দূর হোক সব ছিটমহলবাসীর দীর্ঘশ্বাস by তুহিন ওয়াদুদ
স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের পর ছিটমহলবাসীর আনন্দমিছিল |
গত
৬ মে ভারতের লোকসভায় স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পর থেকে খুব দ্রুতই
চলছে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের কাজ। ৩১ জুলাই মধ্য রাতে ছিটমহল
বিনিময় কার্যকর হবে। সেই লক্ষ্যে ৬ জুলাই থেকে ছিটমহলবাসী কারা কোন দেশে
থাকতে চায়, তার জরিপ শুরু হয়েছে, চলবে ১৬ জুলাই পর্যন্ত। যারা ছিটমহল ছেড়ে
নিজেদের মূল ভূখণ্ডে যেতে চায়, উভয় রাষ্ট্র তাদের জন্য ১ আগস্ট থেকে ৩০
নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাভেল পাস ইস্যু করবে। চিলাহাটি-হলদিবাড়ী,
বুড়িমারি-চেংরাবান্ধা, সাহেবগঞ্জ-বাগবন্দর চেক পয়েন্ট দিয়ে তারা যাওয়া-আসা
করতে পারবে।
চলমান জরিপের আগেই কিছু কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি ছিল। ছিটমহলগুলোতে জমি নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক সময় সাদা কাগজে লিখে জমি বিক্রি হয়েছে। অনেকের জমি আছে কিন্তু দলিল নেই। সরকারিভাবে এই মালিকানার মূল্য নেই। এ রকম জমির মালিক ভারতের মূল ভূখণ্ডে গেলে তাঁর জমি ব্যবস্থাপনা কী হবে, তা তাঁরা জানতে চান।
২২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত জমি বিক্রি বন্ধ। ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ে যাঁরা নিজেদের মূল ভূখণ্ডে যাবেন, তাঁরা নিজ নিজ স্থানীয় ডিসি/ডিএমের অনুমতি নিয়ে ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে পারবেন। ভালো হতো, যদি নিজ জন্ম ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়া লোকজনের জমি ওই দেশের সরকার কিনে নিত।
যাঁরা ভারতে যাবেন কিংবা বাংলাদেশে আসবেন, তাঁরা সরকারিভাবে কী কী সুবিধা পাবেন, সেটা তাঁরা জানেন না। বর্তমানে চলতে থাকা জরিপের আগেই যদি এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যেত, তাহলে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে কে কোন দেশে থাকবেন তা নির্ধারণ করতে পারতেন।
ইংরেজিতে ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট ফিল্ড ক্যাম্প’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে চলছে জরিপের কাজ। এ রকম একটি ক্যাম্পে দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে ৮ জুলাই ভারতের একজন অবজারভার বিধানচন্দ্র সাধুখারকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা ভারতে গিয়ে কী পাবেন? যাঁরা জমি রেখে যাবেন, তাঁদের জমি ব্যবস্থাপনা কী হবে? যাঁরা ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়েছেন, তাঁদের কী হবে? এই জরিপের আগে কি এসব জানানো জরুরি ছিল না?’ উত্তরে তিনি আমাকে বলেন, ‘এসব আপনার ভ্যালিড কোশ্চেন। আমি ওপরে জানাব।’
চলতি জরিপে মানুষ গণনা হচ্ছে না। ২০১১ সালে যখন ছিটমহল বিনিময় হওয়ার কথা ছিল, তখন বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের উদ্যোগে ছিটমহলে জনসংখ্যা জরিপ চালানো হয়েছিল। সেই তালিকা ধরেই চলছে বর্তমান জরিপের কাজ। সেই জরিপে অনেকেই বাদ পড়েছিলেন। তাঁরা এখন ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। বাদ পড়াদের মধ্যে যাঁরা ভারতে যেতে চান, ২০১১ সালের জরিপে নাম না থাকলে তাঁরা ভারতে যেতে পারবেন না, আবার বাংলাদেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। একই পরিবারের কারও নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আবার কারও হয়নি। দুঃখ করে কবিচন্দ্র নামের একজন বলছিলেন, ‘আমরা ছয় ভাই। দুই ভাইয়ের নাম নাই। একজন ভারতে যাই-যাই করছিল, তার নামই নাই। আমি রংপুরে অসুস্থ হয়া ছিলাম। আমারও নাম নাই।’ কমলিনী রায় বলছিলেন, ‘ডকুমেন্ট হিসেবে জমির কাগজ আছে, তা–ও নাম নাই। এখন আমাদের কী হবে?’ যাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন না, তাঁরা জমির মালিকানা পাবেন কী করে? যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা না গেলে তাঁরা আমৃত্যু ভাসমান হয়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বৈবাহিক সূত্রে যে মেয়েরা ছিটমহলের বাসিন্দা হয়েছেন এবং ২০১১ সালের পর যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা ছাড়া আর কেউ নতুন জরিপে আসছে না। যঁারা ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়েছেন, তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
অনেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজের সন্ধানে গেছেন। ১১১টি ছিটমহলের অনেকেই বৈধ পাস না থাকার কারণে আসতে পারছেন না। ছিটমহলের মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের কারণে ভারতে যাওয়ার বৈধ পাস না থাকলেও তারা জীবন ধারণের তাগিদে সেখানে গেছেন। সীমান্তে তাঁদের জন্য বিশেষ পাস থাকলে তাঁরা হয়তো সবাই নাগরিকত্ব পেতেন। আর তা সম্ভব না হলে ভারতে রেখেও তাঁদের এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ২০১১ সালের জরিপে এঁদের অনেকের নাম আছে, অনেকের নাম নেই। যাঁরা বাংলাদেশে থাকতে চান, তাঁদের কেউ কেউ ভারত থেকে চলে এসেছেন। আবার যাঁরা ভারতে থাকতে চান, তাঁদেরও কেউ কেউ জরিপে নাম লেখানোর জন্য এসেছেন। এ রকম দুজন আলমগীর ও জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা হলো কুড়িগ্রামের দাসিয়ার ছড়ায়। তাঁরা পাঁচ ভাই দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করেন। আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করি। ছিটমহলে না খায়া আছনোং। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পরি দিল্লি গেছি। আমরা ভারতে থাকব। ছিটমহলে যে টিনের বাড়ি দেখেন, এগুলা দিল্লিতে কাজ করার টাকায় হইচে।’
যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা অনেকেই ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। ৮ তারিখ পর্যন্ত কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়ায় একজনও ভারতে যাওয়ার জন্য নাম লেখেননি। তাঁদের আশঙ্কা, অনেকেই তাঁদের ওপর আক্রমণ করবেন। ৮ জুলাই বিকেলে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাসিয়ার ছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাব হোসেনের উঠানে বাংলাদেশ-ভারতের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তাঁদের কাছে ভারতে যেতে আগ্রহীরা নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করছিলেন। সেখানেই গজেন চন্দ্র বর্মণ অভিযোগ করেন, একজন তাঁর পা কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় অংশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে ভারতে যেতে ইচ্ছুকগণ ৯ তারিখ থেকে জরিপে নাম লেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। উপস্থিত সবার মধ্যে আফতাব হোসেন ভারতে যেতে ইচ্ছুক ছিটমহলবাসীর অভিযোগের বিরোধিতা করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবাইকে আশ্বস্ত করেন এবং নিশ্চয়তা দেন, তাঁদের কোনো অসুবিধা হবে না। ফুলবাড়ীর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও কেউ কোনো হুমকি দিলে অথবা অসুবিধা সৃষ্টি করলে লিখিত অভিযোগ করার কথা বলেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আমাকে বলেন, ‘আমরা কাউকে বাধা দিতে চাই না। যাঁরা ভারতে যেতে চান তাঁদেরও আমরা সহযোগিতা করতে চাই। যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা যেন কারও প্ররোচনায় কান না দেন এবং তাঁরা যেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রশাসনের কাছে পরামর্শ নেন।’
কৃষ্ণকান্ত বর্মণ নামের একজন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, ভারতে যাওয়া পর্যন্ত দুই সরকার যেন আমাদের নিরাপত্তা দেয়।’ এই আকুতি ভারতে যেতে চাওয়া দাসিয়ার ছড়ার প্রায় সব ছিটমহলবাসীর।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের উচিত, যাঁরা নিজেদের মূল ভূখণ্ডে যেতে চান, তাঁদের নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করা। ছিটমহলে যাঁরা থাকবেন এবং যাঁরা ছিটমহল ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে যাবেন, তাঁদের সবার জীবনই হোক আনন্দপূর্ণ।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
চলমান জরিপের আগেই কিছু কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি ছিল। ছিটমহলগুলোতে জমি নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক সময় সাদা কাগজে লিখে জমি বিক্রি হয়েছে। অনেকের জমি আছে কিন্তু দলিল নেই। সরকারিভাবে এই মালিকানার মূল্য নেই। এ রকম জমির মালিক ভারতের মূল ভূখণ্ডে গেলে তাঁর জমি ব্যবস্থাপনা কী হবে, তা তাঁরা জানতে চান।
২২ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত জমি বিক্রি বন্ধ। ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ে যাঁরা নিজেদের মূল ভূখণ্ডে যাবেন, তাঁরা নিজ নিজ স্থানীয় ডিসি/ডিএমের অনুমতি নিয়ে ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে পারবেন। ভালো হতো, যদি নিজ জন্ম ভূখণ্ড ছেড়ে যাওয়া লোকজনের জমি ওই দেশের সরকার কিনে নিত।
যাঁরা ভারতে যাবেন কিংবা বাংলাদেশে আসবেন, তাঁরা সরকারিভাবে কী কী সুবিধা পাবেন, সেটা তাঁরা জানেন না। বর্তমানে চলতে থাকা জরিপের আগেই যদি এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা যেত, তাহলে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে কে কোন দেশে থাকবেন তা নির্ধারণ করতে পারতেন।
ইংরেজিতে ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ জয়েন্ট ফিল্ড ক্যাম্প’ লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে চলছে জরিপের কাজ। এ রকম একটি ক্যাম্পে দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলে ৮ জুলাই ভারতের একজন অবজারভার বিধানচন্দ্র সাধুখারকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা ভারতে গিয়ে কী পাবেন? যাঁরা জমি রেখে যাবেন, তাঁদের জমি ব্যবস্থাপনা কী হবে? যাঁরা ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়েছেন, তাঁদের কী হবে? এই জরিপের আগে কি এসব জানানো জরুরি ছিল না?’ উত্তরে তিনি আমাকে বলেন, ‘এসব আপনার ভ্যালিড কোশ্চেন। আমি ওপরে জানাব।’
চলতি জরিপে মানুষ গণনা হচ্ছে না। ২০১১ সালে যখন ছিটমহল বিনিময় হওয়ার কথা ছিল, তখন বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের উদ্যোগে ছিটমহলে জনসংখ্যা জরিপ চালানো হয়েছিল। সেই তালিকা ধরেই চলছে বর্তমান জরিপের কাজ। সেই জরিপে অনেকেই বাদ পড়েছিলেন। তাঁরা এখন ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। বাদ পড়াদের মধ্যে যাঁরা ভারতে যেতে চান, ২০১১ সালের জরিপে নাম না থাকলে তাঁরা ভারতে যেতে পারবেন না, আবার বাংলাদেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। একই পরিবারের কারও নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আবার কারও হয়নি। দুঃখ করে কবিচন্দ্র নামের একজন বলছিলেন, ‘আমরা ছয় ভাই। দুই ভাইয়ের নাম নাই। একজন ভারতে যাই-যাই করছিল, তার নামই নাই। আমি রংপুরে অসুস্থ হয়া ছিলাম। আমারও নাম নাই।’ কমলিনী রায় বলছিলেন, ‘ডকুমেন্ট হিসেবে জমির কাগজ আছে, তা–ও নাম নাই। এখন আমাদের কী হবে?’ যাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন না, তাঁরা জমির মালিকানা পাবেন কী করে? যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা না গেলে তাঁরা আমৃত্যু ভাসমান হয়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। বৈবাহিক সূত্রে যে মেয়েরা ছিটমহলের বাসিন্দা হয়েছেন এবং ২০১১ সালের পর যারা জন্মগ্রহণ করেছে, তারা ছাড়া আর কেউ নতুন জরিপে আসছে না। যঁারা ২০১১ সালের জরিপে বাদ পড়েছেন, তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
অনেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাজের সন্ধানে গেছেন। ১১১টি ছিটমহলের অনেকেই বৈধ পাস না থাকার কারণে আসতে পারছেন না। ছিটমহলের মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের কারণে ভারতে যাওয়ার বৈধ পাস না থাকলেও তারা জীবন ধারণের তাগিদে সেখানে গেছেন। সীমান্তে তাঁদের জন্য বিশেষ পাস থাকলে তাঁরা হয়তো সবাই নাগরিকত্ব পেতেন। আর তা সম্ভব না হলে ভারতে রেখেও তাঁদের এ জরিপে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ২০১১ সালের জরিপে এঁদের অনেকের নাম আছে, অনেকের নাম নেই। যাঁরা বাংলাদেশে থাকতে চান, তাঁদের কেউ কেউ ভারত থেকে চলে এসেছেন। আবার যাঁরা ভারতে থাকতে চান, তাঁদেরও কেউ কেউ জরিপে নাম লেখানোর জন্য এসেছেন। এ রকম দুজন আলমগীর ও জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা হলো কুড়িগ্রামের দাসিয়ার ছড়ায়। তাঁরা পাঁচ ভাই দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করেন। আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করি। ছিটমহলে না খায়া আছনোং। একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পরি দিল্লি গেছি। আমরা ভারতে থাকব। ছিটমহলে যে টিনের বাড়ি দেখেন, এগুলা দিল্লিতে কাজ করার টাকায় হইচে।’
যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা অনেকেই ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। ৮ তারিখ পর্যন্ত কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়ায় একজনও ভারতে যাওয়ার জন্য নাম লেখেননি। তাঁদের আশঙ্কা, অনেকেই তাঁদের ওপর আক্রমণ করবেন। ৮ জুলাই বিকেলে ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির দাসিয়ার ছড়া ইউনিটের সভাপতি আলতাব হোসেনের উঠানে বাংলাদেশ-ভারতের অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। তাঁদের কাছে ভারতে যেতে আগ্রহীরা নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করছিলেন। সেখানেই গজেন চন্দ্র বর্মণ অভিযোগ করেন, একজন তাঁর পা কেটে ফেলার হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় অংশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে ভারতে যেতে ইচ্ছুকগণ ৯ তারিখ থেকে জরিপে নাম লেখাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। উপস্থিত সবার মধ্যে আফতাব হোসেন ভারতে যেতে ইচ্ছুক ছিটমহলবাসীর অভিযোগের বিরোধিতা করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবাইকে আশ্বস্ত করেন এবং নিশ্চয়তা দেন, তাঁদের কোনো অসুবিধা হবে না। ফুলবাড়ীর ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাও কেউ কোনো হুমকি দিলে অথবা অসুবিধা সৃষ্টি করলে লিখিত অভিযোগ করার কথা বলেন। ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ অংশের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আমাকে বলেন, ‘আমরা কাউকে বাধা দিতে চাই না। যাঁরা ভারতে যেতে চান তাঁদেরও আমরা সহযোগিতা করতে চাই। যাঁরা ভারতে যেতে চান, তাঁরা যেন কারও প্ররোচনায় কান না দেন এবং তাঁরা যেন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রশাসনের কাছে পরামর্শ নেন।’
কৃষ্ণকান্ত বর্মণ নামের একজন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, ভারতে যাওয়া পর্যন্ত দুই সরকার যেন আমাদের নিরাপত্তা দেয়।’ এই আকুতি ভারতে যেতে চাওয়া দাসিয়ার ছড়ার প্রায় সব ছিটমহলবাসীর।
বাংলাদেশ-ভারত উভয় রাষ্ট্রের উচিত, যাঁরা নিজেদের মূল ভূখণ্ডে যেতে চান, তাঁদের নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করা। ছিটমহলে যাঁরা থাকবেন এবং যাঁরা ছিটমহল ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে যাবেন, তাঁদের সবার জীবনই হোক আনন্দপূর্ণ।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
No comments