মুরসির মৃত্যু নিয়ে যা বললেন ফরহাদ মজহার
মিসরে
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি
মৃত্যুবরণ করেছেন। ৬৭ বছর বয়সী সাবেক এই প্রেসিডেন্ট সোমবার দেশটির আদালতে
শুনানি চলাকালে এজলাসেই মৃত্যুবরণ করেন। মিসরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ও
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত প্রথম বৈধ প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।
তার মৃত্যুতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ শোক জ্ঞাপন করেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ফরহাদ মজহার মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে নিম্নে সেই পোস্ট হুবহু তোলে ধরা হলো।
“শেষ পর্যন্ত মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মরসি এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ইন্তেকাল করলেন। নির্জন কারাবাসে তাঁকে অমানবিক ভাবে মানসিক নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছে। কারাগারে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক্স, কিডনি ও লিভারের অসুখের চিকিৎসা তিনি পান নি। না পেয়ে আদালতে শুনানির সময় অসুস্থ হয়ে আদালতেই ইন্তেকাল করেছেন। ধন্য আদালত! ধন্য বিচার ব্যবস্থা! আজ ভোরে এই খবরটি, বিশেষত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, মনকে ভয়ানক বিষণ্ণ ও বিষাক্ত করল।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। আরব বসন্তের পরে ২০১২ সালে তিনিই হচ্ছেন মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এরপর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে পালটা গণ আন্দোলন এবং তার সুযোগে আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়।
আদালতে তাঁকে কাঁচের খাচায় রাখা হোত। তাঁর ইন্তেকাল মিশরের আদালত ও শাসন ব্যবস্থার জন্য কলংক হয়ে রইল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান অনুযায়ী এটা মরসির স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বরং সরকারি বা পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা। তিনি বিচার পেলেন না। যেভাবে অত্যাচার করে তাঁকে মারা হয়েছে তার চেয়ে সম্ভবত তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা অনেক সদয় কাজ হোত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই হত্যাকাণ্ডকে বলেছে ‘ভয়াবহ’, কিন্তু ‘একদম এটাই ঘটবে তা আগেই বোঝা গিয়েছিল’। তাদের দাবি, মিশরের কতৃপক্ষকেই মরসির মৃত্যুর দায় বহন করতে হবে। বলাবাহুল্য মিশরে প্রতিক্রিয়া হিশাবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হবে। মিশরের রাজনীতি দেশের ভেতরে এবং বাইরে সরকারি হেফাজতে মরসির হত্যায় কতোটা আলোড়িত হবে পরবর্তী ঘটনাঘটনে সেটা বোঝা যাবে। আমাদের নজর রাখতে হবে।
মিশরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। বিশেষত ইসলামপন্থি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা বোঝার জন্য মোহাম্মদ মরসির নেতৃত্বাধীন ব্রাদারহুডের রাজনীতির পর্যালোচনা বাংলাদেশে আমাদের খুবই দরকার। এ নিয়ে ২০১৩ সালেই আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে লিখেছি:
“মিশরের অভিজ্ঞতা থেকে এই সংশয়ও আরও প্রবল হবে যে ইসলামপন্থি রাজনীতি এখনও পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক ফলাফল ও রাষ্ট্র গঠনের মর্ম ও কাঠামোর অসম্পূর্ণতা ও স্ববিরোধিতার কোন সমাধান দেবার যোগ্য হয়ে ওঠে নি। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও রূপের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করে সেটা সম্ভব নয়। বরং তাকে অতিক্রম করে যাবার সংকল্পের মধ্যেই একালের ইসলামপন্থি রাজনীতিসহ যে কোন ইতিহাস-সচেতন রাজনীতির সম্ভাব্য বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভূমিকা নিহিত রয়েছে। এখন অবধি দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ইসলামি রাজনীতি অন্য সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিয়ে শুধু মুসলমানদের জন্য বড়জোর শরিয়া আইন ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এই কালে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অসম্পূর্ণ ও স্ববিরোধী রাষ্ট্রের ধরণে ও মর্মে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এই রাজনীতি এখনও অর্জন করে নি। এই ক্ষেত্রে আদৌ কোন সমাধান দিতে পারে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ইসলামি রাজনীতির ভবিষ্যৎ। যেমন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পর্যালোচনা ও তাকে অতিক্রম করে যাবার পথ অনুসন্ধানের জন্য ইসলামের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণার বিকাশ, ব্যবহার ও প্রয়োগ । সে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদেই এই ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটবে। আর ঠিক এই ধারণার বিকাশ ঘটানোর জন্য যেমন, ঠিক তেমনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে আরও তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্যই ‘গণতন্ত্র’ দরকার। গণতন্ত্রই রাজনীতির শেষ মঞ্জিল নয়। তবে মিশরে দেখা যাচ্ছে ব্রাদারহুড মিশরের জনগণের জন্য যে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান উপহার দিয়েছে ব্রাদারহুড সমর্থক ছাড়া মিশরের জনগণ তা গ্রহণ করে নি। অথচ তাদের ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার এটাই ছিল সর্বোচ্চ রূপ”।
মিশরে একটা পর্বের অবসান হোল। কিন্তু ইসলামপন্থি রাজনীতি এই তিক্ত ও করুণ অভিজ্ঞতা থেকে আদৌ কিছু শিখবে কিনা সেটা আগামিতেই বোঝা যাবে।”
ফরহাদ মজহারের পোস্ট
তার মৃত্যুতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ শোক জ্ঞাপন করেছেন। বাংলাদেশের অন্যতম চিন্তক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ফরহাদ মজহার মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ওয়ালে একটি পোস্ট দিয়েছেন। পাঠকদের সুবিধার্থে নিম্নে সেই পোস্ট হুবহু তোলে ধরা হলো।
“শেষ পর্যন্ত মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মরসি এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ইন্তেকাল করলেন। নির্জন কারাবাসে তাঁকে অমানবিক ভাবে মানসিক নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়েছে। কারাগারে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিক্স, কিডনি ও লিভারের অসুখের চিকিৎসা তিনি পান নি। না পেয়ে আদালতে শুনানির সময় অসুস্থ হয়ে আদালতেই ইন্তেকাল করেছেন। ধন্য আদালত! ধন্য বিচার ব্যবস্থা! আজ ভোরে এই খবরটি, বিশেষত মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, মনকে ভয়ানক বিষণ্ণ ও বিষাক্ত করল।
তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। আরব বসন্তের পরে ২০১২ সালে তিনিই হচ্ছেন মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এরপর ২০১৩ সালের জুলাইয়ে পালটা গণ আন্দোলন এবং তার সুযোগে আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসির নেতৃত্বে সামরিক অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়।
আদালতে তাঁকে কাঁচের খাচায় রাখা হোত। তাঁর ইন্তেকাল মিশরের আদালত ও শাসন ব্যবস্থার জন্য কলংক হয়ে রইল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের বিধিবিধান অনুযায়ী এটা মরসির স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। বরং সরকারি বা পুলিশী হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা। তিনি বিচার পেলেন না। যেভাবে অত্যাচার করে তাঁকে মারা হয়েছে তার চেয়ে সম্ভবত তাঁকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা অনেক সদয় কাজ হোত।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই হত্যাকাণ্ডকে বলেছে ‘ভয়াবহ’, কিন্তু ‘একদম এটাই ঘটবে তা আগেই বোঝা গিয়েছিল’। তাদের দাবি, মিশরের কতৃপক্ষকেই মরসির মৃত্যুর দায় বহন করতে হবে। বলাবাহুল্য মিশরে প্রতিক্রিয়া হিশাবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হবে। মিশরের রাজনীতি দেশের ভেতরে এবং বাইরে সরকারি হেফাজতে মরসির হত্যায় কতোটা আলোড়িত হবে পরবর্তী ঘটনাঘটনে সেটা বোঝা যাবে। আমাদের নজর রাখতে হবে।
মিশরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। বিশেষত ইসলামপন্থি রাজনীতির সীমাবদ্ধতা বোঝার জন্য মোহাম্মদ মরসির নেতৃত্বাধীন ব্রাদারহুডের রাজনীতির পর্যালোচনা বাংলাদেশে আমাদের খুবই দরকার। এ নিয়ে ২০১৩ সালেই আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। সেখানে লিখেছি:
“মিশরের অভিজ্ঞতা থেকে এই সংশয়ও আরও প্রবল হবে যে ইসলামপন্থি রাজনীতি এখনও পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঐতিহাসিক ফলাফল ও রাষ্ট্র গঠনের মর্ম ও কাঠামোর অসম্পূর্ণতা ও স্ববিরোধিতার কোন সমাধান দেবার যোগ্য হয়ে ওঠে নি। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও রূপের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে অস্বীকার করে সেটা সম্ভব নয়। বরং তাকে অতিক্রম করে যাবার সংকল্পের মধ্যেই একালের ইসলামপন্থি রাজনীতিসহ যে কোন ইতিহাস-সচেতন রাজনীতির সম্ভাব্য বিশ্ব-ঐতিহাসিক ভূমিকা নিহিত রয়েছে। এখন অবধি দেখা যাচ্ছে প্রচলিত ইসলামি রাজনীতি অন্য সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিয়ে শুধু মুসলমানদের জন্য বড়জোর শরিয়া আইন ভিত্তিক একটি রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এই কালে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অসম্পূর্ণ ও স্ববিরোধী রাষ্ট্রের ধরণে ও মর্মে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর দার্শনিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা এই রাজনীতি এখনও অর্জন করে নি। এই ক্ষেত্রে আদৌ কোন সমাধান দিতে পারে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ইসলামি রাজনীতির ভবিষ্যৎ। যেমন, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পর্যালোচনা ও তাকে অতিক্রম করে যাবার পথ অনুসন্ধানের জন্য ইসলামের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফের ধারণার বিকাশ, ব্যবহার ও প্রয়োগ । সে কাজ হচ্ছে না, তা নয়। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের তাগিদেই এই ধারণাগুলোর বিকাশ ঘটবে। আর ঠিক এই ধারণার বিকাশ ঘটানোর জন্য যেমন, ঠিক তেমনি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইকে আরও তীব্র ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলার জন্যই ‘গণতন্ত্র’ দরকার। গণতন্ত্রই রাজনীতির শেষ মঞ্জিল নয়। তবে মিশরে দেখা যাচ্ছে ব্রাদারহুড মিশরের জনগণের জন্য যে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান উপহার দিয়েছে ব্রাদারহুড সমর্থক ছাড়া মিশরের জনগণ তা গ্রহণ করে নি। অথচ তাদের ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার এটাই ছিল সর্বোচ্চ রূপ”।
মিশরে একটা পর্বের অবসান হোল। কিন্তু ইসলামপন্থি রাজনীতি এই তিক্ত ও করুণ অভিজ্ঞতা থেকে আদৌ কিছু শিখবে কিনা সেটা আগামিতেই বোঝা যাবে।”
ফরহাদ মজহারের পোস্ট
No comments