উপত্যকাটি ফিরে পেতে হলে by এম কে নারায়ণান
জম্মু
ও কাশ্মিরের অবনতিশীল পরিস্থিতি এবং সেই সাথে রাজ্যটিতে জোটের শরিকদের
মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি আর প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির মাঝে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ত্বরান্বিত করেছিল। (কাশ্মির)
উপত্যকাকে এবার যে সহিংস প্রতিবাদ কাঁপিয়ে তুলেছে, তার মোকাবেলার জন্য নানা
পদক্ষেপের বিষয়ে তারা আলোচনা করেছেন। তবে বৈঠকের প্রধান অর্জন দৃশ্যত এটাই
যে, বিজেপি-পিডিপি জোট অব্যাহত থাকবে।
দল দু’টির নরম জোটটি আরেকটি ধাক্কা সামলে উঠেছে হতো। তবে এতে যে কাশ্মিরে বিরাট কিছু হয়ে যাবে, তা নয়। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যাদের সন্দেহ, তাদের মূল্যায়ন হলোÑ কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ সব সময়ই প্রায় একই। এই ধারণার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, দিল্লি তার ভূমিকা বদলাতে ইচ্ছুক নয় এবং এই রাজ্যে প্রাণহানি ও বারবার সঙ্কটের ব্যাপারে শিশুসুলভ ব্যাখ্যা দিয়ে পরিতৃপ্ত। ক্ষমতাসীন জোটের শরিক সংগঠন পিডিপি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় দলটি জোট আঁকড়ে ধরে শ্রীনগরের গদি টিকিয়ে রাখতেই বেশি আগ্রহী। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
২০১৬ সালের শেষ দিকে বলা হয়েছিল, কাশ্মির তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কটগুলোর একটি মোকাবেলা করছে। আর যেকোনো বিচারে, আজ সেখানে পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। সহিংস প্রতিবাদের মাত্রা কদাচিৎ কমতে দেখা যায়। বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বুরহান ওয়ানি এনকাউন্টারে মারা যাওয়ার পর থেকে পরিস্থিতির ধরন একই রয়েছে।
কেন কাশ্মিরে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে, শ্রীনগর বা দিল্লির প্রশাসনের কেউই তা জানে বলে মনে হয় না। যারা কাশ্মিরে সহিংসতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং যাদের পরিকল্পনায় আছে সেখানে একটা পরিবর্তন ঘটানো, তাদের একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো, কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকার বিষয় নিশ্চিত করা। কাশ্মিরের দৃশ্যপট গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত একই রকম থাকায় তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কাশ্মিরে যেসব সহিংসতা এখন ঘটছে, এগুলোর বেশির ভাগই ভয়ঙ্কর বিদেশী জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে না। যারা এসব করছে, লশকর-এ-তৈয়বা এবং জইশ-এ-মোহাম্মদ-এর মতো পাকিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় হিজবুল মুজাহিদিনের সাথে ওদের কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে।
কাশ্মিরে চলমান সহিংসতার নেতাদের চেনা যায় না। তাদের তৎপরতার সুনির্দিষ্ট কারণ বোধগম্য নয়। পাকিস্তান তার ভূমিকা বদলায়নি এবং সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে আগের মতো। যেমনÑ উরি ও পাঠান কোটের পর কুপওয়ারায় সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়ে হতাহত করা হয়েছে। তবে কাশ্মিরে নতুন হুমকি আসছে সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎস থেকে।
বর্তমান জটিল পরিস্থিতি বোঝা কঠিন হবে যদি আগের মতো শুধু বাইরের উসকানি এবং পাকিস্তানের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। একেবারে ভিন্ন কিছু ঘটেছে এবং নতুন কিছু করা দরকার।
কাশ্মিরে এবার যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে, তা অসংগঠিত ও বিভক্ত। এ কারণে এটা ইনতিফাদারূপী বিপদ ঘটাতে পারে। ইনতিফাদা হলো এমন গণবিদ্রোহ যার কোনো পরিচিত নেতা থাকে না। ফলে আন্দোলনের নেতা হওয়ার দাবি জানাতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করেÑ এমন লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কারণে এমন পরিস্থিতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের অবস্থা তৈরি হওয়ার আগেই এবং ‘শহীদ’ হওয়ার ঘটনা যাতে নিয়মিত হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য ভারতকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ভারত কি সত্যের সম্মুখীন হতে পারবে কিংবা এর ইচ্ছা পোষণ করে? ভারত আগের মতো বলে যেতে পারে, কাশ্মিরে অতীত সহিংসতার জন্য যারা দায়ী, তারা দৃশ্যপটে রয়ে গেছে। তবে একই সাথে এটাও ভারতের স্বীকার করা প্রয়োজন যে, নেপথ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছে। জঙ্গিদের নতুন নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক এমন লোকও রয়েছে যাদের ব্যাপারে ভারত আশা করত যে, তারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে এবং তারা ভারতেই নিজেদের ভাগ্য গড়তে ইচ্ছুক ছিল।
২০০৮ সাল থেকে কাশ্মির উপত্যকা অস্থিরতার কয়েকটি তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছে। ২০০৮ ও ২০১০ সালে কাশ্মির বেশ কঠিন সময় পার করেছে। তবে তখন এতে যারা কলকাঠি নেড়েছে, প্রধানত তারা ছিল পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত লোকজন। যারা গোলযোগে জড়িত ছিল, তারা প্রেরণা পেয়েছে সেখান থেকে। তবে ২০১৬ থেকে কাশ্মিরে সংগ্রামের সামনের সারিতে আছে ‘সংযুক্ত নয়, এমন’ জঙ্গিরা। এর ব্যাখ্যা কিভাবে দেয়া যায়? আরো অনেক এলাকার মতো এ ক্ষেত্রেও মনে হয়, সত্য শুধু কোনো কোনো উপলক্ষে এখানে ওখানে প্রতিভাত হচ্ছে। বাস্তবতা অন্ধকারে থেকে যায়। মনে হচ্ছে, নব্বই দশকের বিপজ্জনক দিনগুলোর পর কাশ্মিরে জঙ্গিবাদ আবার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শ্রীনগর আর দিল্লির কর্তৃপক্ষের ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের বিপরীতে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় তরুণসমাজ সহিংসতাকে স্থান দিয়েছে। আজকের পরিস্থিতিতে, অ্যাজেন্ডা ফর অ্যালায়েন্স, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, সৈয়দ আলী শাহ গিলানি ও মিরওয়াইজ উমর ফারুকের মতো হুররিয়াত নেতারা, ইয়াসিন মালিকের মতো সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা- সবাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। কাশ্মিরে এখন ক্রোধ ও ক্ষোভেরই প্রাধান্য। সহিংসতাপূর্ণ প্রতিবাদ এবং শ্রীনগরের সাম্প্রতিক নির্বাচন প্রায় পুরোপুরি বর্জনের মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এর মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট। জোরজবরদস্তি কিংবা হুকুমের দ্বারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
কাশ্মিরে এক উপাখ্যানের পর আরেক উপাখ্যান উন্মোচিত হচ্ছে। সিরিজ ঘটনা ঘটে চলেছে আর ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতির’ কথা বলা আসলে ‘কৌশলগত মিথ্যাচার’-এর উদ্ভব ঘটিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে বারবার টুইট করে বাস্তব পরিস্থিতি বদলে দেয়া হচ্ছে। অতিরঞ্জনের বাগাড়ম্বর সত্যকে উপহাস করছে এবং আরো মিথ্যাচারের পথ করে দিচ্ছে। কাশ্মিরে বাস্তবতা হলো : লাশ, জখম, শহীদ এবং সেই সাথে অবশ্যই আছে কর্তৃপক্ষরূপী খলনায়কেরা।
এ দিকে প্রশাসন হেরে যাচ্ছে প্রপাগান্ডা যুদ্ধে। সোশ্যাল মিডিয়া এনকাউন্টারসহ বিভিন্ন ঘটনার ব্যাপারে নিজস্ব ভাষ্য প্রচার করছে। সীমান্তের ওপার থেকে এই মিডিয়ার কয়েক হাজার উৎসও প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনকার অন্যরকম জঙ্গিদের অক্সিজেন জোগায় সামাজিক গণমাধ্যমই। আর এভাবেই ‘রংধনু মোর্চা’ গড়ে তুলেছে ‘অসংযুক্ত জঙ্গি’ এবং পাকিস্তানের ‘গভীর রাষ্ট্র’।
হতাশ হয়ে পরামর্শ দিলে তা কোনো কাজে আসে না। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে পা রাখলে দেবে যেতে পারে। এ জন্য ক্ষমতাসীন জোটকে দায়ী করা হলেই যে কাজ হবে, তা নয়। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ এটাই করেছেন। দেশ দুর্যোগে নিপতিত হচ্ছে বললেই হবে না; বরং আগে যা বলা হয়েছে এবং যে জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিতে পারেন। ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করা থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখা এবং এ ব্যাপারে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র এ জন্য পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত চাপ দেবে বলে আশা না করাই উচিত। আফগান সঙ্কট মোকাবেলায় আমেরিকার জন্য পাকিস্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, কাশ্মিরে বিরাজমান পরিস্থিতিতে হুররিয়াতের প্রভাব অনেক কমে গেছে। দ্বিধাগ্রস্ত পিডিপি-বিজেপি জোট ভুল করছে। যা ঘটছে, সে সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অবাস্তব। কাশ্মির উপত্যকায় একের পর এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেলেও মনে হচ্ছে, দিল্লি সরকার এই বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। এ অবস্থায় সব কিছু ছেড়ে দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা আর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর। অথচ এই সঙ্কট নিরসনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে কম সুফল মিলবে।
আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? প্রথমেই বলতে হয়, কাশ্মিরে যেখানে বাস্তবেই এনকাউন্টার ঘটছে, হতাহত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে হলেও সাধারণ মানুষ সেখানে জড়ো হচ্ছে, যদিও তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভে জড়িত নয়। কেন এটা হচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে অবশ্যই গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। নিরাপত্তাবাহিনীর গাড়ির বনেটে একজন বিক্ষোভকারীকে বেঁধে প্রতিবাদরত জনতার মাঝ দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা যত কম করা যায়, ততই উত্তম। এ ধরনের কৌশল আগুন নিয়ে খেলার শামিল। এখনকার বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ ও বেপরোয়া। তারাই প্রতিবাদের ধরন এবং আন্দোলনের স্বরূপ নির্ধারণ করছে। এমন একটি পরিস্থিতির দাবি হলো, আমূল রূপান্তর ঘটানো। গোড়াতে ফিরে যেতে হবে। ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে যে সংবিধান কাশ্মিরে কার্যকর রয়েছে, এতে আনা চাই পরিবর্তন। এর ফলে ভারতের এই দাবি কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্য হবে যে, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রাখা হবে। এই স্বায়ত্তশাসনকে কাশ্মির খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সাবধানে এসব কাজ করতে হবে।
যা হোক, যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- কাশ্মির উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য খোলা মনে আহ্বান জানিয়ে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী ও হুররিয়াতের সাথেও বৈঠক করা দরকার। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নেপথ্য চ্যানেলে দেয়া প্রস্তাবগুলোর কিছু আইডিয়ার পুনরুজ্জীবন ঘটানো উচিত।
অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে কাশ্মিরের তরুণদের কর্মসংস্থানকে। এ জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। ভারত নিজের অহঙ্কার চাপা দিয়ে পাকিস্তানের সাথে আলোচনা আবার শুরু করার বিষয় বিবেচনা করে দেখতে পারে। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে বলে বেশি আশা করা না গেলেও অন্তত কাশ্মিরে হার্ডলাইনের অনুসারীদের তো আশ্বস্ত করা যাবে। এখন দরকার, পেশিশক্তির ওপর নির্ভর না করে বেশি যুক্তিসঙ্গত পন্থা অবলম্বন করা।
দল দু’টির নরম জোটটি আরেকটি ধাক্কা সামলে উঠেছে হতো। তবে এতে যে কাশ্মিরে বিরাট কিছু হয়ে যাবে, তা নয়। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে যাদের সন্দেহ, তাদের মূল্যায়ন হলোÑ কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ সব সময়ই প্রায় একই। এই ধারণার পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, দিল্লি তার ভূমিকা বদলাতে ইচ্ছুক নয় এবং এই রাজ্যে প্রাণহানি ও বারবার সঙ্কটের ব্যাপারে শিশুসুলভ ব্যাখ্যা দিয়ে পরিতৃপ্ত। ক্ষমতাসীন জোটের শরিক সংগঠন পিডিপি প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অবস্থায় দলটি জোট আঁকড়ে ধরে শ্রীনগরের গদি টিকিয়ে রাখতেই বেশি আগ্রহী। এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, কাশ্মিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
২০১৬ সালের শেষ দিকে বলা হয়েছিল, কাশ্মির তার ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কটগুলোর একটি মোকাবেলা করছে। আর যেকোনো বিচারে, আজ সেখানে পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। সহিংস প্রতিবাদের মাত্রা কদাচিৎ কমতে দেখা যায়। বিপুল সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে বুরহান ওয়ানি এনকাউন্টারে মারা যাওয়ার পর থেকে পরিস্থিতির ধরন একই রয়েছে।
কেন কাশ্মিরে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে, শ্রীনগর বা দিল্লির প্রশাসনের কেউই তা জানে বলে মনে হয় না। যারা কাশ্মিরে সহিংসতা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং যাদের পরিকল্পনায় আছে সেখানে একটা পরিবর্তন ঘটানো, তাদের একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো, কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থাকার বিষয় নিশ্চিত করা। কাশ্মিরের দৃশ্যপট গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত একই রকম থাকায় তারাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। কাশ্মিরে যেসব সহিংসতা এখন ঘটছে, এগুলোর বেশির ভাগই ভয়ঙ্কর বিদেশী জঙ্গিরা ঘটাচ্ছে না। যারা এসব করছে, লশকর-এ-তৈয়বা এবং জইশ-এ-মোহাম্মদ-এর মতো পাকিস্তানপন্থী জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় হিজবুল মুজাহিদিনের সাথে ওদের কিছু সম্পর্ক থাকতে পারে।
কাশ্মিরে চলমান সহিংসতার নেতাদের চেনা যায় না। তাদের তৎপরতার সুনির্দিষ্ট কারণ বোধগম্য নয়। পাকিস্তান তার ভূমিকা বদলায়নি এবং সহিংসতায় উসকানি দিচ্ছে আগের মতো। যেমনÑ উরি ও পাঠান কোটের পর কুপওয়ারায় সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়ে হতাহত করা হয়েছে। তবে কাশ্মিরে নতুন হুমকি আসছে সম্পূর্ণ ভিন্ন উৎস থেকে।
বর্তমান জটিল পরিস্থিতি বোঝা কঠিন হবে যদি আগের মতো শুধু বাইরের উসকানি এবং পাকিস্তানের ভূমিকাকে দায়ী করা হয়। একেবারে ভিন্ন কিছু ঘটেছে এবং নতুন কিছু করা দরকার।
কাশ্মিরে এবার যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে, তা অসংগঠিত ও বিভক্ত। এ কারণে এটা ইনতিফাদারূপী বিপদ ঘটাতে পারে। ইনতিফাদা হলো এমন গণবিদ্রোহ যার কোনো পরিচিত নেতা থাকে না। ফলে আন্দোলনের নেতা হওয়ার দাবি জানাতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করেÑ এমন লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কারণে এমন পরিস্থিতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ধরনের অবস্থা তৈরি হওয়ার আগেই এবং ‘শহীদ’ হওয়ার ঘটনা যাতে নিয়মিত হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য ভারতকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ভারত কি সত্যের সম্মুখীন হতে পারবে কিংবা এর ইচ্ছা পোষণ করে? ভারত আগের মতো বলে যেতে পারে, কাশ্মিরে অতীত সহিংসতার জন্য যারা দায়ী, তারা দৃশ্যপটে রয়ে গেছে। তবে একই সাথে এটাও ভারতের স্বীকার করা প্রয়োজন যে, নেপথ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছে। জঙ্গিদের নতুন নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিপুলসংখ্যক এমন লোকও রয়েছে যাদের ব্যাপারে ভারত আশা করত যে, তারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখবে এবং তারা ভারতেই নিজেদের ভাগ্য গড়তে ইচ্ছুক ছিল।
২০০৮ সাল থেকে কাশ্মির উপত্যকা অস্থিরতার কয়েকটি তরঙ্গ প্রত্যক্ষ করেছে। ২০০৮ ও ২০১০ সালে কাশ্মির বেশ কঠিন সময় পার করেছে। তবে তখন এতে যারা কলকাঠি নেড়েছে, প্রধানত তারা ছিল পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত লোকজন। যারা গোলযোগে জড়িত ছিল, তারা প্রেরণা পেয়েছে সেখান থেকে। তবে ২০১৬ থেকে কাশ্মিরে সংগ্রামের সামনের সারিতে আছে ‘সংযুক্ত নয়, এমন’ জঙ্গিরা। এর ব্যাখ্যা কিভাবে দেয়া যায়? আরো অনেক এলাকার মতো এ ক্ষেত্রেও মনে হয়, সত্য শুধু কোনো কোনো উপলক্ষে এখানে ওখানে প্রতিভাত হচ্ছে। বাস্তবতা অন্ধকারে থেকে যায়। মনে হচ্ছে, নব্বই দশকের বিপজ্জনক দিনগুলোর পর কাশ্মিরে জঙ্গিবাদ আবার সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শ্রীনগর আর দিল্লির কর্তৃপক্ষের ভণ্ডামিপূর্ণ বক্তব্যের বিপরীতে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় তরুণসমাজ সহিংসতাকে স্থান দিয়েছে। আজকের পরিস্থিতিতে, অ্যাজেন্ডা ফর অ্যালায়েন্স, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, সৈয়দ আলী শাহ গিলানি ও মিরওয়াইজ উমর ফারুকের মতো হুররিয়াত নেতারা, ইয়াসিন মালিকের মতো সাবেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা- সবাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। কাশ্মিরে এখন ক্রোধ ও ক্ষোভেরই প্রাধান্য। সহিংসতাপূর্ণ প্রতিবাদ এবং শ্রীনগরের সাম্প্রতিক নির্বাচন প্রায় পুরোপুরি বর্জনের মধ্য দিয়ে এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এর মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া হচ্ছে, তা স্পষ্ট। জোরজবরদস্তি কিংবা হুকুমের দ্বারা শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
কাশ্মিরে এক উপাখ্যানের পর আরেক উপাখ্যান উন্মোচিত হচ্ছে। সিরিজ ঘটনা ঘটে চলেছে আর ‘স্বাভাবিক পরিস্থিতির’ কথা বলা আসলে ‘কৌশলগত মিথ্যাচার’-এর উদ্ভব ঘটিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে বারবার টুইট করে বাস্তব পরিস্থিতি বদলে দেয়া হচ্ছে। অতিরঞ্জনের বাগাড়ম্বর সত্যকে উপহাস করছে এবং আরো মিথ্যাচারের পথ করে দিচ্ছে। কাশ্মিরে বাস্তবতা হলো : লাশ, জখম, শহীদ এবং সেই সাথে অবশ্যই আছে কর্তৃপক্ষরূপী খলনায়কেরা।
এ দিকে প্রশাসন হেরে যাচ্ছে প্রপাগান্ডা যুদ্ধে। সোশ্যাল মিডিয়া এনকাউন্টারসহ বিভিন্ন ঘটনার ব্যাপারে নিজস্ব ভাষ্য প্রচার করছে। সীমান্তের ওপার থেকে এই মিডিয়ার কয়েক হাজার উৎসও প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এখনকার অন্যরকম জঙ্গিদের অক্সিজেন জোগায় সামাজিক গণমাধ্যমই। আর এভাবেই ‘রংধনু মোর্চা’ গড়ে তুলেছে ‘অসংযুক্ত জঙ্গি’ এবং পাকিস্তানের ‘গভীর রাষ্ট্র’।
হতাশ হয়ে পরামর্শ দিলে তা কোনো কাজে আসে না। বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে পা রাখলে দেবে যেতে পারে। এ জন্য ক্ষমতাসীন জোটকে দায়ী করা হলেই যে কাজ হবে, তা নয়। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ এটাই করেছেন। দেশ দুর্যোগে নিপতিত হচ্ছে বললেই হবে না; বরং আগে যা বলা হয়েছে এবং যে জন্য চেষ্টা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিতে পারেন। ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করা থেকে পাকিস্তানকে বিরত রাখা এবং এ ব্যাপারে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র এ জন্য পাকিস্তানকে পর্যাপ্ত চাপ দেবে বলে আশা না করাই উচিত। আফগান সঙ্কট মোকাবেলায় আমেরিকার জন্য পাকিস্তান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে, কাশ্মিরে বিরাজমান পরিস্থিতিতে হুররিয়াতের প্রভাব অনেক কমে গেছে। দ্বিধাগ্রস্ত পিডিপি-বিজেপি জোট ভুল করছে। যা ঘটছে, সে সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অবাস্তব। কাশ্মির উপত্যকায় একের পর এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখা গেলেও মনে হচ্ছে, দিল্লি সরকার এই বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। এ অবস্থায় সব কিছু ছেড়ে দেয়া হয়েছে গোয়েন্দা আর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর। অথচ এই সঙ্কট নিরসনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হলে সবচেয়ে কম সুফল মিলবে।
আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? প্রথমেই বলতে হয়, কাশ্মিরে যেখানে বাস্তবেই এনকাউন্টার ঘটছে, হতাহত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে হলেও সাধারণ মানুষ সেখানে জড়ো হচ্ছে, যদিও তারা প্রতিবাদ বিক্ষোভে জড়িত নয়। কেন এটা হচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে অবশ্যই গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। নিরাপত্তাবাহিনীর গাড়ির বনেটে একজন বিক্ষোভকারীকে বেঁধে প্রতিবাদরত জনতার মাঝ দিয়ে চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা যত কম করা যায়, ততই উত্তম। এ ধরনের কৌশল আগুন নিয়ে খেলার শামিল। এখনকার বিক্ষোভকারীরা ক্ষুব্ধ ও বেপরোয়া। তারাই প্রতিবাদের ধরন এবং আন্দোলনের স্বরূপ নির্ধারণ করছে। এমন একটি পরিস্থিতির দাবি হলো, আমূল রূপান্তর ঘটানো। গোড়াতে ফিরে যেতে হবে। ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে যে সংবিধান কাশ্মিরে কার্যকর রয়েছে, এতে আনা চাই পরিবর্তন। এর ফলে ভারতের এই দাবি কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্য হবে যে, কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন অক্ষুণ্ন রাখা হবে। এই স্বায়ত্তশাসনকে কাশ্মির খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সাবধানে এসব কাজ করতে হবে।
যা হোক, যা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- কাশ্মির উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য খোলা মনে আহ্বান জানিয়ে এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে কাউকে বাদ দেয়া যাবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী ও হুররিয়াতের সাথেও বৈঠক করা দরকার। ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নেপথ্য চ্যানেলে দেয়া প্রস্তাবগুলোর কিছু আইডিয়ার পুনরুজ্জীবন ঘটানো উচিত।
অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে কাশ্মিরের তরুণদের কর্মসংস্থানকে। এ জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিতে হবে। ভারত নিজের অহঙ্কার চাপা দিয়ে পাকিস্তানের সাথে আলোচনা আবার শুরু করার বিষয় বিবেচনা করে দেখতে পারে। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে বলে বেশি আশা করা না গেলেও অন্তত কাশ্মিরে হার্ডলাইনের অনুসারীদের তো আশ্বস্ত করা যাবে। এখন দরকার, পেশিশক্তির ওপর নির্ভর না করে বেশি যুক্তিসঙ্গত পন্থা অবলম্বন করা।
No comments