খুলনায় নির্বাচনের নতুন মডেল: এটাই ভোট by রাশিদুল ইসলাম, রোকনুজ্জামান পিয়াস ও আবদুল আলীম
বাবার
সঙ্গে ভোট দিয়েছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে। কেন্দ্রের বাইরে লাইন।
ব্যালট পেপার শেষ। আপনার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান- সবচেয়ে কমন
ডায়ালগ। জাল ভোটের রীতিমতো উৎসব। বাধা দেয়নি কেউ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহায়ক
ভূমিকায়।
এমনই এক অভূতপূর্ব ভোটের সাক্ষী হলো খুলনা। গায়েবি ভোটের নয়া মডেলও বলা চলে। হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই। ভোটের আগে থেকেই নানা গুজব ছিল মুখে মুখে। সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রার্থী এবং ভোটাররা। নির্বাচনের দিন গুজব আর শঙ্কারই বাস্তবচিত্র দেখা গেল ভোটে। দখল আর অনিয়মের কারণে তিন কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত রাখলেও বাকি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে অন্তত ১৫০ কেন্দ্র দখল করে একতরফা নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে খুলনার নির্বাচন অনেকটা অগ্নিপরীক্ষা ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য। নির্বাচন শেষে গতকাল গণমাধ্যমের সামনে আসেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। কমিশন সচিব নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্তত এ নির্বাচনটি শতভাগ সুষ্ঠু করে কমিশন বিরোধী পক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারতো। এখন তাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে খুলনার নির্বাচনে দৃষ্টি ছিল সারা দেশের। নির্বাচনের ফলের চেয়ে নির্বাচন কেমন হবে এটি নিয়ে উৎসাহ ছিল বেশি। দিনের শেষে নির্বাচনের ফল দেখে হতাশ হয়েছেন অনেকে।
নানা অভিযোগে কারণে ২৪নং ওয়ার্ডের ২০২নং ইকবাল নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ৩১নং ওয়ার্ডের ২৭৭নং লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই ওয়ার্ডের ২৭৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয় বলে জানান রিটার্নিং অফিসার মো. ইউনুচ আলী। এদিকে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন দুপুরের পরই আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি ৬৯টি কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। শতাধিক কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির আরেকটি নমুনা জাতি দেখতে পেল। অপরদিকে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক দাবি করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিুপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে নগরীর জিলা স্কুল কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট আলী আকবরকে মারধর করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর সমর্থকরা। পরে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ছাড়া একই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর ছোট ভাই কাজী বেলায়েত হোসেন নতুনবাজার হাজী আবু হানিফ কেরাতুল কোরআন নূরানী মাদরাসা কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেননি। খুলনা জিলা স্কুল কেন্দ্রের আটটি বুথেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ধানের শীষের কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এসব কারণে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট বাতিলের লিখিত আবেদন করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মাহবুব কায়সার। মঙ্গলবার ভোটের দিন দুপুরে কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুস আলীর কাছে বিএনপি সমর্থিত এই কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ দাখিল করেন। ৩টার দিকে নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে কেন্দ্র দখল করে নেয় বলে স্থানীয়রা জানান। এরপর তারা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে সিল মেরে বাক্স ভরে। এ ঘটনায় সাড়ে তিনটার দিকে ভোটগ্রহণ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২০৫ নম্বর ভোটকেন্দ্র সোনাপোতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের ভোটকক্ষে বসে সিগারেট খেতে দেখা যায়।
এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় তারা ফিরে যায়। কিছু সময় পরে তারা এসে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে আসা একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিককে ২৪নং ওয়ার্ড নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা জালভোট দিতে অনুরোধ জানান। খালিশপুর থানার ১১নং ওয়ার্ডে জামিয়াহ তৈয়্যেবাহ নূরানী তালিমুল কোরআন মাদরাসা কেন্দ্র থেকে সহোদর সিরাজকে কুপিয়ে আহত এবং আলমকে মারধর করা হয়। তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে দুপুর ২টার দিকে নৌকা প্রতীকের লোকজন প্রকাশ্যে সিল মারে। এ ছাড়া এ ওয়ার্ডে জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম বয়স্ক মাদরাসা কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জামান মোল্লা জেলিনের এজেন্ট আসাদ ও হাবিবকে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। বেলা ২টা থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত ভোটার ছাড়া অন্য কোনো ভোটারকে নগরীর ১১নং ওয়ার্ডের প্লাটিনাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তারা কেন্দ্রে ঢুকে এক একজন ৪/৫টি করে ভোট দিয়ে বের হয়ে এসেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
১০নং ওয়ার্ডের বঙ্গবাসী ও মওলানা ভাসানী স্কুল কেন্দ্রটি দুপুরের পর থেকে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ধানের শীষের প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারে বলে অভিযোগ উঠেছে। নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-২৩৭ নম্বর কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় অভিযোগ করেন বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহেদি রেজভী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাততুন। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্যালটে সিল মেরে তা বাক্সে ফেলছে। অনেক ভোটার এসে বিমুখ হয়ে ফিরে গেছেন।’
কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহদী রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী প্রার্থীর লোকের নৌকায় সিল দিচ্ছে।’ একই অভিযোগ করে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন বলেন, ‘অভিযোগ করায় আমাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট কারচুপি হচ্ছে। তা নিয়ে আমাদের কোনো কথাও বলতে দেয়া হচ্ছে না।’
নগরীর বেলা ১১টার সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা উজ্বল কুমার পাল একটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে বাধা দেয়ার পর তাকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ৫/৭ জন লোক এসে ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়। পরে তারা নৌকায় সিল মারতে গেলে আমি তাতে বাধা দিয়েছি। এমনকি আমি সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বক্সে ভরতে দেইনি।’ তারা আমার নাম পরিচয় জেনে গেছে। ভোট শেষ হলে দেখে নেবে বলেছে। আপনাদের মিডিয়ার ভাইদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চাই।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে থাকা একশ’ ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যার সিরিয়াল নং ০০৪৫৮৪০১ থেকে ০০৪৫৮৫০১ পর্যন্ত। সেগুলো সিল মেরে বাক্সে দিতে দেইনি। আমি তাদের বাধা দিলে তারা আমাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে।’ এই ঘটনার পর এই কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবারও ভোট গ্রহণ করা হয়। পাশেই আরো একটি কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর সেটিও দুই ঘণ্টা ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজে জাল ভোট দেয়ার সময় দু’জনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু আটকদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের এসআই বোরহান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, অসহায়। আপনাদেরই ভাই ব্রাদার। নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে। এ সময় নির্বাচনী দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সে কেন্দ্রে গেলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত সমন্বয়ক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আটকদের ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্যই তাদের তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। এদিকে জাল ভোট দেয়ার সময় সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যম সেখানে পৌঁছার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের কয়েকটি গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা ভোট দিতে আসছেন তাদেরও ফেরত দেয়া হয়েছে ব্যালটের অভাবে।
৩১নং ওয়ার্ডের লবণচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের পাশাপাশি প্রিজাইডিং অফিসারদেরও বের করে দেয় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের সমর্থকরা। তারা বুথের ভেতরে ঢুকে যখন সিল মারছিল তখন প্রিজাইডিং অফিসাররা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
২০নং ওয়ার্ডে এইচআরএইচ প্রিন্স আগাখান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোটারদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মারে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৪নং ওয়ার্ডে দেয়ানা উত্তরপাড়া কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বিএনপি কর্মী মিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৯নং ওয়ার্ড ইসলামাবাদ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে মারধর করে প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। পাইওনিয়ার স্কুল ভোটকেন্দ্র থেকেও প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয়া হয়েছে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের। গল্ডামারি লায়ন্স স্কুল ও নিরালয় স্কুল কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টকে প্রশাসনের সামনে মারধর করে বের করে দেয়া হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে কেএমপির সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ১৪নং ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন স্কুল কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় একযোগে প্রকাশ্যে নৌকা ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকে ছিল মারতে দেখা যায় বলে বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করেন। এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মাহবুবুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন- এ কেন্দ্রে প্রতিটি বুথ থেকে একশ’টির মতো ব্যালটে সন্ত্রাসীরা সিল মারে।
বেলা ৩টার দিকে নগরীর ১৬নং ওয়ার্ডের নূর নগর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা নির্ধারিত সময় শেষ হ্ওয়ার পরেও নৌকা প্রতীকে সিল মারতে দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। খবর পেয়ে র্যাবের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তারা পালিয়ে যায়। এর আগে সকালে এসব কেন্দ্রে কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের এ কেন্দ্র ছাড়াও আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্নুজান স্কুল কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সকাল ৯টা থেকে ৯নং ওয়ার্ডের বৈকালী ইউসেফ স্কুল কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত: কেসিসি নির্বাচনে জোরপূর্বক ব্যালটে সিল মারার কারণে দুটি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এগুলো হলো- ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র (পুরুষ) ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ও লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। দুপুর ১২টার দিকে ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের (পুরুষ) ভোট স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আর বেলা ২টার দিকে অপর কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়।
ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কেন্দ্রে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক জোর করে ঢুকে পড়েন। তারা কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মেরে ভোট বাক্স ভরতে থাকে। এই ঘটনার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের ঘোষণা দেন।
কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুধের ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট কাকলী খান ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জাকিয়া সুলতানার এজেন্ট সাজেদা খাতুন বলেন, ওই যুবকদের সবার শার্টে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। তারা এসেই অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের গ্লাস প্রতীকে ভোট দিয়ে তা বাক্সে ভরেন।
এ সময় প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে কি না, সেটা তার জানা নেই।
প্রিজাইডিং কর্মকর্তার পাশেই ছিলেন ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা। তার পোশাকে নামের কোনো ব্যাজ ছিল না। ব্যাজ কোথাও পড়ে গেছে জানিয়ে নিজের নাম নয়ন মিয়া বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র যে দখল হয়েছে, এমন তথ্য তাদের কাছে ছিল না।
এরপর দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রে আসেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই কেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে। সব ব্যালট পেপার জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে মারধর করা হলে সেটা পুলিশের ব্যাপার।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ‘ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়’ কেন্দ্রে একদল যুবক ঢুকে ব্যালটে সিল মারতে থাকেন। তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলের নির্বাচনী প্রতীকে টিফিন ক্যারিয়ারে সিল মারতে থাকেন। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১ হাজার ৬৯১ জন। প্রায় আধা ঘণ্টা তারা ব্যালটে সিল মারেন। এরপর পুলিশ এলে তারা চলে যান।
ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আলীম হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা ব্যালটে সিল মারলেও তা বাক্সে ভরতে পারেনি। পরে দুটার দিকে কেন্দ্র স্থগিত করা হয়। এদিকে দুপুরে আমরা ৩১ নং ওয়ার্ডের শিশুমেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলকে। সে সাংবাদিকদের দেখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বাইরে আসলে জানা যায়, সাংবাদিকদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালককে শাসিয়ে যায় রাসেলের ক্যাডাররা। তারা বলে- রাসেল ভাই ছালাম দিয়েছে, আপনারা দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যান।
এমনই এক অভূতপূর্ব ভোটের সাক্ষী হলো খুলনা। গায়েবি ভোটের নয়া মডেলও বলা চলে। হানাহানি নেই, রক্তপাত নেই। ভোটের আগে থেকেই নানা গুজব ছিল মুখে মুখে। সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন প্রার্থী এবং ভোটাররা। নির্বাচনের দিন গুজব আর শঙ্কারই বাস্তবচিত্র দেখা গেল ভোটে। দখল আর অনিয়মের কারণে তিন কেন্দ্রে নির্বাচন স্থগিত রাখলেও বাকি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচনে অন্তত ১৫০ কেন্দ্র দখল করে একতরফা নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। জাতীয় নির্বাচনের আগে খুলনার নির্বাচন অনেকটা অগ্নিপরীক্ষা ছিল নির্বাচন কমিশনের জন্য। নির্বাচন শেষে গতকাল গণমাধ্যমের সামনে আসেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা। কমিশন সচিব নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অন্তত এ নির্বাচনটি শতভাগ সুষ্ঠু করে কমিশন বিরোধী পক্ষের আস্থা অর্জন করতে পারতো। এখন তাদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে খুলনার নির্বাচনে দৃষ্টি ছিল সারা দেশের। নির্বাচনের ফলের চেয়ে নির্বাচন কেমন হবে এটি নিয়ে উৎসাহ ছিল বেশি। দিনের শেষে নির্বাচনের ফল দেখে হতাশ হয়েছেন অনেকে।
নানা অভিযোগে কারণে ২৪নং ওয়ার্ডের ২০২নং ইকবাল নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, ৩১নং ওয়ার্ডের ২৭৭নং লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একই ওয়ার্ডের ২৭৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয় বলে জানান রিটার্নিং অফিসার মো. ইউনুচ আলী। এদিকে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন দুপুরের পরই আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দিয়েছি ৬৯টি কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে নৌকায় সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। শতাধিক কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আওয়ামী লীগের ভোট ডাকাতির আরেকটি নমুনা জাতি দেখতে পেল। অপরদিকে আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক দাবি করেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিুপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে নগরীর জিলা স্কুল কেন্দ্রে ধানের শীষের এজেন্ট আলী আকবরকে মারধর করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর সমর্থকরা। পরে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ছাড়া একই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ বিকুর ছোট ভাই কাজী বেলায়েত হোসেন নতুনবাজার হাজী আবু হানিফ কেরাতুল কোরআন নূরানী মাদরাসা কেন্দ্রে ধানের শীষের কোনো এজেন্ট ঢুকতে দেননি। খুলনা জিলা স্কুল কেন্দ্রের আটটি বুথেও ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ধানের শীষের কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এসব কারণে ২২ নম্বর ওয়ার্ডের ভোট বাতিলের লিখিত আবেদন করেছেন কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মাহবুব কায়সার। মঙ্গলবার ভোটের দিন দুপুরে কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ইউনুস আলীর কাছে বিএনপি সমর্থিত এই কাউন্সিলর প্রার্থী অভিযোগ দাখিল করেন। ৩টার দিকে নগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কাশিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে কেন্দ্র দখল করে নেয় বলে স্থানীয়রা জানান। এরপর তারা ব্যালট পেপার ছিনিয়ে সিল মেরে বাক্স ভরে। এ ঘটনায় সাড়ে তিনটার দিকে ভোটগ্রহণ সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২০৫ নম্বর ভোটকেন্দ্র সোনাপোতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীদের ভোটকক্ষে বসে সিগারেট খেতে দেখা যায়।
এ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় তারা ফিরে যায়। কিছু সময় পরে তারা এসে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে আসা একটি জাতীয় পত্রিকার সাংবাদিককে ২৪নং ওয়ার্ড নৌকা প্রার্থীর সমর্থকরা জালভোট দিতে অনুরোধ জানান। খালিশপুর থানার ১১নং ওয়ার্ডে জামিয়াহ তৈয়্যেবাহ নূরানী তালিমুল কোরআন মাদরাসা কেন্দ্র থেকে সহোদর সিরাজকে কুপিয়ে আহত এবং আলমকে মারধর করা হয়। তাদের খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই কেন্দ্রে দুপুর ২টার দিকে নৌকা প্রতীকের লোকজন প্রকাশ্যে সিল মারে। এ ছাড়া এ ওয়ার্ডে জামিয়া ইসলামিয়া আশরাফুল উলুম বয়স্ক মাদরাসা কেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র কাউন্সিলর প্রার্থী জামান মোল্লা জেলিনের এজেন্ট আসাদ ও হাবিবকে সকালেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। বেলা ২টা থেকে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরিহিত ভোটার ছাড়া অন্য কোনো ভোটারকে নগরীর ১১নং ওয়ার্ডের প্লাটিনাম মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তারা কেন্দ্রে ঢুকে এক একজন ৪/৫টি করে ভোট দিয়ে বের হয়ে এসেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে।
১০নং ওয়ার্ডের বঙ্গবাসী ও মওলানা ভাসানী স্কুল কেন্দ্রটি দুপুরের পর থেকে নৌকা প্রতীকের সমর্থকরা ধানের শীষের প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মারে বলে অভিযোগ উঠেছে। নগরীর ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়-২৩৭ নম্বর কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় অভিযোগ করেন বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহেদি রেজভী ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাততুন। তারা বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ব্যালটে সিল মেরে তা বাক্সে ফেলছে। অনেক ভোটার এসে বিমুখ হয়ে ফিরে গেছেন।’
কাউন্সিলর প্রার্থী হাসান মেহদী রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘ভোটারদের ভোট দিতে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে আওয়ামী প্রার্থীর লোকের নৌকায় সিল দিচ্ছে।’ একই অভিযোগ করে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী মাজেদা খাতুন বলেন, ‘অভিযোগ করায় আমাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোট কারচুপি হচ্ছে। তা নিয়ে আমাদের কোনো কথাও বলতে দেয়া হচ্ছে না।’
নগরীর বেলা ১১টার সময় ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের সময় রূপসা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫নং বুথের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা উজ্বল কুমার পাল একটি কেন্দ্রে জাল ভোট দিতে বাধা দেয়ার পর তাকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ ৫/৭ জন লোক এসে ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়। পরে তারা নৌকায় সিল মারতে গেলে আমি তাতে বাধা দিয়েছি। এমনকি আমি সিল মারা ব্যালট পেপারগুলো বক্সে ভরতে দেইনি।’ তারা আমার নাম পরিচয় জেনে গেছে। ভোট শেষ হলে দেখে নেবে বলেছে। আপনাদের মিডিয়ার ভাইদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা চাই।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে থাকা একশ’ ব্যালট পেপার কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যার সিরিয়াল নং ০০৪৫৮৪০১ থেকে ০০৪৫৮৫০১ পর্যন্ত। সেগুলো সিল মেরে বাক্সে দিতে দেইনি। আমি তাদের বাধা দিলে তারা আমাকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে।’ এই ঘটনার পর এই কেন্দ্রটিতে ভোটগ্রহণ কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবারও ভোট গ্রহণ করা হয়। পাশেই আরো একটি কেন্দ্রে জালভোট দেয়ার প্রমাণ পাওয়ার পর সেটিও দুই ঘণ্টা ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
নগরীর ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজে জাল ভোট দেয়ার সময় দু’জনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু আটকদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের এসআই বোরহান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, অসহায়। আপনাদেরই ভাই ব্রাদার। নাম বলে দিলে এখানে অনেক সমস্যা হবে। এ সময় নির্বাচনী দায়িত্বরত একজন ম্যাজিস্ট্রেট সে কেন্দ্রে গেলেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত সমন্বয়ক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, আটকদের ছেড়ে দেয়া হবে। এ জন্যই তাদের তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেনি পুলিশ। এদিকে জাল ভোট দেয়ার সময় সোনাডাঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু গণমাধ্যম সেখানে পৌঁছার আগেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে আবদুল মালেক ইসলামিয়া কলেজ কেন্দ্রের কয়েকটি গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। যারা ভোট দিতে আসছেন তাদেরও ফেরত দেয়া হয়েছে ব্যালটের অভাবে।
৩১নং ওয়ার্ডের লবণচরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের পাশাপাশি প্রিজাইডিং অফিসারদেরও বের করে দেয় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেকের সমর্থকরা। তারা বুথের ভেতরে ঢুকে যখন সিল মারছিল তখন প্রিজাইডিং অফিসাররা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
২০নং ওয়ার্ডে এইচআরএইচ প্রিন্স আগাখান উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভোটারদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় সিল মারে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
৪নং ওয়ার্ডে দেয়ানা উত্তরপাড়া কেন্দ্রে বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর হামলা এবং বিএনপি কর্মী মিশুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৯নং ওয়ার্ড ইসলামাবাদ ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে মারধর করে প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয় সরকার সমর্থকরা। পাইওনিয়ার স্কুল ভোটকেন্দ্র থেকেও প্রশাসনের সামনেই বের করে দেয়া হয়েছে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের। গল্ডামারি লায়ন্স স্কুল ও নিরালয় স্কুল কেন্দ্র থেকে ধানের শীষের এজেন্টকে প্রশাসনের সামনে মারধর করে বের করে দেয়া হয়।
দুপুর দেড়টার দিকে কেএমপির সবচেয়ে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ১৪নং ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন স্কুল কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় একযোগে প্রকাশ্যে নৌকা ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রতীকে ছিল মারতে দেখা যায় বলে বিএনপির প্রার্থীরা অভিযোগ করেন। এ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মাহবুবুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন- এ কেন্দ্রে প্রতিটি বুথ থেকে একশ’টির মতো ব্যালটে সন্ত্রাসীরা সিল মারে।
বেলা ৩টার দিকে নগরীর ১৬নং ওয়ার্ডের নূর নগর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কেন্দ্র দখল করে নেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা নির্ধারিত সময় শেষ হ্ওয়ার পরেও নৌকা প্রতীকে সিল মারতে দেখা যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। খবর পেয়ে র্যাবের একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তারা পালিয়ে যায়। এর আগে সকালে এসব কেন্দ্রে কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেয়নি। এমনকি অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের এ কেন্দ্র ছাড়াও আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্নুজান স্কুল কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সকাল ৯টা থেকে ৯নং ওয়ার্ডের বৈকালী ইউসেফ স্কুল কেন্দ্র দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তিনটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত: কেসিসি নির্বাচনে জোরপূর্বক ব্যালটে সিল মারার কারণে দুটি ভোটকেন্দ্রের ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এগুলো হলো- ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্র (পুরুষ) ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ও লবণচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। দুপুর ১২টার দিকে ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের (পুরুষ) ভোট স্থগিত করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। আর বেলা ২টার দিকে অপর কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়।
ইকবালনগর সরকারি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট শুরুর পর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই কেন্দ্রে ২০ থেকে ২৫ জন যুবক জোর করে ঢুকে পড়েন। তারা কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথে ঢুকে ব্যালট পেপার নিয়ে সিল মেরে ভোট বাক্স ভরতে থাকে। এই ঘটনার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের ঘোষণা দেন।
কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুধের ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট কাকলী খান ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী জাকিয়া সুলতানার এজেন্ট সাজেদা খাতুন বলেন, ওই যুবকদের সবার শার্টে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগানো ছিল। তারা এসেই অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের বের হয়ে যেতে বলেন। এরপর ব্যালট পেপার নিয়ে নৌকা প্রতীকে এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ঠেলাগাড়ি ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদের গ্লাস প্রতীকে ভোট দিয়ে তা বাক্সে ভরেন।
এ সময় প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খলিলুর রহমান বলেন, তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেছে কি না, সেটা তার জানা নেই।
প্রিজাইডিং কর্মকর্তার পাশেই ছিলেন ওই কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা। তার পোশাকে নামের কোনো ব্যাজ ছিল না। ব্যাজ কোথাও পড়ে গেছে জানিয়ে নিজের নাম নয়ন মিয়া বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্র যে দখল হয়েছে, এমন তথ্য তাদের কাছে ছিল না।
এরপর দুপুর ১২টার দিকে কেন্দ্রে আসেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইউনুচ আলী। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই কেন্দ্র স্থগিত করা হয়েছে। সব ব্যালট পেপার জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কাউকে মারধর করা হলে সেটা পুলিশের ব্যাপার।
এদিকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ‘ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়’ কেন্দ্রে একদল যুবক ঢুকে ব্যালটে সিল মারতে থাকেন। তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলের নির্বাচনী প্রতীকে টিফিন ক্যারিয়ারে সিল মারতে থাকেন। এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১ হাজার ৬৯১ জন। প্রায় আধা ঘণ্টা তারা ব্যালটে সিল মারেন। এরপর পুলিশ এলে তারা চলে যান।
ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা আলীম হোসেন বলেন, দুর্বৃত্তরা ব্যালটে সিল মারলেও তা বাক্সে ভরতে পারেনি। পরে দুটার দিকে কেন্দ্র স্থগিত করা হয়। এদিকে দুপুরে আমরা ৩১ নং ওয়ার্ডের শিশুমেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গেলে দেখা যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী এস এম আসাদুজ্জামান রাসেলকে। সে সাংবাদিকদের দেখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বাইরে আসলে জানা যায়, সাংবাদিকদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালককে শাসিয়ে যায় রাসেলের ক্যাডাররা। তারা বলে- রাসেল ভাই ছালাম দিয়েছে, আপনারা দ্রুত এলাকা ছেড়ে চলে যান।
No comments