বাংলাদেশে আইএসের হুমকি, সরকারের অস্বীকার -নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধ by এলেন ব্যারি
২৩ অক্টোবর শুক্রবার রাতে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতিতে হোসনি দালানে শিয়াদের সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে |
যুক্তরাষ্ট্রের
কর্মকর্তারা গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে বলেছেন, তাঁদের
কাছে এমন খবর আছে, যাতে ইঙ্গিত মেলে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে জঙ্গিগোষ্ঠী
ইসলামিক স্টেট তাদের তৎপরতা সম্প্রসারণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরের দিনগুলোতে বেশ কয়েকটি অস্বাভাবিক হামলা ও হুমকি প্রদানের ঘটনা ঘটেছে, যাতে দৃশ্যত ওই সতর্কবার্তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। একজন ইতালীয় সাহায্য সংস্থার কর্মী ঢাকা শহরের কূটনৈতিকপাড়ায় গুলিতে নিহত হয়েছেন। এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন জাপানি কৃষিবিদ। এ ছাড়া গত সপ্তাহে ঢাকায় শিয়া মুসলিমদের একটি বিরাট সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। অথচ ঘটনাস্থলে ছিল পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি। নিরাপত্তার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে চালানো এই হামলায় একজন কিশোর নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু লোক আহত হয়। (এ ঘটনায় পরে আরও একজন মারা যায়)
প্রতিটি হামলার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলোর দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই দায় স্বীকার করা হয়েছে, সেগুলো ওই সন্ত্রাসীদেরই বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন। এমনকি বিদেশি দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিলেও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, দেশে ইসলামিক স্টেট, আইএসআইএস বা আইএসআইএলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাঁদের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্র অতীতেও ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছে। যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে অভিযান চালানোর আগে।
উপরন্তু, শেখ হাসিনা এসব ঘটনাকে তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের একটা ষড়যন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন। তিনি গত বুধবার (২৮ অক্টোবর) বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এটা অব্যাহত থাকবে। আমাকে একটি কথা বলার সুযোগ দিন: দুটি বোমা বা পাঁচটি ডিম নিক্ষেপের ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। যারা এমনটি মনে করছে, তারা ভুল করছে।’
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই সংযোগ-বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও দ্বিধাগ্রস্ত করছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সম্প্রসারণ ঠেকানোর চেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে। তাদের উত্থানের পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর। সেটা হলে বছরের পর বছরের চেষ্টায় অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্টোপথে হাঁটতে পারে।
দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কিছু সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের উৎপাতে জর্জরিত। কিছু ক্ষেত্রে তাদের বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর চলতি বছর সন্ত্রাসীরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। তারা এমন চারজনকে হত্যা করেছে, যাঁরা ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একই সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন এবং আরও কিছু শহরে কিছু বাংলাদেশি প্রবাসীর অস্তিত্ব শনাক্ত করেছে, যারা ইসলামিক স্টেটের তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে। তাদের কেউ কেউ জঙ্গিগোষ্ঠীটির জন্য সদস্য সংগ্রহ করে, অন্যরা সরাসরি যোদ্ধা।
এসব গোষ্ঠীর মধ্যে নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে তা বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে, যে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই সুন্নি।
ঢাকায় নিযুক্ত একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা ইসলামিক স্টেটের দাবিগুলোকে গুরুত্বসহকারে নিচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা বিশ্বব্যাপী ডানা মেলছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত এসব যোগাযোগের প্রমাণগুলো বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে। পুলিশ এরই মধ্যে আইএসের ৩০ জনের বেশি অনুসারীকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী এবং তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। এসব ব্যক্তি সিরিয়া বা আফগানিস্তানে জঙ্গিদের পক্ষে লড়াই করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। তিনি বলেন, তাঁরা আইএসের পক্ষে লন্ডনভিত্তিক একজন সদস্য সংগ্রহকারীকেও গ্রেপ্তার করেছেন। ওই ব্যক্তি ছেলেদের দলে ভেড়াতে বাংলাদেশে এসেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলছেন, বাংলাদেশে বড় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ‘সাংগঠনিক উপস্থিতি’ আছে, এ বিষয়ে তিনি ‘খুবই সন্দিহান’। কিন্তু অভ্যন্তরীণ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এসব বড় গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে যে খুবই আগ্রহী, সেটাও মনে করেন তিনি। আলী রীয়াজ বলেন, ‘সুযোগ সামনে এলে এবং পথ খুঁজে পেলে, এসব স্থানীয় গ্রুপ আইএসের সহযোগী হতে সময়ক্ষেপণ করবে না।’
গত মাসের সতর্কবার্তা জারির ঘটনাগুলো বাংলাদেশ ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান পারস্পরিক সুগভীর সন্দেহ-অবিশ্বাসেরই একটা ইঙ্গিত। যদিও তারা সবাই সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে আসছে।
মাস খানেক আগে কথিত ‘ফাইভ-আইস’ জোটের (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত) গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য পায়, বাংলাদেশে বিদেশিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে জঙ্গিরা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর, অস্ট্রেলিয়া তার নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণবার্তা হালনাগাদ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ‘অস্ট্রেলীয়দের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার তথ্য বিশ্বাসযোগ্য’। টেস্ট খেলতে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের ঢাকা সফরের প্রস্তুতিকালে ওই তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
মনে করা হচ্ছিল, জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ‘গ্লিটার বল’। ‘গ্লিটার বল’ হচ্ছে একটি বার্ষিক কসটিউম পার্টি, যেটি বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নাগরিকদের জন্য অনুরূপ সতর্কবার্তা জারি করে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার ‘জঙ্গি ভীতি’কে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেন। ওই সময় আমেরিকার কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র সফররত শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী কর্মকর্তাদের কাছে হুমকির বার্তাটি পৌঁছে দেন। শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) মনে করেছিলেন ওই সতর্কবার্তাগুলো সুনির্দিষ্ট নয় এবং হতাশাজনক। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য দিতে পারেনি, যার ওপর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ তারা ওই তথ্য কোথা থেকে এল, তা-ও বলেনি।
এক সাক্ষাৎকারে গওহর রিজভী বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে আমাদের একটা লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এ ঘটনায় কেন আপনারা একতরফা পদক্ষেপ নিলেন? কেন আপনারা তথ্য আদান-প্রদান করলেন না?’ তিনি যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে অতীতে ‘বিশ্বের বিশ্বাসপ্রবণতার পরীক্ষা’ হয়ে গেছে। ইরাকযুদ্ধের আগে দেশটিতে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে দাবি তুলেছিল, তার প্রতি ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে রিজভী প্রথমে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৫ বা ২৬ সেপ্টেম্বর ওই ব্রিফিং করেছিল। কিন্তু পরে তিনি বলেন, সেটি হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর।
এই ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাতেই ঢাকায় খুন হয়েছিলেন ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা। ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় হাঁটার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর সন্দেহভাজন ইসলামিক স্টেটের কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে এ ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়। মুঠোফোনে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ ‘টেলিগ্রামের’ একটি অ্যাকাউন্টে এবং টুইটারের দুটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই দায় স্বীকার করা হয় বলে জানিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ, যারা অনলাইনে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রোপাগান্ডা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের এসব বার্তা নির্ভরযোগ্য নয়। জাপানি নাগরিক হত্যা এবং শিয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশস্থলে হামলার পর জঙ্গিরা দায় স্বীকার করলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা তখনো একই কথা বলেছেন।
উপদেষ্টা রিজভী বলছেন, বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের উপস্থিতির সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিলে তা হবে ‘হঠকারিতা’। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন তিনি। তাঁর মতে, এখানে অন্যতম তত্ত্বটা হচ্ছে, বিরোধী শক্তিগুলো শেখ হাসিনাকে সংকটে ফেলার চেষ্টা করছে।
গওহর রিজভী বলেন, ‘নিচু সারির কেউ বলে থাকতে পারে, ‘চলেন, কিছু বিশৃঙ্খলা উসকে দিই। এই সরকার তো সংবাদমাধ্যমে অনেক বেশি প্রচার পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ছিল তাঁর (শেখ হাসিনার) জন্মদিন। যেদিন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেদিন এটা ঘটেছিল।’
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের অভিযোগ, যখন সতর্কবার্তাটি আসে, তখন তাবেলা হত্যা এড়ানোর মতো সময় আর হাতে ছিল না। তিনি বলেন, ‘ঘটনার আগেই তাদের উচিত ছিল নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তারা সেটা করলে হয়তো ওই হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত।’
বাংলাদেশের সমালোচনার বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলতে রাজি হননি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন মুখপাত্র ন্যান্সি ভ্যানহর্ন। এমনকি গোয়েন্দা তথ্য সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর কারণে বাংলাদেশকে সমালোচনা করতেও অস্বীকৃতি জানালেন তিনি।
মুখপাত্র বলেন, ‘বিদেশি সরকারগুলো তাদের কাছে যেসব তথ্য ছিল, তা তাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের কাছে প্রদান করেছে। কিন্তু এটা স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বাংলাদেশে যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধ করা বিশেষভাবে কঠিন। আমরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি।’
ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সিগফ্রিড ও. উলফ বলছেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশ থেকে পাওয়া স্পর্শকাতর তথ্যগুলো এই ভয়ে চাপা রেখেছিল যে সেগুলোর অপব্যবহার হতে পারে। কারণ, দেশটি এখন চরম রাজনৈতিক মেরুকরণের কবলে রয়েছে। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ভেতরেও দলাদলি ও শত্রুতা রয়েছে।
আর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে বাংলাদেশে সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকড় অনেক গভীরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই সন্দেহ-অবিশ্বাসের একটি ব্যক্তিগত উপাদানও রয়েছে। এটার শুরু তাঁর বাবা শেখ মুজিবকে (জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান) ১৯৭৫ সালে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটা হাত ছিল বলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সন্দেহ থেকে। আর অতি সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তাঁর দলের জয় নিয়ে ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া এবং পোশাকশিল্প খাতে দেওয়া বাণিজ্যিক সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনাগুলোতে তিনি হতাশ হয়েছেন।
জঙ্গিদের বিষয়ে শেখ হাসিনার সন্দেহকে সমর্থন করেছে কিছু দেশ। ঢাকায় রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার এ. নিকোলায়েভ ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হুমকির বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করেছে। দুই বিদেশি হত্যার ঘটনার পর তিনি এ–ও মন্তব্য করেছেন যে ‘দুই ফোঁটা জল পড়ার অর্থই বৃষ্টিপাত নয়’।
এক মাসের বেশি সময় পার হওয়ায় বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কগুলো এখন কমে এসেছে। তাঁরা এখন ঢাকার বিপণিবিতান ও পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে আবার যাওয়া-আসা শুরু করেছেন। তবে এখনো তাঁরা রাস্তায় হাঁটেন না, স্কুটারে চড়েন না, বাইসাইকেল-রিকশায় চড়েন না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি পোশাকশিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিমা কিছু ক্রেতা তাদের বার্ষিক সফর বাতিল করেছে। শীতকাল সামনে রেখে পোশাক আমদানির জন্য এই বার্ষিক সফরকে সাধারণত ব্যবহার করে থাকে তারা।
এখানকার কূটনীতিকেরা বলছেন, হুমকি এখনো মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। প্রটোকলের কারণ দেখিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, এই সর্বোচ্চ হুমকিটি ছিল একটি ‘সম্পূর্ণ গেম চেঞ্জার’। এটা বিদেশিদের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করবে। ওই কূটনীতিক বলেন, ‘এটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বোতল থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যটা আবার বোতলে ফিরে যাচ্ছে না।’
জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে যেসব বাংলাদেশি ওয়াকিবহাল, পরস্পরবিরোধী এসব বার্তা তাদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘সরকার যেভাবে ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে যাচ্ছে, তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ চীনের ইসলামপন্থী উইঘুর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নিয়ে নিবন্ধ লেখার পর গত মাসে তিনি নিজেও সন্দেহভাজন আইএস সদস্যদের কাছ থেকে মুঠোফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে একটি হুমকি পেয়েছেন। ‘ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ’ নামে পাঠানো ওই লিখিত বার্তায় বলা হয়, ‘ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী লেখা বন্ধ কর। তা না হলে, আমরা তোমাকে নরকে পাঠানোর জন্য এখানে আছি।’
দুই সপ্তাহ পরে মিজানুর রহমান খান যখন একটি রিকশায় উঠছিলেন, তখন একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তাঁর গতি রোধ করে। ওই ব্যক্তি অস্ত্র উঁচিয়ে তাঁকে হুমকি দেয়। তিনি তখন আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে একটি দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান যখন বিষয়টি পুলিশকে অবগত করেন, তখন পুলিশের একজন কর্মকর্তা তাঁকে রিকশায় আর না চড়ার পরামর্শ দেন। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন। আর পত্রিকার সম্পাদকের পরামর্শে তিনি একেকদিন একেক পথ ব্যবহার করে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করছেন।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘প্রকৃত বিপদ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমরা খুবই কঠিন একটা অবস্থায় রয়েছি। হুমকিটা আসলে কী ছিল, সে বিষয়ে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো কিছুই জানতে পারছি না; যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও নয়। এমনকি সরকারের পদক্ষেপ কী ছিল, কেনই বা তারা সহযোগিতা করছে না, সেসব বিষয়েও কিছু জানা যাচ্ছে না।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: হারুন-অর-রশীদ
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জুলফিকার আলী মানিক ও ওয়াশিংটন থেকে এরিক স্মিডট
এলেন ব্যারি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো-প্রধান।
পরের দিনগুলোতে বেশ কয়েকটি অস্বাভাবিক হামলা ও হুমকি প্রদানের ঘটনা ঘটেছে, যাতে দৃশ্যত ওই সতর্কবার্তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। একজন ইতালীয় সাহায্য সংস্থার কর্মী ঢাকা শহরের কূটনৈতিকপাড়ায় গুলিতে নিহত হয়েছেন। এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন জাপানি কৃষিবিদ। এ ছাড়া গত সপ্তাহে ঢাকায় শিয়া মুসলিমদের একটি বিরাট সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। অথচ ঘটনাস্থলে ছিল পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি। নিরাপত্তার ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকে চালানো এই হামলায় একজন কিশোর নিহত হওয়ার পাশাপাশি বহু লোক আহত হয়। (এ ঘটনায় পরে আরও একজন মারা যায়)
প্রতিটি হামলার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেগুলোর দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট। যেসব অ্যাকাউন্ট থেকে এই দায় স্বীকার করা হয়েছে, সেগুলো ওই সন্ত্রাসীদেরই বলে ধারণা করা হয়।
কিন্তু, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব দাবিকে সন্দেহের চোখে দেখে আসছেন। এমনকি বিদেশি দূতাবাসগুলো তাদের নাগরিকদের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে দিলেও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, দেশে ইসলামিক স্টেট, আইএসআইএস বা আইএসআইএলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাঁদের বক্তব্য, যুক্তরাষ্ট্র অতীতেও ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছে। যেমনটি তারা করেছিল ইরাকে অভিযান চালানোর আগে।
উপরন্তু, শেখ হাসিনা এসব ঘটনাকে তাঁর সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের একটা ষড়যন্ত্র হিসেবে বর্ণনা করে আসছেন। তিনি গত বুধবার (২৮ অক্টোবর) বলেন, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এটা অব্যাহত থাকবে। আমাকে একটি কথা বলার সুযোগ দিন: দুটি বোমা বা পাঁচটি ডিম নিক্ষেপের ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না। যারা এমনটি মনে করছে, তারা ভুল করছে।’
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এই সংযোগ-বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশিদেরও দ্বিধাগ্রস্ত করছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সম্প্রসারণ ঠেকানোর চেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে। তাদের উত্থানের পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর। সেটা হলে বছরের পর বছরের চেষ্টায় অর্জিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্টোপথে হাঁটতে পারে।
দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কিছু সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের উৎপাতে জর্জরিত। কিছু ক্ষেত্রে তাদের বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকার পর চলতি বছর সন্ত্রাসীরা পুনরায় সংগঠিত হয়েছে। তারা এমন চারজনকে হত্যা করেছে, যাঁরা ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একই সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন এবং আরও কিছু শহরে কিছু বাংলাদেশি প্রবাসীর অস্তিত্ব শনাক্ত করেছে, যারা ইসলামিক স্টেটের তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছে। তাদের কেউ কেউ জঙ্গিগোষ্ঠীটির জন্য সদস্য সংগ্রহ করে, অন্যরা সরাসরি যোদ্ধা।
এসব গোষ্ঠীর মধ্যে নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ পর্যায়ের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে তা বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে, যে দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সবাই সুন্নি।
ঢাকায় নিযুক্ত একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা ইসলামিক স্টেটের দাবিগুলোকে গুরুত্বসহকারে নিচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা বিশ্বব্যাপী ডানা মেলছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত এসব যোগাযোগের প্রমাণগুলো বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে। পুলিশ এরই মধ্যে আইএসের ৩০ জনের বেশি অনুসারীকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী এবং তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। এসব ব্যক্তি সিরিয়া বা আফগানিস্তানে জঙ্গিদের পক্ষে লড়াই করতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। তিনি বলেন, তাঁরা আইএসের পক্ষে লন্ডনভিত্তিক একজন সদস্য সংগ্রহকারীকেও গ্রেপ্তার করেছেন। ওই ব্যক্তি ছেলেদের দলে ভেড়াতে বাংলাদেশে এসেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলছেন, বাংলাদেশে বড় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর ‘সাংগঠনিক উপস্থিতি’ আছে, এ বিষয়ে তিনি ‘খুবই সন্দিহান’। কিন্তু অভ্যন্তরীণ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এসব বড় গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে যে খুবই আগ্রহী, সেটাও মনে করেন তিনি। আলী রীয়াজ বলেন, ‘সুযোগ সামনে এলে এবং পথ খুঁজে পেলে, এসব স্থানীয় গ্রুপ আইএসের সহযোগী হতে সময়ক্ষেপণ করবে না।’
গত মাসের সতর্কবার্তা জারির ঘটনাগুলো বাংলাদেশ ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান পারস্পরিক সুগভীর সন্দেহ-অবিশ্বাসেরই একটা ইঙ্গিত। যদিও তারা সবাই সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে আসছে।
মাস খানেক আগে কথিত ‘ফাইভ-আইস’ জোটের (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র এর অন্তর্ভুক্ত) গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য পায়, বাংলাদেশে বিদেশিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে জঙ্গিরা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর, অস্ট্রেলিয়া তার নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণবার্তা হালনাগাদ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে ‘অস্ট্রেলীয়দের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার তথ্য বিশ্বাসযোগ্য’। টেস্ট খেলতে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের ঢাকা সফরের প্রস্তুতিকালে ওই তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছিল।
মনে করা হচ্ছিল, জঙ্গিদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ‘গ্লিটার বল’। ‘গ্লিটার বল’ হচ্ছে একটি বার্ষিক কসটিউম পার্টি, যেটি বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের নাগরিকদের জন্য অনুরূপ সতর্কবার্তা জারি করে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার ‘জঙ্গি ভীতি’কে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেন। ওই সময় আমেরিকার কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র সফররত শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী কর্মকর্তাদের কাছে হুমকির বার্তাটি পৌঁছে দেন। শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) মনে করেছিলেন ওই সতর্কবার্তাগুলো সুনির্দিষ্ট নয় এবং হতাশাজনক। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য দিতে পারেনি, যার ওপর ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ তারা ওই তথ্য কোথা থেকে এল, তা-ও বলেনি।
এক সাক্ষাৎকারে গওহর রিজভী বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করার ক্ষেত্রে আমাদের একটা লম্বা ইতিহাস রয়েছে। এ ঘটনায় কেন আপনারা একতরফা পদক্ষেপ নিলেন? কেন আপনারা তথ্য আদান-প্রদান করলেন না?’ তিনি যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ত্রুটিপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে অতীতে ‘বিশ্বের বিশ্বাসপ্রবণতার পরীক্ষা’ হয়ে গেছে। ইরাকযুদ্ধের আগে দেশটিতে ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র থাকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে দাবি তুলেছিল, তার প্রতি ইঙ্গিত করে এ কথা বলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে রিজভী প্রথমে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৫ বা ২৬ সেপ্টেম্বর ওই ব্রিফিং করেছিল। কিন্তু পরে তিনি বলেন, সেটি হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর।
এই ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাতেই ঢাকায় খুন হয়েছিলেন ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা। ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় হাঁটার সময় তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর সন্দেহভাজন ইসলামিক স্টেটের কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টে এ ঘটনার দায় স্বীকার করা হয়। মুঠোফোনে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ ‘টেলিগ্রামের’ একটি অ্যাকাউন্টে এবং টুইটারের দুটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই দায় স্বীকার করা হয় বলে জানিয়েছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ, যারা অনলাইনে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর প্রোপাগান্ডা পর্যবেক্ষণ করে থাকে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের এসব বার্তা নির্ভরযোগ্য নয়। জাপানি নাগরিক হত্যা এবং শিয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশস্থলে হামলার পর জঙ্গিরা দায় স্বীকার করলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা তখনো একই কথা বলেছেন।
উপদেষ্টা রিজভী বলছেন, বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেটের উপস্থিতির সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিলে তা হবে ‘হঠকারিতা’। কিন্তু সেটার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন তিনি। তাঁর মতে, এখানে অন্যতম তত্ত্বটা হচ্ছে, বিরোধী শক্তিগুলো শেখ হাসিনাকে সংকটে ফেলার চেষ্টা করছে।
গওহর রিজভী বলেন, ‘নিচু সারির কেউ বলে থাকতে পারে, ‘চলেন, কিছু বিশৃঙ্খলা উসকে দিই। এই সরকার তো সংবাদমাধ্যমে অনেক বেশি প্রচার পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা ছিল তাঁর (শেখ হাসিনার) জন্মদিন। যেদিন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেদিন এটা ঘটেছিল।’
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামের অভিযোগ, যখন সতর্কবার্তাটি আসে, তখন তাবেলা হত্যা এড়ানোর মতো সময় আর হাতে ছিল না। তিনি বলেন, ‘ঘটনার আগেই তাদের উচিত ছিল নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। তারা সেটা করলে হয়তো ওই হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত।’
বাংলাদেশের সমালোচনার বিষয়ে সরাসরি কোনো কথা বলতে রাজি হননি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একজন মুখপাত্র ন্যান্সি ভ্যানহর্ন। এমনকি গোয়েন্দা তথ্য সঠিকভাবে কাজে না লাগানোর কারণে বাংলাদেশকে সমালোচনা করতেও অস্বীকৃতি জানালেন তিনি।
মুখপাত্র বলেন, ‘বিদেশি সরকারগুলো তাদের কাছে যেসব তথ্য ছিল, তা তাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের কাছে প্রদান করেছে। কিন্তু এটা স্বীকার করে নেওয়া জরুরি যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বাংলাদেশে যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা প্রতিরোধ করা বিশেষভাবে কঠিন। আমরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি।’
ইউনিভার্সিটি অব হাইডেলবার্গের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সিগফ্রিড ও. উলফ বলছেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বাংলাদেশ থেকে পাওয়া স্পর্শকাতর তথ্যগুলো এই ভয়ে চাপা রেখেছিল যে সেগুলোর অপব্যবহার হতে পারে। কারণ, দেশটি এখন চরম রাজনৈতিক মেরুকরণের কবলে রয়েছে। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ভেতরেও দলাদলি ও শত্রুতা রয়েছে।
আর যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে বাংলাদেশে সন্দেহ-অবিশ্বাসের শিকড় অনেক গভীরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এই সন্দেহ-অবিশ্বাসের একটি ব্যক্তিগত উপাদানও রয়েছে। এটার শুরু তাঁর বাবা শেখ মুজিবকে (জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান) ১৯৭৫ সালে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটা হাত ছিল বলে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান সন্দেহ থেকে। আর অতি সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তাঁর দলের জয় নিয়ে ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া এবং পোশাকশিল্প খাতে দেওয়া বাণিজ্যিক সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘটনাগুলোতে তিনি হতাশ হয়েছেন।
জঙ্গিদের বিষয়ে শেখ হাসিনার সন্দেহকে সমর্থন করেছে কিছু দেশ। ঢাকায় রুশ রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার এ. নিকোলায়েভ ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা হুমকির বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করেছে। দুই বিদেশি হত্যার ঘটনার পর তিনি এ–ও মন্তব্য করেছেন যে ‘দুই ফোঁটা জল পড়ার অর্থই বৃষ্টিপাত নয়’।
এক মাসের বেশি সময় পার হওয়ায় বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কগুলো এখন কমে এসেছে। তাঁরা এখন ঢাকার বিপণিবিতান ও পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে আবার যাওয়া-আসা শুরু করেছেন। তবে এখনো তাঁরা রাস্তায় হাঁটেন না, স্কুটারে চড়েন না, বাইসাইকেল-রিকশায় চড়েন না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি পোশাকশিল্পও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিমা কিছু ক্রেতা তাদের বার্ষিক সফর বাতিল করেছে। শীতকাল সামনে রেখে পোশাক আমদানির জন্য এই বার্ষিক সফরকে সাধারণত ব্যবহার করে থাকে তারা।
এখানকার কূটনীতিকেরা বলছেন, হুমকি এখনো মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। প্রটোকলের কারণ দেখিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, এই সর্বোচ্চ হুমকিটি ছিল একটি ‘সম্পূর্ণ গেম চেঞ্জার’। এটা বিদেশিদের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে স্থায়ীভাবে প্রভাবিত করবে। ওই কূটনীতিক বলেন, ‘এটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না। বোতল থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যটা আবার বোতলে ফিরে যাচ্ছে না।’
জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে যেসব বাংলাদেশি ওয়াকিবহাল, পরস্পরবিরোধী এসব বার্তা তাদের উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘সরকার যেভাবে ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে যাচ্ছে, তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ চীনের ইসলামপন্থী উইঘুর সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে নিয়ে নিবন্ধ লেখার পর গত মাসে তিনি নিজেও সন্দেহভাজন আইএস সদস্যদের কাছ থেকে মুঠোফোনের খুদে বার্তার মাধ্যমে একটি হুমকি পেয়েছেন। ‘ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ’ নামে পাঠানো ওই লিখিত বার্তায় বলা হয়, ‘ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী লেখা বন্ধ কর। তা না হলে, আমরা তোমাকে নরকে পাঠানোর জন্য এখানে আছি।’
দুই সপ্তাহ পরে মিজানুর রহমান খান যখন একটি রিকশায় উঠছিলেন, তখন একজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তাঁর গতি রোধ করে। ওই ব্যক্তি অস্ত্র উঁচিয়ে তাঁকে হুমকি দেয়। তিনি তখন আত্মরক্ষার্থে দৌড়ে একটি দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেন।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান যখন বিষয়টি পুলিশকে অবগত করেন, তখন পুলিশের একজন কর্মকর্তা তাঁকে রিকশায় আর না চড়ার পরামর্শ দেন। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বিরত রয়েছেন। আর পত্রিকার সম্পাদকের পরামর্শে তিনি একেকদিন একেক পথ ব্যবহার করে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করছেন।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘প্রকৃত বিপদ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে আমরা খুবই কঠিন একটা অবস্থায় রয়েছি। হুমকিটা আসলে কী ছিল, সে বিষয়ে আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনো কিছুই জানতে পারছি না; যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও নয়। এমনকি সরকারের পদক্ষেপ কী ছিল, কেনই বা তারা সহযোগিতা করছে না, সেসব বিষয়েও কিছু জানা যাচ্ছে না।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ৩০ অক্টোবর প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: হারুন-অর-রশীদ
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জুলফিকার আলী মানিক ও ওয়াশিংটন থেকে এরিক স্মিডট
এলেন ব্যারি: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো-প্রধান।
No comments