হিমালয়ের দুর্গমতম পাস অতিক্রম করলো বাংলাদেশের বিএমটিসি by কাজী বিপ্লব
ভাবুন তো, সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার ওপরে খোলা আকাশের নিচে একটি
ঢালে তীব্র বরফ ঝড়ের মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। মাইনাস ১০-১২ ডিগ্রি হবে
তাপমাত্রা। ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেটের হুডির ফাঁক গলে বরফকুচি আঘাত হানছে মুখে।
একটু বিশ্রাম চাইছে শরীর। বসে জিরিয়ে নিতে মুখিয়ে আছে বলা যায়। কিন্তু
কোনও উপায় নেই। উপরন্তু গন্তব্যের কোনও হদিস নেই। তখন মনের অবস্থাটা কেমন
হবে?
হিমালয়ের দুর্গতম পাস তাশি লাপচা |
সত্যি বলতে আমার কোনও অনুভূতিই ছিল না। কোনও শক্তিই যেন
পাচ্ছিলাম না। বৃষ্টিমেদুর দিনে সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছি, বস্তুত
এর চেয়ে ঠিক ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত ছিল তাশি লাপচার সেইসব দিন।
কয়েকদিন আগেই আমার জীবনতীর্থ হিমালয় থেকে ফিরেছি। হিমালয় আমাকে টানে,
তাই কারণে-অকারণে সেখানে ছুটে যেতে চাই। যাওয়া বললে ভুল হবে, এ যেন এক
অদৃশ্য সুতোর টানে ছুটে যাওয়া। আমাদের এবারের অভিযান ছিল ৬ হাজার ১৮৭ মিটার
উঁচু মাউন্ট ফারচামো ও ৫ হাজার ৭৫৭ মিটার উঁচু তাশি লাপচা। বিএমটিসির
এবারের দলে দু’বারের এভারেস্ট আরোহী এম এ মুহিতের নেতৃত্বে আমার পাশাপাশি
ছিল রিয়াসাদ সানভী।
দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে হিমালয়ে ৮ হাজার মিটারসহ অসংখ্য পর্বত শিখর অভিযান
করা বিএমটিসি এবারের লক্ষ্য হিসেবে একটি পাস বেছে নেয়। সেটি হলো তাশি
লাপচা, যা রোলওয়ালিং ও সলোখুম্বু অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে। আর তাশি লাপচার
ঠিক মাথার মুকুট হওয়ায় ফারচামো অভিযানের লক্ষ্য ছিল দুটি। সেন্ট্রাল
হিমালয়ে উচ্চতা, দুর্গমতা ও আরোহণ কঠিনত্ব বিবেচনায় মাকালু বরুণ অঞ্চলের
শেরপেনি কোলের পরেই ধরা হয় তাশি লাপচাকে।
এবারের
অভিযানে বিএমটিসি’র দলটির সামনেও তাশি লাপচার পথ বারবার তুলে দিয়েছে
দুর্গমতার দেয়াল। তুষার ঝড়ে পড়া ও হোয়াইট আউটে পথ হারিয়ে ফেলার মতো ঘটনার
মুখে পড়তে হয়েছে। পাসের পথেই ব্লু আইস ওয়ালে ফিক্সড রোপে আরোহণের মতো বিরল
কাজ করতে হয়েছে। এটি অতিক্রমের জন্য পর্বতারোহণের প্রাতিষ্ঠানিক সব বিদ্যা
কাজে লেগেছে।
বিএমটিসির টিম তাশি লাপচা ও ফারচামোর উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে গত ২১ মে। সব
আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাঠমান্ডু থেকে আমরা রোলওয়ালিংয়ের গঙ্গুর থেকে ট্রেক
শুরু করি ২৫ মে। প্রথম দিন সিমিগাও, দ্বিতীয় দিন ডঙ্গং, তৃতীয় দিন বেদিং ও
চতুর্থ দিনে না-গ্রামে পৌঁছাই। প্রায় ৪ হাজার ২০০ মিটার উঁচু গ্রামটিতে
এক্লেমাটাইজের জন্য একরাত কাটাতে হয়।
সেন্ট্রাল হিমালয়ের অন্যান্য অঞ্চল যেমন, সলোখুম্বু বা অন্নপূর্ণার মতো
রোলওয়ালিং ভ্যালিতে ট্রেকারদের অতটা আনাগোনা নেই। প্রকৃতির নিভৃত অপার কোলে
এখানে আছে অ্যাডভেঞ্চারের পসরা। চো রোলপা লেকের ধারে চুকিমায় ক্যাম্পিং
শুরু করি আমরা। রাত কাটে লোয়ার জাবুকে। এদিন টানা দশ ঘণ্টা গ্লেসিয়ারের ওপর
ট্রেকিং করতে হয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দ্রুত গলে যাওয়ায় ট্র্যাকারডিঙ
গ্লেসিয়ারে পথ হারিয়ে এদিন নতুন পথ তৈরি করে ক্যাম্প সাইটে পৌঁছাতে হয়
আমাদের। শেষ অংশ অতিক্রমের সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল তুষারপাত।
পরদিন তৈরি হয় আরও বড় চ্যালেঞ্জ। কয়েকশ’ মিটারের পাথুরে খাড়া দেয়াল বেয়ে
ঝুঁকিপূর্ণ আরোহণ করতে হয়েছে। আমরা উঠে যাই ড্রোলামবু গ্লেসিয়ারের বুকে।
তারপর গ্লেসিয়ার মোরেইনের উচুঁ-নিচু বুকে একটানা চলা। কয়েকদিনের
ধারাবাহিকতায় দুপুরের পর থেকে আবহাওয়া রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। একটানা
তুষারপাত চলে। এর মধ্যেই বিএমটিসি টিম পথচলা অব্যাহত রাখে। কারণ এদিন পাস
অতিক্রম করার কথা ছিল। কিন্তু পথের দুর্গমতা ও তুষারপাতের কারণে পাসের খাড়া
দেয়ালের নিচে গ্লেসিয়ারের বুকেই মিডল ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নেন দলনেতা
এম এ মুহিত। সেটি ছিল প্রায় ৫ হাজার ৩০০ মিটার উচ্চতায়।
পরের দিনের শুরুতেই শক্ত নীল বরফের দেয়ালে ফিক্সড রোপে আরোহণ করে
বিএমটিসি টিম তাশি লাপচা পাসের পথে একটি আইসফিল্ডে উঠে আসে। কিছুদূর যেতেই
আবারও ভার্টিক্যাল স্লোপে রোপ ফিক্সড করতে হয়। তখন আবহাওয়া আগের দিনগুলোর
মতো প্রতিকূল হয়ে পড়ে। তুষারপাতের সঙ্গে শুরু হয়ে একটানা বইতে থাকে তীব্র
বাতাস। পাসের কাছাকাছি চলে আসার সময় হোয়াইট আউটে দৃষ্টিসীমা সাত-আট হাতের
মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
এদিকে
পাসের পথ হারিয়ে ফেলেন গাইড। এ কারণে একই জায়গায় একঘণ্টা খোলা আকাশের নিচে
তীব্র ব্লিজার্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একঘণ্টা পর অবশেষে পাসের
শীর্ষপথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। ৫ হাজার ৭৫৫ মিটার উঁচু সেন্ট্রাল হিমালয়ের
অন্যতম বিপদসঙ্কুল পাস তাশি লাপচা অতিক্রম করে তাসি ফুক নামে অপেক্ষাকৃত
নিচু একটি জায়গায় ফারচামোর শিখরে বেজক্যাম্প স্থাপন করে বিএমটিসি। এর
উচ্চতা ছিল ৫ হাজার ৬৬৫ মিটার। বেজক্যাম্প ছিল পাথুরে দেয়ালে প্রায় ঝুলন্ত
অবস্থায়। জায়গাটা ভয়াবহ বলা যায়। ওপর থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ছিল নিচে। তাশি
লাপচা পাস থেকে ফারচামোর শিখর পর্যন্ত পুরো রাস্তা ক্রেভাসে পরিপূর্ণ।
কোথাও আবার দীর্ঘ খাড়া দেয়াল।
পরদিন ফিক্সড রোপ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পাস পেরোনোর সময় আগের
দিনগুলোর ধারাবাহিকতায় আবহাওয়া আবারও রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এমন প্রতিকূল
অবস্থা অব্যাহত থাকে পরবর্তী দুই দিন। অভিযানের রসদ হিসাব করে আনা হয়েছিল।
কিন্তু সেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দু’পাশের সবচেয়ে নিকটবর্তী গ্রাম
রোলওয়ালিংয়ের না ও সলোখুম্বুর থ্যাংবায় গিয়ে রসদ নিয়ে আসা ছিল অসম্ভব। তাই
বাধ্য হয়ে ফারচামো অভিযান বাতিল করতে হয়। তবে আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলাম।
অক্সিমিটারে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা চার অভিযাত্রীরই গড়ে আশির ওপরে দেখা
গেছে পরীক্ষায়।
ফিরে
আসার পথেও পড়তে হয় চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। টানা তুষারপাতের পরে সকালের
রোদে পিচ্ছিল একচিলতে পাথুরে কার্নিশ ধরে এগোতে হয়। পড়লেই হাজার মিটার নিচে
ধপাস! এরপর কয়েকশ’ মিটার রকফল জোনে মেকানিক্যাল ফিগার অব এইট ডিভাইস ছাড়াই
বিএমটিসি সদস্যরা সাইড র্যা পেলিং করে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায় নেমে
আসেন। এ সময় আমরা দেখি ২০১৮ সালে সেই স্থানে রকফলে মৃত্যুবরণ করা দুই
অভিযাত্রীর সরঞ্জামাদি।
শেষ বিকালে আমরা পৌঁছাই সলোখুম্বুর অন্যতম শেরপা বসতি থামেতে। আমরা থাকি
বিশ্বরেকর্ডধারী শেরপা আপা শেরপার লজে। এরপর নামচে বাজার, ফাকদিন হয়ে
লুকলাতে যাই। আবহাওয়া শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে লুকোচরি খেলে গেছে। এরই
ধারাবাহিকতায় লুকলাতে একদিন প্রতিকূল আবহাওয়া আটকে রেখেছিল আমাদের।
>>>ছবি: এম এ মুহিত
No comments