জ্যোতি বসু: ভারতীয় সমাজতন্ত্রের আলোকবর্তিকা, প্রধানমন্ত্রী প্রায় হয়েই গিয়েছিলেন যিনি

পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু
৮ জুলাই জ্যোতি বসুর জন্মবার্ষিকী। এই বাম রাজনীতিক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২৩ বছর ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যটি শাসন করেন।
ভারতের বাম আন্দোলনের আলোকবর্তিকা ছিলেন জ্যোতিবসু। তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২৩ বছর। তার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে স্মরণ করার জন্য এই আয়োজন।
জ্যোতি বসুর নামের পাশে তার অনেক অর্জনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বেশি দিন দায়িত্ব পালনকারী মুখ্যমন্ত্রী (পবন কুমার চামলিংকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি),ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আলোকবর্তিকা। তবে ১৯৯৬ সালে তার টুপিতে আরেকটি পালক লাগানোর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। তিনি হতে চলেছিলেন ভারতের প্রথম বাঙালি ও মাকর্সবাদী প্রধানমন্ত্রী। তবে তার কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারে যোগদান না করায় পদটি চলে যায় এইচ ডি দেব গৌড়ার কাছে।
জ্যোতি বসু ১৯৭৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত টানা ২৩ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সর্বোচ্চ উত্তেজনার সময় তিনি কলকাতার যে রাস্তায় আমেরিকান কনস্যুলেট অবস্থিত, তার নাম কমিউনিস্ট আইকন হো চি মিনের নামে রেখে তারপর বিনিয়োগ চাইতে ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন।
কমিউনিস্ট হওয়া
জ্যোতি বসু জন্মগ্রহণ কছিলেন ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই কলকাতার হ্যারিসন রোডে (বর্তমানে মহাত্মা গান্ধী রোড)। তিনি ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত বাবা-মা নিশিকান্ত ও হেমলতার তৃতীয় সন্তান। নিশিকান্ত ছিলেন ঢাকা জেলার বারদি গ্রামে নিয়োজিত চিকিৎসক।
শৈশবে তার নাম ছিল জ্যোতিরিন্দ্র। তবে ১৯২০ সালে ধর্মতলার লরেটো স্কুলে ভর্তির সময় তার বাবা তার নাম ছোট করে রেখেছিলেন জ্যোতি। তিন বছর পর তিনি সেন্ট জ্যাভিয়ার স্কুলে পাড়ি জমান, সেখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন শেষ করে হিন্দু কলেজ থেকে ইংরেজিতে (সম্মান) ভর্তি হন। এই কলেজের বর্তমান নাম প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।
তারপর ১৯৩৫ সাল সদ্য গ্রাজুয়েট হওয়া জ্যোতি বসু যুক্তরাজ্যে যান। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৪০ সালে ফিরে আসেন। তিনি মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টার হয়েছিলেন।
লন্ডনে অবস্থান করার সময় জ্যোতি বসু কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেনের মাধ্যমে রাজনীতির সাথে পরিচিত হন। তিনি হ্যারি পলিট, রজনী পামে দত্ত, বেন ব্রাডলি ও অন্যান্য নেতার সাথে পরিচিত হন। তিনি মার্কসবাদী কবি হ্যারলন্ড লাস্কির বক্তৃতা শুনতেন। এই কবি পরে ব্রিটিশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। জ্যেতি বসু যুক্তরাজ্যে ভারতীয় ছাত্রদের বিভিন্ন কার্যক্রমেও জড়িত ছিলেন।
তার রাজনৈতিক জীবনের টার্নিং পয়েন্ট আসে ১৯৩৮ সালে। এ সময় তিনি লন্ডন মজলিসে যোগ দিয়ে এর প্রথম সেক্রেটারি হন। মজলিসের প্রথম কাজ ছিল ইংল্যান্ড সফরকারী ভারতীয় নেতাদের সাথে লেবার পার্টি ও অন্যান্য সমাজবাদী দলের সভার আয়োজন করা। এটি জ্যোতি বসুকে জওহেরলাল নেহরু, সুবাস চন্দ্র বসু ও বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিতের মতো নেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেয়।
এ সময়ে জ্যোতি বসু লন্ডনের বস্তিগুলোতে বসবারসরত নিরক্ষর ভারতীয় নাবিকদের ইংরেজি শেখানোর জন্য একটি গ্রুপকে সংগঠিত করেন। এটিই ছিল তার গরিব ও নিরক্ষরদের সাথে কাজ করার প্রথম অভিজ্ঞতা।
ভারতের বামপন্থীদের নেতৃত্ব দেয়া
কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে ১৯৪০ সালে জ্যোতি বসু ভারতে ফিরে আসেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়ে ফ্রেন্ডস অব দি সোভিয়েত ইউনিয়ন, অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট রাইটার্স অ্যান্ড আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি হন।
১৯২৯ সালে মিরাট ষড়যন্ত্রের পর সিপিআইকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে জ্যোতি বসুর প্রধান কাজ ছিল আত্মগোপনে থাকা নেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা ও গোপন সভার আয়োজন করে দেয়া।
জ্যোতি বসু ১৯৪৪ সালে বাংলার ট্রেড ও রেলওয়ে ইউনিয়নের সাথে কাজ করা শুরু করেন। একই বছর তিনি বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৫১ সালে সিপিআইয়ের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন।
পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক ও সোসালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি ও বলশেভিক পার্টি অব ইন্ডিয়া (ইউনাইটেড সোস্যালিস্ট অর্গ্যানাইজেশন) কংগ্রেসবিরোধী ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। জ্যোতি বসু ছিলেন এই ফ্রন্টের অংশবিশেষ। তিনি বরনগর রাজ্য বিধান সভার আসনে কংগ্রেসের হরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীকে পরাজিত করেন। ২৩৮ আসনবিশিষ্ট পরিষদে ৭১টি আসনে নির্বাচন করে সিপিআই ২৮টিতে জয়ী হন। আইনসভায় জ্যোতি বসু সর্বসম্মতিক্রমে এর নেতা নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৭ সালে আসনটি ধরে রাখেন। এবার সিপিআইয়ের আসন বেড়ে হয় ৪৬। এছাড়া ৫ জন স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থন নিয়ে তিনি বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর সিপিআইয়ের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। দুই বছর পর দলটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিসবাদী) গঠনে নেতৃত্বে দেন তিনি, এর পলিটব্যুরোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও হন তিনি।
কংগ্রেসবিরোধী দুটি গ্রুপ ১৯৬৭ সালে সরকার গঠন করে। এতে অজয় মুখার্জি হন মুখ্যমন্ত্রী, জ্যোতি বসু হন তার ডেপুটি ও অর্থমন্ত্রী। তবে মাত্র চার বছর পর বরনগরে জ্যোতি বসু ও মুখার্জি অনন্য লড়াইয়ে মুখোমুখি হন। এতে জ্যোতি বসু জয়ী হন।
পরের পর আবার রাজ্য বিধান সভার নির্বাচন হয়। এতে জালিয়াতির অভিযোগের মধ্যে কংগ্রেস জয়ী হয়। জ্যোতি বসু তার জীবনে এই প্রথম নির্বাচনে পরাজয় বরণ করেন, সিপিআই (এম) রাজ্য পরিষদ বয়কট করে।
মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার পর লেফট ফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে। জ্যোতি বসু হন মুখ্যমন্ত্রী।
তিনি ভূমি সংস্কার, কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন, তিন স্তরের পঞ্চায়েত, বেকার ও বিধবাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বড় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি ২০০০ সালে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে লেফট ফ্রন্ট সরকারের দায়িত্ব তুলে দেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে। তিনি আরো ১১ বছর শাসন করেন। জ্যোতি বসু ২০০৮ পর্যন্ত সিপিআই (এম)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য থাকেন।
প্রায় প্রধানমন্ত্রী
১৯৯৬ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির ১৩ দিনের সরকারের পতন হওয়ার পর জ্যোতি বসু ছিলেন ইউনাইটেড ফ্রন্টের সর্বসম্মত নেতা। কিন্তু সিপিআই (এম) নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। জ্যোতি বসু এটিকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
সাধারণ সম্পাদক হরকিশান সিং সুরজিতসহ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ছিলেন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পক্ষে। কিন্তু ভি এস অচাতথানন্দন, প্রকাশ কারাট, সিতারাম ইয়েচুরি, এ কে নায়ানার এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল মাত্র ৩২ জন এমপি নিয়ে সিপিআই (এম) যথেষ্ট শক্তিশালী হবে না।
তবে সিবিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও বাংলার ডিজিপি অরুন প্রসাদ মুখার্জি তার আত্মজীবনী আননোন ফ্যাসেটস অব রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু, ইন্দ্রজিত গুপ্তে লিখেছেন যে রাজীব গান্থী ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে অর্থাৎ দুবার চেয়েছিলেন যে জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হোন।
বিবাহিত জীবন
জ্যোতি বসু দুবার বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী বাসন্তি ১৯৪২ সালে পরলোকগমন করেন। মাত্র দুবছর ছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। ১৯৪৮ সালে তিনি কমলাকে বিয়ে করেন। তাদের এক সন্তান হয়েছিল। কিন্তু সে জন্মের অল্প পরই মারা যায়। তার ছেলে সুভাব্রত পরিচিত চন্দন নামেও।
মৃত্যু
জ্যোতি বসুকে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি নানা শারীরিক সমস্যার কারণে সল্ট লেকের এএমআরআই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি সেখানে ওই বছরের ১৭ জানুয়ারি পরলোকগমন করেন।
তার ইচ্ছা অনুযায়ী গবেষণার জন্য তার দেহ ও চোখ দুটি এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.