পৌষ সংক্রান্তি ও পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব by শফিক রহমান
পৌষসংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিসহ উপমহাদেশে একটি বিশেষ উৎসবের দিন।
বাংলা বর্ষপঞ্জির নবম মাস ‘পৌষ’-এর শেষ দিন এই উৎসব পালন করা হয়। তবে
উৎসবটি পুরান ঢাকায় সাকরাইন নামে পরিচিত। দিনটি উদযাপনে নানা আয়োজনের মধ্যে
আকর্ষনীয় পর্ব দিনভর ঘুড়ি উড়ানো। পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যে দিনটিতে
সূর্য দেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা বা আকূতিকে পৌঁছাতে পালন করা হয় ঘুড়ি
উৎসব।
১৭৪০ সালে ঢাকার নবাব নাজিম নওয়াজেস মোহাম্মদ খাঁনের উদ্যেগে ঢাকায় ঘুড়ি
উড়ানোর প্রচলন শুরু হয়। আজও উৎসবের দিনে আকাশ ছেয়ে যায় বাহারি রঙ্গে
ঘুড়িতে। চলে সুতায় সুতায় কাটাকাটি।
সন্ধ্যায় শুরু হয় মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনে ফু দিয়ে আকাশে অগ্নিকুণ্ড
তৈরির খেলা (ফায়ার ব্রিদ), আতশবাজির মেলা আর ফানুস উড়ানো। হালে যোগ হয়েছে
লেজার লাইটের আঁকি-বুকি। এভাবে বিদায় জানানো হয় পৌষ মাসকে।
পঞ্জিকার হিসাব মতে গত ১৪ জানুয়ারি ছিল পৌষ সংক্রান্তি। নাটাই, ঘুড়ি আর
আতশবাজির কেনাবেচা, সুতোয় কাচের গুড়া ও রং দিয়ে ‘মাঞ্জা’ দেয়া এবং খাবারের
আয়োজনের প্রায় ১ মাসের প্রস্তুতি শেষে ওই দিন সকালে পুরান ঢাকার সব
কিশোর-যুবক যোগ দেয় ঘুড়ি উড়ানোর উৎসবে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গেণ্ডারিয়া,
মুরগীটোলা, ধুপখোলা, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর, কাগজিটোলা,
বাংলাবাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, কলকতাবাজার, ধোলাই খাল,
নারিন্দা ও সদরঘাট এলাকার পুরো আকাশ ছেয়ে যায় ঘুড়িতে।
আগে এ উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে পুরান
ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয়। উৎসবে অংশ নেন সব ধর্মের সব বয়সী মানুষ। সাকরাইন
পরিণত হয়েছে পুরান ঢাকায় বসবাসকারী সকল মানুষের উৎসবে। এখন সাকরাইনে অংশ
নিতে নতুন ঢাকাসহ নানা এলাকা থেকে মানুষ পুরান ঢাকায় হাজির হয়। আসেন অনেক
বিদেশি পর্যটকও।
আমরা যখন পৌঁছালাম তখন বিকাল ৩টা। কিন্তু ঘুড়ি, সুতা ও নাটাইয়ের দোকানে
তখনও ভিড়। পাড়া মহল্লার গলিতে গলিতে কিশোর-যুবকরা ছুটছে ঘুড়ি নিয়ে। ছাদে
ছাদে তখন বাগট্টা বয়েজ ক্লাব (ঘুড়ির সুতা কেটে দিলে পুরান ঢাকায় বাগট্টা
বলা হয়), কাইট বয়েজ ক্লাব, সুতা ক্লাব, রঙ সুতা ক্লাবসহ নানা নামের কিশোর
ক্লাবের প্রস্তুতি শেষ। এর মধ্যেই ২/৩টি ছাদ পেড়িয়ে আমাদের ঠাঁই হয়
সূত্রাপুরের কাগজিটোলার ‘রুটলেস ক্লাবের’ আয়োজনে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কিশোরদের এ আয়োজনে যুক্ত হন শিশু থেকে বয়স্ক
পুরুষ-মহিলা সবাই। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সামান্য বিরতির পরেই
এছাদ-ওছাদের আলোর ঝলকানি, আতশবাজির আলোর বিচ্ছুরণ, রঙিন ফানুস আর লেজার
লাইটের আঁকি-বুকিতে ঝলমল করে ওঠে পুরান ঢাকার আকাশ। সঙ্গে চলে কান ফাটা
আওয়াজের গান-সঙ্গীত।
তবে সাকরাইন উদযাপনের চলমান এ রীতিতে আপত্তি পুরনোদের। তারা বলেন, এ
পদ্ধতিতে ছাদে ছাদে বন্ধুবান্ধবদের দলের টাকা তুলে লাখ লাখ টাকার বাহারি
আয়োজনে উদযাপন জমজমাট হচ্ছে কিন্তু হারিয়ে গেছে শৈল্পিক নৈপূন্য।। আগে
ঘুড়ি-নাটাই প্রত্যেকে হাতে বানাতো। থাকতো ঢাউস ‘ল্যাঞ্জার’ ঘুড়ি (ঘুড়ির
লেজকে পুরান ঢাকায় বলে ল্যাঞ্জা)। একই পদ্ধতিতে সুতায় হাতে মাঞ্জা মারা
হতো। আর ঘরে ঘরে বানানো হতো পিঠা বিশেষ করে পাটিসাপটা, দুধ চিতই, মালপোয়া,
ক্ষীর পুলি। সঙ্গে থাকতো নলেন গুড়ের পায়েশ। কিন্তু এখন এসবকিছু নেই।
জায়গাটি দখল করেছে কারখানায় তৈরি বাণিজ্যিক পণ্য।
তারপরও মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদ, হিন্দুদের পুজা, খ্রিস্টানদের বড় দিন
আর শিয়া মুসলিমদের আশুরাসহ সব উৎসবেরই উদযাপন মাটির সংস্পর্শে। কিন্তু
পৌষসংক্রান্তি বা সাকরাইন উদযাপনে ঢাকাইয়ারা উঠে যায় ওপরে, উদযাপন করে খোলা
আকাশের নিচে। বিউটি আর ভাইবরেন্সিতে এই একটি দিনে তারা যেন জানান দেন,
‘ঢাকাইয়ারা আলাদা’।
এশিয়ার অন্যান্য দেশেও বর্ণিল আয়োজনে উৎসবটি পালিত হয়। নেপালে দিবসটি
‘মাঘি’, থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’, লাওসে ‘পি মা লাও’ নামে পরিচিত। এছাড়া
মিয়ানমারে ‘থিং ইয়ান’, কম্বোডিয়ায় ‘মহাসংক্রান’ এবং পশ্চিমবঙ্গে
মকরসংক্রান্তি নামে উদযাপিত হয়।
এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মকরসংক্রান্তিতে নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’
উদযাপিত হয়। নতুন ধানের চাল, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের
ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়।
ফসলের উৎসব বা ‘পৌষ পার্বণ’ ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে এটি ‘উত্তরায়ণের
সূচনা’ হিসেবে পরিচিত। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই
দিনে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে
পুণ্যস্নান ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আর বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে দিনটিকে
ঘিরে হয় জয়দেব মেলা।
গুজরাটে গুড় দিয়ে তৈরি তিলের লাড্ডু এই উৎসবের অন্যতম উপাদেয় খাবার।
মহারাষ্ট্রে একে বলা হয় ‘তিলগুল’। কর্ণাটকে একে বলা হয় ‘ইল্লু বিল্লা’।
ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রে ‘মকরসংক্রান্তি’র অর্থ-নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়।
No comments