ফরহাদ মজহার এখনও আতঙ্কগ্রস্ত
রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার এখনও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেননি। তিনি বেশ আতঙ্কগ্রস্ত। সময়ে সময়ে তিনি খেই হারিয়ে ফেলছেন। চিকিৎসকদের ভাষায় তিনি এ মুহূর্তে ‘ট্রুমাটাইজড’ (মানসিক আঘাতে সৃষ্ট স্নায়ুরোগ)। সুস্থ হতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে বুধবার যুগান্তরকে এসব তথ্য দিয়েছেন ফরহাদ মজহারের স্বজনরা। ১৯ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে যশোরের অভয়নগরে তাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর মঙ্গলবার দুপুরে ফরহাদ মজহারকে ঢাকা নিন্ম আদালতে হাজির করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ভিকটিম হিসেবে আদালতে জবানবন্দি নেয়া হয়। এছাড়া এদিন একই আদালতে ফরহাদ মজহারকে নিজ জিম্মায় যাওয়ার অনুমতি দেন। শারীরিকভাবে অসুস্থবোধ করায় ওই দিন (মঙ্গলবার) রাতেই তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের ১১০৬ নম্বর কেবিনে ইন্টারনাল মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. একেএম মুসার তত্ত্বাবধানে আছেন। তবে তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে চাননি। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনায় আদাবর থানায় করা মামলার তদন্ত কাজ আজ বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিক শুরু করতে যাচ্ছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ফরহাদ মজহার সুস্থ হলে তাকে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদও করবে ডিবি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান তার কেবিনে আসেন। তার চিকিৎসার সার্বিক খোঁজখবর নেন এবং তার কক্ষে যেন কোনো দর্শনার্থী না আসেন, সে বিষয়ে রোগীর স্বজনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনার পর পরই সংশ্লিষ্টরা ফরহাদ মজহারের কেবিনে কঠোর নাজরদারি করছেন। এমনকি কেবিনের প্রবেশপথে ‘পরিচিতি বোর্ড’-এ তার কেবিন নম্বরের ফোল্ডারের স্থানটি ফাঁকা রাখা হয়েছে। ফরহাদ মজহারের বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে কেবিনে অবস্থানকারী বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের পরিচালক সীমা দাস সিমু যুগান্তরকে বলেন, তিনি এখনও ট্রুমাটাইজড অবস্থায় রয়েছেন। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি আতঙ্কগ্রস্ত। কিছুক্ষণ পর পর চমকে ওঠেন। তার জীবনে যে অস্বাভাবিক অবস্থা ঘটেছে, এখনও সেই ঘোর কাটেনি। কথা বলতে গেলে তিনি গুলিয়ে ফেলছেন। সীমা জানান, তিনি আগে থেকে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের রোগী। নিখোঁজ হওয়ার পর প্রায় ২৪ ঘণ্টা তার কোনো ওষুধ খাওয়া হয়নি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে এর প্রভাব পড়েছে। তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার হার্টে ছোট একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে চিকিৎসকরা তার শারীরিক অবস্থার আপডেট জানাবেন। এর বাইরে আমরা আর কিছু বলতে পারছি না। অপহরণ সম্পর্কে ফরহাদ মজহার কিছু বলেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবারের সঙ্গে এনিয়ে তেমন কথা হয়নি। তবে সুস্থ হয়ে তিনি প্রেস ব্রিফিং করে বিস্তারিত জানাবেন। এক প্রশ্নের উত্তরে সীমা বলেন, তাকে ঢাকায় আনার পর থেকেই তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তিনি যখন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন, তখনও তার শরীর খারাপ ছিল। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিতে চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে এখানে ভর্তি করার পরামর্শ দেয়া হয়। ফরহাদ মজহারকে একবার দেখতে চাইলে সীমা দাশ বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশনা আছে কেবিনে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পরে। কেবিনের সামনে ওয়াকিটকি হাতে একজন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে গোয়েন্দাবাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেন। তিনি জানান, গত রাত থেকেই এখানে পালাক্রমে ডিউটি করা হচ্ছে। তিনি এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি। সকাল থেকে ফরহাদ মজহারকে দেখতে কারা এসেছিলেন জানতে চাইলে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মী জানান, এখানে যেন কেউ না আসেন, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। তিনটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারি করা হচ্ছে। এছাড়া কেবিনে কেউ ঢুকতে গেলে নার্সেস স্টেশন থেকেও বাধা দেয়া হচ্ছে। এমনকি নার্সেস স্টেশন থেকে এই প্রতিবেদককেও সেখানে অবস্থান করতে বাধা দেয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের অপর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, হাসপাতালে ও ডায়াবেটিক সমিতিতে ফরহাদ মজহারের অনেক সুহৃদ আছেন। গোয়েন্দা নজরদারির কারণে তাকে দেখতে যেতে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। ডিবির আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু : ফরহাদ মজহার অপহরণের ঘটনায় আজ বৃহস্পতিবার থেকে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বুধবার যুগান্তরকে এ তথ্য জানিয়ে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে ডিবি আগে থেকেই ছায়া তদন্ত করছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নির্দেশে মামলাটি ডিবিতি হস্তান্তর হওয়ার পর বুধবার রাতে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র থানা পুলিশের কাছ থেকে ডিবিতে এসেছে। রাতেই ওইসব কাগজপত্র ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করেছেন। একই ধরনের তথ্য জানিয়েছেন ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান। ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, প্রাথমিকভাবে পুরো বিষয়টিই রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। ফরহাদ মজহারকেও অসুস্থ মনে হচ্ছে। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এর পরই ঘটনার রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। বারডেম হাসপাতালের যে কেবিনে ফরহাদ মজহার চিকিৎসাধীন রয়েছেন, সেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো পাহারা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত তাকে ব্যক্তিগত জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে। আদালত তাকে পুলিশি পাহারা দেয়ার নির্দেশ দেননি। তাই তার কেবিনে পুলিশি পাহারার প্রশ্নই আসে না। ফরহাদ মজহারের কেবিনের আশপাশে সাংবাদিক প্রবেশে কড়াকড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একান্তই বারডেম কর্তৃপক্ষের বিষয়। এক প্রশ্নের জবাবে ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, তার কাছ থেকে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে সবই পুলিশ জব্দ করেছে। তবে পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত কমিশনার ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, ফরহাদ মজহারের কাছ থেকে কেবল মোবাইল ফোনটি জব্দ করা হয়েছে। অন্য জিনিসপত্র তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদিকে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, সবাই নানাভাবে বিষয়টি জটিল করার চেষ্টা করছেন। তাই এ নিয়ে এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলতে চাই না। ফরহাদ মজহার সুস্থ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সবকিছু জানানো হবে। প্রসঙ্গত, গত সোমবার ভোরে মোহাম্মদপুর রিং রোডের হক গার্ডেনের নিজ বাসা থেকে ওষুধ কেনার উদ্দেশে বের হন ফরহাদ মজহার। এরপর ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে তিনি তার স্ত্রীকে ফোন করে জানান, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে মেরে ফেলবে।’ পরে তার স্ত্রী ফরিদা আখতার আদাবর থানায় অভিযোগ করেন। পরবর্তী সময়ে এ অভিযোগটি মামলা হিসেবে নেয়া হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যশোর নওয়াপাড়া থেকে তাকে উদ্ধার করে আদাবর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর মঙ্গলবার তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জবানবন্দি দেয়ার জন্য ফরহাদ মজহারকে আদালতে পাঠানো হয়। জবানবন্দি দেয়ার পর তিনি নিজ জিম্মায় যাওয়ার আবেদন করলে শুনানি শেষে ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় তাকে ছাড়া হয়।
No comments