এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার? by মাহমুদুজ্জামান বাবু
নিরাপত্তাহীনতার কথা জানানোর পরও ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং আহমেদুর রশীদ টুটুল ও তার দুই বন্ধুক কীভাবে হামলার শিকার হন |
খুব
ভয় পেয়েছি। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর লালমাটিয়ায় ও শাহবাগের
আজিজ সুপার মার্কেটে দুটি প্রকাশনা সংস্থায় হামলা চালিয়ে তিনজনকে গুরুতর
আহত ও একজনকে খুন করার প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ
সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ শনিবার সন্ধ্যায় বলেছেন, হামলাকারীরা
জামায়াত-বিএনপির অংশ (বিডিনিউজ ২৪ ডটকম, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫)। কুষ্টিয়ায়
জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কার্যালয় উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন,
‘ব্লগারদের বা মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলাকারীরা দেশ ও সরকারকে
অস্থিতিশীল করতে চায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চায়।...কেউ
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কেউ হরকাতুল জিহাদ, কেউ হুজি—বিভিন্ন নাম দিয়ে
নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করছে। এরা জামায়াত-শিবির-বিএনপির খণ্ডিত অংশ,
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। আজকে
ব্লগারদের ওপর হামলা হয়েছে, এটা তাদেরই অংশ।’
দেশের একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জনাব হানিফের এই বক্তব্যের মধ্যেই আছে আমার ভয় পাওয়ার উৎস। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিসে হামলা হয়েছে শনিবার বেলা আড়াইটায়। হামলাকারীরা তিনজনকে কুপিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে চলে যায়। বন্ধু ও স্বজনেরা আহত ব্যক্তিদের টেলিফোন পেয়ে পুলিশকে জানালে পুলিশ তালা ভেঙে যখন তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে, তার কিছুক্ষণ পরেই আজিজ মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীতে প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। গণমাধ্যমকে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দীপনের মৃত্যু আঘাতজনিত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই হয়েছে। অর্থাৎ দীপন ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার টুটুল এবং অন্য দুজনকে কাছাকাছি সময়েই আক্রমণ করা হয়েছিল।
চাপাতির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় হত্যা করা হয়েছিল মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার রাজীবকে। রাজীব বিজ্ঞান নিয়ে ব্লগে লিখতেন। বিজ্ঞানচর্চা করলে কুসংস্কার প্রতিপক্ষ হবেই। সে কারণেই বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আক্রান্ত হয়েছিলেন, অভিজিৎ খুন হয়ে বেঁচে গেছেন আর বন্যা অঙ্গহানির বাহ্যিক ক্ষত এবং আরও বেশি অন্তর্গত বেদনা নিয়ে দূর প্রবাসে জীবন্মৃত হয়ে আছেন। একে একে খুন হয়েছেন ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়, নিলয়। ৩১ অক্টোবর খুন হলেন প্রকাশক ও বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক দীপন। আর এক প্রকাশক গুরুতর আহত টুটুলসহ মোট তিনজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
৩১ অক্টোবরের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন প্রকাশক সম্প্রদায়। শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি—এই দুই সংস্থা থেকেই অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল না, চলতে থাকল। বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অ্যাকটিভিস্টদের যেহেতু হত্যা করে, হুমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সুতরাং যাঁরা তাঁদের বইয়ের প্রকাশক, এবার তাঁদের হত্যা করা হোক, সর্বব্যাপক একটি ভয়ের বিস্তার ঘটানো হোক। মৌলবাদী গোষ্ঠী, জঙ্গি বা জামায়াত-শিবির চক্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, রাষ্ট্রকে, অস্থিতিশীল করার চেষ্টা যে করছে, সেটা তো আমজনতার চেয়েও বেশি জানে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ। জানেন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব। এটা জানার পরও সেই সব অন্ধকারের খুনে শক্তি কীভাবে একের পর এক রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন করতে পারছে আলোকিত স্বপ্নে বিভোর বিজ্ঞানমনস্ক মন ও শরীরকে?
যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা হুমকি পেয়ে আগেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার কথা যথাযথ জায়গায় জানানোর পরও তাঁদের অরক্ষিত রাখা হয়েছিল বা হয় কেন? আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। জনগণ ও তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বের। নির্ভয়ের। দুই দিক থেকেই। কিন্তু তাঁরা যখন কোনো অনুষ্ঠানে আসেন বা যান, অথবা দাপ্তরিক কাজে চলাচল করেন, গাড়িবহরে নিরাপত্তার বলয় এত বজ্রকঠিন করতে হয় কেন? কিসের ভয়? তার মানে কি আমরা একটা ভয়ের বাংলাদেশে বেঁচে থাকার অভিনয় করছি? ভয়হীনতার অভিনয়?
আমার কয়েকজন স্বনামখ্যাত লেখক-বন্ধু বেশ কিছুদিন থেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে চলাচল করছেন। তাঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন। বাসা থেকে গাড়িতে চড়ে বের হন। অফিসের দোরগোড়ায় গাড়ি থামলে নিরাপত্তারক্ষীসহ লিফটের সামনে দাঁড়ান। তারপর সারা দিন নিরাপদ বহুতল ভবনে প্রাত্যহিক কাজ শেষে আবার একইভাবে ঘরে ফেরা। এটা কি স্বাধীন দেশের জীবন? এ রকম সকাল-দুপুর-রাত নিয়ে লেখক ও শিল্পীসত্তা বাঁচে? সৃজনশীল নির্মাণ হয়? অচলায়তন টিকিয়ে রেখে, স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার খাঁচায় বন্দী থেকে মুক্তির কবিতা লেখা যায়? গান গাওয়া যায়? তার ওপরে যদি ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’র মতো রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য ভেংচি কাটে নিত্য প্রহর? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর আসে না। তাঁরাই বেশি মৌন, যাঁরা বাঙ্ময় ছিলেন সেদিনও। যাঁরা বলেন, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কেন মৌন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, সংগঠক ও সংস্কৃতিজন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ ৩১ অক্টোবর ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘মর্মাহত! বাকরুদ্ধ! কে কার কাছে কিসের প্রতিবাদ করবে? কে কার কাছে কিসের বিচার চাইবে? কে চিহ্নিত করবে আততায়ীকে? রক্তের এই স্রোত, মৃত্যুর এই ধারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? কতটা অন্ধকার নামলে আমরা বুঝব যে আলো নেই? কে জেগে আছে এই রাত্রির গুহায়? জীবনের এই অপচয়, এই অপঘাত, এই মৃত্যু, এই রক্তের স্রোত কি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাবে আমি কী ভূমিকা পালন করেছিলাম? আজ পথে দাঁড়ানোর আগে আসুন, নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াই সবাই। আজ উচ্চকণ্ঠে ক্ষোভের আগে নিজেকে প্রশ্ন করি, এই মৃত্যুর দায় আমারও কি না—প্রশ্ন করুন, আসুন আমরা সবাই প্রশ্ন করি।’ অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজ পড়ন্ত বিকেল থেকে রাতের প্রথম প্রহর অবধি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে না দাঁড়াতে পারলেও সবার অনুভূতির পক্ষে উচ্চকিত হয়েছেন।
৩১ অক্টোবরের আগমনী সন্ধ্যায় যখন পুলিশের গাড়িতে করে দীপনের ক্ষতবিক্ষত নিষ্প্রাণ শরীরটা আনা হলো জরুরি বিভাগে, শত শত তরুণ-তরুণী, গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরার লাইট, বিশিষ্টজনদের বক্তব্য প্রদান, মন্ত্রী, নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর শোকার্ত মুখাবয়ব আর চারপাশের উপায়হীনতার মধ্যে আমি ভাবছিলাম, আমার লেখার কলমটি এখনো স্বাধীন। কারণ, এটা ভাষা আন্দোলনের ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ড. জি সি দেব, জহির রায়হানের উত্তরাধিকার। আমার গান ও সুর এখনো স্বাধীন। কারণ, তা মুকুন্দ দাস, লালন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, আলতাফ মাহমুদের উত্তরাধিকার। তাঁরা অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি কে হে? আর আমার কানে এই মুহূর্তে বাজছে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই গান.—‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার?’
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
mzamanbubu71@gmail.com
দেশের একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা জনাব হানিফের এই বক্তব্যের মধ্যেই আছে আমার ভয় পাওয়ার উৎস। লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর অফিসে হামলা হয়েছে শনিবার বেলা আড়াইটায়। হামলাকারীরা তিনজনকে কুপিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তালা মেরে চলে যায়। বন্ধু ও স্বজনেরা আহত ব্যক্তিদের টেলিফোন পেয়ে পুলিশকে জানালে পুলিশ তালা ভেঙে যখন তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে, তার কিছুক্ষণ পরেই আজিজ মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীতে প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সল আরেফিন দীপনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। গণমাধ্যমকে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দীপনের মৃত্যু আঘাতজনিত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই হয়েছে। অর্থাৎ দীপন ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার টুটুল এবং অন্য দুজনকে কাছাকাছি সময়েই আক্রমণ করা হয়েছিল।
চাপাতির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় হত্যা করা হয়েছিল মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগার রাজীবকে। রাজীব বিজ্ঞান নিয়ে ব্লগে লিখতেন। বিজ্ঞানচর্চা করলে কুসংস্কার প্রতিপক্ষ হবেই। সে কারণেই বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আক্রান্ত হয়েছিলেন, অভিজিৎ খুন হয়ে বেঁচে গেছেন আর বন্যা অঙ্গহানির বাহ্যিক ক্ষত এবং আরও বেশি অন্তর্গত বেদনা নিয়ে দূর প্রবাসে জীবন্মৃত হয়ে আছেন। একে একে খুন হয়েছেন ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয়, নিলয়। ৩১ অক্টোবর খুন হলেন প্রকাশক ও বিজ্ঞান-বিষয়ক লেখক দীপন। আর এক প্রকাশক গুরুতর আহত টুটুলসহ মোট তিনজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
৩১ অক্টোবরের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিলেন প্রকাশক সম্প্রদায়। শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি—এই দুই সংস্থা থেকেই অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল না, চলতে থাকল। বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অ্যাকটিভিস্টদের যেহেতু হত্যা করে, হুমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সুতরাং যাঁরা তাঁদের বইয়ের প্রকাশক, এবার তাঁদের হত্যা করা হোক, সর্বব্যাপক একটি ভয়ের বিস্তার ঘটানো হোক। মৌলবাদী গোষ্ঠী, জঙ্গি বা জামায়াত-শিবির চক্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে, রাষ্ট্রকে, অস্থিতিশীল করার চেষ্টা যে করছে, সেটা তো আমজনতার চেয়েও বেশি জানে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহ। জানেন রাষ্ট্র পরিচালনাকারী ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব। এটা জানার পরও সেই সব অন্ধকারের খুনে শক্তি কীভাবে একের পর এক রক্তাক্ত ও ছিন্নভিন্ন করতে পারছে আলোকিত স্বপ্নে বিভোর বিজ্ঞানমনস্ক মন ও শরীরকে?
যাঁরা খুন হয়েছেন, তাঁরা হুমকি পেয়ে আগেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতার কথা যথাযথ জায়গায় জানানোর পরও তাঁদের অরক্ষিত রাখা হয়েছিল বা হয় কেন? আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। জনগণ ও তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বের। নির্ভয়ের। দুই দিক থেকেই। কিন্তু তাঁরা যখন কোনো অনুষ্ঠানে আসেন বা যান, অথবা দাপ্তরিক কাজে চলাচল করেন, গাড়িবহরে নিরাপত্তার বলয় এত বজ্রকঠিন করতে হয় কেন? কিসের ভয়? তার মানে কি আমরা একটা ভয়ের বাংলাদেশে বেঁচে থাকার অভিনয় করছি? ভয়হীনতার অভিনয়?
আমার কয়েকজন স্বনামখ্যাত লেখক-বন্ধু বেশ কিছুদিন থেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে চলাচল করছেন। তাঁদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন। বাসা থেকে গাড়িতে চড়ে বের হন। অফিসের দোরগোড়ায় গাড়ি থামলে নিরাপত্তারক্ষীসহ লিফটের সামনে দাঁড়ান। তারপর সারা দিন নিরাপদ বহুতল ভবনে প্রাত্যহিক কাজ শেষে আবার একইভাবে ঘরে ফেরা। এটা কি স্বাধীন দেশের জীবন? এ রকম সকাল-দুপুর-রাত নিয়ে লেখক ও শিল্পীসত্তা বাঁচে? সৃজনশীল নির্মাণ হয়? অচলায়তন টিকিয়ে রেখে, স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার খাঁচায় বন্দী থেকে মুক্তির কবিতা লেখা যায়? গান গাওয়া যায়? তার ওপরে যদি ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’র মতো রাষ্ট্রের ঔদাসীন্য ভেংচি কাটে নিত্য প্রহর? প্রশ্নগুলো সহজ। কিন্তু উত্তর আসে না। তাঁরাই বেশি মৌন, যাঁরা বাঙ্ময় ছিলেন সেদিনও। যাঁরা বলেন, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। কেন মৌন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, সংগঠক ও সংস্কৃতিজন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ ৩১ অক্টোবর ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘মর্মাহত! বাকরুদ্ধ! কে কার কাছে কিসের প্রতিবাদ করবে? কে কার কাছে কিসের বিচার চাইবে? কে চিহ্নিত করবে আততায়ীকে? রক্তের এই স্রোত, মৃত্যুর এই ধারা দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? কতটা অন্ধকার নামলে আমরা বুঝব যে আলো নেই? কে জেগে আছে এই রাত্রির গুহায়? জীবনের এই অপচয়, এই অপঘাত, এই মৃত্যু, এই রক্তের স্রোত কি আমাদের প্রশ্ন করতে শেখাবে আমি কী ভূমিকা পালন করেছিলাম? আজ পথে দাঁড়ানোর আগে আসুন, নিজের বিবেকের সামনে দাঁড়াই সবাই। আজ উচ্চকণ্ঠে ক্ষোভের আগে নিজেকে প্রশ্ন করি, এই মৃত্যুর দায় আমারও কি না—প্রশ্ন করুন, আসুন আমরা সবাই প্রশ্ন করি।’ অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজ পড়ন্ত বিকেল থেকে রাতের প্রথম প্রহর অবধি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে না দাঁড়াতে পারলেও সবার অনুভূতির পক্ষে উচ্চকিত হয়েছেন।
৩১ অক্টোবরের আগমনী সন্ধ্যায় যখন পুলিশের গাড়িতে করে দীপনের ক্ষতবিক্ষত নিষ্প্রাণ শরীরটা আনা হলো জরুরি বিভাগে, শত শত তরুণ-তরুণী, গণমাধ্যমকর্মীদের ক্যামেরার লাইট, বিশিষ্টজনদের বক্তব্য প্রদান, মন্ত্রী, নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীর শোকার্ত মুখাবয়ব আর চারপাশের উপায়হীনতার মধ্যে আমি ভাবছিলাম, আমার লেখার কলমটি এখনো স্বাধীন। কারণ, এটা ভাষা আন্দোলনের ও মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, ড. জি সি দেব, জহির রায়হানের উত্তরাধিকার। আমার গান ও সুর এখনো স্বাধীন। কারণ, তা মুকুন্দ দাস, লালন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, আলতাফ মাহমুদের উত্তরাধিকার। তাঁরা অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি কে হে? আর আমার কানে এই মুহূর্তে বাজছে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সেই গান.—‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার?’
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
mzamanbubu71@gmail.com
No comments