তোমরা একেকটা নেকড়ে: ওয়ামব্যাক
অ্যাবি ওয়ামব্যাক |
অ্যাবি
ওয়ামব্যাক যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক ফুটবলার ও কোচ। দুইবার অলিম্পিকে
স্বর্ণপদক জিতেছেন, তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নারীদের ফুটবল বিশ্বকাপে। এ
ছাড়া ছয়বার যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষসেরা নারী ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি।
টাইম সাময়িকী অ্যামিকে ২০১৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ মানুষের
তালিকায় স্থান দিয়েছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বার্নার্ড কলেজের সমাবর্তনে
বক্তা ছিলেন তিনি।
এমন কখনো হয়েছে? তুমি জীবন মাত্র গোছাতে শুরু করেছ আর অমনি তোমাকে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হচ্ছে? বুজুর্গদের মতে, এটা হলো জীবনের রূপান্তরের সময়। তবে আমি বলব—ভীতিকর সময়! সম্প্রতি এ রকম একটা ভীতিকর রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, ফুটবল থেকে অবসর নেবার পর। রূপান্তরের বিহ্বলতা কাটিয়ে তুলতেই আয়োজন করা হয় নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। ঠিক তেমনি একটা অনুষ্ঠানে তোমরা এখন বসে আছ। আমার বেলায় এটা ছিল একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। উপলক্ষ: আমার অবসরপ্রাপ্তি।
ইএসপিএন আয়োজিত সে অনুষ্ঠানে আমার পাশাপাশি পুরস্কৃত করা হয় আরও দুজনকে। কোবি ব্রায়ান্ট ও পেইটন ম্যানিং। নামকরা খেলোয়াড়। আর আমাকে দেওয়া হয় একজন আইকনের মর্যাদা। সামনে ভক্তদের উচ্ছ্বাস। আমাদের ঘিরে শত শত ক্যামেরা। আমি একেবারে ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি পেরেছি!
হাততালির পর্ব শেষে মঞ্চ ছাড়ার পালা। একে একে নেমে পড়লেন কোবি ও পেইটন। ঠিক তখনই আমার মনে জেঁকে বসল এক নতুন ভাবনা। আমরা তিনজন খেলোয়াড়। তিনজনই সমপরিমাণ পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও তেজ নিয়ে মাঠে নেমেছি। খেলেছি বছরের পর বছর। দেশের হয়ে। নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে। তবু অবসরপ্রাপ্তির পর যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, দেখি আমার ভবিষ্যৎ ঠিক ওদের মতো নয়। এত দিনে কোবি ও পেইটনের ব্যাংকে জমা পড়েছে শত কোটি টাকা। আর তাই ওদের আছে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, কাজের চাপ থেকে মুক্তি। ওদের আর টাকার পেছনে দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার লড়াইয়ের কেবল শুরু।
এর পেছনে দায়ী আসলে কী? চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য। আমাদের অসম বেতনব্যবস্থা বা ‘পে গ্যাপ’।
‘পে গ্যাপের’ কারণে একজন নারী-পুরুষের তুলনায় ব্যবসায়ে তেমন একটা বিনিয়োগ করতে পারেন না। সঞ্চয় করতে পারেন যৎসামান্য। তাই কাজ করে যেতে হয় দীর্ঘদিন ধরে।
যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখি সমস্ত ক্যারিয়ারজুড়ে আমি কেবল কৃতজ্ঞই ছিলাম। যেমনটা ছিলাম ইএসপিএনের সংবর্ধনার দিন। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম গুটিকয় নারীর ভেতর একজন হতে পেরে। পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াতে পেরে। আসলে কৃতজ্ঞতায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে বহুবার নিজেদের অধিকারের আদায়ের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছি!
আজ তোমরা ৬১৯ জন নারী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছ। সবাই বার্নার্ড কলেজের গ্র্যাজুয়েট। আমি তোমাদের জোর গলায় বলছি, পরিবর্তন এসে গেছে! নারী হিসেবে আমরা যা পাই, তা নিয়েই কৃতজ্ঞ হতে শিখেছি। তবে সময় এলে আমরাও নিজ অধিকারের জন্য লড়তে পারি! ছেলেবেলায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমাকে শেখানো হয়েছিল অল্পতে তুষ্ট হতে। শেখানো হয়েছিল মাথা নুইয়ে, একাগ্র চিত্তে নিজ পথ ধরে এগিয়ে যেতে। আমি ছিলাম রূপকথার সেই ছোট্ট মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে!
সেই গল্প তোমাদের সবার জানা। পৃথিবীজুড়ে সতর্কবাণীস্বরূপ মেয়েদের এই গল্প শোনানো হয়। বনের ভেতর দিয়ে চলেছে মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে। তাকে কঠোরভাবে শেখানো হয়েছে কারও সঙ্গে কথা না বলতে। পথ বিচ্যুত না হতে। আর মুখ লুকিয়ে রাখতে ঘোমটার নিচে। এ যেন ঠিক ‘হ্যান্ডমেইডস টেলের’ সেই কাহিনি!
মেয়েটি কিছু পথ নির্দেশনা মোতাবেক চলতে থাকে। কিন্তু যেই না সে কৌতূহলবশত অন্য পথে ঢুঁ মারল, ব্যস! পড়ে গেল নেকড়ের কবলে! এ গল্পের মূল বক্তব্য: মেয়েদের জানার আগ্রহ থাকা চলবে না। বেশি কথা বলা যাবে না। তাহলেই বিপত্তি বাধবে। বিপদ হবে। আমি জীবনে কখনো পথচ্যুত হইনি। তবে তা নেকড়ের ভয়ে নয়। দলচ্যুত হওয়ার ভয়ে। পদোন্নতির সুযোগ না পাওয়ার ভয়ে। বেতন হারানোর দুশ্চিন্তায়।
আজ যদি অতীত ফেরত পেতাম, তাহলে নিজেকে বলতাম, ‘অ্যাবি, তুমি কিন্তু সেই মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে নও, তুমি আসলে নেকড়ে!’ এই সমাবর্তন সভায় দাঁড়িয়ে আমি তোমাদেরও বলছি, ‘তোমরাও একেকজন একেকটা নেকড়ে!’
১৯৯৫ সাল। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে হঠাৎ হরিণের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেখানে নতুন করে নেকড়ের জোগান দেওয়া হলো। গত ৭০ বছর ধরে সে এলাকায় ছিল হরিণের আধিপত্য। ওরা সব বনাঞ্চল খেয়ে একেবারে নদীভাঙন বাধিয়ে দিয়েছিল। নেকড়ের পাল এলে হরিণের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে এল। হরিণেরাও জান বাঁচাতে সবুজ উপত্যকা এড়িয়ে চলতে লাগল, সে অঞ্চলে জন্মাতে লাগল নতুন গাছপালা। পাখিরা গাছে বাসা বাঁধল। বিভার নামক এক প্রাণী লেগে পড়ল নদীর মধ্যে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরিতে। এতে জুটে গেল হাঁস ও ভোঁদড়ের দল। অর্থাৎ, নেকড়ের উপস্থিতিতে বদলে গেল পরিবেশ। এত দিন যে নেকড়েকে আমরা ক্ষতিকারক ধরে বসেছিলাম, সেই নেকড়েই যেন নিয়ে এল মুক্তির বাণী!
তাহলে কী বুঝলে? নারীরা আমাদের সমাজে সেই নেকড়ের মতো। সমাজ আমাদের হুমকি হিসেবে দেখলেও ভবিষ্যতে আমরাই হব শান্তির বাহক! আমাদের নারীদের একতাবদ্ধ হতে হবে। প্রিয় নেকড়ের দল, আমি তোমাদের সফলতার পথ দেখাব। এর জন্য আমি চারটি উপায় বের করেছি।
প্রথমেই ব্যর্থতাকে সফলতার জ্বালানি হিসেবে দেখতে হবে। একজন সাধারণ লোক তার ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখে। সে তা ভুলে যেতে চায়। কিন্তু একজন ক্রীড়াবিদ জানে ব্যর্থতার উপকারিতা। একসময় আমি জাতীয় যুব দলে খেলতাম। সে সময় স্বপ্ন ছিল, একদিন মিয়া হ্যামের সঙ্গে মাঠে নামব। হঠাৎ একদিন তাদের লকার ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেদিনের সেই লকারে একটি জিনিস আমার নজর কেড়েছিল। তা হলো একটা ছবি। দরজায় টেপ দিয়ে সাঁটা। এমন এক জায়গায় লাগানো, যাতে মাঠে নামার আগে প্রত্যেক খেলোয়াড় তা দেখে যেতে বাধ্য হয়।
তোমরা হয়তো ভাবছ এটা কোনো একটা বিজয়ের ছবি। আসলে ঘটনা কিন্তু উল্টো! ছবিটি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর! নরওয়ের নারী ফুটবল টিমের বিজয়ের ছবি। ১৯৯৫ সালে ওরা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকাপে হারিয়েছিল। সেদিন সেই লকার রুমে দাঁড়িয়ে আমি শিখেছিলাম, জীবনে সফল হতে হলে ব্যর্থতাকে কাজে লাগাতে হবে। ব্যর্থতাকে সফলতার জ্বালানি হিসেবে ধরে নিয়ে এগোতে হবে।
আমার দ্বিতীয় উপদেশ, নিজ নিজ অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিতে শেখো।
ধরো, তুমি পৃথিবীর যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি গোল দিয়েছ। এক যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র দলের হয়ে সহ-অধিনায়কত্ব করেছ। এরপরও কোচ সিদ্ধান্ত নিলেন, জীবনের শেষ বিশ্বকাপে তুমি শুরুতেই মাঠে নামতে পারবে না। তোমার জায়গায় সুযোগ পাবে অন্য কেউ। কেমন লাগবে তখন? মনে হতেই পারে তোমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। হয়তো তোমার পদোন্নতি নিয়ে গেছে অন্য কেউ। তুমি বাদ পড়ে গেছ দল থেকে। হয়তো ব্রিফকেসের জায়গায় তোমার কোলে এখন সন্তান। চোখের সামনে তোমার সহকর্মীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে জেনে রেখো, জীবন যদি তোমায় মাঠ থেকে সরিয়ে দর্শকের সারিতে বসিয়ে দেয়, তো সেখানে বসেই তুমি নেতৃত্ব দেবে। যদি মাঠের বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিতে না-ই পারলে, তো মাঠে থেকেও পারবে না। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় নেতা হলেন একজন মা। একজন অভিভাবক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটা হয়তো জীবনের কঠিনতম ম্যাচ।
তৃতীয় উপদেশ, সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। ফুটবলে প্রতিটা খেলোয়াড় তার নিজ নিজ দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করলে তবেই একজন খেলোয়াড় গোল দিতে পারে। তখন সবাই ছুটে যায় গোল যে করল, তার দিকে। হয়ে ওঠে আনন্দে আত্মহারা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, তারা শুধু একজনের সাফল্যকেই উদ্যাপন করছে। আসলে কিন্তু তারা প্রতিটা খেলোয়াড়ের অবদান, কোচের নির্দেশনা, ব্যর্থতা, সবকিছুকেই উদ্যাপন করে থাকে। সব সময় যে একজনই গোল দেবে তা কিন্তু নয়। তাই যখন তুমি গোল দিতে পারছ না, কিন্তু আরেকজন দিয়েছে, তখন তাকে বাহবা দেওয়া উচিত। নারীদের বলব, তোমরাও একে অন্যের সাফল্যে অভিবাদন জানাও। নিজেদের অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলো।
সবশেষে বলব, জগতে নিজের জায়গা নিজেকেই করে নিতে হবে। একবার আমি মিশেল একারসের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি একজন দারুণ খেলোয়াড়। ম্যাচের শুরুতে তিনি খেলাচ্ছলে আমাদের ফুটবলের কিছু নিয়ম শেখাচ্ছিলেন। এভাবে তিন রাউন্ড চলে গেল। চতুর্থ রাউন্ডে তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর সামান্য ঢিলেমির জন্য দল প্রায় হারতে বসেছে। তিনি তখন গোলরক্ষকের কাছে ছুটে গেলেন। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আমাকে বল দাও।’ গোলকিপার তাঁকে বল দিল, আর তিনি নিজেই তিনবার গোল দিয়ে জিতিয়ে দিলেন দলকে। মিশেল বোঝালেন, দলকে জেতাতে তার সমস্ত মনোযোগ দিতে হবে খেলায়। মনে রাখবে, চতুর্থ রাউন্ডের আগে তাঁর দায়িত্ব ছিল দলকে সাহায্য করা ও খেলা শেখানো। কিন্তু শেষের দিকে, তিনি নেতৃত্বের গুণেই বল দাবি করেছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে।
আমার নেকড়ের দল, তোমরা জেনে রেখো সময় হয়েছে নিজের বল নিজেই চেয়ে নেওয়ার।
তোমাদের চেয়ে নিতে হবে চাকরি করার সুযোগ। পদোন্নতির আবেদন। মাইক্রোফোন। অফিসের বড় পদ। মর্যাদা। নিজের জন্য, সব নারীর জন্য।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন, সূত্র: টাইমস ডট কম
এমন কখনো হয়েছে? তুমি জীবন মাত্র গোছাতে শুরু করেছ আর অমনি তোমাকে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হচ্ছে? বুজুর্গদের মতে, এটা হলো জীবনের রূপান্তরের সময়। তবে আমি বলব—ভীতিকর সময়! সম্প্রতি এ রকম একটা ভীতিকর রূপান্তরের ভেতর দিয়ে গিয়েছি, ফুটবল থেকে অবসর নেবার পর। রূপান্তরের বিহ্বলতা কাটিয়ে তুলতেই আয়োজন করা হয় নানা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। ঠিক তেমনি একটা অনুষ্ঠানে তোমরা এখন বসে আছ। আমার বেলায় এটা ছিল একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। উপলক্ষ: আমার অবসরপ্রাপ্তি।
ইএসপিএন আয়োজিত সে অনুষ্ঠানে আমার পাশাপাশি পুরস্কৃত করা হয় আরও দুজনকে। কোবি ব্রায়ান্ট ও পেইটন ম্যানিং। নামকরা খেলোয়াড়। আর আমাকে দেওয়া হয় একজন আইকনের মর্যাদা। সামনে ভক্তদের উচ্ছ্বাস। আমাদের ঘিরে শত শত ক্যামেরা। আমি একেবারে ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি পেরেছি!
হাততালির পর্ব শেষে মঞ্চ ছাড়ার পালা। একে একে নেমে পড়লেন কোবি ও পেইটন। ঠিক তখনই আমার মনে জেঁকে বসল এক নতুন ভাবনা। আমরা তিনজন খেলোয়াড়। তিনজনই সমপরিমাণ পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও তেজ নিয়ে মাঠে নেমেছি। খেলেছি বছরের পর বছর। দেশের হয়ে। নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে। তবু অবসরপ্রাপ্তির পর যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, দেখি আমার ভবিষ্যৎ ঠিক ওদের মতো নয়। এত দিনে কোবি ও পেইটনের ব্যাংকে জমা পড়েছে শত কোটি টাকা। আর তাই ওদের আছে ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা, কাজের চাপ থেকে মুক্তি। ওদের আর টাকার পেছনে দৌড়ানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার লড়াইয়ের কেবল শুরু।
এর পেছনে দায়ী আসলে কী? চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য। আমাদের অসম বেতনব্যবস্থা বা ‘পে গ্যাপ’।
‘পে গ্যাপের’ কারণে একজন নারী-পুরুষের তুলনায় ব্যবসায়ে তেমন একটা বিনিয়োগ করতে পারেন না। সঞ্চয় করতে পারেন যৎসামান্য। তাই কাজ করে যেতে হয় দীর্ঘদিন ধরে।
যখন পেছনে ফিরে তাকাই, দেখি সমস্ত ক্যারিয়ারজুড়ে আমি কেবল কৃতজ্ঞই ছিলাম। যেমনটা ছিলাম ইএসপিএনের সংবর্ধনার দিন। আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম গুটিকয় নারীর ভেতর একজন হতে পেরে। পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াতে পেরে। আসলে কৃতজ্ঞতায় এতটাই মশগুল ছিলাম যে বহুবার নিজেদের অধিকারের আদায়ের সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছি!
আজ তোমরা ৬১৯ জন নারী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছ। সবাই বার্নার্ড কলেজের গ্র্যাজুয়েট। আমি তোমাদের জোর গলায় বলছি, পরিবর্তন এসে গেছে! নারী হিসেবে আমরা যা পাই, তা নিয়েই কৃতজ্ঞ হতে শিখেছি। তবে সময় এলে আমরাও নিজ অধিকারের জন্য লড়তে পারি! ছেলেবেলায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো আমাকে শেখানো হয়েছিল অল্পতে তুষ্ট হতে। শেখানো হয়েছিল মাথা নুইয়ে, একাগ্র চিত্তে নিজ পথ ধরে এগিয়ে যেতে। আমি ছিলাম রূপকথার সেই ছোট্ট মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে!
সেই গল্প তোমাদের সবার জানা। পৃথিবীজুড়ে সতর্কবাণীস্বরূপ মেয়েদের এই গল্প শোনানো হয়। বনের ভেতর দিয়ে চলেছে মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে। তাকে কঠোরভাবে শেখানো হয়েছে কারও সঙ্গে কথা না বলতে। পথ বিচ্যুত না হতে। আর মুখ লুকিয়ে রাখতে ঘোমটার নিচে। এ যেন ঠিক ‘হ্যান্ডমেইডস টেলের’ সেই কাহিনি!
মেয়েটি কিছু পথ নির্দেশনা মোতাবেক চলতে থাকে। কিন্তু যেই না সে কৌতূহলবশত অন্য পথে ঢুঁ মারল, ব্যস! পড়ে গেল নেকড়ের কবলে! এ গল্পের মূল বক্তব্য: মেয়েদের জানার আগ্রহ থাকা চলবে না। বেশি কথা বলা যাবে না। তাহলেই বিপত্তি বাধবে। বিপদ হবে। আমি জীবনে কখনো পথচ্যুত হইনি। তবে তা নেকড়ের ভয়ে নয়। দলচ্যুত হওয়ার ভয়ে। পদোন্নতির সুযোগ না পাওয়ার ভয়ে। বেতন হারানোর দুশ্চিন্তায়।
আজ যদি অতীত ফেরত পেতাম, তাহলে নিজেকে বলতাম, ‘অ্যাবি, তুমি কিন্তু সেই মিষ্টি লাল টুকটুকে মেয়ে নও, তুমি আসলে নেকড়ে!’ এই সমাবর্তন সভায় দাঁড়িয়ে আমি তোমাদেরও বলছি, ‘তোমরাও একেকজন একেকটা নেকড়ে!’
১৯৯৫ সাল। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে হঠাৎ হরিণের সংখ্যা বেড়ে গেলে সেখানে নতুন করে নেকড়ের জোগান দেওয়া হলো। গত ৭০ বছর ধরে সে এলাকায় ছিল হরিণের আধিপত্য। ওরা সব বনাঞ্চল খেয়ে একেবারে নদীভাঙন বাধিয়ে দিয়েছিল। নেকড়ের পাল এলে হরিণের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চলে এল। হরিণেরাও জান বাঁচাতে সবুজ উপত্যকা এড়িয়ে চলতে লাগল, সে অঞ্চলে জন্মাতে লাগল নতুন গাছপালা। পাখিরা গাছে বাসা বাঁধল। বিভার নামক এক প্রাণী লেগে পড়ল নদীর মধ্যে প্রাকৃতিক বাঁধ তৈরিতে। এতে জুটে গেল হাঁস ও ভোঁদড়ের দল। অর্থাৎ, নেকড়ের উপস্থিতিতে বদলে গেল পরিবেশ। এত দিন যে নেকড়েকে আমরা ক্ষতিকারক ধরে বসেছিলাম, সেই নেকড়েই যেন নিয়ে এল মুক্তির বাণী!
তাহলে কী বুঝলে? নারীরা আমাদের সমাজে সেই নেকড়ের মতো। সমাজ আমাদের হুমকি হিসেবে দেখলেও ভবিষ্যতে আমরাই হব শান্তির বাহক! আমাদের নারীদের একতাবদ্ধ হতে হবে। প্রিয় নেকড়ের দল, আমি তোমাদের সফলতার পথ দেখাব। এর জন্য আমি চারটি উপায় বের করেছি।
প্রথমেই ব্যর্থতাকে সফলতার জ্বালানি হিসেবে দেখতে হবে। একজন সাধারণ লোক তার ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখে। সে তা ভুলে যেতে চায়। কিন্তু একজন ক্রীড়াবিদ জানে ব্যর্থতার উপকারিতা। একসময় আমি জাতীয় যুব দলে খেলতাম। সে সময় স্বপ্ন ছিল, একদিন মিয়া হ্যামের সঙ্গে মাঠে নামব। হঠাৎ একদিন তাদের লকার ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সেদিনের সেই লকারে একটি জিনিস আমার নজর কেড়েছিল। তা হলো একটা ছবি। দরজায় টেপ দিয়ে সাঁটা। এমন এক জায়গায় লাগানো, যাতে মাঠে নামার আগে প্রত্যেক খেলোয়াড় তা দেখে যেতে বাধ্য হয়।
তোমরা হয়তো ভাবছ এটা কোনো একটা বিজয়ের ছবি। আসলে ঘটনা কিন্তু উল্টো! ছবিটি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর! নরওয়ের নারী ফুটবল টিমের বিজয়ের ছবি। ১৯৯৫ সালে ওরা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকাপে হারিয়েছিল। সেদিন সেই লকার রুমে দাঁড়িয়ে আমি শিখেছিলাম, জীবনে সফল হতে হলে ব্যর্থতাকে কাজে লাগাতে হবে। ব্যর্থতাকে সফলতার জ্বালানি হিসেবে ধরে নিয়ে এগোতে হবে।
আমার দ্বিতীয় উপদেশ, নিজ নিজ অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিতে শেখো।
ধরো, তুমি পৃথিবীর যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি গোল দিয়েছ। এক যুগ ধরে যুক্তরাষ্ট্র দলের হয়ে সহ-অধিনায়কত্ব করেছ। এরপরও কোচ সিদ্ধান্ত নিলেন, জীবনের শেষ বিশ্বকাপে তুমি শুরুতেই মাঠে নামতে পারবে না। তোমার জায়গায় সুযোগ পাবে অন্য কেউ। কেমন লাগবে তখন? মনে হতেই পারে তোমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। হয়তো তোমার পদোন্নতি নিয়ে গেছে অন্য কেউ। তুমি বাদ পড়ে গেছ দল থেকে। হয়তো ব্রিফকেসের জায়গায় তোমার কোলে এখন সন্তান। চোখের সামনে তোমার সহকর্মীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে জেনে রেখো, জীবন যদি তোমায় মাঠ থেকে সরিয়ে দর্শকের সারিতে বসিয়ে দেয়, তো সেখানে বসেই তুমি নেতৃত্ব দেবে। যদি মাঠের বাইরে থেকে নেতৃত্ব দিতে না-ই পারলে, তো মাঠে থেকেও পারবে না। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় নেতা হলেন একজন মা। একজন অভিভাবক হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এটা হয়তো জীবনের কঠিনতম ম্যাচ।
তৃতীয় উপদেশ, সবাইকে নিয়ে এগোতে হবে। ফুটবলে প্রতিটা খেলোয়াড় তার নিজ নিজ দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করলে তবেই একজন খেলোয়াড় গোল দিতে পারে। তখন সবাই ছুটে যায় গোল যে করল, তার দিকে। হয়ে ওঠে আনন্দে আত্মহারা। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, তারা শুধু একজনের সাফল্যকেই উদ্যাপন করছে। আসলে কিন্তু তারা প্রতিটা খেলোয়াড়ের অবদান, কোচের নির্দেশনা, ব্যর্থতা, সবকিছুকেই উদ্যাপন করে থাকে। সব সময় যে একজনই গোল দেবে তা কিন্তু নয়। তাই যখন তুমি গোল দিতে পারছ না, কিন্তু আরেকজন দিয়েছে, তখন তাকে বাহবা দেওয়া উচিত। নারীদের বলব, তোমরাও একে অন্যের সাফল্যে অভিবাদন জানাও। নিজেদের অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলো।
সবশেষে বলব, জগতে নিজের জায়গা নিজেকেই করে নিতে হবে। একবার আমি মিশেল একারসের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি একজন দারুণ খেলোয়াড়। ম্যাচের শুরুতে তিনি খেলাচ্ছলে আমাদের ফুটবলের কিছু নিয়ম শেখাচ্ছিলেন। এভাবে তিন রাউন্ড চলে গেল। চতুর্থ রাউন্ডে তিনি লক্ষ করলেন, তাঁর সামান্য ঢিলেমির জন্য দল প্রায় হারতে বসেছে। তিনি তখন গোলরক্ষকের কাছে ছুটে গেলেন। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আমাকে বল দাও।’ গোলকিপার তাঁকে বল দিল, আর তিনি নিজেই তিনবার গোল দিয়ে জিতিয়ে দিলেন দলকে। মিশেল বোঝালেন, দলকে জেতাতে তার সমস্ত মনোযোগ দিতে হবে খেলায়। মনে রাখবে, চতুর্থ রাউন্ডের আগে তাঁর দায়িত্ব ছিল দলকে সাহায্য করা ও খেলা শেখানো। কিন্তু শেষের দিকে, তিনি নেতৃত্বের গুণেই বল দাবি করেছিলেন। সময়ের প্রয়োজনে।
আমার নেকড়ের দল, তোমরা জেনে রেখো সময় হয়েছে নিজের বল নিজেই চেয়ে নেওয়ার।
তোমাদের চেয়ে নিতে হবে চাকরি করার সুযোগ। পদোন্নতির আবেদন। মাইক্রোফোন। অফিসের বড় পদ। মর্যাদা। নিজের জন্য, সব নারীর জন্য।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: শাহরোজা নাহরিন, সূত্র: টাইমস ডট কম
No comments