ইরান নিয়ে যুদ্ধ কি আসন্ন?
ইরাকের
সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর, ইরান সেখানকার বিভিন্ন সশস্ত্র
গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করে। সমর্থন জোগায় ইরাকি রাজনৈতিক দলগুলোকে। আরব
বসন্ত যখন শুরু হলো, তখনও সিরিয়া ও ইয়েমেনে যোদ্ধা পাঠালো ইরান। সেখানকার
বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সমর্থন দিল। সিরিয়ায় যখন বছরের পর বছর ধরে
গৃহযুদ্ধ চলছে, ইরান সেখানে সুযোগ বুঝে নিজস্ব সামরিক অবকাঠামো বানিয়ে নিল।
২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানকে যেই প্রস্তাব দিলেন, সেটি ছিল
দেশটির জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। পারমাণবিক প্রকল্প বন্ধ করার বিনিময়ে কঠোর
মার্কিন অবরোধ প্রত্যাহারের সুযোগ।
কিন্তু এখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ইসরাইল ও সুন্নি আরব শাসকেরা পাশার দান পালটে দিতে চান। গেল সপ্তাহে ট্রাম্প ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ইরানের ওপর পুনরায় মার্কিন অবরোধ আরোপ করেছেন। এমনকি ইরানকে আরও শাস্তি দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন তিনি।
ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরানের ‘ক্ষমতা পরিবর্তনে’র আলোচনা ফের জমে উঠেছে। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরানকে ‘শয়তানের অক্ষে’র অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেবারের পর থেকে ইরানে ক্ষমতা পরিবর্তনের গুঞ্জন এখনের মতো জোরালো কখনোই হয়নি।
পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নাক গলানো কমেনি বলে মনে করেন ট্রাম্প ও তার মিত্ররা। কিন্তু চুক্তি অকার্যকর করেও ইরানকে বিরত রাখা যাবে কিনা, তা মোটেই স্পষ্ট নয়। মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস এক সংবাদ বিশ্লেষণীতে এসব বলেছেন। ইরানের রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর এক নেটওয়ার্ক, যেটি ইরানের স্বার্থ রক্ষা করে। ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে সরে গেলেও, ইরান-সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো লেবানন ও ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়ছে। ইয়েমেনে ইরান-অনুগত বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে নিত্য ব্যালিস্টিক মিশাইল নিক্ষেপ করছে। একসময় যেই দেশটিকে বুশ বলেছিলেন ‘শয়তানের অক্ষ’, সেই ইরান এখন গড়ে তুলেছে ‘প্রতিরোধের অক্ষ।’ ইরাক থেকে শুরু করে সিরিয়া ও লেবানন জুড়ে এই অক্ষের বিস্তার। ইরানি বাহিনী বা দেশটির সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এখন কার্যত ইসরাইল ও সৌদি আরবের দোরগোড়ায় অবস্থান করছে। এই দুই দেশই মূলত ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ।
তবে ইরানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জোট গড়ে উঠেছে। দেশটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ। এই দেশগুলো হয়তো এই মুহূর্তে ইরানের শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের সামর্থ্য সীমিত।
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধান্বিত যুক্তরাষ্ট্র। সিরিয়ায় কিছু সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি চান সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রায় ২ হাজার মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে।
অপরদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশগুলো গত কয়েক বছরে অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনতে শ’ শ’ কোটি ডলার খরচ করেছে। কিন্তু এসব অস্ত্র কার্যকরভাবে ব্যবহার করার ব্যাপারে দেশগুলোর সক্ষমতা এখনও প্রমাণসিদ্ধ নয়। যেমন, ইয়েমেনে ইরান-অনুগত বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইকে এই আরব দেশগুলো এত জটিল করে ফেলেছে যে তারা সেখান থেকে না পারছে সরে আসতে, না পারছে আক্রমণ চালিয়ে যেতে। অপরদিকে অর্থ সহায়তা নির্ভর কূটনীতির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে এই আরব দেশগুলোর প্রভাব বেশ সীমিত। অথচ, নানা ধরণের সৃজনশীল উপায় অবলম্বন করে বহু কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে ইরান। এসব সম্পর্ক বজায় রাখতে বিপুল অংকের সামরিক ব্যয় প্রয়োজন হচ্ছে না দেশটির।
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষক রান্ডা ¯ি¬ম বলেন, ‘শুধু টাকা দিয়েই নেটওয়ার্ক গড়া যায় না। আদর্শ ও নিজ লোকবল যুক্ত করতে ইরানের সদিচ্ছাও এখানে বড় বিষয়। সৌদিদের কাছে এই সরঞ্জাম নেই।’
বাকি থাকে খালি ইসরাইল। দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আছে। তবে আরব দেশগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে মিত্রতা তৈরি করার সামর্থ্য দেশটির সীমিত। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের আচরণের কারণে দেশটি এখনও এই অঞ্চলে ঘৃণিত। ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর উত্তেজনা তুঙ্গে উঠার সর্বশেষ ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার। ওইদিন সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি বাহিনী প্রথমবারের মতো ইসরাইলের দিকে একগুচ্ছ রকেট ছুড়ে। প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বিভিন্ন ইরানি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান বা ইসরাইল কেউই পুরোমাত্রার যুদ্ধ চায় না। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ খুব দ্রুতই পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে সামগ্রিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ঝুঁকি এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রধান ক্লিফ কাপচ্যান বলেন, ‘আমরা হয়তো আগামী একমাস বা তারও কিছু সময়ের জন্য ঠিকই থাকবো। তবে কাঠামোগতভাবে আমাদের বড় ধরণের সমস্যা আছে। ইরান চায় সিরিয়ায় সামরিক স্থাপনা তৈরি করতে। আর ইসরাইল তীব্রভাবে তা হতে দিতে চায় না। এটি হলো গুরুতর কোনো দীর্ঘমেয়াদী সংকটের পূর্বচিত্র।’
সিরিয়া, ইরাক, লেবানন সহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রায়ান সি ক্রোকারও এই উদ্বেগের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যত সংঘাত দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বড় লড়াইয়ের সত্যিকার সম্ভাবনা রয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইসরাইল। এ থেকে কি ভালো কিছু আসবে? মোটেই নয়।’
ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সরাসরি ও বহুমুখী আক্রমণ হলে ইরানকে হয়তো আত্মরক্ষায় বেগ পেতে হবে। শিয়া-নেতৃত্বাধীন দেশটি মূলত সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবী ইসলামি সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা একঘরে। পশ্চিমা সমরাস্ত্র পাওয়ার কোনো উপায় দেশটির নেই। আর অর্থনীতি দুর্বল হওয়ায়, দেশটির প্রতিপক্ষরা গতানুগতিক অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে অনেক এগিয়ে।
ইরান জানে গতানুগতিক অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে গোটা অঞ্চলজুড়ে আধা-রাষ্ট্রীয় কিছু সংগঠন তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে ইরান। এসব সংগঠন মূলত ইরানের মতোই শিয়া ধর্মাবলম্বী।
এই কৌশলের আদর্শ নমুনা ছিল হিজবুল্লাহ। আশির দশকের শুরুর দিকে লেবাননে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা। হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের মাধ্যমে আক্রমণের উপায় তৈরি করে নিয়েছে ইরান। এছাড়া পরবর্তীতে লেবাননের রাজনীতিতেও ইরানের প্রভাব তৈরি হয় হিজবুল্লাহর মাধ্যমে। এখন হিজবুল্লাহ নিজেই স্বগুণে একটি আঞ্চলিক শক্তি।
বৈরুতের লেবানিজ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক বাসেল এফ সালুখ বলেন, ‘ইরানকে আমরা যতটা শক্তিশালী মনে করি ততটা তারা নয়। দেশটির অর্থনীতি বেশ দুর্বল। চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা একটি দেশ। ফলে নিজেকে রক্ষা করতে হলে ক্ষমতা প্রসারিত করতে হয় দেশটির। এই কৌশল খুব ভালো কাজে দিয়েছে। তাই একই কৌশল তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগ করছে।’
ইরানের ক্ষমতার আরেকটি উপাদান হলো পারমাণবিক বোমা নির্মাণে দেশটির আকাঙ্খা ও সামর্থ্য। তবে ইরান সবসময়ই পারমাণবিক বোমা নির্মাণের দাবি অস্বীকার করেছে। ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তি অনুযায়ী, ইরান কখনই পারমাণবিক বোমা নির্মাণ বা নির্মাণ করার আকাঙ্খা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। আমেরিকা চুক্তি থেকে সরে গেলেও ইরান চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তই করেছে।
গতানুগতিক যুদ্ধ হলে ইরানকে তার আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে পারবে না। তবে তারা প্রতিপক্ষের চরম ক্ষতি করতে পারবে।
উদাহরণস্বরূপ, ইরান সরাসরি হিজবুল্লাহর মাধ্যমে ইসরাইলে আক্রমণ করতে পারবে। ধারণা করা হয়, হিজবুল্লাহর হাতে এক লাখেরও বেশি মিসাইল ও রকেট রয়েছে। এদের বেশিরভাগই ইসরাইলের বড় বড় শহর ও সংবেদনশীল অবকাঠামোয় হামলা চালাতে সক্ষম। অপরদিকে ইয়েমেনে ইরান অনুগত হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবকে খুবই ব্যয়বহুল এক যুদ্ধে বেধে ফেলেছে। তার ওপর সৌদি আরবের বড় শহরগুলো এখন মিসাইল হামলার ঝুঁকিতে। এসব আধা-রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোকে সামরিক পন্থায় পরাজিত করা কঠিন। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে হলো দেশগুলোকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এই অস্থিতিশীলতাকেই ইরান নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বাধার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো সিরিয়া। তবে দুই পক্ষই বলছে যুদ্ধ তারা চায় না। পরিস্থিতি যাতে আরও অবনতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে উভয় পক্ষই দৃশ্যত কাজ করছে। যেমন, সিরিয়ায় ইসরাইল যতবার হামলা করেছে, ততবারই শুধু সমরাস্ত্রকে টার্গেট করেছে, মানুষকে নয়। কারণ, ইসরাইলের আশঙ্কা বেশি মানুষ এসব হামলায় মারা গেলে ইরান পালটা জবাব দিতে চাপ বোধ করবে। ইসরাইলি হামলার জবাবে ইরানের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত সীমিত। বৃহস্পতিবার ইরান যেসব রকেট হামলা চালিয়েছে সেগুলোর টার্গেট ছিল ইসরাইলের সামরিক স্থাপনা, কোনো বেসামরিক শহর নয়।
ইরানের প্রভাব হ্রাস করতে যেসব প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেসব দেশটি কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা স্পষ্ট নয়। ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে চান যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলেও পারমাণবিক চুক্তি বহাল থাকুক। তবে কেউ কেউ চান সংঘাত। গত সপ্তাহে ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর উপ-প্রধান হোসেন সালামি বলেন, ‘এসব শত্রুকে মোকাবিলার একমাত্র উপায় হলো প্রতিরোধ, কূটনীতি নয়। চুক্তি থেকে প্রস্থান বা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ হলো আমাদের দেশকে অসাড় করার অজুহাত।’
কিন্তু এখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প, ইসরাইল ও সুন্নি আরব শাসকেরা পাশার দান পালটে দিতে চান। গেল সপ্তাহে ট্রাম্প ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। ইরানের ওপর পুনরায় মার্কিন অবরোধ আরোপ করেছেন। এমনকি ইরানকে আরও শাস্তি দেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন তিনি।
ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরানের ‘ক্ষমতা পরিবর্তনে’র আলোচনা ফের জমে উঠেছে। ২০০২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরানকে ‘শয়তানের অক্ষে’র অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। সেবারের পর থেকে ইরানে ক্ষমতা পরিবর্তনের গুঞ্জন এখনের মতো জোরালো কখনোই হয়নি।
পারমাণবিক চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের নাক গলানো কমেনি বলে মনে করেন ট্রাম্প ও তার মিত্ররা। কিন্তু চুক্তি অকার্যকর করেও ইরানকে বিরত রাখা যাবে কিনা, তা মোটেই স্পষ্ট নয়। মার্কিন সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস এক সংবাদ বিশ্লেষণীতে এসব বলেছেন। ইরানের রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর এক নেটওয়ার্ক, যেটি ইরানের স্বার্থ রক্ষা করে। ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে সরে গেলেও, ইরান-সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো লেবানন ও ইরাকের পার্লামেন্ট নির্বাচনে লড়ছে। ইয়েমেনে ইরান-অনুগত বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে নিত্য ব্যালিস্টিক মিশাইল নিক্ষেপ করছে। একসময় যেই দেশটিকে বুশ বলেছিলেন ‘শয়তানের অক্ষ’, সেই ইরান এখন গড়ে তুলেছে ‘প্রতিরোধের অক্ষ।’ ইরাক থেকে শুরু করে সিরিয়া ও লেবানন জুড়ে এই অক্ষের বিস্তার। ইরানি বাহিনী বা দেশটির সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এখন কার্যত ইসরাইল ও সৌদি আরবের দোরগোড়ায় অবস্থান করছে। এই দুই দেশই মূলত ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ।
তবে ইরানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জোট গড়ে উঠেছে। দেশটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলো এখন ঐক্যবদ্ধ। এই দেশগুলো হয়তো এই মুহূর্তে ইরানের শক্তিমত্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক অঙ্গীকারাবদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের সামর্থ্য সীমিত।
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধান্বিত যুক্তরাষ্ট্র। সিরিয়ায় কিছু সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি চান সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস’র বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রায় ২ হাজার মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে।
অপরদিকে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশগুলো গত কয়েক বছরে অত্যাধুনিক অস্ত্র কিনতে শ’ শ’ কোটি ডলার খরচ করেছে। কিন্তু এসব অস্ত্র কার্যকরভাবে ব্যবহার করার ব্যাপারে দেশগুলোর সক্ষমতা এখনও প্রমাণসিদ্ধ নয়। যেমন, ইয়েমেনে ইরান-অনুগত বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইকে এই আরব দেশগুলো এত জটিল করে ফেলেছে যে তারা সেখান থেকে না পারছে সরে আসতে, না পারছে আক্রমণ চালিয়ে যেতে। অপরদিকে অর্থ সহায়তা নির্ভর কূটনীতির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ফলে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে এই আরব দেশগুলোর প্রভাব বেশ সীমিত। অথচ, নানা ধরণের সৃজনশীল উপায় অবলম্বন করে বহু কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে ইরান। এসব সম্পর্ক বজায় রাখতে বিপুল অংকের সামরিক ব্যয় প্রয়োজন হচ্ছে না দেশটির।
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষক রান্ডা ¯ি¬ম বলেন, ‘শুধু টাকা দিয়েই নেটওয়ার্ক গড়া যায় না। আদর্শ ও নিজ লোকবল যুক্ত করতে ইরানের সদিচ্ছাও এখানে বড় বিষয়। সৌদিদের কাছে এই সরঞ্জাম নেই।’
বাকি থাকে খালি ইসরাইল। দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনী আছে। তবে আরব দেশগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্যে মিত্রতা তৈরি করার সামর্থ্য দেশটির সীমিত। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের আচরণের কারণে দেশটি এখনও এই অঞ্চলে ঘৃণিত। ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর উত্তেজনা তুঙ্গে উঠার সর্বশেষ ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার। ওইদিন সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি বাহিনী প্রথমবারের মতো ইসরাইলের দিকে একগুচ্ছ রকেট ছুড়ে। প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বিভিন্ন ইরানি সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান বা ইসরাইল কেউই পুরোমাত্রার যুদ্ধ চায় না। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ খুব দ্রুতই পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে যেতে পারে। তবে সামগ্রিক যুদ্ধের সম্ভাবনা ঝুঁকি এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের প্রধান ক্লিফ কাপচ্যান বলেন, ‘আমরা হয়তো আগামী একমাস বা তারও কিছু সময়ের জন্য ঠিকই থাকবো। তবে কাঠামোগতভাবে আমাদের বড় ধরণের সমস্যা আছে। ইরান চায় সিরিয়ায় সামরিক স্থাপনা তৈরি করতে। আর ইসরাইল তীব্রভাবে তা হতে দিতে চায় না। এটি হলো গুরুতর কোনো দীর্ঘমেয়াদী সংকটের পূর্বচিত্র।’
সিরিয়া, ইরাক, লেবানন সহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রায়ান সি ক্রোকারও এই উদ্বেগের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত যত সংঘাত দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বড় লড়াইয়ের সত্যিকার সম্ভাবনা রয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইসরাইল। এ থেকে কি ভালো কিছু আসবে? মোটেই নয়।’
ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সরাসরি ও বহুমুখী আক্রমণ হলে ইরানকে হয়তো আত্মরক্ষায় বেগ পেতে হবে। শিয়া-নেতৃত্বাধীন দেশটি মূলত সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপ্রাচ্যে জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবী ইসলামি সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা একঘরে। পশ্চিমা সমরাস্ত্র পাওয়ার কোনো উপায় দেশটির নেই। আর অর্থনীতি দুর্বল হওয়ায়, দেশটির প্রতিপক্ষরা গতানুগতিক অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে অনেক এগিয়ে।
ইরান জানে গতানুগতিক অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে গোটা অঞ্চলজুড়ে আধা-রাষ্ট্রীয় কিছু সংগঠন তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে ইরান। এসব সংগঠন মূলত ইরানের মতোই শিয়া ধর্মাবলম্বী।
এই কৌশলের আদর্শ নমুনা ছিল হিজবুল্লাহ। আশির দশকের শুরুর দিকে লেবাননে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিলেন ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তারা। হিজবুল্লাহকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের মাধ্যমে আক্রমণের উপায় তৈরি করে নিয়েছে ইরান। এছাড়া পরবর্তীতে লেবাননের রাজনীতিতেও ইরানের প্রভাব তৈরি হয় হিজবুল্লাহর মাধ্যমে। এখন হিজবুল্লাহ নিজেই স্বগুণে একটি আঞ্চলিক শক্তি।
বৈরুতের লেবানিজ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক বাসেল এফ সালুখ বলেন, ‘ইরানকে আমরা যতটা শক্তিশালী মনে করি ততটা তারা নয়। দেশটির অর্থনীতি বেশ দুর্বল। চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা একটি দেশ। ফলে নিজেকে রক্ষা করতে হলে ক্ষমতা প্রসারিত করতে হয় দেশটির। এই কৌশল খুব ভালো কাজে দিয়েছে। তাই একই কৌশল তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগ করছে।’
ইরানের ক্ষমতার আরেকটি উপাদান হলো পারমাণবিক বোমা নির্মাণে দেশটির আকাঙ্খা ও সামর্থ্য। তবে ইরান সবসময়ই পারমাণবিক বোমা নির্মাণের দাবি অস্বীকার করেছে। ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তি অনুযায়ী, ইরান কখনই পারমাণবিক বোমা নির্মাণ বা নির্মাণ করার আকাঙ্খা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। আমেরিকা চুক্তি থেকে সরে গেলেও ইরান চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তই করেছে।
গতানুগতিক যুদ্ধ হলে ইরানকে তার আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনের নেটওয়ার্ক রক্ষা করতে পারবে না। তবে তারা প্রতিপক্ষের চরম ক্ষতি করতে পারবে।
উদাহরণস্বরূপ, ইরান সরাসরি হিজবুল্লাহর মাধ্যমে ইসরাইলে আক্রমণ করতে পারবে। ধারণা করা হয়, হিজবুল্লাহর হাতে এক লাখেরও বেশি মিসাইল ও রকেট রয়েছে। এদের বেশিরভাগই ইসরাইলের বড় বড় শহর ও সংবেদনশীল অবকাঠামোয় হামলা চালাতে সক্ষম। অপরদিকে ইয়েমেনে ইরান অনুগত হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবকে খুবই ব্যয়বহুল এক যুদ্ধে বেধে ফেলেছে। তার ওপর সৌদি আরবের বড় শহরগুলো এখন মিসাইল হামলার ঝুঁকিতে। এসব আধা-রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোকে সামরিক পন্থায় পরাজিত করা কঠিন। এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মানে হলো দেশগুলোকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। আর এই অস্থিতিশীলতাকেই ইরান নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত বাধার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো সিরিয়া। তবে দুই পক্ষই বলছে যুদ্ধ তারা চায় না। পরিস্থিতি যাতে আরও অবনতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে উভয় পক্ষই দৃশ্যত কাজ করছে। যেমন, সিরিয়ায় ইসরাইল যতবার হামলা করেছে, ততবারই শুধু সমরাস্ত্রকে টার্গেট করেছে, মানুষকে নয়। কারণ, ইসরাইলের আশঙ্কা বেশি মানুষ এসব হামলায় মারা গেলে ইরান পালটা জবাব দিতে চাপ বোধ করবে। ইসরাইলি হামলার জবাবে ইরানের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত সীমিত। বৃহস্পতিবার ইরান যেসব রকেট হামলা চালিয়েছে সেগুলোর টার্গেট ছিল ইসরাইলের সামরিক স্থাপনা, কোনো বেসামরিক শহর নয়।
ইরানের প্রভাব হ্রাস করতে যেসব প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেসব দেশটি কীভাবে মোকাবিলা করবে, তা স্পষ্ট নয়। ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের অনেকে চান যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলেও পারমাণবিক চুক্তি বহাল থাকুক। তবে কেউ কেউ চান সংঘাত। গত সপ্তাহে ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর উপ-প্রধান হোসেন সালামি বলেন, ‘এসব শত্রুকে মোকাবিলার একমাত্র উপায় হলো প্রতিরোধ, কূটনীতি নয়। চুক্তি থেকে প্রস্থান বা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ হলো আমাদের দেশকে অসাড় করার অজুহাত।’
No comments