উত্তর মেলেনি দুই ডজন প্রশ্নের
কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারের অপহরণে ঘটনা নিয়ে রহস্য যেন কাটছেই না। নিখোঁজের ১৯ ঘণ্টা পর উদ্ধার হলেও তাকে কারা, কী উদ্দেশ্যে অপহরণ করেছে, তা এখনও উদঘাটিত হয়নি। শুধু এই দুই প্রশ্নই নয়, মিলছে না এমন দুই ডজন প্রশ্নের উত্তর। আদৌ এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কিনা- এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, উদ্ধারের পর ফরহাদ মজহারের বক্তব্য, পরিবারের বক্তব্য এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সৃষ্টি হয়েছে এ শঙ্কার। যেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফরহাদ মজহারের সঙ্গে থাকা একটি ব্যাগ। এই ব্যাগ নিয়ে চারটি প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাগ নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। আবার পরিবার বলছে, তিনি বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হননি। তার কাছ থেকে যে ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে এ ধরনের ব্যাগ তিনি ব্যবহার করেন না। আর খুলনার যে হোটেলে তিন রাতের খাবার খেয়েছেন, সেই হোটেলের মালিক তার কাছে কোনো ব্যাগ দেখেননি। সোমবার রাতে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পরপরই খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার (ফরহাদ মজহার) কাছে একটি কালো ব্যাগ পাওয়া গেছে। এরপর মঙ্গলবার ঢাকায় ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ফরহাদ মজহারের কাছ থেকে একটি সাদা ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ও র্যাবের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেছেন, খুলনায় গ্রিল হাউস রেস্তোরাঁয় তিনি সেদিন সন্ধ্যার পর সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছেন। তবে ওই সময় তার সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল না বলে দাবি করেছেন রেস্তোরাঁর মালিক আবদুল মান্নান। আবদুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, সোমবার রাত ৮টা ২০ মিনিট নাগাদ কবি ফরহাদ মজহার তাদের রেস্তোরাঁয় আসেন। এ সময় তাকে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। মেন্যু দেখে অর্ডার দেয়ার পর তিনি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। ওয়েটারের ডাকে তার ঘুম ভাঙলে তিনি আহার করে ৯টার মধ্যে বেরিয়ে যান। পরে টিভিতে খবর শুনে ও দেখে তারা ফরহাদ মজহারকে চিনতে পারেন। এদিকে ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক বলেছেন, যে ব্যাগের কথা বলা হচ্ছে তিনি এ ধরনের ব্যাগ ব্যবহার করেন না। তিনি সাধারণত কাঁধে ঝোলানো যায়, এমন ব্যাগ ব্যবহার করেন। ওই ব্যাগে সব সময় বই রাখা থাকে। তার ব্যবহৃত ব্যাগটি বাসায় ছিল। এছাড়া বাসা থেকে বের হওয়ার সময় জব্দ করা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কোনো ব্যাগ ছিল না। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কী আদৌ ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছিলেন? যদি ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে থাকেন, সেটি কোন রঙের ব্যাগ। আর যদি কোনো ব্যাগ না নিয়ে বের হন, সেক্ষেত্রে সেই ব্যাগ তার কাছে এলো কীভাবে? সেই ব্যাগে আবার সাড়ে ১২ হাজার টাকা ও লুঙ্গি পাওয়া গেছে। এগুলো কোত্থেকে এলো। সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই এসব প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর। ব্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ বুধবার বিকালে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ডিবি যদি বলে থাকে সাদা ব্যাগ তবে আমি দ্বিমত করব না। কারণ রাতের বেলা অন্ধকারের মধ্যে ব্যাগের রঙটি আমি ওইভাবে খেয়াল করিনি। এছাড়া অপহরণের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফরহাদ মজহারের অবস্থান ৬ বার শনাক্ত করার পরও কেন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার অভিযান চালায়নি এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। অপহরণের পর ‘মুক্তিপণ’ দাবি নিয়েও উঠেছে নানা প্রশ্ন। তার পরিবারও এখন এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাইছে না। উদ্ধারের পর খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘তিনি (ফরহাদ মজহার) অপহরণের নাটক সাজিয়েছেন। তিনি ঢাকা থেকে খুলনা ভ্রমণ করেছেন।’
এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, তার মতো বয়স্ক মানুষ এভাবে ভ্রমণ করবেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন সময় রহস্যজনক অপহরণের পর উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের ঘটনাগুলোর রহস্য যেমন উদ্ঘাটন হচ্ছে না, এই ঘটনাটির ক্ষেত্রে তা পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান যুগান্তরকে বলেন, গুম ও অপহরণের প্রবণতা বেশি এমন শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ঘটনাগুলোর রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না। আবার দেখা যাচ্ছে, অপহরণের দীর্ঘ সময় পর যাদের পাওয়া যাচ্ছে তারা মুখ খুলছেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব রহস্য উদ্ঘাটন করছে না। অপহরণের শিকার ব্যক্তি হয়তো সন্ত্রাসী বা যারা অপহরণ করেছে তাদের ভয় পাচ্ছে। তারা ভাবছেন বেঁচে ফিরেছি, এখন এ নিয়ে আর নতুন করে ঝামেলায় যেতে চান না। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেও অনেকেই মুখ খুলছেন না। ফরহাদ মজহারের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। উল্লেখ্য, সোমবার ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগর এলাকায় খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর প্রথমে ফরহাদ মজহারকে খুলনায় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে সেখান থেকে মঙ্গলবার সকালে তাকে ঢাকার আদাবর থানায় আনা হয়। পরে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে আদালতে পাঠানো হলে সেখানে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
আরও যেসব প্রশ্ন : কারা, কেন অপহরণ করেছে এর উত্তর এখনও নেই। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এ বিষয়েও অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফরহাদ মজহার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়টি তিনি কীভাবে নিশ্চিত হয়েছেন, সে ব্যাপারে তিনি (ফরহাদ মজহার) বিস্তারিত বলেননি। এ ছাড়া খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, তার কালো রঙের ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ফরহাদ মজহার কখনও শার্ট পরেন না বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তার কাছে ওই শার্ট কিভাবে এলো- এ প্রশ্নের উত্তর নেই। ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক দাবি করেছেন, উদ্ধারের পর যে পাঞ্জাবি তার গায়ে ছিল এ ধরনের পাঞ্জাবি তিনি পরেন না। তাহলে ওই পাঞ্জাবি এলো কোত্থেকে? ফরহাদ মজহারকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়েছিল বলে তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন। খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ বলেছেন, তিনি গাবতলী থেকে নিজেই খুলনা গিয়েছেন। আবার ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, তাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে খুলনা নেয়া হয়েছে। তাকে কীভাবে খুলনায় নেয়া হল- এ বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। যদি মাইক্রোবাসে নেয়া হয় তবে সেই মাইক্রোবাসটি কোথায়? সেটি উদ্ধারে তৎপরতা চলছে কিনা? এসব বিষয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদককে বারডেম হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য ফরহাদ মজহার শারীরিক অসুস্থতার কারণে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এ বিষয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার সুস্থ হলে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে। মাইক্রোবাসের বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহারকে হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার সঙ্গে কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি মাইক্রোবাসে করে খুলনা এসেছিলেন কিনা এটা আমরা নিশ্চিত নই। মামলার তদন্তের দায়িত্বে আমরা নেই। এ কারণে মাইক্রোবাসের বিষয়ে আমরা খোঁজ করছি না।
মুক্তিপণ নিয়ে প্রশ্ন : ফরহাদ মজহারকে অপহরণের পর তার স্ত্রী ফরিদাকে ফোন করে বলেছিলেন, ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে ছেড়ে দেবে। তাহলে মুক্তিপণ ছাড়াই কেন তাকে ছেড়ে দেয়া হল- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ ও ফরহাদ মজহার নিজেও জবানবন্দিতে বলেছেন, ফরহাদ মজহার নিজেই অপহরণকারীদের মুক্তিপণের কথা বলেছিলেন। পরে তারা তাতে রাজি হয়েছিল। কেন মুক্তিপণ না দিয়েই অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিল। এই দুই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তবে পরিবার ধারণা করছিল, মুক্তিপণ নেয়া মূল উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল। বাসের টিকিট নিয়ে বিভ্রান্তি : ফরহাদ মজহার আদালতে দাবি করেছেন, অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেয়ার পর ঢাকায় ফেরার টিকিট কেটে দিয়েছিল। অন্যদিকে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ফরহাদ মজহার নিজেই বাসের টিকিট কিনেছিলেন। যখন ফরহাদ মজহার টিকিট কাটেন তখন খুলনা ও যশোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উদ্ধারে অভিযানে নেমেছিল। তারপরও অপহরণকারীরা ফরহাদ মজহারকে কীভাবে টিকিট কিনে দিয়েছিল- এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। ফরহাদ মজহার যে বাসে ঢাকায় ফিরছিলেন ওই বাসে আরও দু’জন যাত্রী ছিলেন। সেই দু’জন যাত্রীর পরিচয় কী?
ফরহাদ মজহার কেন আতঙ্কিত : ফরহাদ মজহার উদ্ধার হওয়ার পর থেকে তিনি ভয়ে আছেন, আতঙ্কে আছেন। তিনি কেন আতঙ্কে আছেন? তিনি কী অপহরণকারীদের চেনেন? যদি তিনি চিনে থাকেন তবে তাদের নাম বলছেন না কেন? অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরহাদ মজহারকে বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ অপহরণ করেছিল। হয়তো ভয় দেখানোর জন্যই এটা করেছে। এ কারণে তিনি আতঙ্কে আছেন। হয়তো পরিবারের কথা চিন্তা করে তিনি পুরো বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করছেন।
দীর্ঘ সময় পর অভিযান নিয়ে প্রশ্ন : সোমবার ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর প্রযুক্তির সহায়তায় মোট ছয়বার তার অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। প্রথমে তার অবস্থান ছিল গাবতলী, পরে মানিকগঞ্জ, দৌলতদিয়া ঘাট, ফরিদপুর, যশোর এবং সর্বশেষ অবস্থান ছিল খুলনা। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, বেলা ৩টার পর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ এলে সবাই তৎপর হয়। ওই সময় সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়। এদিকে ফরহাদ মজহার সোমবার রাত ৮টার দিকে খুলনা নগরের নিউমার্কেটের উত্তর পাশে অবস্থিত গ্রিল হাউস নামের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খান। এ সময় র্যাব তার অবস্থান শনাক্ত করে আশপাশের এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিল। ওই সময় তারা কেন খুঁজে পায়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে র্যাব-৬-এর অপারেশন অফিসার সিনিয়র এএসপি খন্দকার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার যখন খাচ্ছিলেন তখন তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। এর কিছুক্ষণ আগে হোটেল থেকে একটু দূরে তার অবস্থান আমরা শনাক্ত করি। ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটি রহস্যজনক। আমরা তদন্ত করছি। নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমরা।’
আরও যেসব প্রশ্ন : কারা, কেন অপহরণ করেছে এর উত্তর এখনও নেই। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল এ বিষয়েও অন্ধকারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ফরহাদ মজহার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, সরকারকে বিব্রত করতে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তবে এ বিষয়টি তিনি কীভাবে নিশ্চিত হয়েছেন, সে ব্যাপারে তিনি (ফরহাদ মজহার) বিস্তারিত বলেননি। এ ছাড়া খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানিয়েছিলেন, তার কালো রঙের ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। ফরহাদ মজহার কখনও শার্ট পরেন না বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তার কাছে ওই শার্ট কিভাবে এলো- এ প্রশ্নের উত্তর নেই। ফরহাদ মজহারের মেয়ে সমতলী হক দাবি করেছেন, উদ্ধারের পর যে পাঞ্জাবি তার গায়ে ছিল এ ধরনের পাঞ্জাবি তিনি পরেন না। তাহলে ওই পাঞ্জাবি এলো কোত্থেকে? ফরহাদ মজহারকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়েছিল বলে তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন। খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ বলেছেন, তিনি গাবতলী থেকে নিজেই খুলনা গিয়েছেন। আবার ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন, তাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে করে খুলনা নেয়া হয়েছে। তাকে কীভাবে খুলনায় নেয়া হল- এ বিষয়টি এখনও অস্পষ্ট। যদি মাইক্রোবাসে নেয়া হয় তবে সেই মাইক্রোবাসটি কোথায়? সেটি উদ্ধারে তৎপরতা চলছে কিনা? এসব বিষয়ে কথা বলতে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদককে বারডেম হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য ফরহাদ মজহার শারীরিক অসুস্থতার কারণে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এ বিষয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার সুস্থ হলে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে। মাইক্রোবাসের বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি বুধবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহারকে হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার সঙ্গে কাউকে পাওয়া যায়নি। তিনি মাইক্রোবাসে করে খুলনা এসেছিলেন কিনা এটা আমরা নিশ্চিত নই। মামলার তদন্তের দায়িত্বে আমরা নেই। এ কারণে মাইক্রোবাসের বিষয়ে আমরা খোঁজ করছি না।
মুক্তিপণ নিয়ে প্রশ্ন : ফরহাদ মজহারকে অপহরণের পর তার স্ত্রী ফরিদাকে ফোন করে বলেছিলেন, ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলে ছেড়ে দেবে। তাহলে মুক্তিপণ ছাড়াই কেন তাকে ছেড়ে দেয়া হল- এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ ও ফরহাদ মজহার নিজেও জবানবন্দিতে বলেছেন, ফরহাদ মজহার নিজেই অপহরণকারীদের মুক্তিপণের কথা বলেছিলেন। পরে তারা তাতে রাজি হয়েছিল। কেন মুক্তিপণ না দিয়েই অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিল। এই দুই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। তবে পরিবার ধারণা করছিল, মুক্তিপণ নেয়া মূল উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য টাকা চাওয়া হয়েছিল। বাসের টিকিট নিয়ে বিভ্রান্তি : ফরহাদ মজহার আদালতে দাবি করেছেন, অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দেয়ার পর ঢাকায় ফেরার টিকিট কেটে দিয়েছিল। অন্যদিকে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, ফরহাদ মজহার নিজেই বাসের টিকিট কিনেছিলেন। যখন ফরহাদ মজহার টিকিট কাটেন তখন খুলনা ও যশোরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে উদ্ধারে অভিযানে নেমেছিল। তারপরও অপহরণকারীরা ফরহাদ মজহারকে কীভাবে টিকিট কিনে দিয়েছিল- এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। ফরহাদ মজহার যে বাসে ঢাকায় ফিরছিলেন ওই বাসে আরও দু’জন যাত্রী ছিলেন। সেই দু’জন যাত্রীর পরিচয় কী?
ফরহাদ মজহার কেন আতঙ্কিত : ফরহাদ মজহার উদ্ধার হওয়ার পর থেকে তিনি ভয়ে আছেন, আতঙ্কে আছেন। তিনি কেন আতঙ্কে আছেন? তিনি কী অপহরণকারীদের চেনেন? যদি তিনি চিনে থাকেন তবে তাদের নাম বলছেন না কেন? অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফরহাদ মজহারকে বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ অপহরণ করেছিল। হয়তো ভয় দেখানোর জন্যই এটা করেছে। এ কারণে তিনি আতঙ্কে আছেন। হয়তো পরিবারের কথা চিন্তা করে তিনি পুরো বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করছেন।
দীর্ঘ সময় পর অভিযান নিয়ে প্রশ্ন : সোমবার ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার পর প্রযুক্তির সহায়তায় মোট ছয়বার তার অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। প্রথমে তার অবস্থান ছিল গাবতলী, পরে মানিকগঞ্জ, দৌলতদিয়া ঘাট, ফরিদপুর, যশোর এবং সর্বশেষ অবস্থান ছিল খুলনা। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, বেলা ৩টার পর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ এলে সবাই তৎপর হয়। ওই সময় সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়। এদিকে ফরহাদ মজহার সোমবার রাত ৮টার দিকে খুলনা নগরের নিউমার্কেটের উত্তর পাশে অবস্থিত গ্রিল হাউস নামের একটি রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খান। এ সময় র্যাব তার অবস্থান শনাক্ত করে আশপাশের এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিল। ওই সময় তারা কেন খুঁজে পায়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে র্যাব-৬-এর অপারেশন অফিসার সিনিয়র এএসপি খন্দকার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ফরহাদ মজহার যখন খাচ্ছিলেন তখন তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। এর কিছুক্ষণ আগে হোটেল থেকে একটু দূরে তার অবস্থান আমরা শনাক্ত করি। ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘পুরো ঘটনাটি রহস্যজনক। আমরা তদন্ত করছি। নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি আমরা।’
No comments