উদ্যোগের ফলে তার জাতীয় স্বীকৃতি মেলে।
তিনি কখনো সরকারি দায়িত্ব গ্রহণ না করেই ১৯৯২ সালে এক টকশোতে ঘোষণা করেন যে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। প্রচারণাকালে তিনি ভারসাম্যপূর্ণ বাজেট, চাকরির জন্য বিদেশে আউটসোর্সিংয়ের কথা তুলে ধরেন।
তিনি নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রে এগ্রিমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলেন, এমনটা হলে প্রধানত এশিয়ানদের কাছে আমেরিকানরা চাকরি হারাবে।
তিনি আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করতেন। এ দিক থেকে তিনি ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পূর্বসূরী। পেরটের ছোট সরকার ও বিশ্বায়নবিরোধী দাবির কারণেই ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৯ ভাগ জনমত পেয়ে এগিয়ে থাকা অবস্থাতেই অজ্ঞাত কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে যান।
তবে অনুসারীদের অনুরোধে আবার নির্বাচনে এসেছিলেন ১ এপ্রিল। কিন্তু তখন আগের ধারাটি হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে তিনি হয়েছিলেন তৃতীয়। বিল ক্লিনটন পেয়েছিলেন ৪৫ ভাগ, জর্জ বুশ ২৭.৫ ভাগ আর তিনি ১৯ ভাগ। মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর এটিই সেরা সাফল্য।
রাজনৈতিক পরিকল্পনা ত্যাগ করে ১৯৯৬ সালে তিনি তার ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত পেরট সিস্টেমস করপোরেশনের প্রেসিডেন্ট ও সিইওর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০০ পর্যন্ত তিনি ছিলেন কোম্পানিটির প্রধান। ৭০ বছর বয়সে তিনি তার ছেলে রস পেরট জুনিয়রের কাছে দায়িত্বভারটি অর্পণ করেন।
তবে দেশ নিয়ে তার উদ্বেগ কখনো কমেনি। আমেরিকার জাতীয় ঋণ নিয়ে তিনি চিন্তায় ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি তার দেশবাসীকে সচেতন করতে থাকেন।
আমি ১৯৯৪ সালে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ছেলে জারারের গ্রাজুয়েশনের সময় আমি প্রথম রস পেরট সিনিয়রকে দেখি। তিনি ছিলেন ওই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে ভালো বক্তা। পরে তার ছেলে রস পেরট জুনিয়রের সুবাদে আমি পেরট পরিবারের ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পেরট সিনিয়রের সাথে সাক্ষাত করার। ২০১৩ সালে প্রথম সাক্ষাতের সময় তার বয়স ছিল ৮৩ বছর।
রস জুনিয়রও অন্যদের মতো ধনী নন। তিনি তার পিতার মতোই দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ মানুষ। তিনিও নানা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন।
ডাভোসে পাকিস্তান ব্রেকফাস্টে আমার একটি বড় সাফল্য ছিল রস জুনিয়রের উপস্থিতি। তিনি টানা কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ব্রেকফাস্টে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ইমরান খান (তখন তিনি ছিলেন স্রেফ একজন পরিচিত রাজনীতিবিদ) উপস্থিত ছিলেন, তখন তিনিও ছিলেন। তিনি তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই লোক নিকট ভবিষ্যতে তোমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার কথা সত্যে পরিণত হয়েছে।
জর্ডানের আম্মানে কয়েক বছর আগে গত ইস্ট ওয়েস্ট ইনস্টিটিউট (ইডব্লিউআই) ডিরেক্টর্স বোর্ড মিটিংয়ে রস জুনিয়র ও আমার উভয় পরিবার দারুণভাবে একত্রিত হয়েছিলাম।
রস পেরট সিনিয়রের মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে পেরট পরিবার যথার্থভাবেই বলেছে যে ব্যবসা ও জীবনে রস ছিলেন সৎ ও কাজের লোক। একজন দেশপ্রেমিক আমেরিকান, বিরল ভিশনের অধিকারী, নীতিবান ও গভীর সহানাভূতিসম্পন্ন লোক হিসেবে তিনি সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধফেরত সৈনিকদের প্রতি অটল সমর্থন ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছেন।
টেক্সাসের পেরটরা সত্যিই মহান আমেরিকান পরিবারগুলোর অন্যতম।
>>>লেখক: প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
No comments