ওরা আমাকে চড় থাপ্পড় মারে, বলে তুই বাড়াবাড়ি করছিস
বিশিষ্ট কবি ও লেখক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘যারা আমাকে তুলে নিয়েছিল, তারা টাকার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। কারণ তারা টাকার জন্য আমাকে চাপ দেয়নি। আমি নিজেই তাদের টাকা অফার করেছিলাম। আমার কাছে সবচেয়ে যেটি বেশি মনে হচ্ছে সেটি হল- যারা বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না, তারা সরকারকে দেশের মধ্যে ও বিশ্ব দরবারে বিব্রত করানোর জন্য আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।’ মঙ্গলবার আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে আদাবর থানায় ১৬১ ধারায় পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেন ফরহাদ মজহার। আদালত ও পুলিশের জবানবন্দিতে তিনি প্রায় একই কথা বলেন। তবে পুলিশের জবানবন্দির গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আদালতে বলেননি। পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ বলেন, মাইক্রোবাসে তুলে দরজা বন্ধ করেই আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে এবং গালাগাল করতে থাকে। বলে, তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। অপহরণের ১৯ ঘণ্টা পর সোমবার রাতে যশোর থেকে উদ্ধার হন ফরহাদ মজহার। ওই রাতেই তাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর মঙ্গলবার সকালে তাকে আদাবর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পুলিশের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন ফরহাদ মজহার। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে।
সেখানে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিকালে হাজির করা হয় আদালতে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. আহ্সান হাবীবের খাস কামরায় তিনি জবানবন্দি দেন। আদালত ও পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দির কপি যুগান্তরের হাতে এসেছে। এতে ফরহাদ মজহার যা বলেছেন তা হুবহু তুলে ধরা হল- আদালতে জবানবন্দি : আমি পেশায় একজন লেখক ও গবেষক। আমি ২/৭/২০১৭ তারিখ দুুুপুর ২টা ৫০ মিনিট থেকে ৩ ঘটিকার সময় আমার বাসায় ফিরি। ওইদিন আর বাসা থেকে বের হইনি। রাত অনুমান ৯টার দিকে আমি ও আমার স্ত্রী ঘুমাতে যাই। আমি ৩/৭/২০১৭ তারিখে অনুমান ৩টা থেকে সাড়ে ৩টায় ঘুম থেকে ওঠে কম্পিউটারে লেখালেখির কাজ শুরু করি। আমি ফজরের আজান পর্যন্ত কাজ করি। আজানের পর পরই আমার চোখের ওষুধ কেনার জন্য ও হাঁটাহাঁটির জন্য ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশের ফার্মেসির উদ্দেশে বাসা থেকে বের হই। আমি বাসার কাউকে কিছু না বলেই বের হই, তবে স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বাইরে যাওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিই। আমার চোখ শুকিয়ে যাওয়ার কারণে আমি নিয়মিত চোখের ড্রপ ব্যবহার করি। আমার চারতলা বাসা থেকে লিফটে নিচে নামি। তারপর বাসার দারোয়ান আমাকে দেখে মেইন গেট খুলে দিলে আমি বাসা থেকে বের হয়ে পূর্ব (বাম) দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল মেডিকেল হাসপাতালের দিকে হেঁটে রওনা হই। আমি গোল্ডেন স্ট্রেটের গলির কাছাকাছি পৌঁছামাত্র একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস আমার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং কিছু বুঝে উঠার আগে তিনজন লোক নেমে আমাকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। আমাকে সিটের মাঝখানে বসিয়ে দু’জন আমার দু’পাশে বসে। তারা আমাকে চিৎকার করতে নিষেধ করে। গাড়ি যখন চলা শুরু করে, তখন তারা আমার মাথা নিচের দিকে রাখতে বলে। এ সময় আমি আমার স্ত্রীকে ফোন করি এবং বলি আমাকে কারা যেন নিয়ে যাচ্ছে এবং মেরে ফেলবে। সঙ্গে সঙ্গে একজন আমার ফোন কেড়ে নেয় এবং আমার চোখ বেঁধে ফেলে।
এর অনুমান এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর আমি তাদের বলি, টাকা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও। তারা আমাকে টাকা কোথায় পাব বলে জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি, আমার স্ত্রী জোগাড় করবে। তারা ৩৫ লাখ টাকার বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। তারা আমার স্ত্রীকে আমার মোবাইল ফোন থেকে কল দিয়ে আমার কানে ধরিয়ে দেয়। তখন স্ত্রীকে ৩৫ লাখ টাকা রেডি রাখতে বলি। আমি টাকা জোগাড়ের অজুহাতে বারবার ফোনে কথা বলতে চাচ্ছিলাম; কিন্তু তারা আমাকে ৩-৪ বার কথা বলতে দিয়েছে। যারা আমাকে তুলে নিয়েছিল তারা টাকার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। কারণ তারা টাকার জন্য আমাকে চাপ দেয়নি। আমি নিজেই তাদের টাকা অফার করেছিলাম। গাড়ি চলতে চলতে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা আমাকে খুলনায় নামিয়ে দেয়। এ সময় তারা বলে ‘আমরা আশপাশে আছি। সোজা ঢাকা চলে যাবি।’ তারা আমাকে হানিফ পরিবহনের একটা টিকিট ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। উল্লেখ্য, আমাকে ঢাকা থেকে উঠানোর পর মাইক্রোবাসটি খুলনা ব্যতীত আর কোথাও থামেনি। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে রিকশাওয়ালার কাছ থেকে ওই জায়গার পরিচয় পাই। তাকে জিজ্ঞাসা করে একটা খাবারের দোকানে (গ্রিল হাউস) খাবার খাই।
আমার সঙ্গে থাকা ব্যাগটি সঙ্গেই ছিল। তারা আমার ব্যাগে হাত দেয়নি। আমার ব্যাগে যা ছিল, তা অটুট ছিল। খাবার দোকান থেকে আমি রিকশা করে হানিফ (শিববাড়ী) কাউন্টারে আসি। আমার ফোনটি ব্যাগে ছিল। ফোন বের করে দেখি চার্জ নেই। তখন আমি ব্যাগ থেকে চার্জার বের করে মোবাইলে চার্জ দিই। আমি অনুমান রাত সোয়া ৯টার দিকে হানিফ পরিবহনের বাসে উঠি। আমি বাসে উঠে সিটে শুয়ে পড়ি। বাস চলতে শুরু করে। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। একপর্যায়ে আমি চোখ খুলে দেখি, আমার সামনে ৩-৪ জন ব্যক্তি এবং তাদের মধ্যে একজন আমি ফরহাদ মজহার কিনা জানতে চাইলে উত্তরে হ্যাঁ বললে তারা আমাকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে এলে র্যাব ও পুলিশের অনেক লোক দেখতে পাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আমাকে অভয়নগর থানায় নিয়ে যায়। আমার সঙ্গে যে মোবাইল ছিল তার নম্বর ০১৮৮৩০৮৬৪৮০। আমি এ ফোনটি মাঝেমধ্যে ব্যবহার করি। আমি সব সময় অন্য নম্বরের একটি ফোন ব্যবহার করি। সেটি রবি অপারেটরের একটি নম্বর। ওই নম্বর থেকে আমি পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলি। যারা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তাদের চিনি না। তারা আমাকে কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়াই ছেড়ে দেয়। আমার কাছে সবচেয়ে যেটি বেশি মনে হচ্ছে সেটি হল- যারা বর্তমান সরকারকে পছন্দ করে না তারা সরকারকে দেশের মধ্যে ও বিশ্ব দরবারে বিব্রত করানোর জন্য আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এরপর ফরহাদ মজহার স্বাক্ষর করেন। পাশেই ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহা. আহ্সান হাবীবের স্বাক্ষর। পরের প্যারায় লেখা রয়েছে, ভিকটিমের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পর পাঠ করে শুনানো হলে সঠিক বলে জানায় এবং স্বাক্ষর করে। পরে আবারও ফরহাদ মজহার এবং ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষর রয়েছে। আদালতে দেয়া জবানবন্দির শুরুতে বলা হয়, সূত্র আদাবর থানার মামলা নং ০৪, তারিখ ০৩/০৭/২০১৭, ধারা ৩৬৫/৩৮৫ পেনাল কোড। বয়স আনুমানিক ৭০ বছর। নাম মো. মাজহারুল হক ওরফে ফরহাদ মজহার, পিতা মৃত মফিজুল হক, ফ্ল্যাট নং-০৪ এ-বি হক গার্ডেন, ১নং রিং রোড শ্যামলী, ঢাকা। ১৬১-এ আরও যা রয়েছে : পুলিশের কাছে জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, মাইক্রোবাসে তোলার পর তাদের জিজ্ঞেস করি কোনো টাকা-পয়সা নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেবেন কিনা। তারা আমাকে টাকা কোথায় পাব জিজ্ঞাস করলে, আমি উত্তরে বলি, আমার স্ত্রীকে ফোন করতে হবে। তারা আমাকে ১/২ কোটি টাকার কথা বলে। আমি অপারগতা প্রকাশ করে ৩০-৩৫ লাখ টাকা দিতে পারব বলে জানাই। আজকের মধ্যেই তারা ৩৫ লাখ টাকা দিতে বলে। তারা আমার কানে ফোন ধরিয়ে দিলে আমি আমার স্ত্রীকে বলি, ৩৫ লাখ টাকা চায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেড়ে নেয়। আমি কৌশলে বারবার ফোন ব্যবহার করতে চেয়েছি, যাতে সহজেই আমার অবস্থান শনাক্ত করা যায়। আমার চোখ বাঁধা থাকায় কোন দিকে গাড়ি যাচ্ছে বুঝতে পারিনি। পথিমধ্যে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য বলি এত টাকা জোগাড় করতে সময় দিতে হবে। ব্যাংক খোলা নেই। তবে তারা টাকার জন্য খুব বেশি চাপ দিচ্ছিল না। গ্রিল হাউসে খাবার খাওয়া পর্যন্ত উভয় জবানবন্দি প্রায় একই। তবে এরপর পুলিশের জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, আমি কাউন্টারে প্রায় আধা ঘণ্টা ছিলাম। আমি বাসে শুয়ে পড়ি। কোনো হুঁস ছিল না, ফোন করার মতো কোনো ... ছিল না। মাইক্রো থেকে নামার পর ফোনে চার্জ না থাকায় কোনো ফোন করতে পারিনি।
No comments